ডেকে বেশ কয়েকজন রুক্ষ চেহারার নাবিক। সবার পরনে পুরানো আমলের পোশাক। দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে। ভ্রু কুঁচকে দেখছে ওদেরকে। একজনের হাতে একটা হাপুন। অস্ত্রটা ভীতিকর ভঙ্গিতে দোলাল সে।
ট্রেনিং শিপ, নিচু গলায় দুই সহকারীকে বলল কিশোর। মনে হচ্ছে।
এমন ভূতুড়ে ট্রেনিং শিপ জীবনে দেখিনি আমি, ফিসফিস করল মুসা।
নোনা পড়া জ্যাকেট গায়ে এক লোক এগিয়ে এল ওদের সামনে। লোকটা লম্বা, মুখভর্তি কালো দাড়ি। তীক্ষ্ণ, কালো চোখ। কথা বলার সময় গলার স্বর শুনে গোয়েন্দারা বুঝল, খানিক আগে এই লোকই ওদের পরিচয় জানতে চেয়েছিল।
নাম কি তোমাদের? কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল লোকটা।
নিজেদের পরিচয় দিল কিশোর।
ঘোৎ-ঘোৎ করে উঠল লোকটা। তোমরা যে-ই হও তাতে আমার কিছু এসে যায় না।
সাহস করে জানতে চাইল রবিন, আপনি কে?
আমি এডওয়ার্ড নাইল। অ্যাড্রিয়াটিক পাঞ্চের ক্যাপ্টেন। তিমি শিকারী জাহাজ এটা। আমরা এসেছি নাটুকেট থেকে। ওখানেই ফিরে যাচ্ছি আবার। শক্ত সমর্থ কয়েকজন লোক দরকার আমাদের। তোমাদেরকে দিয়ে কাজ হবে মনে হচ্ছে। নানটুকেট না পৌঁছা পর্যন্ত তোমরা আমার ক্রু হিসেবে কাজ করবে।
অবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা। এ লোক বলছে কি? উনবিংশ শতাব্দীর পরে আর কোন পাল তোলা তিমি শিকারীর জাহাজ তৈরি করা হয়নি। লোকটা ঠাট্টা করছে ভেবে কিশোর বলল, ক্যাপ্টেন নাইল, আপনার জাহাজে থাকতে আসিনি আমরা। আমাদের ইঞ্জিন খারাপ হয়ে গেছে। মেরামতের জন্যে লোক দরকার। দয়া করে যদি বোটটা সহ আমাদের তীরে পৌঁছে দেন, কৃতজ্ঞ থাকব।
ইঞ্জিন? ইঞ্জিন আবার কি জিনিস? খেঁকিয়ে উঠল নাইল।
লোকটা কি রসিকতা করছে নাকি! কিশোর বলল, জাহাজ চালাতে আপনার শক্তির দরকার হয় না?
গাধা নাকি! হয় না মানে? শক্তি ছাড়া জাহাজ চলে? সেজন্যেই তো বাতাস দরকার, আর বাতাসের শক্তিকে ব্যবহার করার জন্যে পাল! গমগমে গলায় বলল ক্যাপ্টেন। এ ছাড়া সাগরে জাহাজ চালাতে আর কোনও শক্তি জোগাড় করতে পারবে তুমি? আরেকটা কাজ অবশ্য করা যায়-সাগরে লগি ঠেলে জাহাজ চালাতে পারো।
ক্যাপ্টেনের কথা শুনে হো হো হাসিতে ফেটে পড়ল নাবিকরা। নাইলও হাসছে। যেন খুব মজার একটা রসিকতা করে ফেলেছে।
লোকগুলো ভারী অদ্ভুত! রাগ লাগল কিশোরের। চলো। এই পাগলদের সঙ্গে থাকার চেয়ে নিজেদের বোটে নেমে যাই। উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে ভেসে থাকব, সে-ও ভাল।
রেলিং-এর ধারে ছুটে এল ওরা। যেখান দিয়ে মই বেয়ে উঠেছে। উঁকি দিল।
সাথে সাথে জমে গেল যেন।
বোটটা নেই!
ধরো ওদেরকে! নাইল হুকুম দিল তার দেরকে। ধরো! ধরো!
নাবিকরা ছুটে এসে ধরে ফেলল তিন গোয়েন্দাকে। জোর করে নিয়ে এল মাঝ ডেকে। ক্যাপ্টেন নাইল গনগনে মুখ নিয়ে দাঁড়াল ওদের সামনে।
তোমাদের মতলব ভালই বুঝতে পারছি আমি, কর্কশ কঠে বলল সে। তোমরা অন্য তিমি শিকারীদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে চাইছ। কিন্তু সে-সুযোগ আর পাবে না। পাঞ্চেই থাকতে হবে তোমাদেরকে আমরা কেপ হন হয় প্রশান্ত মহাসাগরে যাচ্ছি। তোমাদেরকে তিমি শিকারী বানিয়েই ছাড়ব। আমাদের কথা না কালে স্রেফ হাওরের মুখে ছুঁড়ে ফেলে দেব।
অবাক লাগছে কিশোরের। না বলে পারল না, প্রশান্ত মহাসাগরেই তো রয়েছি আমরা। আবার যাব কি ওখানে?
আমাকে জাহাজ চালানো শেখাবে, না? খেঁকিয়ে উঠল ক্যাপ্টেন। চল্লিশ বছর ধরে সাগরে সাগরে ঘুরছি, আমাকে সাগর চেনাবে। আর একটা কথা বলেই কি ভাল হবে না বলে দিলাম।
নাইলের হুমকি তিন গোয়েন্দার মেরুদণ্ডে ঠাণ্ডা শিহরণ জাগাল। কিশোরের মনে হলো একদল পাগলের কবলে পড়েছে। মুসা আর রবিনের মনে শচ্ছে জ্যান্ত দুঃস্বপ্ন দেখছে।
হুইল হাউজের দিকে ঘুরল নাইল। চেঁচিয়ে আদেশ দিল, ডেভিড পুকার। এখানে এসো।
বিশালদেহী, মোটাসোটা এক নাবিক হাজির হলো হুইল হাউজের সামনে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল ডেকে। নাইল তাকে হুকুম করল তিন গোয়েন্দাকে নিচে নিয়ে যেতে। ডিউটির জন্যে প্রস্তুত করতে হবে।
পুকার নিয়ে চলল ওদের। পেছন থেকে ভেসে এল ক্যাপ্টেন এবং তার আজব নাবিকদের ভৌতিক হাসি।
আমি ফাস্ট মেট, সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় নিজের পরিচয় দিল পুকার। ডিউটি যখন থাকবে না, তখন তোমরা কোথায় থাকবে দেখিয়ে দিচ্ছি।
এ সব কি ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছি না, মুসা বলল।
কি ঘটছে ঠিকই জানো তোমরা, কড়া গলায় বলল ফাস্ট মেট।
না, জানি না! প্রতিবাদ করল কিশোর।
সিঁড়ির শেষ মাথায় এসে ঘুরে দাঁড়াল পুকার। ধমকে উঠল, তাহলে আগে জেনে নাও কি কি করতে হবে তোমাদের। সব সময় নির্দেশ মেনে চলবে। নির্দেশ অমান্যকারী নাবিককে সাগরে, হাঙরের মুখে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়।
ক্যাপ্টেন নাইলের হুমকির কথা মনে পড়তে কেঁপে উঠল রবিন।
ওদের নিয়ে ক্রুদের লিভিং কোয়ার্টার্সে চলে এল পুকার। বেশ বড় ঘর। দেয়ালের সাথে লাগানো কতগুলো বাঙ্ক। প্রতিটি বাঙ্কের নিচে ঝুলছে একটা করে হারপূন। হারপূনের পাশে বর্ষাতি আর সাউথ ওয়েস্টার। ঝড় বাদলার দিনে চামড়ার জ্যাকেটের ওপর বর্ষাতি চাপাতে হয়। মাথা ঢাকতে হয় সাউথ ওয়েস্টার দিয়ে।
*
ওই খালি বাঙ্ক তিনটে তোমাদের, হাত তুলে দেখাল ফাস্ট মেট। ডেকে কাজ করার জন্যে রেডি হয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসো।