কয়েক মিনিট পর ক্ষণিকের বিরতি দিয়ে আবার বইতে শুরু করল বাতাস। আগের চেয়ে দ্বিগুণ জোরে। সেই সঙ্গে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়তে লাগল। এইবার শঙ্কা দেখা দিল আক্কেল আলীর চোখে। জরুরী গলায় বলল, জলদি ঘরে যান! তুফান এসে গেছে!
বারান্দায় গিয়ে উঠলাম। কিন্তু প্রবল বাতাস আর বৃষ্টির দাপটে সেখানেও টিকতে পারলাম না। ঘরে ঢুকে যেতে হলো। আমাদের সঙ্গে ঢুকল আক্কেল আলী আর কালু।
প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে বইল ভয়াবহ ঝড়। তারপর হঠাৎ যেমন এসেছিল তেমনি করেই থেমে গেল আবার। কমে গেল বাতাস, আস্তে আস্তে বৃষ্টি পড়াও থেমে গেল। বাইরে বেরিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। পশ্চিম আকাশে বিশাল এক মেঘের পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে পড়ন্ত সূর্য। আশ্চর্য তার রূপ আর রঙ! বিশ্বাসই হতে চায় না–এই কয়েক মিনিট আগেও কালিগোলা অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল এখানে পৃথিবী। মাটিতে পড়ে থাকা ঝরাপাতার স্তূপ, ভেঙে পড়া ডাল আর পানি জমা না থাকলে ঝড় হয়ে গেল যে সেটাই বোঝা যেত না।
অনেক আম পাওয়া গেল। খেতে খেতে গলা পর্যন্ত ভরে গেল আমাদের। দু হাত, মুখ রসে মাখামাখি। ফল যে কোনদিন এত মজা করে, এভাবে খাওয়া যায়, তা-ও জানতাম না। এত মায়া, এত মাধুর্য আছে যে এই দেশটাতে, এখানে কেউ না এলে, বাস না করলে অনুভব করা তো দূরের কথা, আন্দাজও করতে পারবে না।
সন্ধ্যা হলো। প্রচণ্ড ঝড়ের পর কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে প্রকৃতি। দূর থেকে আজান শোনা গেল। ধ্যানমগ্ন হয়ে গেছে বুঝি সবাই-ওই যে গোধূলির কালচে আকাশ, নিচের গাছপালায় ছাওয়া প্রকৃতি, পোকামাকড়, পশুপাখি, সব, সবাই যেন স্রষ্টার প্রার্থনায় মগ্ন। দেখতে দেখতে মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায় অকারণে।
আলো জ্বেলে দিল আক্কেল আলী। রাতের জন্যে রান্না করতে গিয়ে ঢুকল রান্নাঘরে। আমরা তিন বন্ধু আবার ফিরে এলাম হলঘরে, আমিন উদ্দিন সরকারের ছবির কাছে। সাঙ্কেতিক অক্ষরের সমাধান করতে বসলাম।
অক্ষর আর নম্বরগুলো সাজিয়ে ফেলতে লাগল কিশোর। সে বলতে লাগল, আমি লিখে নিলাম। প্রথমে লালচে রঙে লেখা অক্ষর, লাইনটা দাঁড়াল এ রকম:
নিজচে২ খোঁজজো৪ আধাজর৩ জালেজর১
তারপর বাদামী:
আজছে২ তাজাহার৩ ভেজতর৪ সিজন্দুক১
একেক রঙে লেখা অক্ষরের একেকটা লাইন, সব মিলিয়ে হলো চারটে:
নিজচে২ খোঁজজোঃ আধাজরত জালেজর১
আজছে২ তাজাহার ভেজতরঃ সিন্দুক
সাজত তিন২ পাঁজচে৩ মিজলিয়ে দেজখো৫
রজতুরাজি৩ পেজয়ে যাজবেহ
অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম বোকার মত, কিছুই বুঝতে পারলাম না।
মুসা তো বলেই ফেলল, খাইছে! এ কোন ভাষা!
কারও কথার জবাব দিল না কিশোর। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অক্ষরগুলোর দিকে। তারপর নীরবে আমার হাত থেকে পেন্সিলটা নিয়ে বলল, মনে হয় বুঝতে পারছি। এক, দুই, তিন করে নম্বর দেয়া আছে। নম্বর অনুসারে অক্ষরগুলোকে পর পর সাজিয়ে ফেলা যাক।
সাজিয়ে লেখার পর দাঁড়াল:
জালেজর নিজচে আধাজর খোঁজজো
সিজন্দুক আজছে তাজাহার ভেজতর
সাজত তিজন পাজচ মিজলিয়ে দেজখো
পেজয়ে যাজবে রজতুরাজি
মুসা বলল, এতেই বা কি হলো? সহজ কি হয়েছে?
হাসি ফুটল কিশোরের মুখে। মাথা নেড়ে বলল, হয়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এখনও বুঝতে পারছ না? একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ? প্রতিটি শব্দেই একটা করে বর্গীয় জ জুড়ে দেয়া হয়েছে, জটিল করে তোলার জন্যে। বাদ দিয়ে দাও…
বুঝে গেছি! প্রায় চিৎকার করে উঠলাম। পানির মত সহজ হয়ে গেছে এখন। তাড়াতাড়ি নোটবুকে লিখে ফেললাম:
জালের নিচে আধার খোজো
সিন্দুক আছে তাহার ভেতর
সাত তিন পাঁচ মিলিয়ে দেখো
পেয়ে যাবে রত্নরাজি
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। বলল, মেসেজ পেয়ে গেছি! কোথায় খুঁজতে হবে বলে দিয়েছে। কাল থেকেই শুরু করব খোঁজা!
.
০৭.
সারাদিন অনেক পরিশ্রম গেছে। রাতের খাওয়া সেরে শোয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম।
মাঝরাতে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল আমার। কালুর ডাকে। নিচতলায় আক্কেল আলীর সঙ্গে ছিল সে। এখন বাইরে চলে গেছে। তার ঘেউ ঘেউ শুনে আক্কেল আলীর ঘুমও ভাঙল। ডাকতে ডাকতে বাইরে বেরোল সে।
মুসা আর কিশোরও জেগে গেল। সবাই বেরোলাম। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলাম আক্কেল আলীকে। সে বলল, মনে হয় চোর ঢুকেছিল!
জিজ্ঞেস করলাম, কিছু নিয়েছে?
বুঝতে পারছি না!
ঘরে ফিরে এসে দেখতে লাগল সে, কিছু নিয়েছে কিনা। দেখা গেল সব ঠিকঠাকই আছে। কিছু খোয়া যায়নি। সময়মত কালু জেগে যাওয়াতেই বোধহয় খালিহাতে পালিয়েছে।
তবে খালি হাতে যে যায়নি, যা নিতে এসেছিল, নিয়েই গেছে, সেটা জানতে পারলাম পরদিন সকালে। আমাদের ঘরে টেবিলের ওপর রেখেছিলাম পোড় বাড়িতে পাওয়া বাক্স আর তার ভেতরের কাগজটা। অনেক খুঁজেও আর পেলাম না সেটা। বুঝলাম, ওটা নিতেই এসেছিল চোর।
আরও নিশ্চিত হয়ে গেলাম, সঠিক পথেই এগোচ্ছি আমরা। গুপ্তধনগুলো এখনও খোয়া যায়নি, এ বাড়িতেই আছে। তবে দুঃখের বিষয়, আমরা ছাড়াও আরও কেউ জানে সে-খবর। ছবিটাও নিয়ে গেছে। আমাদের আগেই যদি গুপ্তধন কোথায় আছে, বের করে ফেলে?
কিশোর বলল, ফেললে ফেলুক। সিন্দুকের চাবি আমাদের কাছে। খুলবে কি করে?
তালা ভেঙে, জবাব দিল মুসা।
দেখা যাক কি করে। আমরাও তো আর বসে থাকব না। আমাদের অনেক সুবিধে। বাড়ির যেখানে-সেখানে যখন-তখন খোঁজাখুঁজি করতে পারব, সে পারবে না। তাকে আসতে হবে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে।