কাউন্টারের কাছে এসে দাঁড়াল মুসা। হেডব্যান্ডটা পড়ে আছে। দ্বিধা করতে করতে হাত বাড়িয়ে তুলে নিল। জিনিসটা বাস্তব। ভূতুড়ে কিংবা স্বপ্নের মধ্যে হাতে নিয়েছে মনে হলো না। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত জিনিসটার দিকে তাকিয়ে রইল সে। তারপর পকেটে ভরল। রওনা হলো দরজার দিকে।
বাইরে যখন বেরোল, তখনও মৃদু মৃদু কাঁপছে তার শরীর। মাথার ভেতরটা পরিষ্কার হয়নি পুরোপুরি। বুক ভরে টেনে নিল রাতের ঠাণ্ডা তাজা বাতাস। দপদপ করছে মাথার পেছনটা। চিৎকার করে ডাকল রবিন আর কিশোরের নাম ধরে। কোলা ব্যাঙের স্বর বেরোল। বেশি দূর গেল না তার দুর্বল কণ্ঠ। কোন জবাবও এল না।
আবার ডাকল সে। এটুকু পরিশ্রমেই বে করে চক্কর দিয়ে উঠল মাথা। ঘোলাটে হয়ে গেল দৃষ্টি। ভুলভাল দেখতে আরম্ভ করল। অন্ধকারে বহু লোকের জ্বলন্ত চোখ দেখতে পেল। তাদের কণ্ঠস্বর, কথাবার্তা কানে আসছে যেন। মনে হচ্ছে তাকে ঘিরে রেখেছে সবাই। হাঁটাচলা করছে আশপাশ দিয়ে।
মাথা ঝাড়া দিয়ে মাথার ভেতরের মাকড়সার জালের মত ঘোলাটে ভাবটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল সে। লক্ষ করল, যে চোখগুলোকে এতক্ষণ মানুষের চোখ মনে করেছে, সেগুলো আসলে মরুভূমির নিশাচর প্রাণীর চোখ। ওদের ডাক, হাঁটাচলার শব্দকে ভেবেছে মানুষের শব্দ। খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছে অসংখ্য কাঠবিড়ালী আর ইঁদুর। হুটোপুটি করছে। আশ্চর্য! মানুষের ঘোলাটে মগজ কত অসম্ভব দৃশ্যই না দেখিয়ে ছাড়ে। বাস্তব জিনিসগুলোকে কি ভাবে অবাস্তব করে তোলে।
বেরিয়ে এসে আবার চিৎকার করে রবিন আর কিশোরের নাম ধরে ডাকল। সাড়া পেল না এবারেও। গেল কোথায় ওরা? কোথায় গিয়ে বিপদে পড়ল? না পাওয়া পর্যন্ত খুঁজতে হবে। প্রতিটি ঘরে ঢুকে দেখতে হবে। খুঁজে বের করতেই হবে ওদের।
*
রবিনও ওদিকে বাড়ির পর বাড়ি খুঁজে চলেছে। আলো ফেলে ফেলে দেখছে। নতুন কিছুই চোখে পড়ল না। ফ্লেমিং রকের সেই একই রকম স্বাভাবিক দৃশ্য।
তাই বলে খোঁজায় বিরতি দিল না। জেদ চেপে গেছে তার। এই রহস্যের কিনারা করতেই হবে।
বড় আরেকটা ঘরে ঢুকল সে। একটা সেলার দেখতে পেল এখানে। মাটির নিচের ঘর। ঢোকার দরজা একটাই, কিন্তু বড় বড় দুটো পাল্লা রয়েছে তাতে। ভেতরে ঢুকে দেখবে ঠিক করল। দরজা দুটো খুলতে বেশ কষ্ট হলো। ভারী কাঠের পাল্লা। মরচে পড়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে কজা।
উঁকি দিয়ে দেখল রবিন। নানা রকম যন্ত্রপাতি, পুরানো কাঠের টুকরো, আর কিছু ভাঙা আসবাবপত্র পড়ে আছে ঘরটাতে। ঢুকে পড়ল সে। পরক্ষণেই বরফের মত জমে গেল। পা দিয়ে বসার পর বুঝতে পারল কিসের গায়ে পা দিয়েছে।
সাপ।
সাপটাও তার মতই চমকে গেছে।
কুণ্ডলী পাকিয়ে দরজার কাছে পড়ে ছিল। অন্ধকারে বিশ্রাম নিচ্ছিল বোধহয়। টর্চের আলোয় চকচক করছে খুদে খুদে দুটো চোখ। ডায়মন্ডব্যাক র্যাটলার। ফণার পেছনে হীরার টুকরোর মত ছাপ মারা বলেই এ রকম নাম দেয়া হয়েছে। র্যাটলম্নেককে সংক্ষেপ কবে বলা হয় ব্যাটলার।
ভাগ্য ভাল, সাপের গায়ে পায়ের পুরো চাপ পড়েনি। কেবল ছোঁয়া লেগেছে। পা ফেলতে গিয়ে টের পেয়েই মাঝপথে যে ভাবে ছিল সেভাবেই রেখে দিয়েছে পাটা। চাপ লাগলে এতক্ষণে শিওর ছোবল মেরে বসত। ডায়মন্ড র্যাটলারের ছোবল খাওয়ার অর্থ নিশ্চিত মৃত্যু।
দরদর করে ঘাম ঝরতে শুরু করল কপাল বেয়ে। পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রবিন। কানে আসছে হুটোপুটির শব্দ। ঘরের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করছে অসংখ্য ইঁদুর। এ রকম একটা খুনে সাপের সঙ্গে বাস করে এখনও বেঁচে আছে কি করে ইঁদুরগুলো ভেবে অবাক লাগল তার। একটা ইঁদুর দৌড়ে এসে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল সাপটার ফুটখানেক দূরে। চকচকে চোখ মেলে এক মুহূর্তের জন্যে তাকিয়ে দেখল সাপ আর রবিনের হাতের আলো দুটোকেই। তারপর বিরাট এক লাফ দিল সরে যাওয়ার জন্যে। চোখের পলকে ছোবল মারল সাপটা। কিন্তু মিস করল। নিরাপদে ইঁদুরটা চলে গেল ঘরের কোণে।
সুযোগটা রবিনও হাতছাড়া করল না। ছোবল মারতে গিয়ে সাপের মুখটা বেশ খানিকটা দূরে সরে গিয়েছিল। রবিনের পায়ের দিকেও নজর ছিল না। ইঁদুরের মত অতটা না হলেও, বেশ বড়সড় একটা লাফ দিয়েই রবিনও পিছিয়ে চলে এল। একটা সেকেন্ডও আর দেরি করল না ওখানে। দৌড়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
*
একই ভাবে বাড়িঘরের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে শহরের জেলখানার কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। ঢুকে পড়ল ভেতরে। সামনের দিকের একটা বড় ঘরকে বানানো হয়েছে অফিস আর ওয়েইটিং কম। পেছনে আসামী রাখার দুটো ঘর। দেয়ালে দেয়ালে আলো ফেলে দেখতে লাগল কিশোর।
এক জায়গায় লেখা রয়েছে: গ্র্যাফিটি, ১৮৩০ স্টাইল।
বেশির ভাগ শব্দই ইনডিয়ান, ড্রয়িংগুলোও তাই। আপনমনেই বিষণ্ন হাসি হাসল কিশোর। লিখে অভিশাপ দেয়া হয়েছে নিশ্চয়। ড্রয়িং একে শেতাঙ্গ জবরদখলকারীদের জাদু করে তাদের শাস্তি দিতে চেয়েছে। বোঝা গেল এই জেলখানা তৈরি হয়েছে মূলত ইনডিয়ানদের তরে রাখার জন্যেই। ইতিহাসে পড়েছে, প্রচুর শয়তানি আর চালাকি কছিল ততকালীন শেতাঙ্গরা। সস্তা মদ খাইয়ে প্রথমে মাতাল করেছে ইনডিয়ানদের। মাতাল অবস্থায় তাদেরকে দিয়ে অপরাধ করিয়েছে। তারপর আসামী করে এনে ভরে রেখেছে জেলখানায়। আটকে থাকার সুযোগে দখল করে নিয়েছে ওদের বাড়িঘর, জমিজমা সব।