খোলো তো দেখি! তাড়া দিল মুসা। ভেতরে কি আছে দেখার জন্যে তর সইছে না আমার।
খাম খুলল কিশোর। ভেতরে জরাজীর্ণ, মলিন এক টুকরো কাগজ। তাতে অদ্ভুত কিছু কথা লেখা ছড়ার ঢঙে। কিশোর জোরে জোরে পড়ে শোনাল:
ভাবছ ওটা আছে হেথায়।
খুঁজলে পাবে নাকো সেথায়
পাহাড় বেয়ে ওঠা মাথায়
আবার নামে নিচে।
অনেক গভীর শিকড় যেথায়
পাহারা দেয় সিম্বু সেথায়
সোনা চুরির ফন্দি ছাড়ো
মানে মন কেটে পড়ো
নইলে আছে দুঃখ অনেক
বাঁচবে নাকো কেউ।
অবাক হয়ে গেল ওরা।
রাশেদ আঙ্কেল যে বুড়ো লোকটার গল্প বলেছে এটা নিশ্চয় তার কাজ। অবশেষে বলল রবিন। ওই লোক তার ক্রীতদাসের সাহায্যে সোনাদানা লুকিয়ে রেখেছিল। পাহারার ব্যবস্থা করেছিল সিম্বুকে দিয়ে।
জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে ধাপে ধাপে মিলে যাচ্ছে, ফাঁকা শোনাল মুসার কণ্ঠ। আমরা লোভে পড়ে গুপ্তধনের সন্ধানে বেরোলেই অভিশাপ নেমে আসবে আমাদের ওপর।
দূর, তোমার অভিশাপ! কে বিশ্বাস করে? মুখ ঝামটা দিল রবিন।
যা-ই বলল, অদ্ভুত কিছু যে ঘটছে এখানে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কি বলল, কিশোর?
চিন্তিত ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে ফিরে তাকাল কিশোর, হুঁ।
আমাদের এখন কি করা উচিত তাহলে? রবিনের প্রশ্ন।
হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল কিশোর। ব্যাপারটার শেষ দেখে ছাড়ব। সোনা যদি পেয়েই যাই পুলিস বা কোন চ্যারিটির হাতে তুলে দেব।
জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল কিশোর। দুপা ওদের দিকে নজর রাখছে কিনা দেখার জন্যে পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল। বৃষ্টি শুরু হয়েছে, জানাল সে। আমাদের বন্ধুটি এখনও আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে-না না, চলে যাচ্ছে। ভেবেছে হয়তো ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে আমরা কোথাও বেরোব না।
আকাশ ফুটো করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। গাছের শাখায় ঝোড়ো হাওয়ার মাতামাতি।
চলো, এই সুযোগে বেরিয়ে পড়ি, প্রস্তাব দিল মুসা। রেইনকোট আছে। কাজেই ভিজতে হবে না বৃষ্টিতে। আর ক্যাম্পিং-এর জন্যে গর্ত খোঁড়ার কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছিলাম। ওগুলোও নেব সাথে।
প্রস্তাবটা মন্দ না, নিমরাজি হলো কিশোর। ঠিক আছে, চলো। চুপচাপ হোটেলে বসে থাকতে ভাল্লাগবে না। দেখেই আসি সিম্বুকে পাওয়া যায় কিনা।
কয়েক মিনিট পরে হোটেলের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল ওরা। এখানে ওদের বাইক রেখেছে। সাবধানে মোটর সাইকেল দুটো নিয়ে উঠে এল মেইন রোডে। তাকাল এদিক-ওদিক। নাহ্, সাদা মার্সিডিজের চিহ্নও নেই কোথাও। রাস্তা প্রায় জনমানবশূন্য। গন্তব্য বুড়োর বাড়ি।
ভাগ্য ভালই বলতে হবে। একটু পরেই থেমে গেল বৃষ্টি। মেঘ সরিয়ে দিয়ে হেসে উঠল ঝলমলে চাঁদ। নদীর ধারে চলে এসেছে ওরা। নদীর পাশের সরু রাস্তায় ঢুকে পড়ল। অনেকটা পথ যাবার পর চোখে পড়ল বুড়োর বাড়ি। রাস্তা মেরামতির কাজ চলছে। বড় বড় সব যন্ত্রপাতি। খানিক দূরে একটা পাথুরে দেয়াল। ঘিরে রেখেছে বুড়োর শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটাকে। মোটর সাইকেল থামাল ওরা। হেঁটে ঢুকে পড়ল গেট দিয়ে। চাঁদটাকে আড়াল করে দিতে শুরু করেছে মেঘ। বাতাস উঠছে। একটু পরেই আবার নামল বৃষ্টি।
বাহু, দারুণ! বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠল মুসা। এই আসে এই যায়!
টর্চ জ্বেলে এগোচ্ছে ওরা। বড় বড় ওক গাছের ডালে ঝুলে থাকা এক ধরনের শ্যাওলার কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে যাত্রা। টর্চের আলোতে খুব কম জায়গাই আলোকিত হচ্ছে।
কানের পাশে নিশাচর পাখি তীক্ষ্ণ গলায় ডেকে উঠে দারুণ চমকে দিল ওদেরকে। ডাকতে ডাকতে বৃষ্টির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ কোরাস ধরেছে ব্যাঙ। হাঁটু ডুবে যাওয়া গভীর জলায় নেমে পড়েছে কিশোর। পায়ের নিচে পিচ্ছিল কি একটা কিলবিল করে উঠল। আঁতকে উঠল ও। এক লাফে উঠে এল তীরে।
কি হলো? জানতে চাইল রবিন।
সাপ! বিড়বিড় করল কিশোর। গোখরো! আরেকটু হলেই গেছিলাম।
পুরানো বাড়িটার কাছাকাছি এসেছে ওরা, এমন সময় মড়মড় করে একটা ডাল ভেঙে গেল। মুসা দেল ডালটা সোজা রবিনের গায়ে পড়তে যাচ্ছে। সাবধান করে দেয়ার সময় নেই। প্রচণ্ড এক ধাক্কা মারল রবিনকে। ছিটকে পড়ে গেল রবিন। বিশাল মোটা ডালটা এক সেকেন্ডের জন্যে তার শিকার হারাল। ডালটার দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল রবিন। আরেকটু হলে আমিও গেছিলাম, খসখসে গলায় বলল ও।
কিশোরের দিকে তাকাল মুসা। সিম্বু পুতুলের কারণে মিউজিয়ামে দুর্ঘটনাগুলোর কথা মনে পড়ে গেছে তার। ফিরে যাবে নাকি?
নাহ? ওই তো সামনেই বাড়িটা।
ওটাকে এখন আর বাড়ি বলা যায় না। দেয়ালগুলো শুধু খাড়া হয়ে আছে, ছাদ অদৃশ্য। এবড়োখেবড়ো মেঝে। আবর্জনা, ভাঙা কাঠ আর অন্যান্য পরিত্যক্ত জিনিসপত্রে বোঝাই মাটির নিচের ঘরটা।
ভাবছ ওটা আছে হোথায়, খুঁজলে পাবে নাকো সেথায়, পাহাড় বেয়ে ওঠো মাথায়, আবার নামো নিচে, বিড়বিড় করে ছড়াটা আওড়াল কিশোর। ছোটখাট একটা পাহাড়ের মত টিলার মাথায় চড়ে তরাইয়ের চারপাশে চোখ বোলাল। বেশির ভাগটাই সমতল।
নেমে কোন দিকে যেতে হবে? জানতে চাইল রবিন।
মনে হয় বাড়ির পেছন দিকে যেতে বলেছে। চলো, দেখে আসি।
দেখা গেল বাড়ির পেছন থেকে মাটি ঢালু হয়ে নেমে গেছে।
অনেক গভীর শিকড় যেথায়, পাহারা দেয় সিম্বু সেথায়, এবার আবৃত্তি করল রবিন। কিসের শিকড়? এদিকে কোনও বড় গাছটাছ তো চোখে পড়ছে না।