চামড়ায় মোড়া গদিওয়াল আর্মচেয়ারে নেতিয় পড়ল ডায়না। চকের মত সাদা হয়ে গেছে গাল।
এ রকম কিছু হবে, আমি জানতাম, মুসা বলল। খারাপ লাগছে মেয়েটার জন্যে।
জানতে, না? কেঁকিয়ে উঠল ডায়না। তা তো জানবেই। তোমার তো আর কিছু না।
সরি, ডায়না। ওভাবে বলতে চাইনি-
জানি, জানি! জোরে নিঃশ্বাস ফেলল ডায়না। একদিক থেকে ভালই হলো। হতচ্ছাড়া এই জিনিসগুলো শুধু ভোগাচ্ছেই আমাকে, ক্ষতিই করছে। দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলোর ওপর চোখ বোলাল সে। ওগুলো ফেরত দিতে কষ্ট হবে, চোখ দেখেই বোঝা গেল।
জিনিসগুলো দেয়ার পরও কিন্তু আমাদের তদন্ত বন্ধ হবে না, কিশোর বলল।
অন্য কোন জগতে চলে গিয়েছিল যেন ডায়না, বাস্তবে ফিরে এল। ঠিক? কিশোরের চোখে চোখে তাকাল। এরপর কি করবে?
পারলারে খুঁজতে যাব…
না!
না কেন?
ডায়নার নিচের ঠোঁট সামান্য কাপল। আহত দৃষ্টিতে তাকাল কিশোরের দিকে। তুমি আমাকে একা ফেলে যাবে না। সিকিউরিটি অফিসার হয়েছ, মনে আছে?
তা আছে। মুসার দিকে তাকাল কিশোর। শ্রাগ করল। ঠিক আছে, তোমার ওপরই ছেড়ে দিলাম। সূত্র খুঁজে বের করা। পারবে তো?
পারব। দরজার দিকে এগোতে গিয়ে বিড়বিড় করে বলল, তুমি তো গার্ড দেবে ওকে, তোমাকে গার্ড দেবে কে?
কি বললে?
না, কিছু না। বেরিয়ে গেল মুসা।
*
কাঁচের বাক্সে আগের জায়গায়ই রয়েছে বোরজিয়া ড্যাগার। সাবধানে ডালাটা তুলল মুসা। অস্বাভাবিক কোন কিছু নেই তো বাক্সটায়? এই যেমন ইলেকট্রিক সুইচ, চোর ঠেকানোর কোন যন্ত্র…
আস্তে করে ছুরিটা তুলে আনল সে। মখমলের গদির নিচে খুঁজল হাত দিয়ে টিপে টিপে। কিছু নেই। ছুরিটা আবার রেখে দিয়ে এসে দেখল মূর্তিটা যেখানে ছিল সেখানটা। না, এখানেও চোখে পড়ার মত কিছু নেই।
তার মনে হচ্ছে, কিছু না কিছু আছেই ঘরে। ও দেখতে পাচ্ছে না এই যেমন সার্কিট ব্রেকারের বাক্স, লুকানো টেলিভিশন ক্যামেরা
এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে সে। ওক কাঠে তৈরি দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বোলাচ্ছে সারা ঘরে। নড়তে গিয়ে খোদাই করা একটা জিনিসে কনুই লাগল। সরে গেল ওটা।
লাফিয়ে সরে এল মুসা। আবার আগের জায়গায় ফিরে এসেছে জিনিসটা।
কিরিচ করে একটা শব্দ হলো, তারপর ঝাঁকুনি। অবাক হয়ে দেখল সে, বুককেসটা সরে যাচ্ছে, নাড়া লেগে পড়ে গেল কয়েকটা বই। পেছনে দেয়াল টেয়াল কিছু নেই, শুধু গাঢ় অন্ধকার।
একটা গোপন কুঠুরি, ভাবল মুসা। পুরানো গোয়েন্দা গল্পের সিনেমাগুলোতে যেমন থাকে।
অতি সাবধানে ভেতরে পা বাড়াল সে। মনে করল, সিঁড়িটিড়ি। আছে। কিন্তু কিছুই ঠেকল না পায়ে। শুধু মাকড়সার জাল। এত সতর্ক থেকেও দুর্ঘটনা এড়াতে পারল না। পড়ে গেল, গিলে ফেলল যেন তাকে অন্ধকার!
.
০৯.
সিমেন্টের মেঝেতে পড়ল সে। একটা মুহূর্ত পড়ে থাকল চুপচাপ। দম নিল। প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে। নেড়েচেড়ে দেখল হাত-পা। না, ঠিকই আছে, ভাঙেনি।
ধীরে ধীরে চোখে সয়ে এল অন্ধকার। চারপাশে তাকাল সে। যেখান দিয়ে পড়েছে, সেই ফাঁক দিয়ে আলো আসছে আবছাভাবে। বেশ বড় একটা ঘরে পড়েছে সে। জিনিসপত্র নেই। অন্য পাশের দেয়ালে একটা ছোট দরজা।
উঠে এসে দাঁড়াল ওই দরজাটার কাছে। ঢোকার আগে দ্বিধা করল একবার। দরজাটা এত নিচু, মাথা নুইয়ে ঢুকতে হলো তাকে। খুব সতর্ক রইল যাতে আগের বারের অবস্থায় না পড়ে। দুই পাশে হাত ছড়িয়ে দেখল, দেয়ালের খসখসে পাস্টার লাগে হাতে। মাথা সোজা করতে যেতেই ছাতে বাড়ি লাগল, নিচু করে ফেলল আবার। একটা সুড়ঙ্গে প্রবেশ করেছে সে, বুঝতে পারল। আলোর অভাবে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। পা বাড়াল সামনে। কোথায় যাচ্ছে, বোঝার উপায় নেই। শুধু এটুকু বুঝল, ঢালু হয়ে নেমে গেছে সুড়ঙ্গটা।
মাথা নিচু করে রেখে, দুহাতে দেয়াল ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগোল সে। প্রথমে ধীরে, তারপর গতি বাড়াল। কোন একটা জায়গায় নিশ্চয় পৌঁছবে, ভাবল সে। স্টোররূম, বয়লার রূম, কিংবা…
ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই কিসে যেন বাড়ি খেলো। কপাল ডলল, যেখানে লেগেছে। আরেক হাত বাড়িয়ে দিল সামনে, একটা দরজা লাগল হাতে। হাতড়ে বের করল নব। ওটা ঘুরিয়ে ঠেলা দিতেই খুলে গেল পাল্লা।
আরেকটা অন্ধকার ঘর। ভেতরে পা দিল সে। পায়ের নিচে পড়ল কি যেন, আরেকটু হলেই উল্টে পড়ে যেত, সময়মত ধরে ফেলল দরজার পাল্লাটা। সুইচবোর্ডের আশায় হাতড়াতে লাগল দেয়ালের পাশে।
হাতে ঠেকল ধাতব বোর্ডটা। সুইচ টিপতে উজ্জ্বল ফ্লোরেসেন্ট আলোয় ভরে গেল ঘর। এতক্ষণ অন্ধকারে থেকে এই আলো অসহ্য লাগল চোখে, বন্ধ করে ফেলল। আবার খুলে মিটমিট করল। ঠিক হয়ে এল ধীরে ধীরে। নানা রকম জিনিসে বোঝাই। ট্রাংক, বাক্স, বাগানে কাজ করার যন্ত্রপাতি, আরও নানা রকম জিনিস। দেখল, যেটাতে পা দিয়ে পিছলে পড়ে যাচ্ছিল, সেটা একটা ধাতব রোলার-টে।
একপাশের দেয়ালে দেখতে পেল সার্কিট ব্রেকারের ধাতব বাক্সটা। বাক্সের সামনে দরজাটা টেনে খুলল সে। সুইচ আছে মোট বিশটা। নিচে লেখা রয়েছে কোনটা কোন্ ঘরের: রান্নাঘর, বসার ঘর, পারলার…। সুইচগুলোর নিচে একটা বড় মেইন সুইচ। এখান থেকেই ঘটনাটা ঘটানো হয়েছে, বিড়বিড় করে বলল সে নিজেকেই। পুরো ম্যানশন অন্ধকার করে দেয়া হয়েছিল, সুইচ অফ করে দিয়ে!