আপনি আমাকে ইচ্ছে করে ফেলে দিচ্ছিলেন। কঠোর কণ্ঠে বলে উঠল কিশোর।
খিকখিক করে হাসল ল্যাম্বার্ট। আমি ফেলব? আড়কাঠে বি ভাবে কাজ করতে হয় জানো না তুমি। তাই পড়ে গেছ।
জানি কি জানি না দেখাচ্ছি আপনাকে, ওকে চ্যালে করে বসল কিশোর। আপনার আগেই পাল খাটাব আমি।
কিছুদিন আগে কোস্ট গার্ড ট্রেনিং শিপে তার দুই সহকারী কাজ করে এসেছে কিশোর। জানে কি ভাবে পাল খাটাতে হয়। বাতাসে উড়তে থাকা পালের অংশটা থাবা দিয়ে ধরে ফেলল ও। ওটার ধাতব ফুটোয় চামড়ার ফালি ঢুকিয়ে দিল। ফালিটা গোল করে আড়কাঠের হুকের মধ্যে ঢোকাল। তারপর গিট দিয়ে দিল শক্ত করে, নাবিকরা যে ভাবে দেয়। ব্যস, হয়ে গেল পাল খাটানো।
কাজ শেষ করে মইয়ের কাছে চলে এল কিশোর। ল্যাম্বার্টের তখন শোচনীয় অবস্থা। কিশোর যখন মই বেয়ে ডেকে নেমে এসেছে, তখনও পাল নিয়ে যুদ্ধ করছে ল্যাম্বার্ট।
চমৎকার দেখিয়েছ, কিশোর পাশা, পুকার বলল। সে সবই দেখেছে। ল্যাম্বার্ট ভুল করেছে। ওর তুলনায় তুমি অনেক বেশি দক্ষ। এক নম্বরের তিমি শিকারী হতে পারবে তুমি।
মুচকি হাসল কিশোর। মুসা আর রবিনের কাছে সরে এসে ফিসফিস করে বলল, প্ল্যানটা কাজে লাগছে। অন্তত ফার্স্ট মেটের মন গলাতে পেরেছি। আশা করি আমাদের পক্ষ নিয়ে এখন ক্যাপ্টেনের কাছে কথা বলতে দ্বিধা করবে না। বলবে আমাদের সাগরে ছুঁড়ে ফেলা উচিত হবে না। কারণ আমরা কাজের লোক।
আমারও তাই ধারণা, নিচু গলায় বলল রবিন। তবে বিপদ নিশ্চয় কাটেনি এখনও আমাদের…
ক্যাপ্টেনের চিৎকারে থেমে গেল সে।
এই, এদিকে এসো, হাত নেড়ে ডাকল ক্যাপ্টেন।
তাড়াহুড়া করে তার কাছে চলে এল রবিন।
যাও, ক্রোজ নেস্টে গিয়ে বসো, হুকুম দিল ক্যাপ্টেন। তাহিতির কাছাকাছি এসে পড়েছি মনে হচ্ছে। ডাঙা কত দূরে জানা দরকার। আন্দাজে চলতে গিয়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেতে চাই না। তীক্ষ্ণ নজর রাখবে। প্রবাল প্রাচীরে ধাক্কা খেয়ে ডুবে মরতে চাই না।
নাবিকদের ভঙ্গিতে আই, আই, স্যার, বলে মূল মাস্তুলের দিকে ছুটল রবিন। মই বেয়ে উঠতে লাগল। আড়কাঠ আর মাস্তুলের সবচেয়ে ওপরের পাল পার হয়ে এল। মাস্তুলের মাথায় ঝোলানো একটা ঝুড়িতে উঠে বসল। এটাকেই বলে ক্রোজ নেস্ট। এখান থেকে সাগরের চতুর্দিকে নজর রাখা হয়। সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত চোখে পড়ে।
তবে রাতের বেলা অন্ধকারে খুব বেশিদূর দৃষ্টি চলে না। ঝুড়িতে বসে চোখ টানটান করে রাখল সে। আবছা অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করছে। জাহাজের দুলুনির, সঙ্গে সঙ্গে ঝুড়িটাও দুলছে। জাহাজ যখন কাত হচ্ছে, মাস্তুল কাত হচ্ছে, দুলতে দুলতে প্রায় পানির ওপর চলে আসছে তখন ঝুড়ি। জাহাজ সোজা হলেই আবার অনেক ওপরে উঠে যাচ্ছে। ভীষণ বেকায়দা এক অবস্থা। অনেক সময় কোনও নাবিককে শাস্তি দেবার জন্যেও অতিরিক্ত সময় এই ঝুড়িতে বসিয়ে রাখা হয়।
ঝুড়ির বেকায়দা আসন, সেই সঙ্গে নোনা পানি মেশানো ঝোড়ো বাতাসের প্রচণ্ড ঝাপটা। অস্থির লাগছে রবিনের। চোখ কড়কড় করছে।
আহোয়, নিচ থেকে ভেসে এল ক্যাপ্টেনের নাবিক-সুলভ হাঁক। কিছু দেখছ?
পানি ছাড়া আর কিছু তো দেখছি না, জবাব দিল রবিন। অন্ধকারে বেশি দূর নজরও যায় না।
তাহিতির দেখা অবশ্যই মিলবে, চেঁচিয়ে বলল ক্যাপ্টেন। অন্ধকার হলেও। দেখার সঙ্গে সঙ্গে জানাবে আমাকে।
পাহারা দিতে লাগল রবিন। হঠাৎ রাতের আবছা পর্দা ভেদ করে কালো একটা কাঠামো ফুটে উঠতে শুরু করল। মনে হলো পানিতে ভেসে রয়েছে জিনিসটা।
নিশ্চয়ই ডাঙায় উত্তেজিত হয়ে উঠল রবিন। আহোয়। নিচে কেউ আছেন! ডেকের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল সে। ডাঙা দেখা যাচ্ছে। ডানে! ডানে!…জাহাজ ঘোরান!
ডেক থেকে ওর কথার প্রতিধ্বনি করল কিশোর, ডাঙা ডাঙা! জাহাজ ঘোরাতে বলছে।
সঙ্গে সঙ্গে আদেশ শোনা গেল ক্যাপ্টেনের। হুইল ধরেছে যে, তাকে বলছে জাহাজ ঘোরাতে।
ডানে ঘুরে গেল জাহাজ। ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটতে লাগল।
ঠিক সামনেই ডাঙা! চিৎকার করে জানাল রবিন। বায়ে ঘোরান এখন।
ওর কথারই পুনরাবৃত্তি করল ডেকে দাঁড়ানো কিশোর।
যে লোকটা হুইল ধরেছে, তাকে কি যেন বলতে শোনা গেল। ওপর থেকে রবিনের মনে হলো একা কুলাতে পারছি না এ রকম কিছু বলল লোকটা।
আদেশ দিল ক্যাপ্টেন, মুসা আমান, তুমি যাও, ওকে সাহায্য করোগে।
আই আই, স্যার, বলে এক মুহূর্ত দেরি না করে দৌড় দিল মুসা।
ক্যাপ্টেন বলল, নাক বরাবর সোজা চলে। ডাঙার দিকে। পাল টানটান করো। গতি বাড়াও।
এ-কি পাগলামি! শুনে গা হিম হয়ে গেল কিশোরের। ক্যাপ্টেন কি আত্মহত্যা করতে চাইছে নাকি? জাহাজসুদ্ধ সবাইকে ডুবিয়ে মারতে চাইছে।
প্রচণ্ড বেগে ছুটতে শুরু করল জাহাজ। কালচে কাঠামোটা ভীতিকর গতিতে কাছে চলে আসছে। আরও কাছে যেতে বোঝা গেল, তাহিতির ভূখও নয় ওটা। সাগরের মাঝখানে প্রবালের দ্বীপ।
ভয়ানক গতিতে প্রবাল প্রাচীরে এসে ধাক্কা মারল জাহাজ। বিকট শব্দে ভেঙে পড়ল মূল মাল আছড়ে পড়ল দড়ি-দড়ার জঙ্গলের ওপর। ক্রোজ নেস্ট থেকে ছিটকে পড়ল রবিন। দড়ি আঁকড়ে ধরে পতন ঠেকাল কোনমতে। তবে পুরোপুরি বাঁচতে পারল না। দড়াম করে এসে পড়ল ডেকে, কিশোরের পাশে।
রবিন! রবিন! উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল কিশোর।