এবং তারপর সেই লোক দুজনও মাসখানেকের মধ্যেই রহস্যময় ভাবে উধাও হয়ে যায়, যোগ করল রবিন। আর কোন খোঁজই পাওয়া গেল না তাদের। সে-ই শেষ। এ ঘটনার পর ফ্লেমিং রক দেখে এসেছে বলে দাবি করেনি আর কেউ।
গাড়ি রাখতে বলল কিশোর।
ব্রেক কষল মুসা।
রবিনের দিকে ফিরে তাকাল কিশোর। আমি যা ভাবছি তুমিও কি তাই ভাবছ?
মাথা ঝাঁকাল রবিন। মুসার দিকে তাকাল একবার। তারপর আবার তাকাল কিশোরের দিকে। হ্যাঁ। জায়গাটা থেকে যখন দূরে নই আমরা, কিংবা বলা যায় জায়গাটার কাছাকাছি চলে এসেছি, একবার ঢু মেরে গেলে ক্ষতি কি?
খাইছে! বলো কি? আঁতকে উঠল মুসা। জেনেশুনে ওই ভূতের শহরে ঢুকব ওদের দলে সামিল হতে?
সেটাও তো একটা অভিজ্ঞতা হবে, কিশোর বলল। ভূত দেখার এতবড় সুযোগটা ছাড়ি কেন? নাকি ভোটাভুটি করতে চাও? গণতান্ত্রিক অধিকার?
অধিকার আর পাচ্ছি কোথায়? নিমের তেতো করল মুসার কণ্ঠে। তিনজনের মধ্যে দুজনই তো ভোট দিয়ে বসেই আছো যাওয়ার পক্ষে। আমি দিলেই বা কি না দিলেই কি?
দিলে একটা জিনিস ভাল হবে, হেসে বলল কিশোর। আমাদের দলে চলে আসতে পারলে। একা একা অন্য দলে থাকাটা কি ঠিক?
গীয়ার লিভারে ধরে আবার হ্যাঁচকা টান মারল মুসা। ঝাঁকি দিয়ে চলতে শুরু করল গাড়ি। ওর রাগ দেখে হেসে ফেলল কিশোর।
হাইওয়ে থেকে মোচড় দিয়ে পাশের একটা রাস্তায় গাড়ি নামিয়ে আনল মুসা। মাইল তিরিশেক যাওয়ার পর আরেকটা কাঁচা রাস্তায় পড়ল। সোজাসুজি পবর্তের ওপরে উঠে গেছে রাস্তাটা।
ভীষণ এবড়োখেবড়ো পথ। প্রচণ্ড ঝাঁকি।
এ কি রাস্তা নাকি! বাপরে বাপ!
রাস্তা আসলে নয়ও। মাটিতে তৈরি হয়েছে গরুতে টানা গাড়ির চাকার গভীর দুটো খাজ। তার মধ্যে চাকা ফেলে টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছে।
ভাগ্যিস ফোর-হুইল ড্রাইভ গাড়ি ভাড়া করেছিলাম, কিশোর বলল। নইলে এ রাস্তায় অসম্ভব ছিল চালানো।
আর খাবারগুলো তো জোর করেই নিলাম আমি, মুসা বলল। তোমরা তো নিতেই চাচ্ছিলে না। কাজে লাগবে না এখন? কিন্তু কথা হলো, যে রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাতেই এত কষ্ট হচ্ছে, সেটা ধরে গরুর গাড়ি চলে কি করে?
নিশ্চয় হাতির সাইজের একেকটা গরু, মন্তব্য করল রবিন। গায়ে দানবের জোর। তবে যা-ই বলো, দারুণ একটা অভিযানের পূর্বাভাস পাচ্ছি।
সামনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আচমকা গুঙিয়ে উঠল মুসা।
কি হলো? চমকে উঠল কিশোর।
দেখছ না, বৃষ্টি শুরু হয়েছে, শক্ত হাতে স্টিয়ারিং চেপে ধরে রেখে মুসা বলল। এ সব এলাকায় বৃষ্টির মানে জানো? মাটি এত শুকনো আর কঠিন, সহজে পানি শুষে নিতে পারে না। পর্বতের ওপর থেকে গড়িয়ে নামা পানিতে চোখের পলকে বন্যা হয়ে যাবে।
ঠিকই বলেছে মুসা। তথ্যটা কিশোরেরও জানা। অন্য চিন্তায় ছিল বলে এদিকে খেয়াল ছিল না তার। এ সব অঞ্চলে বছরে মাত্র কয়েকবার বৃষ্টি হয়। কিন্তু যখন হয়, ঢল নামে। খুলে যায় যেন আকাশটা। মেঘের বুকে যত পানি জমা হয়, যত তাড়াতাড়ি পারে ছেড়ে দিয়ে যেন বাঁচতে চায়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের আলামত সবার আগে টের পায় বন্য প্রাণীরা! এতক্ষণ যাদেরকে প্রায় চোখেই পড়ছিল না, এখন তাদেরকেই দেখা যেতে লাগল পালে পালে। পানি থেকে বাঁচার জন্যে উঁচু অঞ্চলের দিকে ছুটে চলেছে ওরা। হরিণ, খটাশ আর অন্যান্য রোমশ প্রাণীদের ছুটতে দেখা গেল উদ্ধশ্বাসে।
শুরু হলো প্রবল বর্ষণ। দেখতে দেখতে রাস্তার গভীর খাঁজ দুটো ভরে গেল পানিতে।
পূর্ণ গতিতে বিরামহীন ভাবে চলছে উইন্ডশীল্ড ওয়াইপার। কিন্তু কোনমতেই কুলিয়ে উঠতে পারছে না জানালার কাঁচ বেয়ে নেমে যাওয়া পানির প্রবল স্রোতের সঙ্গে। চোখের পাতা সরু করে এনে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে সেই পানির চাদরের মধ্যে দিয়ে সামনে দেখার চেষ্টা চালাচ্ছে মুসা। একটা উঁচু পাথুরে জায়গায় উঠে এল। গ্র্যাচ করে ব্রেক কষল। বিস্মিত।
কিশোর, দেখো দেখো, সামনে ওই যে আলো দেখা যাচ্ছে। চেঁচিয়ে উঠল সে।
আরে দুলছে দেখো, রবিনেরও চোখে পড়েছে আলোটা। পাশের জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই লোকগুলোর বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, তাই না?
এবং তারপর একদিন রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হয়ে গেল দুজনে, আনমনে বিড়বিড় করল মুসা। আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি ওদের!
আলোটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কিশোর বলল, কিসের আলো জানিই না আমরা এখনও। আদৌ ওটা ফ্লেমিং রক শহর কিনা, তাই বা শিওর হচ্ছি কি করে?
তা-ও তো কথা। তাহলে কি করব এখন?
আগে বাড়ো। কাছে না গেলে তো বোঝা যাবে না।
অচেনা জায়গা। রাস্তার অবস্থা ভাল না। খুব ধীরে ধীরে চালাতে শুরু করল মুসা। কিন্তু কিছুদূর গিয়েই ব্রেক কষল আবার। কিশোর, দেখো! ওই যে সাইনবোর্ডটা! ঢোক গিলল সে।
মলিন, ভাঙা তক্তাটার দিকে তাকিয়ে রইল ওরা। হেডলাইটের আলোয় পড়া যাচ্ছে খোদাই করা লেখাগুলো:
ফ্লেমিং রক
অ্যারিজোনা
লোকসংখ্যা: ৪৭৭
খাইছে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে মুসা। চারশো সাতাত্তর জন নারী-পুরুষ, ছেলেমেয়ে, বাচ্চাকাচ্চা মুহূর্তে গায়েব হয়ে গেল! এ কি বিশ্বাস করা যায়?
ঘটনাটা যখন ঘটেছে, না করেই বা কি করব, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। দেখা যাক, আমরা ওদের খুঁজে বের করতে পারি কিনা। এত বছর পর দেখতে ওদের কেমন লাগবে আল্লাহই জানে।