সাবধান! চেঁচিয়ে মুসাকে সাবধান করল কিশোর।
ডান হাতে লোকটাকে জড়িয়ে ধরে রেখে অন্য হাতে লোকটার ডান কব্জি চেপে ধরল মুসা। একটা বিশেষ দুর্বল জায়গায় বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ দিতেই নিমেষে খুলে গেল ছুরি ধরা আঙুলগুলো পানিতে পড়ে গেল ছুরিটা।
ইতিমধ্যে দুর্বল হয়ে এসেছে লোকটা। নড়াচড়া আর তেমন করছে না। তাকে নিয়ে সঁতরে তীরে ওঠার চেষ্টা চালাল মুসা। মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে রয়েছে চোখা পাথরের দেয়াল, দুপাশ থেকে চেপে এসেছে, মাঝের সরু ফাঁক দিয়ে বয়ে চলেছে পানি। লোকটাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় মুসা দেখল না সেটা, কিন্তু রবিনের চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
ছেড়ে দাও, মুসা, ছেড়ে দাও! তুমিও মরবে!
জলদি এসে ধরো! আমি একলা পারছি না!
কিছুতেই ছাড়বে না মুসা, বুঝতে পেরে প্রাণপণে সাঁতরে এগোল অন্য দুজনে। কোনমতে কাছে এসে চেপে ধরল লোকটার হাত।
তিনজনে মিলে টেনেটুনে তীরের কাছে নিয়ে এল লোকটাকে। অল্পের জন্যে বেঁচে গেল লোকটা। চোখা পাথরের দেয়াল থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে তীরে এসে উঠল ওরা।
ভেজা মাটিতে চিত করে শুইয়ে দেয়া হলো লোকটাকে। চোখ মুদে রয়েছে সে। বেহুশ হয়ে গেছে বোধহয়। তাড়াতাড়ি ওর মুখে মুখ লাগিয়ে কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাসের চেষ্টা চালাল কিশোর।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ কেশে উঠল লোকটা। আ-আমি…কো-কোথায়…
চোখ মেলল লোকটা। ঘোলাটে দৃষ্টি। শূন্য চাহনি। ঠিক হয়ে এল ধীরে ধীরে। আমি বেঁচে আছি, তাই না?
আছেন। অল্পের জন্যে বেঁচেছেন, জবাব দিল কিশোর। সময় খারাপ যাচ্ছে নাকি আপনার?
খারাপ? বিড়বিড় করল লোকটা। দুর্বল কণ্ঠ, কিন্তু রাগ চাপা পড়ল না, বলল, শুধু খারাপ বললে কম বলা হবে। কোনমতে জীবনটাকে টিকিয়ে রেখেছি আমি!
আস্তে। আস্তে। হাত নাড়ল কিশোর, সহজভাবে কথা বলুন। আপনি কে? এখানে কি করতে এসেছেন?
আমি একজন বিপদে পড়া মানুষ, স্যার, নাটক করতে করতে যেন নাটকীয় ভঙ্গিতে কথা বলা অভাস হয়ে গেছে লোকটার। মাথা ঝাড়ল, যখন তাকে তুলে বসানোর চেষ্টা করল রবিন। নাম আমার নিভার ব্রাউন। চোখ নামিয়ে মাথা নাড়ল বিষণ্ণ ভঙ্গিতে। হ্যাঁ, থিয়েটার আর সিনেমার সেই নিভার ব্রাউন। চমকে গেলে তো?
কারও কাছ থেকে জবাব না পেয়ে মুখ তুলে দেখল ওদের শূন্য দৃষ্টি। আর্ট ফিল্ম বোধহয় দেখো না তোমরা!
মাথা নাড়ল তিনজনেই।
তাহলে আর চিনবে কিভাবে? পচা নাটক আর সিনেমা দেখলে আমার নাম জানার কথা নয়। যাকগে! এখন আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দাও তো। কেন বাধা দিলে আমাকে?
আত্মহত্যা একটা অপরাধ, মিস্টার ব্রাউন, কোমল গলায় বলল রবিন। আপনার পরিবারের কথা ভাবুন…
কঠিন হয়ে গেল লোকটার ধূসর চোখজোড়া, দৃষ্টি যেন ধারাল ছুরির ফলার মত ভেদ করে ঢুকে গেল রবিনের অন্তরে। পরিবার? সেই চরিত্রহীন মেয়ে মানুষটার কথা বলছ, যে আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেছে হলিউডের এক ফিল্ম এডিটরের সঙ্গে!
স-সরি, মিস্টার ব্রাউন, আমি সত্যি দুঃখিত।
আরে শোনোই না, আমার দুঃখের ইতিহাস শুরুই তো করিনি এখনও। আর্ট ফিল্ম আর খুব একটা হয় না আজকাল, ফলে কাজ পাওয়া যায় না। একজন নিয়মিত একটা বেতন দিয়ে যাচ্ছিলেন, এখন সেটাও গেছে। তা ছাড়া মনের খোরাকই যদি গেল একজন মানুষের, বেঁচে থাকার আর কি অর্থ বলো? জীবনের সব কিছু হারিয়ে আমার বয়েসী একজন মানুষ বেঁচে থেকে কি করবে? আঁ! কি করবে? আশপাশে মাটিতে চোখ বোলাল সে। আমার ছুরি কই?
পানির তলায়, কিশোর জানাল। নদীতে। শুনুন, ওসব পাগলামি চিন্তা বাদ দিয়ে আমাদের সঙ্গে আসুন। গাড়ি আছে। বাড়ি পৌঁছে দেব। বিশ্রাম নিলেই মাথা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। ভীষণ উত্তেজিত হয়ে আছেন এখন আপনি।
হবে না, হবে না! ওই ছুরিটা হারিয়ে তো মন আরও খারাপ হয়ে গেল! ওই ছুরিটা আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি। আমার বাবার বাবা, তার বাবা, তার বাবার কাছ থেকে এসেছে! করলে কি তোমরা! আমাকে মরে তোত বাঁচতে দিলেই না, মাঝখান থেকে ওরকম একটা সম্পদ খোয়ালাম…।
দুই সহকারীর দিকে তাকাল কিশোর। তারপর জোর করে ধরে তুলল ব্রাউনকে। কিছুতেই যাবে না লোকটা। শেষে অনেকটা হাল ছেড়ে দেয়ার ভান করে ঘুরে দাঁড়াল তিনজনে। পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করল।
একবার দ্বিধা করে পিছু নিল ব্রাউন। অভিযোগের পর অভিযোগ করে চলল। সমস্ত দুনিয়ার ওপর তার ঘৃণা জন্মেছে। তবে থামল না আর। বন পেরিয়ে এসে দাঁড়াল মুসার ভটভটানি জেলপি গাড়িটার কাছে।
ট্রাংক থেকে উলের একটা শাল বের করল মুসা। ব্রাউনের দিকে বাড়িয়ে দিল। ভেজা শরীর জড়িয়ে নিতে ইশারা করল লোকটাকে।
মুসা যখন ইঞ্জিন স্টার্ট দিল; শাল জড়ানো, এমনকি পেছনের সীটে রবিনের পাশে উঠে বসার কাজটাও সমাপ্ত হয়েছে লোকটার, ফোঁপাতে আরম্ভ করল। যেন কত কষ্ট।
প্লীজ, মিস্টার ব্রাউন, মুসা বলল, এত ভেঙে পড়ার কিছু নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। কোথায় থাকেন, বলবেন?
নাইনটি ফোর লেকভিউ এভিন্য! হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছল বেচারা ব্রাউন। আমার জীবন যদি রক্ষাই করলে, আরেকটু উপকার করো, দয়া করে একটা টিস্যু পেপার দাও।
একটা টিস্যু পেপার বের করে দিল কিশোর।
গাড়ি চালিয়ে রকি বীচের একটা পুরানো অঞ্চলে ঢুকল মুসা। শহরতলি দিয়ে চলেছে। সারা দুনিয়ার প্রতি এক নাগাড়ে অনর্গল অভিযোগ করে চলেছে ব্রাউন।