মাথা চুলকাল মুসা। তা তো বুঝলাম। কিন্তু আবার নিজেদের সময়ে ফিরে যাব কি করে?
চালাকি করতে হবে আরকি আমাদের, রবিন বলল। ক্যাপ্টেন নাইল আমাদেরকে এখান থেকে বের করলে এমন ভান করব যেন আমরা খুব ভাল নাবিক। জাহাজের নানা কাজে লাগছি দেখলে হয়তো তার মন বদলাতেও পারে। তখন নিশ্চয় আর আমাদের সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলার চিন্তা করবে না।
বুদ্ধিটা মন্দ না, হাতঘড়িতে নজর বোলাল কিশোর। আমরা জাহাজে উঠেছি মাত্র কয়েক ঘণ্টা। এর মধ্যে এত কিছু ঘটল কি করে?
জবাবে মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ গা-টা কেন যেন শিরশির করে উঠল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। নাবিকের পোশাক পরা এক লোককে ওদের জেলখানার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেল। মুসার দৃষ্টি অনুসরণ করে একই দিকে তাকাল কিশোরও।
লোকটা নীরবে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। ভূতুড়ে একটা আকৃতি। মুখটা অস্বাভাবিক সাদা। সরু, সাদা সাদা লম্বা আঙুল দিয়ে চেপে ধরেছে জেলের গরাদ। চেহারায় কোন ভাবান্তর নেই। নীল চোখ জোড়া স্থির।
লোকটা এখানে এল কি করে? জড়ানো গলায় বলল মুসা। সিঁড়িতে ওর পায়ের শব্দ পাইনি।
উঠে বসল কিশোর। আমিও না।
রবিন বলল, লোকটাকে এ জাহাজের কেউ মনে হচ্ছে না।
তার পেছন পেছন যাওয়ার জন্যে হঠাৎ ইশারা করল ওদেরকে রহস্যময় আগন্তুক।
কে আপনি? প্রশ্ন করল কিশোর। আপনার সঙ্গে আমাদের যেতে বলছেন কেন?
বেরোতে যে বলছেন, বেরোব কি করে? ইঙ্গিতে বন্ধ দরজাটা দেখাল মুসা। ফাস্ট মেট দরজায় তালা মেরে রেখে গেছে। চাবি আছে নাকি আপনার কাছে?
ওদেরকে তাজ্জব করে দিয়ে তালায় হাত রাখল লোকটা। খুলে গেল তালা। টান দিয়ে দরজাটা খুলে ফেলল সে। কোঁচকানো চামড়াওয়ালা আঙুল দিয়ে আবার বেরোনোর ইশারা করল লোকটা।
খাইছে! চাবি ছাড়াই তালা খুলে ফেলল! মুখ হাঁ হয়ে গেছে মুসার।
দেখাই যাক না ওর সঙ্গে গিয়ে, কিশোর বলল। মুক্তির পথ দেখিয়েও দিতে পারে। কিংবা নতুন কোনও বিপদের পথ। অতএব সাবধান।
সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল তার দুই সহকারী।
জেল থেকে বেরিয়ে এল তিনজনে।
নিঃশব্দে আবার দরজা লাগিয়ে দিল ওদের ভৌতিক পথ প্রদর্শক। তালাটা তুলে লাগিয়ে দিল জায়গামত। তারপর হেঁটে গেল সিঁড়ির ধারে। উঠতে শুরু করল। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় কোন শব্দ হলো না।
অস্বাভাবিক নীরবতায় গা ছমছম করতে লাগল তিন গোয়েন্দার। মুসার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। তলপেট শিরশির করছে রবিনের। কিশোরের শিরদাঁড়া বেয়ে যেন বরফের পানি নামছে।
সিঁড়ির শেষ ধাপ টপকে লোকটা উঠে গেল ডেকে। এগিয়ে গেল জাহাজের সামনের দিকে।
তিন গোয়েন্দাও উঠল। দাঁড়িয়ে পড়ল সিঁড়ির দোরগোড়ায়। উঁকি মেরে দেখল কাছে-পিঠে কেউ আছে কিনা। অন্ধকারে শুধু টিমটিম করে লণ্ঠন জ্বলছে। খালি ডেক।
নিঃশব্দে ঘুরে দাঁড়াল রহস্যময় আগন্তুক। আবার ইশারা করল তিন গোয়েন্দাকে। অনুগতের মত লোকটার পেছন পেছন ডেক ধরে এগোল ওরা। বড় বড় ঢেউ ধাক্কা মারছে জাহাজের গায়ে। জাহাজের কিনার ঢেউয়ের দোলায় উঠছে আর নামছে। নিচে তাকাল ওরা। ঢেউগুলো মাথায় সাদা ফেনা নিয়ে যেন টগবগ করে ফুটছে। দূরের তারাশূন্য অন্ধকার আকাশ থেকে ভেসে এল নাম না জানা নিশাচর পাখির তীক্ষ্ণ চিৎকার।
থেমে দাঁড়াল ভূতুড়ে লোকটা। স্থির দৃষ্টিতে তাকাল তিন গোয়েন্দার দিকে। পলকহীন চাহনি।
এরপর কি করবে নোকটা ভাবল কিশোর। ধাক্কা মেরে ফেলে দেবে না তে!
আঙুল তুলে জাহাজের পেছন দিকটা দেখাল আগন্তুক। ওদিকটা অন্ধকার। চোখ কুচকে ওদিকে তাকিয়ে রইল তিন গোয়েন্দা। অস্পষ্ট ভাবে আরেকটা জাহাজ দেখা গেল। ওদের জাহাজটার পেছন পেছন আসছে।
রহস্যময় আগন্তুক সাগরের দিকে ইশারা করল। তারপর জাহাজটা দেখাল।
লোকটা কি বলতে চাইছে বুঝে ফেলল মুসা। ও বলছে আমরা যেন সাঁতার কেটে ওই জাহাজে উঠে পড়ি। জাহাজটা কাছেই আছে। চলো, সাগরে নেমে পড়ি। রেলিং বেয়ে উঠে পড়ল সে, ডাইভ দেবে পানিতে।
ওর হাত ধরে ফেলল কিশোর। দাঁড়াও। দাঁড়াও। লোকটা সত্যি এটাই বোঝাতে চেয়েছে কিনা সে-ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিই আগে।
লোকটার দিকে ঘুরল ওরা। কিন্তু অদৃশ্য হয়ে গেছে আগন্তক! বোকা বনে গেল ওরা। আবার ঘুরে তাকাল পেছন দিকে। অন্য জাহাজটাকেও দেখা যাচ্ছে না আর।
ভীষণ অবাক হয়ে গেল ওরা।
দেখার জন্যে রেলিঙে উঠেছিল মুসা, নেমে এল সেখান থেকে।
সত্যি কি এ সব আমাদের চোখের সামনে ঘটছে? জিজ্ঞেস করল সে। নাকি দৃষ্টি বিভ্রমের শিকার হচ্ছি?
জানি না, জবাব দিল কিশোর।
এমন সময় পেছন থেকে কে যেন কথা বলে উঠল, বড় বেশি ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছ তোমরা।
পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।
বাফারকে দেখতে পেল! চেহারায় উদ্বেগ। আমি হুইল হাউজের ডিউটিতে ছিলাম, জানাল সে। তাই তোমাদের দেখে ফেলেছি। জেলখানা থেকে কিভাবে বেরিয়ে এলে বুঝতে পারছি না। ধরা পড়লে কপালে কিন্তু সত্যি খারাবি আছে তোমাদের।
বোকা বোকা গলায় জানতে চাইল মুসা, নাবিক লোকটা কোথায় গেল দেখেছ?
নাবিক? তোমাদের দুজনকে ছাড়া ডেকে তো আর কাউকে চোখে পড়েনি আমার।
আর যে জাহাজটা আমাদের পিছু নিয়ে আসছিল ওটা? প্রশ্ন করল কিশোর।
এমন ভাবে ওদের দিকে তাকাল বাফার, যেন ওরা পাগল হয়ে গেছে। এদিকে জাহাজ! তোমাদের উল্টোপাল্টা কথাবার্তা শুনে এখন আমারই পাগল হওয়ার জোগাড় হয়েছে।…•াও, নিচে গিয়ে বিশ্রাম নাও। যে কোন সময় ডিউটি দিতে চলে আসতে পারে পুকার। তার চোখে পড়ে গেলে ভীষণ বিপদ হবে।