হুকুম দিয়ে চলে গেল সে।
চলতে শুরু করেছে জাহাজ, টের পেল ওরা। কাঁচকোচ করছে কড়িকাঠ, দুলছে এদিক-ওদিক। মাথার ওপর একটা লণ্ঠন জ্বলছে মিটমিট করে। চর্বি আর তেলের গন্ধ আসছে ওটা থেকে।
তিমির তেল, মন্তব্য করল রবিন।
সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে সব ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা হয়েছে ওদের। তাই গন্ধ পেয়েই বুঝতে পেরেছে লণ্ঠন জ্বলছে তিমির তেলে।
যদ্দুর জানি, বলল কিশোর, কেরোসিনের ব্যবহার শুরু হবার পর থেকে তিমির তেলের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তাহলে ওটা এল কোত্থেকে? আসলে ঘটছে কি এখানে?
কিছুই বুঝতে পারছি না, জবাব দিল মুসা। তবে মন বলছে সাবধানে থাকা দরকার। ভূত-প্রেত…
আরে ধুত্তেরি তোমার ভূত-প্রেত! খেঁকিয়ে উঠে তাকে থামিয়ে দিল কিপোর। সারাক্ষণ খালি ভূতের ভয়…
বাঙ্কে এসে শুয়ে পড়ছে নাবিকরা। তাদের দিকে হাসি মুখে তাকাল রবিন। কিন্তু ওর দিকে ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে রইল তারা।
আমরা এখানে নতুন, ভাব জমানোর চেষ্টা করল জো। কিন্তু পাথর-মুখ করেই থাকল জাহাজীরা।
নাবিকরা শুনেছি হাসিখুশি থাকে, বিড়বিড় করল কিশোর। কিন্তু এরা তো কবরের লাশ একেকটা।
বললেই তো খেপো, গম্ভীর কঠে মুসা বলল। কিন্তু না বলেও পারছি না। লোকগুলোর মতই জাহাজটাকেও ভূতুড়ে মনে হচ্ছে আমার।
এ জাহাজে বেশিদিন থাকতে হলে আর ভূতের প্রয়োজন পড়বে না, বলার সময় গলার স্বর কেঁপে উঠল রবিনের। নিজেরাও ভূত হয়ে যাব।
সমর্থন পেয়ে খুশি হয়ে তুড়ি বাজাল মুসা, এতক্ষণ ধরে ঠিক এই কথাটাই বোঝাতে চাইছি আমি।
ওদের কাছে বসা যামার্কা চেহারার এক নাবিক তার হারপূনের ধারাল, লম্বা ফলায় তেল মাখছে। সেই সাথে পালিশ করছে কাঠের ডাটা। একটা উকো হাতে নিল সে। ঘষে ঘষে ডগাটা তীক্ষ্ণ ও ধারাল করে তুলল। উকোটা লম্বা, মাছ ধরার বঁড়শির মত বাকানো।
লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল কিশোর। উঁকো দেখতে দেখতে বলল, বিপদজনক অস্ত্র মনে হচ্ছে।
বিপজ্জনক তো বটেই। তবে তিমির জন্যে, ঘেৎ-ঘোৎ করে উঠল লোকটা। কিছু বোকা ছাগলের জন্যেও, বাজি ধরে বলতে পারি, নইলে নাম বদলে রাখব আমার।
কি নাম আপনার খাতির জমানো ভঙ্গিতে নিরীহ স্বরে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হোগার্ট ল্যাম্বার্ট, খসখসে কণ্ঠে জবাব দিল লোকটা। কি, নাম শুনে কোন সুবিধে হলো, বোকা হাগল?
ল্যাম্বার্টের ভাবভলি মোটেও সুবিধের পাগল না কিশোরের কাছে। আর কিছু বলল না তাকে। ওদের চেয়ে দুএক বছরের বড় এক কিশোরের সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করল। একে ওর মত লাগছে না। তোমার নামটা কি, ভাই?
বাফার। আমি নিউ বেডফোর্ড থেকে এসেছি। আমার বাপ-দাদারা বহু কালের পুরানো তিমি শিকারী।
এক প্রশ্ন করে তিনটের জবাব পেয়ে গিয়ে উৎসাহ বেড়ে গেল কিশোরের। জিজ্ঞেস করল, আহা, এডওয়ার্ড পাঞ্চের ব্যাপারটা কি, বলো তো?
বিস্মিত দেখাল বাফারকে। কেন, এটা নানৗঁকেটের একটা তিমি শিকারী জাহাজ।
যাচ্ছে কোথায়?
কেপ হর্ন। কিন্তু আমাকে এ সব প্রশ্ন করছ কেন? জাহাজ কোথায় যাচ্ছে যদি না-ই জানো তাহলে উঠলে কেন?
কিশোর কিছু বলার আগেই রবিন বলে উঠল, আমি তো জানতাম, কেপ হর্নে তিমি শিকার করা হত উনবিংশ শতব্দীতে।
আরও অবাক হলো বাফার। তা তো বটেই। আর এটা তো উনবিংশ শতাব্দীই। ১৮৫০ সাল।
বাফারের কথা শুনে হাঁ হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা। ওদের কথা শুনছিল ল্যাঘাট। মুখ বাকিয়ে বলল, কোন্ সাল তা-ও জানে না! এমন বোকা তো জীবনে দেখিনি।
বাফার ছাড়া বাকি সবাই তিন গোয়েন্দার বোকামিতে হেসে উঠল। খনখনে, ভৌতিক হাসি। গা শিরশির করে উঠল গোয়েন্দাদের।
কিন্তু রেগে গেল মুসা। নাবিকদের দিকে তাকিয়ে ফেটে পড়ল, আমরা জানি এটা কোন্ সাল! আর এখান থেকে যে এখুনি চলে যাওয়া উচিত তা-ও জানি। আপনারা থাকুন আপনাদের অ্যাড্রিয়াটিক পাঞ্চ আর তিমি নিয়ে। আমরা গেলাম…
কটমট করে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকা ঝটকা দিয়ে হারপূনটা তুলে নিল ল্যাম্বার্ট। ছুঁড়ে মারল ওকে লক্ষ্য করে।
সাঁৎ করে সরে গেল মুসা। অল্পের জন্যে মিস হলো ধারাল অস্ত্রটা। ঘ্যাঁচ করে বিধল গিয়ে জাহাজের গায়ে। তিরতির করে কাঁপতে থাকল ওটার দণ্ডটা।
বাপরে! আরেকটু হলেই তো গেছিলে! ঢোক গিলল রবিন।
সাবধান! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। বিপদ এখনও কাটেনি।
দলবল নিয়ে ছুটে এল ল্যাম্বার্ট। আত্মরক্ষার জন্যে তৈরি হলো তিন গোয়েন্দা। হাত বাড়িয়ে দিল কারাতে মারের ভঙ্গিতে।
খেক খেক করে হেসে উঠল জাহাজীরা। ধরার জন্যে হাত বাড়াল।
ঠিক সেই মুহূর্তে ডেক থেকে ভেসে এল চিৎকার। তিমি! তিমি! ওই যে, বাঁ দিকে!
দোরগোড়ায় হাজির হলো পুকার। এই জলদি এসো তোমরা!…কিশোর, মুসা, রবিন-তোমরাও তোমাদের হারপূন নিয়ে ডেকে চলে এসো।
আপাতত ল্যাম্বার্টের দলের হাত থেকে বেঁচে গেল তিন গোয়েন্দা। অকারণে মারমুখী হয়ে ওঠা নাবিকরা ছেড়ে দিল ওদেরকে। কিশোর, মুসা ও রবিন যার যার বাকের মাঝখান দিয়ে হেঁটে দরজার দিকে এগোল। তরতর করে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে।
এখনও চারদিকে অন্ধকার। তবে সাগর আগের চেয়ে শান্ত। মৃদু ঢেউয়ের ওপর দিয়ে ধীর গতিতে চলেছে জাহাজ।
ক্যাপ্টেন কুপারের আদেশে দশ-বারো জন নাবিক একটা তিমি শিকারের নৌকা পানিতে ভাসানোর তোড়জোড় করছে। কপিকলের সাহায্যে শিকলে বাঁধা নৌকা নামানো হলো জাহাজের এক পাশে। খানিক নেমে শূন্যে ঝুলে রইল নৌকাটা।