হঠাৎ সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। লাফিয়ে সিধে হয়ে বসল ওরা।
পায়ের আওয়াজ ক্রমে কাছিয়ে আসছে। একটু পরেই লোকটাকে দেখা গেল। ল্যাম্বার্ট। ডান হাতে একটা হারপূন। ঘরের মাঝখানে চলে এল তিন গোয়েন্দা। লোকটা কোন মতলবে এসেছে দেখতে চায়।
তোমাদের দোষেই আজ তিমিটাকে হারাতে হলো, নাক সিটকাল ল্যাম্বার্ট। কিভাবে নৌকা বাইতে হয়, কিভাবে হারপূন দিয়ে মাছ শিকার করতে হয়, কিছু জানো না তোমরা। আমি থাকলেই হয়েছিল আজ। তিমির বাপও আমার হাত থেকে বাঁচতে পারেনি কোনদিন।
মুচকি হাসল কিশোর। আপনার বদলে হারনার হিসেবে আমাকে পাঠানোটা আসলে সহ্য হচ্ছে না আপনার।
শুনে মুখ লাল হয়ে গেল ল্যাম্বার্টের। হারপূন ছুঁড়ে মারল দুই গরাদের ফাঁক দিয়ে।
ব্যাপারটা আগেই আঁচ করতে পেরেছিল মুসা। চট করে টেবিলটা দুহাতে তুলে ধরল, ঢালের মত করে। টেবিলে লাগল হারপূন। এত জোরে আঘাত হানল, কাঠ ফুটো করে ফেলল ধারাল ফলা। কয়েক ইঞ্চির জন্যে মুসার গায়ে বিধল না।
টেবিলটা নামিয়ে রাখল সে। হাতের চেটো দিয়ে মুখের ঘাম মুছল। একটানে টেবিল থেকে খুলে আনল হারপূন।
ল্যাম্বার্ট, এ নিয়ে দ্বিতীয়বার হলো। আর ছাড়ব না তোমাকে, বলেই হারপূন তুলল ল্যাম্বার্টকে সই করে।
বেগতিক দেখল ল্যাম্বার্ট। ধীরে ধীরে পিছু হঠল সে। তারপর আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছুটে পালাল।
গারদের এক কোনায় হারপূনটা ছুঁড়ে ফেলে দিল মুসা। হাসতে হাসতে বলল, সত্যি সত্যি মারতাম না। তয় দেখালাম শুধু। তবে জিনিসটা আর হাতে নিতে দিচ্ছি না ওকে। তিমি শিকারে যাবার সময় ফাস্ট মেটকে হারপূন হারানোর কি ব্যাখ্যা দেবে তাই ভাবছি।
এমন সময় আবার কার পায়ের শব্দ শোনা গেল সিঁড়িতে।
আবার বোধহয় এসেছে ল্যাম্বার্ট, নিচুস্বরে বলল রবিন। মারামারি করতে। কিংবা হারপূনটা ফেরত নিতে।
বেশ। এবার আমরাও প্রস্তুত, হারপূন তুলে নিল কিশোর। আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে বাগিয়ে ধরল অস্ত্রটা।
তবে আগন্তক ল্যাম্বার্ট নয়, বাফার।
ওকে দেখে হারপূন নামাল কিশোর।
জেলখানার দিকে আসার সময় বারবার পেছন ফিরে দেখছে বাফার। আমার এখানে আসা উচিত হয়নি, ফিসফিস করল বাফার। আমার ডিউটি এখন ওপরে। তোমাদের একটা জরুরী কথা জানাতে এসেছি?
কি? জানতে চাইল রবিন।
ক্যাপ্টেন তোমাদেরকে এখনই হাঙরের মুখে ফেলে দিত। জেলে পুরে রাখার কারণ তোমাদেরকে তার দরকার হতে পারে। তবে নানটুকেটে ফেরার আগে হাঙরের মুখে ফেলবেই, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
তারমানে তার আগেই আমাদেরকে এখান থেকে কেটে পড়তে হবে, কিশোর বলল। তুমি আমাদের সাহায্য করবে?
দরকার হলে লড়াই করব, বুকে চাপড় দিয়ে বলল মুসা। বিনা যুদ্ধে নাহি দেব…
এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল বাফার। আমি সাধারণ একজন ডেকহ্যান্ড। তোমাদেরকে রা করার ক্ষমতা আমার নেই। আর মুক্তি পেলেও লাভ হবে না। কারণ এখন আমরা মাঝ সমুদ্রে। কি করবে তোমরা? হাজার মাইল পথ সাঁতার কেটে ডাঙায় উঠবে?
তিমি শিকারের নৌকা নিয়ে পালাতে পারি, উত্তেজিত গলায় বলল রবিন।
আবার মাথা নাড়ল বাফার। হুইল হাউজ আর ডেকে সব সময়ই কেউ না কেউ নজর রেখে চলেছে। ধরা পড়ে যাবে। তা ছাড়া নৌকা পানিতে নামানোও এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। শব্দ না করে পারবে না। যাকগে, তোমাদেরকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই
করো, কিশোর বলল। শত হলেও তুমি ঝুঁকি নিয়ে নিচে এসেছ। সাবধান করে দিয়েছ আমাদের।
তোমরা এমন অদ্ভুত ভাবে কথা বলছ কেন? জানতে চাইল বাফার। এটা ১৮৫০ সাল। অথচ তোমরা বিংশ শতাব্দীর কথা বলছ। পালের বদলে অন্য শক্তির কথা বলছ। ঘটনাটা কি?
দ্রুত দৃষ্টি বিনিময় করল দুই গোয়েন্দা। এ সব কি বলছে ছেলেটা?
ওকে যে আমরা ভূত ঠাউরে বসে আছি তা বলা যাবে না, ফিসফিস করে কিশোরের কানে কানে বলল মুসা।
মাথা আঁকাল কিশোর। সত্যি কথা বলব? বাফারকে বলল সে, এটা আসলে কোন সাল সেটাই শিওর হতে পারছি না আমরা।
দেয়ালে ঝোলানো একটা ক্যালেন্ডার দেখাল বাফার। বড় বড় অক্ষরে তাতে লেখা: ১৮৫০ সাল।
এর মানেটা দাঁড়াচ্ছে, বিড়বিড় করল মুসা, এই জাহাজটাতেই কেবল সময় বদলে গেছে। পিছিয়ে গেছে। এখানে থাকলে এই সালটাকেই মেনে নিতে হবে আমাদের।
ভুরু কুঁচকে গেল বাফারের। তোমরা পাগলা গারদ-টারদ থেকে পালিয়ে আসোনি তো? উদ্বিগ্ন শোনাল তার কণ্ঠ।
না, পাগলা গারদ থেকে পালাইনি, তাকে আশ্বস্ত করল কিশোর। তবে এই জাহাজ থেকে পালাতে চাই।
সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা দোলাল বাফার। পরে যদি সম্ভব হয় সাহায্য করব তোমাদের। এখন ডিউটিতে যেতে হবে, কথা শেষ করে সিঁড়ি বেয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল সে।
মাথার নিচে হাত রেখে বাঙ্কে শুয়ে পড়ল কিশোর। আরেকটা বাঙ্কে গিয়ে বসল রবিন। টেবিলের ওপর উঠে বসল মুসা। পা ঝোলাতে লাগল। ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আলোচনা করতে লাগল ওরা। বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করল।
সমস্যাটা হলো, মন্তব্য করল কিশোর, ভূত না আসল মানুষ সেটাই বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে একদল পাগলের সঙ্গে চলেছি আমরা। কিন্তু ওদের কাজ কর্ম দেখে তো পাগল বলেও মনে হচ্ছে না।
ভূত! ভূত! কোন সন্দেহই নেই আমার, মুসা বলল। তুমি তো আর বিশ্বাস করবে না।
নাকি কোনও ধরনের টাইম মেশিনের মধ্যে পড়ে গেলাম আমরা? রবিনের প্রশ্ন। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যময় কোন কিছুতে? এক টানে সময়কে পার করে নিয়ে এসেছে ১৮৫০ সালে!