আশ্চর্য! কথাগুলো বানিয়ে বলোনি তো?
উঁহু, মাথা নাড়ল মুসা, বানিয়ে বলেনি ও। এ ধরনের অভিশাপের কথা একটু আগে আমিও শুনে এলাম। একজন ইনডিয়ান যোদ্ধার মুখে।
কার মুখে?
ইনডিয়ান যোদ্ধা। জেনারেল স্টোরে গিয়ে ঢুকেছিলাম। দরজার পাশে ঝোলানো কয়লার হাতারবাড়ি খেয়ে বেহুশ হয়ে গেলাম। হুঁশ ফিরলে দেখি একজন ইনডিয়ান যোদ্ধা হাতে টমাহক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। ও আমাকে জানাল ফ্লেমিং রকে ইনডিয়ানদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচারের কারণে অভিশাপ নেমেছে তাদের ওপর। চিরকালের জন্যে অভিশপ্ত হয়ে থাকতে হবে তাদের। কোনদিন রেহাই পাবে না। মুক্তি পাবে না এভিশপ্ত অবস্থা থেকে। সে আমাকে শর্ত দিয়েছে, এ সব কথা যদি বাইরের দুনিয়াকে জানার কথা দিই, তাহলে এখান থেকে মুক্তি পাব আমরা।
তারপর? লোকটা কই?
উধাও হয়ে গেল। স্রেফ মিলিয়ে গেল বাতাসে।
তারমানে..তারমানে, বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর, সত্যিই একটা ভূত দেখেছ তুমি?
হ্যাঁ। সে যে এসেছিল, তার প্রমাণও আছে আমার কাছে। পকেট থেকে হেডব্যান্ডটা টেনে বের করল মুসা। আমাকে এটা উপহার দিয়ে গেছে সেই ইনডিয়ান যোদ্ধা।
হেডব্যান্ডটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগল কিশোর। কেমন বিমূঢ়ের মত হয়ে গেছে। অবিশ্বাস্য। অনেকক্ষণ পর মুখ খুলল সে। দুই সহকারীর দিকে তাকাল। বিশেষ করে মুসার দিকে। আর কি করতে বলেছে সে?
এখান থেকে চলে যেতে।
আমি আর রবিন থাকি, তুমি গিয়ে শেরিফকে ডেকে নিয়ে এসো।
না, জোরে জোরে মাথা নাড়ল মুসা। সেটা বোধহয় ঠিক হবে না। সকাল হলে দেখা যাবে শহরটাই নেই, আবার গায়েব। বোকা বনতে হবে তখন আমাদের। তা ছাড়া শেরিফকে ডাকাডাকি করতে গেলে সেই ইনডিয়ান যোদ্ধা রেগে গিয়ে ক্ষতি করে বসতে পারে আমাদের।
গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর। কি যেন ভাবছে। হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুখ। আরেক কাজ করি না কেন? চলো, গাড়িতে গিয়ে বসে থাকি। কাটিয়ে দিই রাতটা। ভোরের আলো ফুটলে যদি দেখি তখনও রয়েছে শহরটা, ছবি তুলে নেব পটাপট। তাতে প্রমাণ করতে পারব, ফ্লেমিং রক নামে একটা শহর সত্যিই ছিল এক সময়।
দারুণ। চমৎকার! একমত হয়ে মুঠো ঝাঁকাল রবিন।
চলো, বেরিয়ে যাই, তাগাদা দিল মুসা। এ শহরে থাকতে আর একটা মুহূর্তও ইচ্ছে করছে না আমার।
*
নিরাপদেই গাড়িতে ফিরে এল ওরা। আধো ঘুম আধো জাগরণের মাঝে কোনমতে কাটিয়ে দিল রাতটা। সকাল হলো। আলো ফুটল। সূর্য উঠল। তারপরেও যখন শহরটা মিলাল না, কেন যেন খানিকটা হতাশই হলো ওরা।
গ্লাব কম্পার্টমেন্ট থেকে ৩৫এম এম ক্যামেরাটা বের করল কিশোর। প্রায় পুরো ফিল্মটাই খরচ করে ফেলল রহস্যময় শহরটার ছবি তুলে। টেলিফটো লেন্স লাগিয়ে হোটেল, জেনারেল স্টোর, স্কুলহাউস, গির্জা, জেলখানার ছবি তুলল।
যাক, হয়ে গেল কাজ, সন্তুষ্ট হয়ে ক্যামেরাটা রেখে দিল সে। এখন আর লোকে অবিশ্বাস করতে পারবে না আমাদের।
কিন্তু মুসার মুখে হাসি নেই। এ শহরের গল্প তো গিয়ে আগেও লোকে বলেছে। লাভটা হয়েছে কি? মাঝখান থেকে নিজেরাই গায়েব। আমাদের বেলায়ও যদি সেরকম কিছু ঘটে?
ঘটবে না, কিশোর বলল। তোমার ইনডিয়ান ভূত-বন্ধুটি তো শর্তই দিয়েছে, শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচারের কথা বাইরের দুনিয়াকে গিয়ে জানালে ছেড়ে দেবে আমাদের। আমার ধারণা, বেঁচে থাকতে ভাল লোক ছিল লোকটা। আমাদের ওপর সুনজর আছে তার।
অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। এ সব ভূতপ্রেতের কথা তুমি বিশ্বাস করছ?
করতে ইচ্ছে করছে, জবাব দিল কিশোর। কি করব বলো? হয়তো ফ্লেমিং রক শহরটাই এর জন্যে দায়ী।
যাক, খুশি হলো মুসা, ভূত সম্পর্কে তোমার মানসিক অবস্থার পরিবর্তনে আমি খুশি।
বেশি খুশি হয়ো না, সাবধান করল রবিন। আবেগের বশে এখন বলছে বটে, বাড়ি গিয়েই দেখবে বদলে গেছে।
ইঞ্জিন স্টার্ট দিল মুসা।
রাস্তার খাঁজকাটা সেই দাগে চাকা ফেলেই চালাতে হলো গাড়ি। দিনের বেলা এখন ভালমত দেখতে পারছে চারপাশটা। পথ কোথাও উঁচু কোথাও নিচু। কোথাও পাহাড়ের ওপর দিয়ে গেছে, কোথাও উপত্যকা ধরে। একটা পাহাড়ের মাথায় গাড়ি উঠলে শেষবারের মত ফ্লেমিং রককে দেখার জন্যে ফিরে তাকাল কিশোর।
মুসা! রবিন। চিৎকার করে উঠল সে। শহরটা নেই।
ব্রেক প্যাডালের ওপর প্রায় দাঁড়িয়ে গেল মুসা। ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেল গাড়ি। সে আর রবিন একই সঙ্গে ঘুরে তাকাল, দেখার জন্যে।
সত্যিই নেই শহরটা।
*
হুঁ, ভূতুড়েই। দিন কয়েক পর ঘটনাটার কথা শুনে বলল ওদের বন্ধু টম।
কিংবা টাইম-ডিসটশন জাতীয় কোন কিছুর খপ্পরে পড়েছিলাম, কিশোর বলল। কিছুক্ষণের জন্যে কোনও ধরনের স্পেস হোলেও ঢুকে গিয়ে থাকতে পারি আমরা।
শেরিফকে দেখিয়েছ ছবিগুলো?
কোত্থেকে দেখাব? ওঠেইনি।
মানে? তুমি নিজের হাতে তুলেছিলে বলেছ।
হ্যাঁ, বলেছি। কিন্তু একটা ছবিও স্পষ্ট হয়নি। সব ঘোলা।
একটু দুরে সোফায় বসে নীরবে তাকিয়ে রয়েছে মুসা আর রবিন। ওদের দিকে একবার তাকিয়ে টমের দিকে চোখ ফেরাল কিশোর। শহর তো দূরের কথা, আশেপাশের পাহাড়-পর্বত, আকাশ কোন কিছুই ওঠেনি।
তাহলে ব্যাখ্যাটা কি এর? প্রশ্ন করল বিমূঢ় টম। এমন হতে পারে না, পত্রিকায় লেখাটা পড়ে ফ্লেমিং রক গেঁথে গিয়েছিল তোমাদের মগজে, তারপর রাতবিরেতে দুর্যোগের মধ্যে ওই পাহাড়ের ওপরে গাড়িতে বসে পুরো ব্যাপারটাই কল্পনা করে নিয়েছ তোমরা?