চলে গেল বাফার।
জেলখানায় ফিরে এল আবার তিন গোয়েন্দা। দরজাটা লাগিয়ে দিল কিশোর। দরজা বন্ধ হতে তালাটাও আপনা-আপনি লেগে গেল।
দরজাটাও দেখছি ভূতুড়ে! বিড়বিড় করল কিশোর।
যে যার বাঙ্কে শুয়ে পড়ল ওরা। ভাবছে একের পর এক ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনাগুলো নিয়ে। বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছে।
রবিন কথা বলল প্রথম। নাবিকটা প্রেতাত্মা জাতীয় কিছু হতে পারে।
শিউড়ে উঠল মুসা। ভূতুড়ে জাহাজে প্রেতাত্মা! ভয়ঙ্কর ব্যাপার।
বলা নেই কওয়া নেই, কড়াৎ করে বাজ পড়ল কোথাও। জাহাজটা দুলতে শুরু করল ভীষণ ভাবে। ডেক থেকে ভেসে এল চিৎকার-চেঁচামেচি।
পুকার নেমে এল নিচে। চেঁচিয়ে বলল, ঝড় শুরু হয়েছে। ডেকে চলে এসো সবাই। জেলখানার দরজা খুলে দিল সে। যাও, ডেকে যাও, জলদি। সবাইকেই দরকার।
দৌড়ে চলে গেল পুকার।
ঘুমানোর ঘরে ছুটে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। যার যার বাঙ্কের কাছে রাখা বর্ষাতি, মাথায় সাউথ ওয়েস্টার আর পায়ে রাবার বুট গলিয়ে উঠে এল ওপরে।
আলকাতরার মত কালো আকাশ। মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই সাথে চলছে গুড়ুম গুডুম বজ্রপাত। প্রবল বাতাসে বিশাল ঢেউ উঠছে সাগরে। ঢেউয়ের আঘাতে থরথর করে কাঁপছে জাহাজ। ঢেউ ভেঙে পড়ছে গলুইয়ের ওপর দিয়ে। ভাসিয়ে দিচ্ছে ডেক।
মুখের সামনে দুই হাত জড় করে ধরে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে ক্যাপ্টেন নাইল। হুকুমের পর হুকুম দিয়ে চলেছে নাবিকদের। ঝটপট পাল গুটিয়ে ফেলল কয়েকজন নাবিক। আর কয়েকজন নিচে নামার গর্তের মুখের ঢাকনা আটকে দিল পেরেক ঠকে, যাতে ভেতরে পানি ঢুকতে না পারে। অনেকেই বাতাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে রেলিং ধরে ধরে জাহাজের সামনের দিক থেকে পেছনে যাবার চেষ্টা করছে।
পুকার এসে জানাল, জাহাজের খোলে ফুটো হয়ে গেছে।
এই ছেলেগুলোকে নিয়ে যাও, তিন গোয়েন্দাকে দেখিয়ে বলল ক্যাপ্টেন। ফুটো মেরামত করুক।
ফার্স্ট মেটের সঙ্গে দেখতে গেল ওরা। দেখল খোলের একটা তক্তা ভেঙে গেছে। পানি ঢুকছে হুড়মুড় করে। মেঝের কয়েক ইঞ্চি ইতিমধ্যেই ডুবে গেছে পানিতে।
কিশোর পাশা, লকার থেকে পাম্পটা নিয়ে এসো, হুকুম করল পুকার। কোনার ওই ব্যারেলে পাম্প করে পানি ফেলো তুমি আর রবিন। মুসা আমান, আমার সঙ্গে এসো। ফুটো মেরামত করতে হবে।
যন্ত্রপাতি রাখার একটা বাক্স নিয়ে এসে ফুটোর কাছে ফেলল পুকার। এক টুকরো তক্তা নিয়ে ফুটোর ওপর চেপে ধরল। বাক্স থেকে হাতুড়ি বের করে পেরেক ঠকে তক্তাটা আটকে দিতে শুরু করল মুসা; দু হাতে দ্রুত কাজ করছে সে। একেক বাড়িতে একেকটা করে পেরেক বসিয়ে দিচ্ছে তক্তায়।
দেখতে দেখতে ফুটোটা বন্ধ করে ফেলল দুজনে মিলে। খোলে পানি ঢোকা বন্ধ হলো।
গুড! মুসার প্রশংসা না করে পারল না পুকার।
ওদিকে খোলের লকার থেকে পাম্প নিয়ে এসেছে কিশোর। ছোট, হস্ত চালিত যন্ত্র। অনেক পুরানো মডেল। টিউবওয়েলের হাতলের মত হাতল। সেটাকে ওপরে-নিচে করে পাম্প করতে হয়। এ জিনিস এর আগেও দেখেছে সে, তবে রকি বীচ মিউজিয়ামে। পাম্পের সঙ্গে হোস পাইপ যুক্ত করে পানি সেচতে শুরু করল সে। সেচা পানি ফেলতে লাগল খালি ব্যারেলে।
অল্পক্ষণের মধ্যে ভরে গেল একটা ব্যারেল। দ্বিতীয় আরেকটা ব্যারেলে পাইপের মুখ ঢোকাল কিলোর। ওকে সাহায্য করছে রবিন। এই ব্যারেলটাও কানায় কানায় ভরে গেল। মেঝের পানিও শেষ।
ভালই তো দেখালে, পুকার বলল। ঠিক আছে, যাও এবার। ওপরে যাও। ওখানে যারা আছে তাদের সঙ্গে হাত লাগাওগে।
ডেকে উঠে এল তিন গোয়ে দা। লক্ষ করল ঝড়ের বেগ কমে গেছে অনেক। থেমে গেছে বৃষ্টি, বাতাসের তীব্রতা কমছে। ঢেউয়ের মাতামাতিটাও আর আগের মত নেই।
বড় বাঁচা বেঁচে গেছি, নাবিকদের বলল ক্যাপ্টেন নাইল। তবে ক্ষতিটা কম করেনি। জাহাজের যে সব জায়গায় ক্ষতি হয়েছে, মেরামত করে ফেলে।
বৃষ্টি নেই। অকারণে ভারী বর্ষাতি আর গায়ে চাপিয়ে রাখার কোন মানে হয় না। খুলে রেখে এল তিন গোয়েন্দা। দেখল, ঝড়ে জাহাজের ক্ষতি হওয়া জায়গাগুলো মেরামত করে ফেলেছে নাবিকেরা। মূল মাস্তুলের পালের একটা দড়ি ছুটে গেছে। ওপরে উঠে সেটা লাগানোর চেষ্টা করছে একজন নাবিক।
কিশোরের দিকে তাকাল ক্যাপ্টেন নাইল। কিশোর পাশা, আড়কাঠের উল্টো দিকে উঠে যাও তো। ওকে সাহায্য করো।
মাস্তুলের সাথে লাগানো সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল কিশোর। আড়কাঠে চড়ে বসল। লোকটাকে চিনতে পারল এতক্ষণে। ল্যাম্বার্ট।
ঠিকঠাক মত কাজ করবে বলে দিলাম, অবজ্ঞার ভঙ্গিতে কিশোরকে বলল ল্যাম্বার্ট। পালের দড়িটা ধরো। গিট দাও…ওই যে ওই জায়গাটায়।
জবাব দিল না কিশোর। ওর দিকের পালের প্রান্তটা পতপত করে উড়ছে বাতাসে। ওটাকে ধরতে হলে তাকে আড়কাঠের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে হাত লম্বা করে দিতে হবে। মাত্র কাপড়টা ধরেছে ও, এমন সময় পাল ধরে হ্যাঁচকা টান মারল ল্যাম্বার্ট।
ভারসাম্য হারাল কিশোর। আড়কাঠ থেকে পড়ে যাওয়ার জোগাড় হলো তার। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল মুসা ও রবিন। ডেকের ওপর ছিটকে পড়তে যাচ্ছে কিশোর।
তবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ওরা, যখন দেখল শেষ মুহর্তে আড়কাঠটা ধরে ফেলেছে কিশোর। জাহাজের দুলুনির তালে তালে মালটাও দুলছে। কিশোরও ঝুলে থেকে দুলতে লাগল। তারপর শরীরের সমস্ত শক্তি জড় করে প্রাণপণ চেষ্টায় একটা পা রাখল আড়কাঠে। উঠে এল ওটার ওপর।