স্তব্ধতা ভাঙতে ভয় লাগছে যেন, এমনি ভঙ্গিতে খুব নরম গলায় বলল এক তরুণ, ডায়না, অভিশাপের কথা ভুলে গেছ! ওটার মালিক…
ঝটকা দিয়ে পেছনে মাথা কাত করে ফেলল ডায়না, নেচে উঠল লাল চুল। হা-হা করে হাসল সে। জুভেনারের দিকে ফিরে ছুরিটা তার বুকে বসিয়ে দেয়ার ভান করে বলল, জুভেনার, খুব খিদে পেয়েছে মনে হয়? দেব খাইয়ে?
সাদা হয়ে গেল কিউরেটরের মুখ।
ছুরি দিয়ে এক টুকরো পনির কাটল ডায়না। সেটাকে ছুরির মাথায় গেঁথে বাড়িয়ে দিল জুভেনারের দিকে। মুখে ব্যঙ্গের হাসি।
আধ সেকেন্ড পর দপ করে নিবে গেল ঘরের সমস্ত বাতি। মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেল বাজনা। নিঃশ্বাস ফেলতে যেন ভুলে গেছে পার্টির সব লোক, যেন কোনদিনই আর ফেলতে পারবে না।
অন্ধকারে ধড়াস করে পড়ে গেল কি যেন!
তারপরেই শোনা গেল তীক্ষ্ণ চিৎকার!
ডায়নার!
.
০৪.
আবার আলো জ্বলল। দেখা গেল, মার্বেলের মূর্তিটা ভেঙে পড়ে আছে মাটিতে। সাইডবোর্ডের খানিকটা ভাঙা। মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে কাঁচের টুকরো।
সাইডবোর্ডের নিচে জবুথুবু হয়ে বসে আছে ডায়না। চেহারা সাদা। হাতে ধরে রেখেছে এখনও ছুরিটা।
তার পাশে গিয়ে বসল কিশোর, মুসা আর ডক্টর নরিয়েমা।
লেগেছে কোথাও? ডায়নাকে জিজ্ঞেস করল মুসা।
মূর্তির টুকরোগুলোর কাছে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে জুভেনার, গেল তো তেইশশো বছরের পুরানো… গলা ধরে এল তার। মূর্তির শোকে চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে।
ভয় পেয়ে গেছে ডায়না। কিশোরের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল। ফুঁপিয়ে উঠে হাত থেকে ছেড়ে দিল ছুরিটা। তারপর লাফিয়ে উঠে এসে আঁকড়ে ধরল কিশোরের হাত, আরেকটু হলেই মারা গেছিলাম আজ!
গুঞ্জন করে উঠল মেহমানরা।
গলায় সহানুভূতি ঢেলে কিশোর বলল, কিছুই হয়নি আপনার। আসুন। বসুন এখানে।
একটা সোফায় প্রায় জোর করে ডায়নাকে বসিয়ে দিল সে। তারপর চারপাশে তাকাতে লাগল। অস্বস্তি বোধ করছে।
এই যে, কি হয়েছে? ওপর থেকে জিজ্ঞেস করল একটা কণ্ঠ।
চোখ তুলে কিশোর দেখল, ডিন কথা বলছে। দাঁত বের করা সেই ঝকঝকে হাসিটা উধাও, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রেখেছে।
অ্যাক্সিডেন্ট, কিশোর জবাব দিল।
কিছুই বুঝতে পারছি না, ডিন, ডায়না বলল। আলো নিবে গেল। কে যেন ফেলে দিল রোমান মৃর্তিটা…
রোমান না, গ্রীক! শুধরে দিল জুভেনার। মূর্তি ভাঙার কষ্ট সইতে না পেরে দুহাতে মাথা চেপে ধরে মেঝেতেই বসে পড়েছে।
ছুরিটা তুলে নিয়ে গিয়ে আবার কাঁচের বাক্সে ভরে রাখল রবিন।
একটা তোয়ালে ভিজিয়ে নিয়ে এলেন নরিয়েমা। ডায়নার পাশে বসে তার কপালে চেপে ধরলেন। তাদেরকে ঘিরে দাঁড়াল মেহমানেরা।
ডায়নার হাত ধরে স্নেহের হাসি হেসে কোমল গলায় ডক্টর বললেন, দেখো, ভয়ের কিছু নেই। কুসংস্কার বিশ্বাস করা উচিত না। ওসব অভিশাপ-টভিশাপ সব ফালতু। মেহমানদের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন আবার। কিন্তু অনেকেই বিশ্বাস করে বসে আছে দেখছি।
ঢোক গিলল ডায়না। ভুরুর ওপরে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। অভিশাপের কথা জানো তুমি, নরিখালা?
ওসব চিন্তার দরকার নেই এখন।
প্লীজ, খালা, আমি ভয় পাব না। তুমি বলো।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নরিয়েমা। বেশ, শুনতেই যখন চাও… সোফায় হেলান দিলেন তিনি। চুপচাপ ভাবছেন যেন কোথা থেকে শুরু করবেন। আরও কাছে ঘেঁষে এল মেহমানেরা।
কুসংস্কার বিশ্বাস করলে এই গল্প শুনে ভয়ই পাবে মানুষ, বলতে শুরু করলেন ডক্টর। ষোলোশো শতকে ইটালির অত্যন্ত ধনী আর ক্ষমতাশালী পরিবার ছিল রেজিয়ারা। তাদের কয়েকজন তো ছিল ভয়াবহ, প্রায় উন্মাদ। আস্তে মাথা নাড়লেন তিনি। ইতিহাস অবশ্য স্বীকার করে না সে কথা। তবে লোকের মুখ তো আর বন্ধ থাকে না। গুজব ছড়ায়ও বেশি এবং রঙ ছড়িয়ে। কিংবদন্তী আছে, বোরজিয়াদের যে লোকটার নাম শুনলেই কেঁপে উঠত লোকে, তার নাম অবমান্ডো বোরজিয়া। ডিউকের ভাইপো ছিল বেসমেন্টে চমৎকার একটা কালেকশন ছিল তার, স্টাফ করা মানবদেহের কালেকশন।
মুসা লক্ষ করল, কেঁপে উঠছে ডায়না।
ডায়নার কাঁধে হাত রেখে তাকে সান্ত্বনা দিন ডক্টর, অমন করছ কেন? এটা নিছকই গল্প, একটা হরর স্টোরি আরকি, আর কিছু নয়া। ঠিক আছে, ভয়ই যখন পাচ্ছ, আর বলব না!
না না, বলো! আমি ভয় পাব না
ডানার চেহারার ভয় ভয় ভান চোখ এড়াল না মুসার বুঝতে পারল, গল্পটা চলতে থাকলে আতঙ্কিত হয়ে পড়বে মেয়েটা।
ব্যাপারটা নিয়েও লক্ষ করলেন। বললেন, অনেক সময় ভয়ের গল্প পুরোটা এনে ফেললে ভয় কেটে যায়। বলেই ফেলি।
হ্যাঁ, বলো তুমি, ডায়না বলল। আমি ভয় পাব না।
আবার গল্প বলতে লাগলেন ডক্টর, বলা হয়, আরমান্ডো বোরজিয়া ছিল ইটালির সবচেয়ে নিষ্ঠুর জমিদার। এমন ভাবে করের বোঝা চাপিয়ে দিত গরীব প্রজাদের ওপর, সেটা শোধ করতেই হিমশিম খেয়ে যেত তারা। কোনদিনই পুরোপুরি শোধ করতে পারত না। বিয়ে করেছিল অনেকগুলো। যতক্ষণ ভাল লাগত, রাখত। অপছন্দ হলেই ঘাড় ধরে বের করে দিত রাস্তায়। এমনকি তখনকার বিখ্যাত সুন্দরী ম্যারিজল অ্যাগ্রোর বরাতেও এইই জুটেছিল…
ছুরিটার কথা বলো, খালা। এ সব শুনতে ভাল লাগে না।
হ্যাঁ, বলছি। নিজের প্রাসাদ আর বাগানের বাইরে খুব কমই বেরোত আরমাভো। একদিন বেরিয়ে ভীষণ চমকে গেল। রাস্তায় শুধু ভিখিরি আর ভিখিরি। এক সময় ভালই ছিল লোকগুলো, জমিজমা ছিল, ওদেরকে পথে নামতে বাধ্য করেছে আরমান্ডোই, এ কথা জানা ছিল না তার। জানার চেষ্টাও অবশ্য করল না। তার কাছে মনে হলো ওগুলো শুধুই জঞ্জাল, মানব-জঞ্জাল।