কেমন আর লাগবে? ফাঙ্গাস পড়া কঙ্কাল। গলা কেঁপে উঠল মুসার। কিশোর, আমার ভাল্লাগছে না যেতে। চলো ফিরে যাই।
এতখানি এসে আর পিছিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে না, জবাব দিল কিশোর। রবিনের দিকে ফিরল। রবিন, কি বলো?
কেমন যেন ভয় ভয় করছে আমার এখন, নিচু স্বরে জবাব দিল রবিন। কিন্তু এতদূর এসে ফিরে যাব? রহস্যটার একটা কিনারা করে যাওয়াই উচিত। চলো, অন্তত ঝুলন্ত আলোটা কিসের দেখে যাওয়া যাক।
বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে। বাতাসের বেগও কম। গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট থেকে টর্চ বের করে নিয়ে নেমে পড়ল তিনজনে। এগিয়ে চলল। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে খুব শীঘ্রি একটা বিল্ডিঙের অবয়ব চোখে পড়ল ওদের।
ওই যে, ঠিকই আছে, চারপাশে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে কিশোর বল। শহরটাই এটা। ফ্লেমিংরক।
আর ওইটা বোধহয় এই হোটেলের টাওয়ার, টর্চের আলো ফেলে দেখাল রবিন। দেখো, আলোটা এখনও ঠিক আগের মতই দুলছে। নাড়াচ্ছে না তো কেউ?
সেটা জানতে হলে ওখানে উঠতে হবে, কিশোর বলল।
ও-ওখানে উঠবে! সাহস পাচ্ছে না মুসা।
হ্যাঁ, নাহলে দেখব কি করে? মুখে বললেও মনে মনে ভয় যে একেবারে পাচ্ছে না কিশোর, তা নয়।
হোটেলের বারান্দায় উঠল তিন গোয়েন্দা। লবিতে ঢুকল। কি আছে দেখার জন্যে না থেমে সোজা উঠে এল দোতলায়। সেখান থেকে ছাতে।
কাউকে দেখা গেল না সেখানে। লণ্ঠনটা যদি কেউ নাড়িয়েও থাকে, নেই এখন। চলে গেছে। লণ্ঠনটা আছে। কিন্তু আলো নেই। নিবে গেছে।
কাঁচটা ছুঁয়ে দেখল কিশোর। এখনও গরম।
মেরু বেয়ে ঠাণ্ডা শিহরণ বয়ে গেল তিনজনেরই।
ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল মুসা, দেখা তো হলো। এখন কি?
লণ্ঠন দুলিয়েছে যে লোকটা, তাকে খুঁজে বের করব, কিশোর বলল। চলো, নিচে চলো। আশেপাশেই কোথাও আছে সে।
সিঁড়ি বেয়ে আবার নেমে এল ওরা। সমস্ত হোটেলে খুঁজতে শুরু করল। ডাক দিল কিশোর, এই যে ভাই শুনছেন? কেউ আছেন?
জবাব পেল না।
একটা জিনিস লক্ষ করল, স্বর্ণসন্ধানী যা যা বলেছিল সব ঠিক। একটা বর্ণও বাড়িয়ে বলেনি। জিনিসপত্র যেখানে যা থাকার সব আছে। কাপড় ঝুলছে আলনা থেকে। বিছানায় পরিষ্কার চাদর পাতা। রান্নাঘরে জ্বলন্ত স্টোভের ওপরে খাবার রান্না হচ্ছে।
পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল ওরা। চোখে অবিশ্বাস। কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। লবি ধরে যাওয়ার সময় অ্যাশট্রেতে একটা জলন্ত সিগারেটের টুকরো দেখতে পেল।
হঠাৎ কানে এল বিচিত্র শব্দ।
যান্ত্রিক হাঁস প্যাক-প্যাক করছে।
দেখতে পেল ওটাকে। ডাকতে ডাকতে পর্দার নিচ থেকে বেরিয়ে আসছে একটা খেলনা হাঁস। মেঝে ধরে হাস্যকর ভঙ্গিতে হেলেদুলে এগিয়ে এসে মুসার জুতোয় ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল ওদের পায়ের কাছে।
নিচু হয়ে খেলনাটা তুলে নিল কিশোর। কিন্তু আর চালু করতে পারল না। দম দেয়ার চাবিটা নেই। আস্তে করে আবার মেঝেতে রেখে দিল হাসটা। হাত কাঁপছে।
কিশোর, মানুষজন আছে এখানে, কম্পিত কণ্ঠে বলল মুসা। জ্যান্ত মানুষ। যারা দম নেয়, কথা বলে, খায়দায়। কিন্তু কোথায় ওরা?
অসহায় ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল কিশোর। জানি না। তবে খোঁজা বন্ধ করা যাবে না।
খুঁজতে থাকল ওরা। পেছনের দরজা দিয়ে এসে হোটেলের রান্নাঘরে ঢুকল। কাদামাখা পায়ের ছাপ দেখতে পেল মেঝেতে। বাইরে থেকে লবিতে ঢোকার পর ওদের যেমন ছাপ পড়েছিল এ ছাপগুলোও তেমনি।
বিগফুটের পায়ের ছাপ, রসিকতার চেষ্টা করল রবিন। পাহাড়ী অঞ্চলেই তো থাকে ওরা।
হাসল না অন্য দুজন।
বিগফুটেরা বুনো, কিশোর বলল। ওরা জুতো পরে না। তা ছাড়া বিগফুট নামেও যেমন বিগ, বাস্তবেও তেমন বড়। ওরা জুতো পরলে ছাপগুলো অনেক বড় হত।এগুলো স্বাভাবিক মানুষের পায়ের ছাপের সমান।
পুরো হোটেলটা তন্নতন্ন করে খুঁজল ওরা। সবখানেই মানুষ বসবাসের তাজা চিহ্ন দেখতে পেল, কিন্তু কোন মানুষ চোখে পড়ল না।
অবশেষে আবার বেরিয়ে এল বাইরের অন্ধকারে।
চারপাশে টর্চের আলো ফেলে দেখতে লাগল কিশোর। কিছু কিছু বাড়ির সামনে কেরোসিনের বাতি আছে, দেখো। চলো, জ্বালাই। রাতের বেলা তো আর কোথাও যাওয়া সম্ভব হবে না। বরং আলো জ্বেলে এই মৃত শহরটারই কোথায় কি আছে দেখি।
তাই করি, আর কোন উপায় নেই যখন, রবিন বলল।
মুসা কিছু বলল না। তবে কিশোর আর রবিন যখন এগোল, সে-ও চলল ওদের সঙ্গে সঙ্গে।
হ্যারিকেন জ্বালানো মোটেও কঠিন হলো না। ঝেড়ে-মুছে ঝকঝকে করে তেল ভর্তি করে রেখে দেয়া হয়েছে।
বৃষ্টি থেমে গেছে। কেমন বিষণ্ণ একটা অসুস্থ চাঁদ উঁকি দিল মেঘের ফাঁকে। কিন্তু অস্থির মরুর আবহাওয়া বিদ্যুতের চমক দেখিয়ে, বজ্রের গর্জন তুলে আবারও বৃষ্টির হুমকি দিয়ে চলেছে ওদের। যেন বলতে চাইছে, এত খুশি হওয়ার কিছু নেই। এখনও কাজ শেষ হয়নি আমাদের।
গীর্জাটার দিকে এগোল গোয়েন্দারা। হোটেল থেকে মাত্র দুটো বাড়ি পরেই। খুব সাধারণ একটা আয়তাকার বাড়ি। ওপরে ঘূণ্টাঘরের মাথায় দুটো খুঁটি বানিয়ে তাতে ঘণ্টা ঝুলানোর ব্যবস্থা করেছে শহরের স্থানীয় ছুতোর।
ওরা গীর্জায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ঘণ্টা বাজতে আরম্ভ করল। বৃষ্টিভেজা রাতের বাতাসে কাঁপা কাঁপা ভূতুড়ে শব্দ ছড়িয়ে দিতে থাকল।
আতঙ্কিত হয়ে হুড়মুড় করে গীর্জা থেকে বেরিয়ে এল তিনজনেই। চোখ তুলে ওপরের ঘন্টাটার দিকে তাকাল।