ঘণ্টাখানেক পরে রকি বীচ থেকে অপ্রত্যাশিত একটা ফোন এল। কিশোরের চাচী মেরিচাচীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন। অপারেশন লাগবে।
চাচাকে খবর পাঠাল কিশোর। তক্ষণি বাড়ি যেতে তৈরি হলো। আফসোস করে বলল, সিম্বুর সোনা দেখা আর হলো না আমাদের। যাকগে, কি আর করা! চাচী ভাল হয়ে গেলে আবার আসব। এখন আমি এয়ারপোর্টে ফোন করছি টিকেটের জন্যে।
পরদিন সকালের ফ্লাইটের টিকেট পেল ওরা। এয়ারপোর্টে আসার পথে লক্ষ করল পিছু পিছু সাদা মার্সিডিজটাও আসছে।
বাজি ধরে বলতে পারি, আমাদেরকে চলে যেতে দেখে খুবই অবাক হচ্ছে দুপা, রবিন বলল।
*
মাসখানেক পরে তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টারে বসে গল্প করছে কিশোর, মুসা রবিন ও ওদের বন্ধু বিড ওয়াকার।
সিম্বুর গল্প শুনে বিড জিজ্ঞেস করল, সোনার বারগুলো দেখতে গিয়েছিলে আর?
গিয়েছিলাম, জবাব দিল কিশোর। তবে যেতে দেরি করে ফেলেছিলাম।
মানে? ভুরু কোঁচকাল বিড। তুলে নিয়ে গেছে নাকি কেউ গুপ্তধনগুলো?
না, মাথা নাড়ল কিশোর। বুড়োর বাড়ির পাশে যে রাস্তাটা বানানো হচ্ছিল, দেখে এসেছিলাম, পরের বার গিয়ে দেখি সেটা তৈরি হয়ে গেছে। বুড়োর বাড়ি ভেঙে ফেলেছে। টিলা সমান করে বাড়ির ওপর দিয়ে চলে গেছে ছয় লেনের, কংক্রিটের ঝকঝকে রাস্তা।
তারমানে, হতাশ হলো বিড, বুড়োর গুপ্তধন চিরকালের জন্যে চাপা পড়ে গেল মাটির নিচে।
গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর। হ্যাঁ। সিম্বু আর মনিবের জিনিস বেশ ভালমতই পাহারা দিয়ে রেখেছে। মনে হয় কাউকে ছুঁতে দেয়নি। দুপাকেও না।
.
ভূতের জাহাজ
মোটর বোট নিয়ে সাগরে বেড়াতে বেরিয়েছে তিন গোয়েন্দা। সময় পেলেই এ রকম বেরোয়। তবে আজ সাগরের মতিগতি সুবিধের ঠেকছে না। মাথায় সাদা ফেনা নিয়ে ফুঁসে উঠছে ঢেউ। বোটের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে উঠছে পানি।
কপালে হাত রেখে ঢেউ দেখতে দেখতে কিশোর বলল, ঝড় আসবে মনে হচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তীরে ফিরে যাওয়া দরকার।
হাতের চেটো দিয়ে মুখ থেকে পানির ছিটা মুছল মুসা। হাল ধরে রেখে বলল, হ্যাঁ। সন্ধ্যাও হয়ে আসছে। তবে তীর থেকে বেশি দূরে নই আমরা। বাড়ি ফিরে যাই চলো। আমি ইঞ্জিনের স্পীড বাড়াচ্ছি।
রবিন কিছু বলল না। তাকিয়ে আছে ঢেউয়ের দিকে।
মোটর বোট নিয়ে বেড়াতে বেরোয় ওরা, ঝড়-টর দেখে না তা-ও না। তবে সে-সম্ভাবনা দেখলেই দ্রুত উপকূলে ফিরে আসে।
অ্যাকসিলারেটরে চাপ বাড়াল মুসা। গতি পেয়ে লাফ মেরে ছুটল মোটর বোট।
হঠাৎ খকখক করে কাশতে শুরু করল ইঞ্জিন। তারপর থেমে গেল। স্থির হয়ে পানিতে ভাসতে লাগল বোট।
ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করল মুসা। কাজ হলো না।
নাহ্, হচ্ছে না, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মুসা। কোথাও কিছু গড়বড় হয়ে গেছে।
ইঞ্জিনের ঢাকনা খুলে দেখতে শুরু করল সে। কাজ শেষ করে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, কই, কোথাও তো কোন গলদ দেখতে পাচ্ছি না। ট্রান্সমিশন, তেল, গ্যাস-সবই ঠিক আছে।
ইঞ্জিন স্টার্ট নিচ্ছে না কেন? রবিনের প্রশ্ন।
সাহায্য দরকার আমাদের। সাঁতার কেটে তো আর তীরে পৌঁছুতে পারব না, কিশোর বলল।
শিপ-টু-শোর রেডিও ট্রান্সমিটারের সুইচ অন করল সে। কিছুই ঘটল না। কয়েকবার সুইচ অন-অফ করল। পরীক্ষা করে দেখলতার, ব্যাটারি।
রেডিওতেও কোন সমস্যা দেখতে পাচ্ছি না, বিড়বিড় করল কিশোর। কিন্তু এটাও অকেজো হয়ে পড়েছে! অদ্ভুত ব্যাপার তো! এ কেমন ঝামেলায় পড়লাম।
সাঁঝের আঁধার ঘনিয়ে আসছে। সেই সাথে বাড়ছে বাতাস। বেড়ে যাচ্ছে ঢেউয়ের তীব্রতাও। ঢেউয়ের আঘাতে অসহায়ের মত পানিতে দোল খাচ্ছে বোট। আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। কালো মেঘ ঢেকে রেখেছে নক্ষত্রপুঞ্জ। ঠাণ্ডায় গায়ে কাটা দিতে লাগল ওদের। শীত করছে।
অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে সারা রাত এখানেই কাটাতে হবে, অস্পষ্ট স্বরে বলল রবিন। ঢেউয়ের ধাক্কায় বোট উন্টে না গেলেই বাঁচি।
কেউ যে আমাদের এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে সে-চান্সও নেই, মুখ কালো হয়ে গেছে কিশোরের। এক হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। জাহাজ-টাহাজ এলেও আমাদের দেখতে পাবে না।
হঠাৎ অন্ধকার কুঁড়ে কালো, প্রকাও কি একটা ওদের সামনে ছুটে আসতে লাগল। কর্কশ একটা কণ্ঠ ভেসে এল সাগর থেকে কে তোমরা?
জাহাজ! উল্লসিত হয়ে উঠল মুসা। আমাদেরকে দেখতে পেয়েছে। মুখের সামনে দুই হাত জড় করে এনে চিৎকার করে জবাব দিল, আমরা সাগরে আটকা পড়েছি। আমাদেরকে আপনাদের জাহাজে তুলে নেবেন?
দাঁড়াও। আসছি, জবাব এল।
কালো পাহাড়ের মত জিনিসটা এগিয়ে এল ওদের দিকে, থেমে পড়ল বোটের পাশে।
জাহাজটা বিশাল। বাতাসে দুলতে থাকা লণ্ঠনের আলোয় গলুই চোখে পড়ছে। তার নিচে সাদা অক্ষরে লেখা: অ্যাড্রিয়াটিক পাঞ্চ।
অদ্ভুত নাম! বিড়বিড় করল রবিন।
বোট লক্ষ্য করে জাহাজ থেকে একটা.দড়ির মই ছুঁড়ে দেয়া হলো।
মইটা দুহাতে ধরে ফেলল কিশোর। দ্রুত উঠে এল ওপরে।
বোটের সাথে মই বেঁধে ফেলল মুসা। রবিনকে উঠে যাওয়ার সুযোগ দিল। তারপর নিজেও অনুসরণ করল তাকে।
লাফ মেরে জাহাজের রেলিং টপকাল তিনজনে। দাঁড়াল এসে প্রকাণ্ড ওক কাঠের ডেকে। পুরানো আমলের লণ্ঠনের মিটমিটে আলোয় দেখল এটা একটা পাল তোলা জাহাজ। বাতাসে পতপত করে উড়ছে পাল। মূল মাল খাড়া উঠে গেছে অন্ধকার আকাশে। একটা কাঠের সিঁড়ির মাথা গিয়ে ঠেকেছে হুইল হাউজে।