বেজেই চলেছে ঘন্টা।
অসম্ভব। ইমপসিবল। ফিসফিস করে বলল রবিন। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
ঘন্টার রশি ধরে টান দিচ্ছে কেউ, ঘন ঘন নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করল কিশোর। বাতাস নেই যে বাতাসে দোল খেয়ে নিজে নিজে বেজে উঠবে।
দুই সহকারীকে নিয়ে আবার গীর্জায় ঢুকল সে। দৌড়ে উঠে এল ঘন্টাঘরে, যাতে ওদের ফাঁকি দিয়ে পালাতে না পারে লোকটা। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল ঘণ্টা।
রশি ধরে টান দিল মুসা। নড়লও না ঘণ্টাটা। বহুকাল ব্যবহার না করলেই কেবল এমন করে অনড় হয়ে থাকে। মনেই হয় না এক মুহূর্ত আগেও বাজছিল ওটা।
বিমূঢ়ের মত সিঁড়ি বেয়ে নামছে আবার ওরা, দড়াম করে পেছনে বন্ধ হয়ে গেল ঘন্টাঘরের দরজা। ভীষণ ভাবে চমকে গেল ওরা।
বাবাবাবাব্বাতাসে। তাই না কিশোর? মুসা বলল।
বাতাস কোথায় দেখলে? কিশোর বলল। বাতাস তো স্তব্ধ।
গীর্জার পেছন দিকে চলে এল ওরা। দরজার গায়ে একটা তীর বিদ্ধ দেখে দ্বিতীয়বার চমকানোর পালা। ফ্লেমিং রকের মানুষগুলোকে পাইকারী ভাবে খুন করে গেছে বুনো ইনডিয়ানরা, এ ধারণার কথাটা মনে পড়তেই বরফের মত যেন জমে গেল ওরা।
তোতোত্তোমার কি মনে হয়, এটা কোনও ধরনের হুঁশিয়ারি? কিশোরকে জিজ্ঞেস করল মুসা।
কিসের হুঁশিয়ারি পাল্টা প্রশ্ন করল কিশোর। তবে মুসাকে নয়, নিজেকেই। ওর বাস্তববাদী মন কিছুতেই অলৌকিক কোন কিছু মেনে নিতে পারছে না। নিজেকেই যেন বোঝাতে লাগল, কোন ধরনের ঠগবাজির শিকার হয়েছি আমরা। সত্যি কথাটা জানা গেলে দেখা যাবে, ব্যাখ্যাটা অতি সহজ। মনে আছে, একবার এক পাগল চিত্রপরিচালকের খপ্পরে পড়েছিলাম? সিনেমার সেট সাজিয়ে আমাদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে গোপনে ছবি তুলে নিয়েছিল? এটাও সে-রকম কোন কিছু হতে পারে। সিনেমা কিংবা টিভি নাটকের সেট।
হলে তো ভালই হত, রবিন বলল। কিন্তু হোটেলের টাওয়ারে লণ্ঠন জ্বলে থাকা, গীর্জার ঘন্টা বাজানো…কি করে সম্ভব?
তার প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না কেউ।
গীর্জা থেকে বেরিয়ে এসে শহরের রাস্তা ধরে হেঁটে চলল তিন গোয়েন্দা।
এরপর কোথায় যাব? মুসার প্রশ্ন।
অবশ্যই খুঁজতে, দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। এর একটা বিহিত করতেই হবে। এত বড় একটা রহস্যের সমাধান না করেই চলে যাব?…এক কাজ করা যাক। তিনজনে মিলে একই জায়গায় খোঁজার চেয়ে ভাগাভাগি হয়ে যাই চলো। তাতে অল্প সময়ে অনেক বেশি জায়গা দেখা হয়ে যাবে।
আ-আমি বাপু পারব না। দুই হাত নেড়ে বলল মুসা। একা একা যেতে পারব না আমি।
আরে যাও যাও, কিছু হবে না, সাহস দিয়ে বলল কিশোর ভূতে খেয়ে ফেলবে না তোমাকে।
না খাক, ঘাড় তো মটকাতে পারে?
কথা না বাড়িয়ে যাও তো। কি আছে, তেমন সম্ভাবনা দেখলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু কোরো। তোমাকে উদ্ধার করতে ছুটে যাব আমরা।…মুসা, তুমি ওদিকটা দেখো। আমি ডানে যাচ্ছি। রবিন, তুমি বায়ে। আধ ঘন্টা পর ঠিক এইখানে মিলিত হব আমরা। ঠিক আছে?
কারও জবাবের অপেক্ষা না করে হাঁটতে শুরু করল কিশোর। ডান দিকে চলে গেল সে। রবিন চলল বাঁ দিকে। কিশোরের মত অতটা আত্মবিশ্বাস বা সাহস সে দেখাতে পারছে না। তবে কমও দেখাচ্ছে না। মুসা রওনা হলো সোজা।
পর পর কয়েকটা বাড়ি-ঘরে ঢুকে খুঁজে দেখল সে। ফ্লেমিং রকের স্বাভাবিক দৃশ্য। স্টোভে আগুন জ্বলছে। কোথাও খাবার রান্না হচ্ছে, কোথাও টেবিলে গরম খাবার সাজানো। ডিনারের সময় খাবার ফেলে চলে গেছে যেন বাসিন্দারা।
তারপর স্কুল হাউসটাতে এসে ঢুকল সে। এখানকার সবচেয়ে ভূতুড়ে বিল্ডিং এটা। নিখুঁত ভাবে সাজানো ছোট ছোট ডেস্কের সারি। সেগুলোতে বই খুলে পড়ে আছে। কালির দোয়াতের মুখ খোলা। পাশে কালিতে ভিজানো পালকের কলম। বাতাসে ফড়ফড় করছে খোলা বইয়ের পাতা।
ব্ল্যাকবোর্ডের নিচে রাখা চক আর মোছার ন্যাকড়া। টীচারের শেষ মেসেজ লেখা রয়েছে বোর্ডে: মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর। তার নিচে আজকের করণীয় শব্দ দুটোর নিচে লেখাপড়ার যে সব ফিরিস্তি রয়েছে, তার মধ্যে ভূত শব্দটা দেখা গেল। খুবই যুক্তিসঙ্গত মনে হলো মুসার কাছে। এখানকার কাণ্ড-কারখানার সঙ্গে ভূতের মিলই সবচেয়ে বেশি। যা সব ঘটছে, কেবল ভূতুড়ে বললেই এ সবের সঠিক ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
স্কুল থেকে বেরিয়ে এল সে। আরও কয়েকটা বাড়িঘরের পাশ কাটিয়ে এল। ভেতরে ঢোকার প্রয়োজন মনে করল না। বোঝা যাচ্ছে, কেউ নেই ওগুলোতে। ঢুকলে সেই একই রকম দৃশ্য দেখতে পাবে, সেটাও জানা। একটা বড় বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল সে। জেনারেল স্টোর বলে মনে হলো বাড়িটাকে। ঢুকবে কি ঢুকবে না ভাবতে ভাবতে ঢোকার সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলল। মনে হলো এর মধ্যে ফ্লেমিং রক রহস্য সমাধানের কোন সূত্র পাওয়া যেতে পারে।
দরজায় ঠেলা দিল সে। কাঁচকোচ করে উঠল কজা। মন বলছে, ঢুকো না, ঢেকো না, পালাও। কিন্তু পালাল না সে। বরং দরজা খুলে ভেতরে পা রাখল। প্রচণ্ড বাড়ি লাগল মাথায়। চোখের সামনে আঁধার হয়ে এল দুনিয়া।
জ্ঞান ফিরল এক সময়। মাথার পেছনে ব্যথা। কতক্ষণ বেহুঁশ হয়ে ছিল বুঝতে পারল না। উঠে বসে কপালে হাত বোলাল। হঠাৎ করেই মনে হলো তার, ঘরে একা নয় সে।
ধড়াস ধড়াস করতে লাগল বুকের মধ্যে। পাগল হয়ে গেল যেন হৃৎপিণ্ডটা। মাথার পেছনে হাত চলে গেল নিজের অজান্তে। ফুলে উঠেছে জায়গাটা। আঠা আঠা কি যেন লাগল হাতে। রক্ত, কোন সন্দেহ নেই।