তাই নাকি? আগ্রহ দেখাল কিশোর। পারসোনালিটি তো বলছে, মিউজিয়ামের অর্ধেক জিনিসই নাকি আপনাদের। নিয়ে গেলে খালি হয়ে যাবে তো।
তা যাবে। পত্রিকা ভুল তথ্য দিয়েছে। অর্ধেক নয়, ষাট ভাগই আমাদের। এখন ওগুলো সব আমার সম্পত্তি। মিউজিয়ামে ফেলে রাখার পক্ষপাতি নই আমি। বাড়ি সাজাব। নিজের বাড়ির দেয়ালে ঝোলাব পেইন্টিংগুলো। ওদেরকে দিয়ে রাখব কেন শুধু শুধু?
অর্ধেকের বেশি জিনিস মিউজিয়াম থেকে চলে যাচ্ছে দেখে কিউরেটরের মুখটা কেমন হবে, আন্দাজ করতে চাইল কিশোর।
নিজের চোখেই দেখতে পেল খানিক পরে। মিউজিয়ামের কাছে চলে এসেছে গাড়ি। দেখা গেল, বাড়িটার পাশে একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। ওটার পেছনে জড়ো হয়েছে পাঁচজন লোক। চারজনের পরনে ধূসর রঙের ইউনিফর্ম। বড় একটা বাক্স ট্রাকে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। পঞ্চমজনের গাট্টাগোট্টা শরীর, নীল সুট পরেছে, চোখে সরু তারের চশমা। চারজনে ধরাধরি করে বাক্সটা ট্রাকের পেছনে নিয়ে গেছে। চেঁচিয়ে চলেছে নীল সুট। বার বার হাত নেড়ে কি বোঝাতে চাইছে, রাগে লাল হয়ে উঠেছে চোখমুখ। পাতলা হয়ে আসা সোনালি চুলের কয়েকটা গোছা এসে লেপটে রয়েছে ঘামে ভেজা কপালের ওপর। লোকগুলোকে কাজ থেকে, অর্থাৎ ট্রাকে বাক্স ভোলা থেকে বিরত রাখতে চাইছে।
এটাই বোধহয় শেষ বাক্স, আনমনে বিড়বিড় করল ডায়না। হুকুমের সুরে কিশোরকে বলল, আহ, তাড়াতাড়ি চালাও না। মোটোর সঙ্গে কথা বলা দরকার।
ধনুকের মত বাঁকা ড্রাইভওয়ে ধরে বাড়িটার পাশে এনে গাড়ি রাখল কিশোর। একটানে দরজা খুলে লাফিয়ে নামল ডায়না। কি হলো জুভেনার, ওদের ধমকাচ্ছেন কেন?
রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছল লোকটা। সরে যাওয়া চশমাটা আবার ঠেলে দিল নাকের ওপর। সি মরগান, আপনার নিশ্চয় মনে আছে এই জিনিসগুলো মিউজিয়ামকে দান করে দেয়া হয়েছে। তিরিশ বছর আগে দলিল সই করে দিয়েছেন আপনার দাদা। কিউরেটর হয়ে কি করে আমি এগুলো নিয়ে যেতে দিই
অসহিষ্ণুতা চলে গেছে ডায়নার। শান্তকণ্ঠে বলল, জুভেনার, আপনিই বলেছেন, ওই দলিলটা পাওয়া যাচ্ছে না। ছিল যে তার ঠিক কি?
ছিল, নিশ্চয় ছিল! খুঁজে বের করার জন্যে সময় তো দেবেন? গত বছর আগুন লেগেছিল, জানেন। তখন সমস্ত পুরানো ফাইল সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।
ওসব কথা অনেক শুনেছি, বাধা দিয়ে বলল ডায়না। আমার বাবার উইলের কপি আপনি দেখেছেন। জিনিসগুলো এখন আমার সম্পত্তি। এবং আমি ওগুলো ফেরত চাই। অনেক দিন তো রাখলেন, আর কত? নতুন করে সাজিয়ে নিন আবার।
নতুন করে! মাই ডিয়ার লেডি, এটা মিউজিয়াম, বেডরূম নয় যে বললেই সাজানো হয়ে যাবে। এত দামী দামী ছবি, শিল্পকর্ম, চাইলেই কি পাওয়া যায়? আর ওসব জিনিস ছাড়া মিউজিয়াম বাতিল।
মোলায়েম হেসে পরিবেশ হালকা করে ফেলতে চাইল ডায়না। কিশোর যতটা মাথামোটা ভেবেছিল মেয়েটাকে, এখন দেখল ততটা নয়। বরং বয়েসের তুলনায় অনেক বেশি বুদ্ধিমতী।
আহহা, এত মন খারাপ করছেন কেন? ডায়না বলল। অন্য ভাবেও তো ভেবে দেখতে পারেন। তিরিশটা বছর অন্যের জিনিস দিয়ে মিউজিয়ামের মান বাড়িয়েছেন, নাম কামিয়েছেন, এটা কি কম পাওয়া হলো?
ওগুলো রাখতে পারলেই শুধু খুশি হব আমি। আপনি অত্যন্ত অন্যায় কাজ করছেন। আপনার বাবাও মেনে নিতেন না এটা।
লোকটাকে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করল চারজনের একজন। আহহা, মিস্টার জুভেনার, কি শুরু করলেন? সরুন না! ভীষণ ভারী এটা। সরুন, জায়গা দিন। ম্যাডাম যা বলছেন, শুনুন।
না, নিতে হলে আমার লাশের ওপর দিয়ে নেবে। ধাক্কা দিয়ে লোকটাকে সরিয়ে দিতে গেল জুভেনার।
আরেকজনের পায়ে পা বেধে গিয়ে উল্টে পড়ে গেল লোকটা। গেল রেগে। গাল দিয়ে লাফিয়ে উঠে ঘুসি মেরে বসল জুভেনারের চোয়ালে।
পড়ে গেল জুভেনার।
কিউরেটরকে পড়ে যেতে দেখে ছুটে এল মিউজিয়ামের তিনজন কর্মচারী। এসেই যে লোকটা জুভেনারকে মেরেছে তার পেটে ঘুসি মারল একজন। আরেক ঘুসি মেরে ফেলে দিল একটা বাক্সের ওপর।
চোয়াল ডলতে ডলতে চিৎকার করে উঠল কিউরেটর, এই কি করছ নিক, ওটা রডিনের স্ট্যাচু! ভাঙবে তো!
তার চিৎকার কানেই তুলল না কেউ। পাইকারী মারামারি শুরু হয়ে গেছে। মিস ডায়না মরগানের শ্রমিক বনাম মিউজিয়ামের কর্মচারী। টেনে-হিঁচড়ে বাক্স সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল জুভেনার।
এত দ্রুত ঘটে গেল ঘটনা, কিছুক্ষণের জন্যে যেন হতবুদ্ধি হয়ে গেল কিশোর। তারপর সংবিৎ ফিরল। দেখি, থামাই! রবিন, জলদি পুলিসকে ফোন করো! মুসা, এসো আমার সঙ্গে! বলেই দৌড় দিল সে।
একজন শ্রমিকের ওপর থেকে নিককে টেনে সরিয়ে আনল মুসা। ঘুরতেই দেখল, ঘুসি পাকিয়ে তারই দিকে ছুটে আসছে আরেকজন শ্রমিক। ঝট করে মাথা নিচু করে ফেলল সে। ঘুসিটা চলে গেল তার কাঁধের ওপর দিয়ে। সোজা হয়েই জুজিৎসুর প্যাঁচ মেরে মাটিতে ফেলে দিল লোকটাকে।
আরে থামুন, থামুন আপনারা! শুরু করলেন কি! চেঁচিয়ে বলল কিশোর।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। পেছন থেকে এসে তাকে জাপটে ধরল মিউজিয়ামের এক কর্মচারী। মাটিতে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল। পারল না। কারাতের প্যাঁচে কুপোকাৎ হলো। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে ডায়নার, এ রকম কিছু ঘটবে আশা করেনি। ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছে মুসার গাড়িটার দিকে।