আবার চিত হয়ে শুয়ে পড়ে চোখ মুদল মুসা। স্পষ্ট অনুভব করছে, ঘরে অন্য কেউ আছে। তাকে যে বাড়ি মেরেছে সেই লোকটা? জ্ঞান ফিরতে দেখলে এখন কি করবে সে? আবার বাড়ি মেরে খতম করে দেবে?
আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে মুসা। কিন্তু প্রচণ্ড কৌতূহলের কাছে পরাজিত হলো ভয়। আস্তে করে একটা চোখ মেলল। বেহুশ হয়ে পড়ে যাওয়ার সময় হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল টর্চটা। মেঝেতেই পড়ে আছে ওটা এখন। তবে নেভেনি, জলেই আছে। সেই আলোর আভায় ঘরের মধ্যে যতখানি সম্ভব একটা চোখ বোলাল সে। সারি দিয়ে কিংবা স্তূপ করে রাখা হয়েছে নানা রকম পণ্য। পাতলা ধূলোর আস্তর পড়ে আছে সেগুলোতে। আরেকটু দৃষ্টি সরাতেই লোকটাকে চোখে পড়ল তার।
নানা ধরনের ক্যান্ডি সাজানো বড় একটা কাঁচের বাক্সের সামনে দাঁড়ানো লোকটা। ইনডিয়ান যোদ্ধা। কোমরের কাছে এক টুকরো কাপড় জড়ানো শুধু, এ ছাড়া সারা গা খালি গলায় রঙিন পুঁতির মালা। হাতে একটা খাটো কুড়াল, ইনডিয়ানদের ভাষায় টমাহক বলে এগুলোকে। কুড়ালটা কোপ মারার ভঙ্গিতে উদ্যত নয়। ঝুলিয়ে রেখেছে নিচু করে। এক হাত থেকে আরেক হাতে কুড়ালটা চালান করে দিল লোকটা।
মুসার মনে হলো, বাস্তব নয়, দুঃস্বপ্নের মধ্যে রয়েছে। মনে মনে গুঙিয়ে উঠল সে। খোদা! এটা স্বপ্নই হোক।
লোকটার গায়ের রঙ গাঢ় বাদামী। সুগঠিত শরীর। প্রায় চৌকোণা সুন্দর চেহারা। কপালে বাধা ইনডিয়ানদের হেডব্যান্ড, তাতে নীলকান্তমণি খচিত। বেশ রাজকীয় মনে হলো লোকটাকে। তবে ভয়ে মাথা গরম হয়ে যাওয়ার কারণে মুসা লক্ষ করল না, লোকটার ভাবভঙ্গিতে ভয় পাওয়ার মত কিছু নেই।
আলতো করে ধরে রাখা টমাহকটার দিকে তাকিয়ে একমনে প্রার্থনা করতে লাগল সে; খোদা, ওই কুড়ালটা নামিয়ে রাখুক লোকটা! পুরো ব্যাপারটাই স্বপ্ন হোক। কিংবা হোক তার গরম হয়ে ওঠা মগজের অতিকল্পনা।
এই সময় কথা বলে উঠল যোদ্ধা। খুব ভারী সুনিয়ন্ত্রিত কণ্ঠস্বর। কিন্তু তার মধ্যেও কোথায় যেন একটা গরমিল রয়েছে। কেমন ভূতুড়ে আর নাটকীয় কথাবার্তা, পবিত্র ভূমিতে অনুপ্রবেশ করেছ তোমরা! যেদিন থেকে চুরি গেছে এই ভূমি, সেদিন থেকেই অভিশাপ নেমেছে এখানে, চলবে যতদিন না এখানে ঘাস গজানো বন্ধ হবে। আমার গোত্রের বিরুদ্ধে যে নৃশংসতা প্রদর্শন করেছে বর্বর মাতাল খনিশ্রমিকেরা, তার শাস্তি তাদেরকে পেতেই হবে। ঘরবাড়ি সব তাদের থেকেও যুগ-যুগান্তর ধরে ঘরহারা হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে।
উঠে বসল মুসা। হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে লোকটার দিকে। ওকে বাস্তবও লাগছে, আবার অবাস্তবও। কোনমতে বের করে দিল যেন প্রশ্নটা, কিকিক্কি হয়েছিল ওদের?
তার প্রশ্নের জবাব দিল না ইনডিয়ান যোদ্ধা। যেন শুনতেই পায়নি। তারমত করে সেই একই স্বরে বলে গেল, তোমাকে আর তোমার দুই বন্ধুকে মাপ করে দেয়া হবে। তবে এক শর্তে। ফিরে গিয়ে এখানে যা যা দেখে গেল সব জানাতে হবে বাইরের পৃথিবীর মানুষকে। যাও, এখন চলে যাও।
কেঁপে উঠল মুসা। চলে যাও শব্দ দুটো বড়ই মধুর শোনাল তার কানে। যাওয়ার জন্যে তো সে রেডিই, বরং এ রকম একটা কথা শুনতে পাবে সেটাই আশা করেনি। তবে কিছু বলল না লোকটাকে।
হেডব্যান্ড খুলে নিয়ে সাবধানে ভাঁজ করল লোকটা। এগিয়ে গিয়ে রেখে দিল কাউন্টারের ওপর।
এটা নিয়ে যাও। তোমাকে দিলাম। তারপর হঠাৎ করেই যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল লোকটা।
বসেই আছে মুসা। একটা আঙুলও নড়াতে পারছে না যেন। কিশোর আর রবিন এখন কোথায়? এখানে এখন চলে এলে ভাল হত। আরেকটা ভাবনা মাথায় আসতেই চমকে উঠল সে। তাই তো! ওরাও যদি ওরই মত বিপদে পড়ে থাকে? কিংবা তার চেয়ে বেশি বিপদে? কে জানে, হয়তো এ মুহূর্তে তার সাহায্য ওদের ভীষণ প্রয়োজন।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। পা দুটো দেহের ভর রাখতে চাইছে না। টলমল করে উঠল। পড়ে গেল না। জখমটা মারাত্মক নয়।
মাথার পেছনে হাত দিল আবার। শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেছে রক্ত। জট বেঁধেছে চুলে। বমিটমি আসছে না। তারমানে শুধু চামড়া কেটেছে, খুলিতে তেমন চোট লাগেনি। ভাঙেনি, কিংবা ফেটেও যায়নি।
কি ভাবে লাগল আঘাতটা? টমাহক দিয়ে বাড়ি মেরেছিল ইনডিয়ান যোদ্ধা? উঁহু। তার আচরণে সেটা মনে হয়নি। তা ছাড়া ওই কুড়ালের সামান্য ছোঁয়া লাগলেও ধূলি কেটে দুই ভাগ হয়ে যেত। ভয়ঙ্কর, মারাত্মক অস্ত্র। হতে পারে, বাতাসের ধাক্কায় বন্ধ হতে গিয়ে দরজার পাল্লাই বাড়ি মেরেছে তার মাথায়।
টর্চটা তুলে নিল সে। একটা পুরানো আমলের কয়লা তোলার অনেক বড় হাতা পড়ে থাকতে দেখল। এ সব দিয়ে সে-যুগে মানুষ কয়লা নিয়ে গিয়ে ফেলত তাদের ফায়ারপ্লেস আর চুলার মধ্যে।
আলোর রশ্মি চারপাশে ঘুরিয়ে আনল সে। ডজনখানেক হাতা ঝুলতে দেখল দরজার পাশের দেয়ালে। একটা হাতা হুক থেকে খুলে পড়ে আছে।
হুঁ, আনমনেই মাথা দোলাল সে, মাথায় বাড়ি লাগার রহস্য ভেদ হলো। দরজা খোলার সময় ঠেলা লেগে কোনভাবে হুক থেকে খুলে গিয়েছিল হাতাটা, মাথায় এসে পড়েছে। ফ্রেমিং রকে রাত দুপুরে ঘুরে বেড়ানোর খেসারত। আর আমি ভাবলাম কিনা ভূতের কাণ্ড! কিশোর আর রবিনকে বলা যাবে না এ কথা। হাসাহাসি করবে ওরা। তবে ভূত যে একটা সত্যিই এসেছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই।