প্রথম সেলটায় এসে ঢুকল সে। কানে এল পেছনে দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার শব্দ। চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল। খোলার চেষ্টা করল দরজাটা। অনড় রইল পাল্লা। জেলখানার ভেতরে আটকা পড়ল সে।
আশেপাশে মানুষ তো দূরের কথা, একটা প্রাণীকেও চোখে পড়ল না তার। সামান্যতম বাতাসও ঢুকছে না যে বাতাসে ধাক্কা দিয়ে দরজা লাগাবে। তাহলে?
মেরুদণ্ডে শীতল শিহরণ বয়ে গেল তার। শেষে আর কোন উপায় না দেখে মুসা আর রবিনের নাম ধরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করল।
কিন্তু কোন জবাব এল না। সাড়া এল না কারও কাছ থেকে। শহরের দূরতম প্রান্তে চলে এসেছে সে। এখান থেকে তার চিৎকার কারও কানে পৌঁছবে না। আরেকটা ভাবনা মাথায় আসতে শঙ্কিত হয়ে পড়ল সে। ওরা দুজনও কোন রকম দুর্ঘটনার শিকার হয়নি তো? নিজের চেয়ে ভয়টা ওদের জন্যে বেশি বেড়ে গেল তার। সে নিজে আটকা পড়েছে জেলখানায়। ওরাও যদি কোথাও এমন করে আটকে পড়ে, কেউ বাঁচাতে আসবে না ওদের। কেউ কাউকে মুক্ত করতে পারবে না। ফ্লেমিং রকের অভিশাপের শিকার কি ওরাও হতে যাচ্ছে?
*
ডাকতে ডাকতে জেলখানার কাছে চলে এসেছে মুসা।
রবিনও জায়গামত গিয়ে কিশোর আর মুসাকে না পেয়ে এদিকেই আসছে। মুসার ডাক কানে ঢুকতেই ছুটতে শুরু করল সে।
জেলখানার আরও কাছে আসার পর ক্ষীণ একটা ডাক কানে এল মুসার। কান পেতে শুনল কোনদিক থেকে আসছে। দৌড় দিল জেলখানার দিকে।
আবার ডাকতেই আবারও সাড়া এল। কথাগুলো বুঝতে পারল এবার। কিশোর বলছে, মুসা, আমি এখানে।
জেলখানার দরজার দিকে দৌড় দিল সে। একছুটে ঢুকে পড়ল ভেতরে। কিশোরকে গরাদের ওপাশে দেখে থমকে গেল প্রথমে। তারপর হাসতে শুরু করল।
হাসির কি হলো। যসির কি হলো? ভুরু নাচাল কিশোর। আগে বের করো আমাকে। তারপর যত খুশি হেসে। ওই যে, তোমার মাথার পেছনে দেয়ালে ঝোলানো রয়েছে চাবি।
মুসা ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই ঢুকে পড়ল রবিন। কিশোরের শেষ কথাটা কানে গেছে তার। দেয়াল থেকে চাবি খুলে নিয়ে সেলের দরজা খুলতে এগোল।
দরজার তালায় চাবি ঢোকাল সে। মোচড় দিল। দেখে, তালাটা খোলা। ঠেলা দিতেই পাল্লাটাও খুলে গেল। অবাক হয়ে তাকাল কিশোরের দিকে। তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? দরজা তে খোলাই আছে।
হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। বিমূঢ়ের মত মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ছিল না। এক মিনিট আগেও ছিল না। তোমরা মনে করেছ আমি চেষ্টা করিনি? বহু ভাবে চেষ্টা করে দেখেছি, খুলতে পারিনি।
ঢুকলে কি ভাবে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
দেয়ালে টর্চের আলো ফেলে দেখতে দেখতে ঢুকে পড়লাম, কিশোর বলল আমি ঢুকতেই পেছনে আপনাআপনি লেগে গেল দরজাটা। আশেপাশে কেউ ছিল না। বাতাস ছিল না। কি ভাবে বন্ধ হলো, জিজ্ঞেস কোরো না আমাকে। জবা দিতে পারব না।
জিজ্ঞেস আমি করবও না, বিড়বিড় করে বলল মুসা। কারণ আমি জানি দরজাটা কে বন্ধ করেছে!
দেয়ালের অবস্থা দেখো, টর্চের আলো ফেলল কিশোর। কি সব লিখে রেখেছে। মানে করতে পারবে এ সবের? শব্দগুলো কিছুই বুঝলাম না। তবে ড্রয়িংগুলোর মানে বোঝা যাচ্ছে।
দেখার জন্যে তো ভেতরে ঢুকতে হবে, মুসা বলল। এখান থেকে দেখতে পাচ্ছি না দেয়ালের লেখা। আমি ঢুকতে পারব না। আবার যদি লেগে যায় দরজাটা?
তা-ও তো কথা, চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর। রবিন বাইরে থাকলে অবশ্য খুলে দিতে পারবে।
দেখা গেল রবিনও খুলতে পারল না, তখন? ভূতের ওপর বিশ্বাস নেই। ওর কোন যুক্তি মেনে চলে না। তালা আটকে দিলে তখন আর বেরোনোর জো থাকবে না।
থাক তাহলে, ঢোকার দরকার নেই, বেরিয়ে আসতে আসতে বলল কিশোর ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। বসার ঘরের দেয়ালেও প্রচুর লেখা আছে।
ঘরের প্রতিটি দেয়ালে, প্রতিটি কোণে আলো ফেলে ফেলে দেখল ওরা। একট লেখায় আলো ফেলে থেমে গেল রবিন। জোরে জোরে পড়তে আরম্ভ করল আজকের দিনে, সাদা মানুষদের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৩ এপ্রিল ১৮৭২ সালে ছয়জন ইনডিয়ান যোদ্ধাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে ঘোড়া চুরি অপরাধে, যে অপরাধটা করেইনি ওরা। আগামীকাল আমরা যাচ্ছি আমাদের ভাইদের সঙ্গে সাদা মানুষের দেয়া বিচারের রায়ে মৃত্যুদণ্ড ভোগ করতে। শিরচ্ছে করে হত্যা করা হবে আমাদের। এই অন্যায়ের বিচার হবে, এর শাস্তি ভোগ করতেই হবে ওদের। পুরো ফ্লেমিং রকের ওপর নামবে চিরকালের অভিশাপ। স্বর্গ থেকে নেমে আসবেন মহান প্রেত, এই অন্যায়ের বিচার করতে। আমাদের মহান পিতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করবেন সাদা মানুষরে, সেই সব ভূমি, যেগুলো ফেঁড়ে কেটে খনি বানিয়েছে ওরা, তছনছ করে ছেড়েছে। ফ্লেমিং রককে মহাকাশের কালে শূন্য গর্ভে বিলীন করে দেবেন মহান প্রেত।
ফ্যানটাস্টিক। চিৎকার করে উঠল কিশোর। পকেট থেকে নোটবুক আর পেন্সিল বের করে দ্রুত টুকে নিল কথাগুলো। তারপর চোখ পড়ল দেয়ালের লিখনের ওপর, যেটা থেকে পড়েছে রবিন। দুর্বোধ্য ইনডিয়ান ভাষা দেখে চোখ কপালে উঠল তার।
রবিন। কণ্ঠস্বর ফিসফিসানিতে নেমে এল কিশোরের, কি করে পড়লে তুমি? তোমার তো এই ইনডিয়ান ভাষা জানার কথা নয়।
মাথা ঝাড়া দিয়ে মগজের ভেতর থেকে কি যেন দূর করতে চাইল রবিন। কি জানি। মনে হলো, কে যেন আমার ভেতরে ঢুকে লেখাগুলোর মানে করে দিল ইংরেজিতে।