প্রাসাদের ছাত থেকে উঠে গেছে চারটে মোচা আকৃতির মিনার, দুর্গের টাওয়ারের মত। বিশাল গাড়িবারান্দাকে ঘিরে রেখেছে আঙুরলতা আর ফুলের বেড়। চারদিকে যতদূর চোখ যায়, ছড়ানো লন গিয়ে মিশেছে বনের সঙ্গে। আর কোন বাড়িঘর চোখে পড়ে না। রাতের বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে জোরাল বাজনার শব্দ। দোতলার মস্ত চারটে জানালা দিয়ে উজ্জ্বল আলো এসে পড়েছে বাইরে, ভোরের রোদের মত।
ইয়ার্ডের পিকআপটা পার্ক করে রেখে ভেতরে ঢুকল তিনজনে। মুসার গাড়িটা আনার সাহস পায়নি। প্রচণ্ড শব্দে পাড়া জাগিয়ে দিতে চায়নি। বলা যায় না, পাটির লোকে খেপেও উঠতে পারে।
ঢুকেই যেন ধাক্কা খেলো মুসা, তার নীল সুট বেমানান লাগল তার নিজের কাছেই। দুই ধরনের মেহমান আছে পার্টিতে, পরনে দুই ধরনের পোশাক। একদলের পরনে অতিরিক্ত দামী টাক্সিডো আর ইভনিং গাউন, আরেক দলের পরনে সুট, তবে ওগুলোর দামও কম নয়। মুসারটা ওগুলোর কাছে কিছুই না। ফিটফাট পোশাক পরা, রগ বের হওয়া একজন লোক মেহমানদের মাঝে দাঁড়িয়ে হলদে প্যাডে কি যেন লিখছে।
খবরের কাগজের লোক হবে, ফিসফিস করে বলল মুসা। সোসাইটি কলামিস্ট।
আরি, কিশোর। এসে গেছ। এসো, এসো, জোর গুনকে ছাপিয়ে ভেসে এল ডায়নার কণ্ঠ। রবিন। মুসা। এসো তোমরা।
অকারণেই হাসছে একঝাক লোক, তাদের মাঝ থেকে বেরিয়ে এল সে। চমৎকার পোশাক পরেছে ডায়না। ঘরের এই পরিবেশে পরী মনে হচ্ছে তাকে। কিশোরের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল কালচে বাদামী চুলওয়ালা এক তরুণের কাছে। ছয় ফুটের ওপরে লম্বা। সিনেমার পর্দা থেকে নেমে এসেছে যেন।
কিশোর…রবিন…মুসা, পরিচয় করিয়ে দিল ডায়না। আর এ হলো ডিন রুজভেল্ট।
হাল্লো, বলে হেসে হাত বাড়িয়ে দিল ডিন। ঝিক করে উঠল সাদা দাঁত। এত সাদা, চোখ ধাঁধিয়ে দিতে চায়।
তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ছোটখাট একজন মহিলা। সাদা চুল। বয়েস ষাটের কাছাকাছি। তিন গোয়েন্দাকে যখন পরিচয় করিয়ে দিল ডায়না, মহিলার ভারী লেন্সের চশমার পাশে ঝিলমিল করে উঠল যেন ধূসর-সবুজ চোখ।
আর ইনি হলেন, মহিলার পরিচয় দিল ডায়না, ডক্টর নরিয়েমা ডিলারয়, আমার সবচে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আপনজন। এই দুনিয়ার সবার চেয়ে বেশি চিনি আমি একে।
হাসার সময় কাঁধে ঝাঁকি লাগে ডক্টর ডিলারয়ের। ও আমার ব্যাপারে সব কিছুই খুব বাড়িয়ে বলে। ওয়েলকাম টু ক্লিফসাইড হাইটস। দিনের বেলা এসো একদিন। কি সুন্দর বাগান আছে ডায়নার, দেখবে।
আরেকটা পরিচয় আছে ইনার, ডায়না বলল। ইনি আমার খালা, নরিখালা। চাকরি থেকে অর্ধেক অবসর নিয়েছেন বলা যায়। ক্লিফসাইড কান্ট্রি ক্লাবে এখন পার্টটাইম কাজ করেন। বাকি সময় বাগানের যত্ন করেন। আমার বাগানেও, নিজের বাগানেও। ফুল গাছের পাগল।
সৌজন্য দেখিয়ে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। চারপাশে তাকাল। বিশাল এক পারলারে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। দেয়ালে ঝোলানো অসংখ্য ছবি, সোনালি ফ্রেমে বাঁধাই, ঠাই নেই ঠাই নেই অবস্থা। এককোণে বুককেস আর সাইডবোর্ডের মাঝের ফাঁকে দাঁড়িয়ে আছে গ্রীক যোদ্ধার একটা মার্বেলে তৈরি বিশাল মূর্তি।
এই সময় দরজার ঘন্টা বাজল।
ডিন, রান্নাঘর থেকে আরও কয়েকটা কাপ নিয়ে এসো, প্লীজ, ডায়না বলল। তারপর এক্সকিউজ মি, বলে দরজা খুলতে এগোল।
কালেকশনগুলো দেখলে এসো, তিন গোয়েন্দাকে আমন্ত্রণ জানালেন নরিয়েমা। ডায়নাকে বোঝানোর চেষ্টা করছি, এগুলো এখানে রাখা ঠিক না, মিউজিয়ামেই ভাল। তবে এখানে যতক্ষণ আছে দেখতে অসুবিধে নেই। এসো।
ঘরের মাঝখান থেকে শুরু করে মার্বেলের মৃর্তিটার কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে একটা টেনিস কোর্টের সমান খাবার টেবিল। সেটার দিকে লোলুপ নয়নে একবার তাকিয়ে নরিয়েমার সঙ্গে পুরানো সাইডবোর্ডটার দিকে এগোল মুসা।
খোদাই করা কাঠের বেদির ওপর রাখা হয়েছে একটা কাঁচের বাক্স। ওটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে চামড়ার জ্যাকেট পরা দুজন তরুণ আর একজন তরুণী।
এক্সকিউজ মি, নেলি, মেয়েটাকে বললেন ডক্টর।
সরে দাঁড়াল তিনজনেই।
এগিয়ে গিয়ে আঙুল তুলে বাক্সের ভেতরটা দেখালেন তিনি। ভেতরে বেগুনী মখমলের গদির ওপর শুয়ে আছে চমৎকার একটা ছুরি। লম্বা ফলা, আর মূল্যবান পাথর বসানো সোনার বাট ঝকঝক করছে উজ্জ্বল আলোয়।
মরগান কালেকশনের সবচেয়ে বিখ্যাত জিনিস এটা, নরিয়েমা জানালেন। বোরজিয়া ড্যাগার। নিশ্চয় নাম শুনেছ।
ও, এটাই? সাংঘাতিক! বলে বাক্সের ডালা তুলে ছুরিটা বের করে আনল নেলি।
হঠাৎ গমগম করে উঠল আরেকটা কণ্ঠ, বলেছিলাম না, এই রকমই করবে। করছে কি দেখো না! খেলনা ভেবেছে এত দামী দুর্লভ জিনিসগুলোকে?
ফিরে তাকাল তিন গোয়েন্দা। ছুটে আসছে জুভেনার, পেছনে ডায়না। নেলির হাত থেকে ছুরিটা কেড়ে নিয়ে আগের জায়গায় রেখে দিল কিউরেটর।
বাধা দিয়ে তখন অন্যায় করেছি, মিস মরগান, জুভেনার বলল। ভাবলাম, যাই। গিয়ে মাপ চেয়ে, শান্ত ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি আপনাকে, যে এ সব জিনিস ঘরে রাখা ঠিক নয়। ইশারায় ছুরিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, দাম কল্পনা করতে পারেন ওটার?
মিষ্টি হাসল ডায়না। নিশ্চয়ই। ছুরিটা বের করে হাতে নিল সে। ফলাটা ওপরের দিকে তুলে ধরে ওটা নিয়ে এগোল খাবার টেবিলের দিকে, মেহমানরা যেখানে রয়েছে। চোখের পলকে থেমে গেল গুঞ্জন। একেবারে চুপ সবাই, ফিসফিসানিটুকুও নেই।