তা-ও বটে।
খাবার তৈরি করে, টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে হাসপাতালে রওনা হয়ে গেল আক্কেল আলী। আমরা বাড়িতেই রয়ে গেলাম। বলে দিলাম, বিকেলে ভিজিটিং আওয়ারে দাদাকে দেখতে যাব।
সকালের নাস্তা সেরেই আর দেরি করল না কিশোর, মেসেজটার মানে বের করতে বসে গেল। কয়েকবার করে পড়ল ছড়াটা। তারপর বলল, প্রথম লাইনটা থেকে শুরু করি-জালের নিচে আধার খোজো!
আধার মানে তো পাত্র, তাই না? মুসার প্রশ্ন।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর, হ্যাঁ।
কি বলতে চায়? কোন জালটালের নিচে লুকিয়ে রেখেছে সিন্দুকটা?
মনে হয় না, মাথা নাড়ল কিশোর। জাল এমন কোন জিনিস নয় যার নিচে দেখা যায় না। তা ছাড়া সুতার জাল আর কতদিন টেকে? ব্যবহার করলে তো যায়ই, পড়ে থাকলেও নষ্ট হয়ে যায়।
তাহলে?
সেটাই তো ভাবছি, আনমনে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর।
আমি বললাম, আচ্ছা, দেখতে ভুল করোনি তো? হয়তো জল লিখেছে, তুমি পড়েছ জাল…
তীক্ষ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে তুড়ি বাজাল কিশোর, ঠিক বলেছ! জলই হবে! তাহলে মিলে যায়! জলের নিচে আধার খোজো, তার ভেতরে সিন্দুক আছে। তার মানে কোন জলাশয় বা পানির নিচে লুকানো আছে একটা বড় পাত্র, তার মধ্যে রাখা হয়েছে সিন্দুকটা।
পুকুরের নিচে না তো? মুসা বলল, মজা পুকুরটা! আমি বাবা ওর মধ্যে নামতে পারব না। সাধারণ সিন্দুক থাকলেই ওতে ভূত হয়ে যাবে, আর রত্ন ভরা লোহার সিন্দুক হলে তো কথাই নেই, ভূতুড়ে সিন্দুকদের রাজা হবে!
ওই পুকুরে ডুব দিতে আমারও ভয় লাগবে, স্বীকার করল কিশোর। এক কাজ করতে পারি আমরা। আক্কেল আলী এলে, জেলে এনে মাছ ধরার ছুতোয় বেড়জাল নামিয়ে দিতে পারি। নিচে থাকলে জালে আটকাবেই সিন্দুকটা।
যদি দীঘিটাতে ফেলে দিয়ে থাকে? আমি প্রশ্ন তুললাম।
আমার তা মনে হয় না। এত বড় দীঘি থেকে যে সিন্দুক তোলা সহজ হবে না, এত নিচে নেমে কেউ খুঁজতে পারবে না, এটা জানা ছিল আমিন সরকারের। নিজেকে দিয়েই ভাবি, তার পরিস্থিতিতে আমি হলে কি করতাম? এমন কোথাও রাখতাম, যেখানে খোঁজার কথা সহজে মনে আসবে না কারও, কিন্তু জেনে গেলে বের করে আনতে আর অসুবিধে হবে না। দীঘির তলা থেকে তুলে আনা বেজায় কঠিন। একমাত্র উপায়, সমস্ত পানি সেঁচে ফেলা। তারপরেও কথা থাকে, কাদায় বেশিদিন জেগে থাকবে না ভারি সিন্দুক, দ্রুত তলিয়ে যাবে। তখন পানি সেঁচলেও আর পাওয়ার উপায় থাকবে না। দীঘির নিচে লুকানোটা মোটেও নিরাপদ না। এমন কোথাও রেখেছেন, যেখানে সহজে খুঁজে পাবে না কেউ, আবার নিরাপদে থাকবে দীর্ঘদিন।
পুকুরের বেলায়ও তো এ কথা খাটে?
তা খাটে। তবে ছোট পুকুর তো, পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তা ছাড়া তখন তাড়াহুড়োয় কোনমতে সিন্দুকটা লুকিয়ে ফেলার কথাই কেবল ভেবেছেন আমিন সরকার…
আচ্ছা, বাধা দিয়ে মুসা বলল, আরও সহজ জায়গার কথা ভাবছি না কেন আমরা?
কোথায়? জানতে চাইলাম আমি আর কিশোর।
পোড়ো বাড়িটার পাশের মাছের অ্যাকোয়ারিয়াম! ওটাও তো জলাশয়…
তাই তো! লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর, আজকে আমার মাথাটার হলো কি? এটা ভাবলাম না কেন? জলদি চলো! শাবল, কোদাল নিয়ে যাব!
কালুকে সঙ্গে করে সেই পোড়োবাড়ির কাছে চলে এলাম আমরা। অগভীর নালার মুখটা মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিতেই পুকুরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। অ্যাকোয়ারিয়ামের সামান্য পানি সেঁচে ফেললাম আমরা। নিচে কাদা। কোদাল দিয়ে তুলে ফেলতে যথেষ্ট কষ্ট হলো। তারপরে মাটি খোঁড়া অবশ্য সহজ হয়ে গেল, ভেজা মাটি বেশ নরম। কোপ দিলেই উঠে চলে আসে।
কিন্তু ছয়…সাত…আট ফুট গর্ত করে ফেলার পরও কিছুই পাওয়া গেল না। শাবল কিংবা কোদালের ফলায় লেগে ঠং করে উঠল না লোহার সিন্দুক। আরও ফুট দুয়েক খুঁড়ে দেখল মুসা। গলগল করে পানি উঠে আসছে এখন গর্তের নিচে। ভরে যাচ্ছে।
বোঝা গেল, এখানে নেই সিন্দুকটা।
ক্লান্ত হয়ে বেতবন থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা। সারা গা কাদায় মাখামাখি। দীঘির পানিতে ধুয়ে ফেললাম। খিদে ততটা পায়নি, কারণ কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর আম খেয়েছি।
খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে বাড়িতে এসে ভাত খেয়ে নিলাম। সকালেই রান্না করে রেখে গেছে আক্কেল আলী। তারপর আবার বেরোলাম গুপ্তধন খুঁজতে।
পুকুর আর দীঘিটা বাদে যত রকম জলাশয়, অর্থাৎ পানির আধার আছে ও বাড়িতে, সমস্ত জায়গায় খুঁজলাম। পানির ট্যাংকের ওপর উঠে ঢাকনা তুলে ভেতরটা দেখল মুসা। বাগানের ট্যাপের নিচে মাটি খুঁড়ে দেখা হলো। এমনকি ঘরে বাইরে যতগুলো কল আছে, সবগুলোর আশপাশের, নিচের দেয়াল ঠুকে ঠুকে দেখলাম কোথাও ফাপা জায়গা আছে কিনা। টর্চের আলো ফেলে পুরানো। পাতকুয়াটার নিচেটা দেখলাম। পানি নেই এখন। শুকনো। সিন্দুক জাতীয় কিছু চোখে পড়ল না।
বেশ হতাশ হয়েই বিকেল বেলা হাসপাতালে রওনা হলাম তিনজনে। কালুকে রেখে গেলাম বাড়ি পাহারায়। টিক্কা খানও রইল, তবে তাকে দিয়ে কোন কাজ হবে না। চোর এলে ঠেকাতে পারবে না সে, ঠেকাতে যাবেও না। সে নিজেই একটা বড় চোর।
মতিদাদার অবস্থা আজকে বেশ খারাপ মনে হলো। দাদীর মখ শুকনো। কি ব্যাপার? ডাক্তার বললেন, না, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। জখমগুলো ফুলেছে, প্রচণ্ড ব্যথা, সেজন্যেই কষ্ট পাচ্ছেন দাদা। ব্যথা কমানোর ইনজেকশন দেয়া হয়েছে, সেই সঙ্গে ঘুমের ওষুধ, সেরে যাবে। অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়বেন দাদা।