দেখতে দেখতে বলে উঠল কিশোর, এখানে তিমি এল কোত্থেকে?
কেপ হর্ন হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে এসে পড়েছি, কড়া গলায় বলল ক্যাপ্টেন। এখানেই তো তিমির আড্ডা।
অবাক হয়ে রবিন বলল, এক রাতের মধ্যে কেপ হর্ন পৌঁছা কি সম্ভব? অ্যাটমিক জেট প্লেনের পক্ষেও এত দ্রুত চলা সম্ভব না।
জেট প্লেন! জিনিসটা কি? ক্যাপ্টেনের কণ্ঠে সন্দেহের সুর। আর অ্যাটমিক কথাটারই বা মানে কি?
কাঁধ ঝাঁকাল রবিন। আরও একশো বছর পার না করে দিলে এ প্রশ্নের জবাব জানতে পারবেন না।
মানে! কি বলছ তুমি?
বলছি বিংশ শতাব্দীর কথা। জেট প্লেন জিনিসটা বিংশ শতাব্দীর আকাশ যান।
ছোঁড়াটার মাথাটাই গেছে, বিড়বিড় করল নাইল। ওর কথার মাথামুণ্ডু তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
কনুই দিয়ে রবিনকে গুঁতো লাগাল কিশোর। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, বেশি কথা বলে আর ঝামেলা বাড়িয়ে না তো।
তিমি শিকারের নৌকা পানিতে ভেসে পড়তে প্রস্তুত। নাবিকরা উঠে পড়ল নৌকায়। বৈঠা ধরে বসল। পুকার চলে এল নৌকার মাঝখানে।
কিশোর পাশা, হারপুন ছোঁড়ার দায়িত্ব তোমার। তুমি গলুইয়ে গিয়ে বসো, আদেশ দিল ফাস্ট মেট। মুসা আমান, তুমি ধরবে হাল। রবিন, তুমি পেছন দিকের একটা বৈঠার ধারে বসো।
নৌকায় চড়ে যে যার জায়গায় বসে পড়ার পর কপিকলের লোকজন চাকা ঘুরিয়ে নৌকাটা পানিতে নামিয়ে দিল। দাড়িরা বৈঠা বাইতে শুরু করল। ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে অ্যাড্রিয়াটিক পাঞ্চ থেকে। ডেভিড পুকারের নির্দেশমত হাতল ঘুরিয়ে কোর্স ঠিক রাখছে। উদ্যত হারপূন হাতে গলুইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর।
ওই যে তিমির ফোয়ারা! তিমির ফোয়ারা! তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল পুকার। মুসা, বাঁ দিকে ঘুরাও।
তাড়াতাড়ি বয়ে কাটল মুসা। কই, আমি তো কিছু দেখছি না।
কানা নাকি? বেঁকিয়ে উঠল পুকার, তোমার কিছু দেখার দরকার নেই। যা বলছি করো। নইলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেব সাগরে।
অন্ধকার পানিতে বাঁ দিকে মোড় নিয়ে ছুটে চলল নৌকা। মাথার ওপরে কালো মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা তারা। বৈঠা পানিতে পড়ছে আর উঠছে ছন্দময় গতিতে।
এই যে এসে পড়েছি, ঘোষণা করল পুকার। কিশোর পাশা, হারপূন ছোড়ো।
এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল কিশোর। কই, তিমি কই? কিসের গায়ে ছুঁড়ব?
ওই যে তিমি। ছুঁড়লেই বুঝবে কিসের গায়ে পড়েছে, খেক খেক করে উঠল ফাস্ট মেট।
হারপূন ছুঁড়ল কিশোর। তারপর রশি ধরে টে। তুলল অস্ত্রটা। কোন কিছুর গায়ে হারপূন বেঁধেনি দেখে মন মনে খুশি হলো ও।
রাগে কাঁপতে লাগল পুকার। তিমিটাকে মিস করেছ তুমি! ইচ্ছে করে ওটাকে পালিয়ে যেতে দিয়েছ।
কিশোরের কথা সমর্থন করে রবিন বলল, আমারও কিন্তু কোন তিমি চোখে পড়েনি।
নিশ্চয় তারমানে ভুল দিকে নৌকা ঘুরিয়েছ! চিৎকার করে উঠল পুকার। দাঁড়াও, জাহাজে ফিরে নিই। তারপর বোঝাব মজা। ক্যাপ্টেনের কাছে নালিশ করে তিনজনের পিঠের চামড়া না ছাড়িয়েছি তো আর কি বলব-নাও, ঘোরো এখন। পুরো এক পাক ঘোয়রা। আবার দেখা যেতে পারে তিমিটাকে। এবার যদি মিস করো কিশোর পাশা, তাহলে… দাঁতে দাঁত চাপল ফার্স্ট মেট।
হাল ঘুরিয়ে আবার নৌকার মুখ ঘোরাল মুসা। ছপাৎ-ছপাৎ দাঁড় ফেলছে দাড়িরা। গলুইয়ে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাগরে চোখ বোলাচ্ছে কিশোর। নৌকাটা চক্কর মেরে মেরে ঘুরতেই থাকল।
তিমির চিহ্নও দেখা গেল না আর। হাল ছেড়ে দিল পুকার। জাহাজে ফিরে যাওয়ার হুকুম দিল।
জাহাজের কাছে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়াল নৌকা। ওপর থেকে দড়িতে বাধা হুক নামিয়ে দেয়া হলো। সেগুলোতে আটকে আবার জাহাজে তুলে নেয়া হলো নৌকা। আগের জায়গায় ঝুলিয়ে রাখা হলো।
তিমিটাকে মারতে পারিনি ক্যাপ্টেন, ক্ষোভের সঙ্গে রিপোর্ট করল পুকার। এ জন্যে ওই ছোকরা তিনটে দায়ী।
এ কথা শুনে রেগে আগুন হলো নাইল। হুকুম দিল, জেলে ভরে তালা দিয়ে রাখোগে!
তিন গোয়েন্দাকে ঠেলা-ধাক্কা মেরে নিচে নিয়ে আসা হলো। একটা শিক লাগানো ছোট ঘরে ঢোকানো হলো। এটাই জাহাজের জেলখানা। সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। ওদেরকে একা রেখে চলে গেল জাহাজীরা। তিমির তেল ভরা একটা লণ্ঠন মিটমিট করে জ্বলছে গারদে। গোটা দুয়েক কাঠের বাঙ্ক আর মাঝখানে একটা ছোট টেবিল ছাড়া আর কোন আসবাব নেই ঘরটাতে। বাঙ্কে বসল। পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল।
ঘটনা দেখছি জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে, মন্তব্য করল মুসা। একটা ভূতুড়ে জাহাজের কতগুলো নাবিক-ভূতের হাতে আমরা এখন বন্দী।
আর এজন্যে দায়ী একটা ভূতুড়ে তিমি, খিটখিটে গলায় যোগ করল রবিন।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে কিশোর বলল, অথচ পুকার বলছে সে তিমিটাকে দেখেছে।
আমাদেরকে ফাঁসানোর জন্যে বলেছে, এ তো সোজা কথা। আর নাইল যে ওর কথাই বিশ্বাস করবে সেটাও স্বাভাবিক। তবে আমার কি মনে হয় জানো-পুকার নিজেই একটা ভূত।
কিশোরের দিকে তাকাল মুসা। ওরা আমাদের নিয়ে কি করবে বলো তো?
জবাবে নিচের ঠোঁটে একটা টান দিয়ে ছেড়ে দিল কিশোর। বুঝতে পারছি না।
চুপ হয়ে গেল তিনজনেই। নাইলের হুমকির কথা ভাবছে ওরা।
নাইল আমাদেরকে হাঙর দিয়ে খাওয়াবে বলেছে, নীরবতা ভাঙল মুসা। হারে-ভূত বলে আবার কিছু নেই তো? আর ওগুলো নিশ্চয় মানুষখেকো নয়?
হাঙরের মানুষখেকো হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, বলল কিশোর। সেটা আসল হাঙরই হোক, কিংবা ভূতুড়ে…।