মেরে ফেলল? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল ডায়না।
সব কজনকে, এক এক করে। ওদেরকে প্রাসাদে দাওয়াত দিল সে। গোসল করতে দিল, পেট ভরে খাওয়াল। কৃতজ্ঞতায়, আনন্দে চোখে পানি এসে গেল ওদের। তারপর ওদেরকে মদের ভাড়ার দেখার দাওয়াত দিল আরমান্ডো। দেখতে নামল ওরা, কিন্তু একজনও উঠতে পারল না আর। শোনা যায়, প্রত্যেকটা মানুষকে আরমান্ডো খুন করেছে একটা রত্নখচিত ছোরা দিয়ে। হৃৎপিণ্ডে ঢুকিয়েছে ছুরি। লাশগুলো ফেলে রেখেছে মাটির নিচের ঘরে। সাতদিন পর একটামাত্র কবরে দাফন করা হয়েছিল ওগুলো।
চোখের কোণ দিয়ে কিশোর দেখল, ঝড়ের গতিতে হলুদ প্যাডে লিখে যাচ্ছে। সোসাইটি কলামিস্ট।
বাইরের কেউ কিছু জানল না, বলে গেলেন ডক্টর নরিয়েমা। তবে সবাই একদিন দেখল, রাস্তা ভিখিরি মুক্ত হয়ে গেছে। একজনও নেই।
হঠাৎ খাদে নেমে গেল ডক্টরের কণ্ঠ। শ্রোতারা ভালমত শোনার জন্যে আরও কাছে সরে এল।
একরাতে তন্দ্রা লেগেছে আরমান্ডোর। তার দরজা খুলে গেল। সে ভাবল, চাকর। ঘুমের ঘোরেই গাল দিয়ে পাশ ফিরল সে। কিন্তু চাকর নয়। মাটির নিচের ঘরে নিয়ে যাওয়া এক ভিখিরি। ছুরিটা তার হৃৎপিণ্ডে লাগেনি, ফলে মরেনি সে। একে জখম, তার ওপর না খেয়ে খেয়ে কাহিল হয়ে পড়েছে। তবু শরীরে শেষ শক্তিটুকু দিয়ে কোনমতে উঠে এসেছে ভাড়ার থেকে। রক্তমাখা ছুরিটা ফেলে এসেছিল আরমাভো, সেটা তুলে নিয়ে এসেছে ভিখিরি।
কিন্তু আরমান্ডোর বেডরূম চিনল কি করে, বালা? ডায়নার প্রশ্ন। প্রাসাদটা নিশ্চয় অনেক বড় ছিল, আর অনেক ঘর ছিল…
ছিল। অন্য কেউ হলে হয়তো চিনত না। কিন্তু ভিখিরি আসলে ভিখারিনী। ম্যারিজল। আরমান্ডোর ত্যাগ করা স্ত্রীদের একজন। রাস্তায় থেকে থেকে শেষ হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। চেহারা শরীর সবই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এমনকি আরমান্ডোও চিনতে পারেনি তাকে ছুরি মারার সময়। জানালা দিয়ে তখন চাঁদের আলো আসছে। ছুরি মারার সময় আরমাভোর নাম ধরে এত জোরে গাল দিয়েছিল ম্যারিজল, লোকে বলে, সেই শব্দে জানালার কাঁচ নাকি চুরচুর হয়ে গিয়েছিল।
পারলারে স্তব্ধ নীরবতা। থমথমে পরিবেশ। সবাই যেন শুনতে পাচ্ছে নিজেদের হৃৎপিরে ধুকপুকানি।
চাকরেরা এসে দেখল, নরিয়েমা বললেন, বিছানায় পড়ে আছে দুটো লাশ। মরার আগে নিজের নিয়তি বুঝতে পেরে আতঙ্কিত হয়েছিল আরমাভো। বড় বড় হয়ে গিয়েছিল চোখ। তার কপালে ছুরি দিয়ে কেটে একটা অক্ষর, বি লিখে দিযেছিল ম্যারিজল। বি বোরজিয়ার নামের আদ্যক্ষর। নাকি ব্যাড বোঝাতে চেয়েছিল সে-ই জানে। এরপর থেকেই গুজব রটে যায়, ওই ছুরিটার মালিক যে-ই হবে, ছোঁয়ার চার মাসের মধ্যেই অপঘাতে মৃত্যু হবে তার।
শ্রাগ করলেন ডক্টর। ফিক করে ছোট্ট একটা হাসি দিলেন। আরে, মুখ অমন করে কেন রেখেছ তোমরা? এ-তো একটা গল্প। সত্যি না-ও হতে পারে। আর অভিশাপের কথা যে ঠিক নয়, তার তো প্রমাণই রয়েছে। কত দিন ধরে মিউজিয়ামে রইল ছুরিটা, কিন্তু কই, মালিক তো মরল না। কি বলেন, জুভেনার?
টেনেটুনে টাইয়ের নট ঢিলে করল কিউরেটর। আমতা আমতা করে বলল, সত্যি কথাটাই বলি। মিউজিয়ামে থাকার সময় কেউ ওটা ছুঁতে সাহস করেনি।
*
মেহমানদের যাবার সময় হলো।
ডায়না বলল, নরিখালা, গেস্টদের এগিয়ে দিয়ে এসো, প্লীজ। আমি এখানেই থাকি। শরীরটা ভাল্লাগছে না!
নিশ্চয়ই, ডক্টর নরিয়েমা বললেন। এত ভয় কেন? কিচ্ছু হবে না, দেখো। সব ফালতু কথা।
আমরা আরও কিছুক্ষণ থাকি? অনুরোধের সুরে বলল কিশোর। সাহায্য টাহায্য লাগতে পারে।
আড়চোখে দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে দেখে বোঝার চেষ্টা করল, ওদের মনোভাবটা কি। মুখ দেখেই বুঝল, সম্মতি আছে।
ডায়নাও আপত্তি করল না।
মেহমানদের মধ্যে প্রথম যে মানুষটা বেরিয়ে গেল, সে কিউরেটর জুভেনার। রাগে, ক্ষোভে গটমট করে চলে গেল সে। তারপর একে একে গেল অন্যেরা। সদর দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন ডক্টর নরিয়েমা, ডায়নার হয়ে গুডবাই জানাচ্ছেন সবাইকে।
পার্টিতে কাজ করার জন্যে ভাড়া করে তোক আনা হয়েছে। ওদেরকে সাহায্য করল তিন গোয়েন্দা। টেবিল থেকে সমস্ত বাসন-কোসন সরাতে আধ ঘণ্টার বেশি লাগল না। সোফাতেই গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ডায়না। অভিশাপের ভয়ে কাবু হয়ে গেছে। তাকে বিরক্ত করল না গোয়েন্দারা। বেরিয়ে এল বারান্দায়।
কি ভাবে থাকা যায় এখানে বলো তো? কিশোর বলল। খানসামা-টানসামা হয়ে যাব নাকি?
মুসা বলল, থাকাটা কি ঠিক হবে? ছুরির গল্পটা শুনলে না! রোম খাড়া করে দেয়।
আমার কাছে যেন কেমন কেমন লাগছে! কিশোর বলল।
জুভেনারের কথা বলছ? রবিনের প্রশ্ন। ও এখানে আসার আগে কিন্তু সব ঠিকঠাকই ছিল।
হ্যাঁ। আর ডায়না এত ভয় পাচ্ছে দেখেও গল্পটা চালিয়েই গেলেন ডক্টর নরিয়েমা। থেমে যাওয়া উচিত ছিল। না বললেও পারতেন।
একবার ভেবেছি, নিষেধ করি বলতে… থেমে গেল মুসা। তাকিয়ে রয়েছে বাড়ির পাশের দিকে।
কি হলো?
শশশ! সার্ভেন্টস কটেজ!
ঘুরে তাকাল কিশোর। কটেজের জানালা গলে কালো পোশাক পরা একটা মূর্তিকে নামতে দেখল। বাড়ির সামনের দিকে যাচ্ছে, ফিসফিসিয়ে বলল সে। চলো, চমকে দিই।
নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়ল তিনজনে। ঝোঁপঝাড়ের অভাব নেই। লুকিয়ে পড়ল একটার ভেতরে।