দুঃখ করে দাদী বলতে লাগলেন, আমরাও বেড়াতে এলাম, আর এ রকম একটা অঘটন ঘটল। আটকে বসে থাকতে হচ্ছে তাকে, আমাদের জন্যে কিছুই করাতে পারছেন না।
তাঁকে নানা ভাবে সান্তনা দিলাম। কিশোর ইঙ্গিত দিল, খুব তাড়াতাড়িই গুপ্তধনগুলোও বের করে ফেলা যাবে। ও বাড়িতেই যে আছে ওগুলো, এখন এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত।
ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলে বাড়ি ফিরলাম আমরা।
সিংহ দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। ভেবেছিলাম, গেটের কাছে বসে থাকবে কাল, কিন্তু তাকে দেখলাম না। উঠানে এসে দেখি নিশ্চিন্ত মনে খাবার খুঁটছে একজোড়া ঘুঘু আর কয়েকটা কবুতর। কালু নেই। গেল কোথায়? হঠাৎ তার ঘেউ ঘেউ শোনা গেল মালীর ঘর থেকে, আমাদের সাড়া পেয়েই বোধহয় ডেকেছে।
গিয়ে দেখি বাইরে থেকে দরজায় শেকল তুলে দিয়ে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে তাকে। অবাক কাণ্ড! কে করল এ কাজ?
গম্ভীর হয়ে কিশোর বলল, ওই চোরটা এসেছিল। কোন ভাবে কুত্তাটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে ঘরে আটকে রেখে গুপ্তধন খুঁজেছে! জলদি এসো, দেখি কি করল!
আর কোথাও কোন পরিবর্তন দেখলাম না, কেবল হলঘরে আমিন উদ্দিন সরকারের ছবিটা মেঝেতে নামানো। তারমানে আমাদেরই মত ওটার পেছনে গুপ্তপথ আছে কিনা দেখতে চেয়েছে চোর। বোধহয় আমাদের সাড়া পেয়েই আর তোলার সময় পায়নি, তাড়াহুড়ো করে পালিয়েছে।
আচ্ছা, আক্কেল আলী কিছু করছে না তো? মুসার প্রশ্ন। মাথা নাড়ল কিশোর, মনে হয় না। এ বাড়ির অনেক পুরানো চাকর সে…
পুরানো চাকরেরা যে অঘটন ঘটায় না, এমন তো কোন কথা নেই। হাসপাতাল থেকে আমাদের অনেক আগে বেরিয়ে এসেছে সে।
সে তো বাজারে যাবে বলে।
আমরা তো আর সঙ্গে যাইনি। দেখব কি করে? বাজারে যাওয়ার ছুতো করে হয়তো এখানে চলে এসেছিল।
চুপ হয়ে গেল কিশোর। হা-না কিছু আর বলল না।
আমরা আসার ঘণ্টাখানেক পর ফিরল আক্কেল আলী। হাসল আমাদের দিকে তাকিয়ে। বলল, আজ পাঙ্গাস মাছ রান্না হবে। অনেক বড় দেখে এনেছি। টমেটো দিয়ে মাছ, ফুলকপি ভাজি, ডাল। আম-কাঁঠাল-দুধ তো আছেই। চলবে?
মুহূর্তে চোরের খাতা থেকে তাকে খারিজ করে দিল মুসা। তাড়াতাড়ি বলল, চলবে মানে! জলদি যাও, ভাই, রান্নাটা সেরে ফেলো! এতটা খিদে পেয়েছে বুঝিনি
আক্কেল আলী রান্নাঘরে চলে গেল। আমরা বেরিয়ে এসে বসলাম দীঘির ঘাটে। সূর্য তখন প্রায় ডুবে গেছে। পশ্চিম আকাশের বিশাল মেঘটা একটা লাল-কালো বিচিত্র পাহাড়ের মত লাগছে।
গুপ্তধনের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগলাম আমরা।
কিন্তু কোন মানে বের করতে পারলাম না। মুসা বলল, দেখো, আমার মনে হয় ওই মজা পুকুরটাতেই খোঁজা দরকার। জেলে নামিয়ে দিয়ে দেখা উচিত।
দাদা থাকলে সুবিধে হত, কিশোর বলল। বেকায়দা হয়ে গেল। দেখি আক্কেল আলীকে জিজ্ঞেস করে, সে কোন ব্যবস্থা করতে পারে কিনা।
.
০৮.
খাবার টেবিলে বসে জিজ্ঞেস করা হলে আক্কেল আলীকে। কেন জাল ফেলতে চাই, জানতে চাইল সে। সব শুনে বলল, তা জেলের ব্যবস্থা করা যায়। নগদ টাকা দিতে হবে না। মাছ যা উঠবে তার অর্ধেক দিয়ে দিলেই হবে। কিন্তু ওই পুকুরটাতে ভাল জাতের মাছ কিছু নেই। শোল, গজার এসব ছাড়া।
ওসব মাছের ভাগ নিয়ে কোন জেলে জাল ফেলতে রাজি হবে না? কিশোর জানতে চাইল।
হয়তো হবে। শোল-গজারেরও মেলা দাম। মাছই পাওয়া যায় না আজকাল মোটে। ভোরবেলা বেরোব। পেয়ে যাব কাউকে না কাউকে।
রাতটা নিরাপদেই কাটল।
পরদিন সকালে জেলের ব্যবস্থা ঠিকই করে ফেলল আক্কেল আলী।
তিনবার করে বেড়া দেয়া হলো পুকুরটাতে। ভকভক করে নিচ থেকে কাদা উঠে ওপরের পানিও ঘোলা করে দিল, সর্বনাশ হয়ে গেল শাপলার। মাছ ধরা পড়ল প্রচুর–কই, শিং, মাগুর, টাকি, শোল এসব মাছ। জেলেরা অখুশি হলো না। অখুশি হলাম আমরা। সিন্দুক তো দূরের কথা, ছোটখাটো একটা বাক্সও পাওয়া গেল না।
মাছের ভাগ নিয়ে চলে গেল জেলেরা। ভাগে পাওয়া বাকি অর্ধেক মাছের বেশির ভাগই আবার পুকুরে ছেড়ে দিল আক্কেল আলী, কিছু জিইয়ে রাখল খাওয়ার জন্যে।
দাদা আর দাদীর জন্যে খাবার নিয়ে হাসপাতালে চলে গেল সে। আমরা আবার এসে বসলাম পুকুর পাড়ে।
কিশোর হাত বাড়াল আমার দিকে, দেখি, দাও তো তোমার নোটবইটা। মেসেজের মানে বুঝতে হয়তো ভুল করেছি আমরা। অন্য কিছু বোঝাতে চেয়েছে।
কয়েকবার করে ছড়াটা পড়ল সে।
আমি বললাম, আচ্ছা, তোমার দেখার ভুল না তো? লিখেছে এক অক্ষর, তুমি পড়েছ আরেকটা, এমন হতে পারে না?
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। তা তো পারেই! চলো, দেখি!
ভুল একটা সত্যিই হয়েছে, বেরোলো সেটা। প্রথম লাইনে জানের নিচে আধার খোজোর জায়গায় হবে জালের নিচে আঁধার খোজো। মাত্র একটা চন্দ্রবিন্দুর গোলমাল। কিন্তু ওই একটা চন্দ্রবিন্দুই যে এভাবে ভোগাবে আমাদের, তা কি আর জানতাম!
মুসা বলল, লাভটা কি হলো? আগের মতই গ্রীক ভাষা হয়ে আছে। জালের নিচে আঁধার কোথায়? জাল নিজেই তো একটা ফাঁকওয়ালা জিনিস…
লেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল কিশোর। বলল, বোধহয়, বুঝেছি! এসো!
সোজা আমাদের থাকার ঘরে চলে এল সে। চৌকাঠের নিচ থেকে বের করল লুকিয়ে রাখা চাবিটা। টর্চ নিয়ে এগোল আলমারির দরজার মত দরজাটার দিকে। কোন প্রশ্ন করলাম না। জানি, নিজে থেকে কিছু সে না বললে প্রশ্ন করে তার কাছে থেকে জবাব পাব না।