ভাগ্যিস কান ছাড়া আর কিছু কাটতে পারেনি, কিছুটা রসিকতা করেই বলল মুসা।
কান দিল না রবিন। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে না! ডিনের মাথা এখন খারাপ! ডায়াকে পেলে ছাড়বে না। জলদি চলো।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলো!
ওপরতলা থেকে হঠাৎ আরেকটা চিৎকার শোনা গেল, প্রতিধ্বনি তুলল প্রাসাদের দেয়ালে। ছুটতে আরম্ভ করেছে ততক্ষণে কিশোর, মুসা আর রবিন। বড় একটা চিলেকোঠায় এসে ঢুকল।
ঢালু হয়ে নেমে গেছে কাঠের সিলিং। শেষ প্রান্তে একটা টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে ডিন আর ডায়না।
সরো, জানোয়ার কোথাকার! হিস্টিরিয়া রোগীর মত চেঁচিয়ে উঠল ডায়না। ছুরিটা তুলে ধরেছে ডিন। এবার টেবিলের এ পাশ ঘুরে, আরেকবার ওপাশ ঘুরে পৌঁছতে চাইছে ডায়নার কাছে।
এই, ফেলো ওটা! দরজার কাছ থেকে বলল কিশোর।
ঝট করে ঘুরে তাকাল ডিন। মুখে পড়েছে কিশোরের টর্চের আলো।
বিকট চিৎকার করে টেবিলের ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ল ডিন। প্রায় পিছলে চলে এল আরেক পাশে। ছুরি তুলে ছুটে এল কিশোরকে মারার জন্যে। কাছে এসে প্রথমেই থাবা দিয়ে কিশোরে হাত থেকে টর্চটা ফেলে দিল। মেঝেতে গড়াতে শুরু করল ওটা, তবে আলো নিভল না। থাবা দিয়ে ধরতে গিয়েও পারল না কিশোর, চলে গেছে আওতার বাইরে।
বোরজিয়া ড্যাগারের স্বাদ দেখে কেমন লাগে! সাপের মত হিসহিস করে উঠল ডিন।
দাঁড়িয়ে রইল না মুসা। তাড়াতাড়ি গিয়ে তুলে নিল টর্চটা, দুজনের গায়ের ওপর ফেলে দেখল, ডিনের ছুরিধরা হাতটা ধরে ফেলেছে কিশোর। কব্জির ওপরটায় একহাতে ধরে মোচড় দিয়ে আরেক হাতে কিছু একটা করল সে, ছুরিটা প্রায় উড়ে চলে গেল ডিনের হাত থেকে। খটাং করে গিয়ে পড়ল মেঝেতে।
ঘরের সবাই ছুটল ওটার দিকে। কিশোর, ডিন, রবিন, মুসা, ডায়না, সব্বাই। একসাথে হাত বাড়াল ওটা তুলে নেয়ার জন্যে। শুধু একজনের হাত পৌঁছল ওটার ওপর।
সরো! সরে যাও! চেঁচিয়ে বলল কিশোর। ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করল রবিন আর ডায়নাকে।
মাথার ওপর ছুরিটা তুলে ঘোরাতে লাগল ডিন।
হঠাৎ লাফিয়ে এসে পড়ল ডায়নার ওপর। বাহু দিয়ে গলা পেঁচিয়ে ধরল। চেঁচানোর চেষ্টা করল ডায়না, সুর বেরোল না ঠিকমত, আ-আ-মার…দম…
ছুটে গেল কিশোর-মুসা।
সরো! ছুরিটা ডায়নার গলায় ঠেকিয়ে ধমক দিয়ে বলল ডিন।
মাঝপথেই দাঁড়িয়ে গেল দুই গোয়েন্দা।
এ রকম হওয়ার কথা তো ছিল না, ডায়না! তীক্ষ্ণ হয়ে গেছে ডিনের কণ্ঠ। কত কষ্ট করে, আলাপ-আলোচনা করে প্ল্যান করেছিলাম আমরা। ভেবেছিলাম বাকি জীবনটা সুখে কাটাব দুজনে। কিন্তু তুমি সব নষ্ট করেছ। সব শেষ করে দিয়েছে তোমার লোভ। কি, করেনি?।
ডি-ডিন, ছড়ো…! শরীর মুচড়ে গলা ছাড়ানোর চেষ্টা করল ডায়ণ। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তুমি পাগল হয়ে গেছ!
প্যাঁচ আরও শক্ত করল ডিন। আমার সঙ্গে বেঈমানী করেছ, স্বীকার করো সে-কথা! করতে লজ্জা লাগছে? বলো, নীলামের সমস্ত টাকা মেরে দেয়ার ফন্দি করোনি তুমি? আমাকে কি দিতে চাওনি?
নাআআ…! হাঁসফাঁস করছে ডায়না। ছাড়ো, প্লীজ…
ঠেলে নিয়ে চলল তাকে ডিন। ধাক্কা দিয়ে ফেলল একটা কেবিনেটের ওপর। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল ওটার দরজা। অসংখ্য প্লেট আর রূপার তৈজসপত্রের ফোয়ারা ঝরতে লাগল যেন। ওপর দিকে তাকাল সে। কিছুটা ঢিল হয়ে গেল বাহুর বাধন।
সুযোগটা কাজে লাগাল ডায়না। ঝাড়া মেরে গলা ছোটাল, তবে বাসনে পা পিছলে আছড়ে পড়ল মেঝেতে। ঝনঝন করে পড়ছে জিনিসপত্র।
আলো নিভিয়ে দিল মুসা। নরক গুলজার শুরু হয়ে গেল যেন।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হলে লড়াই। শেষ হলো ভোতা একটা ধুপ শব্দ দিয়ে।
আবার যখন আলো জ্বালল মুসা, দেখা গেল ডিনের ভূপাতিত নিথর দেহের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। ডান হাতের আলগা মুঠোয় পড়ে আছে বোরজিয়া ড্যাগার।
বেশি জোরে মারলাম না তো? হাতের টর্চটা নেড়ে হেসে বলল মুসা। মরে না গেলেই বাঁচি।
আরে নাআহ, ঠিক হয়ে যাবে, ডায়নাকে টেনে সরিয়ে নিতে নিতে বলল কিশোর।
মেরে ফেলেছিল আরেকটু হলেই! ফুঁপিয়ে উঠল ডায়না।
আর পারবে না, অভয় দিল কিশোর।
বাইরে একটা গাড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হলো।
কে এল? রবিনের প্রশ্ন।
কি জানি! মুসা বলল।
এখনও কাঁপছে ডায়না। ধরে ধরে তাকে এনে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল কিশোর।
সব আমার দোষ, কিশোর, ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল ডায়না। আমি আর ডিনই সব করেছি…
এক মিনিট, হাত তুলল রবিন। হাতের টর্চটা ঘোরাল ডায়না আর ডিনের ওপর। একটা ব্যাপার বাদ পড়ে যাচ্ছে। ধরলাম, বনের ভেতর থেকে গুলি করেছিল ডিন। সুইমিং পুলে বিদ্যুতের তার ফেলে রাখাটাও ওর কাজ। কিন্তু সেদিন পার্টিতে ইলেকট্রিসিটি অফ করে দিয়ে মূর্তিটা ঠেলে ফেলল কে সেটা তো তার কাজ হতে পারে না?
ডায়নার দিকে তাকাল কিশোর-মুসা। পেছনের সিঁড়িতে মৃদু পায়ের শব্দ হলো।
কি, জবাব দাও? ডায়নার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল রবিন। দরজার দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে গেল ডায়না। ঘরে স্নান আলো এসে পড়ল।
ফিরে তাকাল অন্যরা।
হাতে একটা কেরোসিনের বাতি নিয়ে গড়িয়ে আছেন ডক্টর নরিয়েমা। মুখে কুৎসিত হাসি। হাতের পিস্তলটা তুলে বললেন, এই যে তোমার জবাব।
.
১৪.
ডায়না, সব ভণ্ডুল করে দিয়েছ তুমি, নিমের তেতো করল যেন ডক্টরের কণ্ঠে। বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। সব ঠিকঠাক চলছিল। এ রকম যে ঘটবে ভাবতেই পারিনি।