আপনারা আসার আগে এই টেবিলে এক বন্ধুকে নিয়ে বসেছিলাম আমি। সে একটা খাম নাকি ফেলে রেখে গেছে এখানে। খামটা কি আপনাদের চোখে পড়েছে?
না, পড়েনি, জবাব দিলেন রাশেদ পাশা।
কিছু মনে না করলে একটু উঠে দাঁড়াবেন দয়া করে? বলল লোকটা।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়ালেন মিস্টার পাশা। দেখাদেখি তিন গোয়েন্দাও।
দুপা টেবিলের নিচে, চেয়ারের নিচে, গদির তলায় তন্নতন্ন করে খুঁজল। পেল না কিছুই। তার চেহারা কঠিন। বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত, মশিয়ে পাশা। তবে খামটা আপনাদের চোখে পড়ে গেলে, দয়া করে আমাকে পৌঁছে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব। আমি জানি আপনার মত গণ্যমান্য ব্যক্তির ওপর ভরসা রাখা চলে, কি বলেন?
রাশেদ পাশা কটমট করে তাকালেন ট্রুপার দিকে। খামটা আমরা পাইনি।
তীক্ষ হয়ে উঠল দুপার কণ্ঠ। আমি চাই না পুলিস ডেকে আপনার এবং আপনার ছেলেদের সার্চ করাই। চেয়ারের ওপর রাখা কিশোরের ব্রীফকেসের দিকে ইঙ্গিত করল সে। ওটাতে নেই তো?
রাশেদ পাশা বসে পড়েছিলেন, লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ন্যাপকিনটা টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, আমি জানি না তোমার খামে কি আছে। তবে মনে হচ্ছে ওটা পড়তে পারলে খুশিই হবে পুলিস। যাও, ডেকে নিয়ে এসো পুলিসকে। আমরা অপেক্ষা করছি।
ঘেৎ-ঘোৎ করে উঠল দুপা, বিড়বিড় করে কি যেন বলল। বোধহয় গোয়েন্দাদের মজা দেখাবে বা এ রকম কিছু। তারপর জুতোর গোড়ালিতে ভর করে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল। চলে গেল যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে।
এতে কি প্রমাণ হলো? রবিনের প্রশ্ন।
জ্যোতিষীর কাছে গেলে জবাব মিলতে পারে, ঠাট্টা করল কিশোর।
ব্যাপারটা অদ্ভুত, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন রাশেদ পাশা। আমার ধারণা দুপা বা সিম্বুকে নিয়ে আরও ঘটনা ঘটবে।
সিম্বু সম্পর্কে আর কি জানো, চাচা? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
আটলান্টা রাজ্যের অনেকেই জানে সিম্বুর কথা। গৃহযুদ্ধের আগে এই পুতুলটাকে নিয়ে একটা গুজব চালু হয়েছিল, রাশেদ পাশা বললেন। ধনী এক বুড়ো বাস করত এখনকার রূট থ্রী-এইটি রোডের ধারে, বিশাল এক বাড়িতে। আপনার বলে কেউ ছিল না বুড়োর। কালো চামড়ার এক চাকরকে নিয়ে থাকত বিশাল বাড়িতে। চাকরটাকে পছন্দ করত বুড়ো। চাকরটারও ছিল বুড়োর জন্যে জান-প্রাণ। ভুডু ম্যাজিকে বিশ্বাস করত চাকরটা। তার মালিককেও সে ভুডু চর্চায় উৎসাহিত করে তোলে। যা হোক, গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ইউনিয়ন আর্মি হামলা চালায় দক্ষিণ এবং পুবে। বুড়ো তার ধন-সম্পদের কি দশা হবে তা ভেবে খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়।
খুবই স্বাভাবিক, মুচকি হাসল কিশোর।
সোনার টাকা, মোহর-যা কিছু ছিল তার, সব গলিয়ে সোনার বার বানিয়ে মাটিতে পুঁতে রাখে বুড়ো। সে-সব পাহারা দেয়ার জন্যে ওগুলোর সঙ্গে রেখে দেয় একটা সিম্বু পুতুল। পুতুলটা বানিয়ে দিয়েছিল তার কালো-চাকর। ইউনিয়ন আর্মিকে ঠেকাতে পাথরের দেয়ালও তুলেছিল বুড়ো। কিন্তু ঠেকাতে পারেনি। সৈন্যরা বাড়িতে ঢুকে খুন করে বুড়ো আর তার চাকরকে। তবে যদ্দুর জানি, সোনা-দানার সন্ধান আজতক কেউ পায়নি।
দারুণ গল্প! রবিন বলল। সেই গুপ্তধনের খোঁজ করেনি কেউ?
করেছে নিশ্চয়। আমি জানি না, জবাব দিলেন রাশেদ পাশা। তবে কেউ ওগুলোর খোঁজ পেলে মূল্যবান সিম্বু পুতুলটাও পেয়ে যাবে।
তা পাবে, মুসা বলল। সেই সঙ্গে অভিশাপের শিকারও হওয়া লাগবে হয়তো।
নীরব হয়ে গেল চারজনেই। চুপচাপ খাওয়া শেষ করল।
তারপর এয়ারপোর্টে গেল তিন গোয়েন্দা, রাশেদ পাশাকে পৌঁছে দিতে। রাশেদ পাশা নিউ ইয়র্কে যাবেন বিশেষ কাজে।
যাবার পথে কেন যেন অস্বস্তি লাগতে লাগল কিশোরের। অদ্ভুত এক অনুভূতি। ট্যাক্সির রিয়ার ভিউ মিররে চোখ রেখে বলল, কেউ আমাদের পিছু নিয়েছে।
সামনের ট্রাফিক লাইটে দাঁড়াতেই চেনা গেল লোকটাকে। সাদা একটা মার্সিডিজ, কিশোরদের ট্যাক্সির প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়াল। এক চোখে সেই লোকটা।
হয়তো ভেবেছে তার খামটা মেরে দিয়েছি আমরা! নিচু স্বরে বলল রবিন।
মনে হয়, চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন রাশেদ পাশা। আমাদেরকে খুন করার ইচ্ছে থাকলেও অবাক হব না। সাবধানে থাকতে হবে। বিশেষ করে তোমাদের।…আগামী কদিন কি প্ল্যান তোদের, কিশোর? কি করবি ভাবছিস?
কোস্টের দিকে যাব। সৈকতে ঘুরে বেড়াব। দেখি, আরও কি কি করা যায়।
যা-ই করিস, সাবধানে থাকিস। বলা যায় না…
আর কয়েক মিনিটের মধ্যে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল ওরা। পিয়েরে ট্রুপার টিকিটিও দেখা গেল না আর আশেপাশে। চাচাকে প্লেনে তুলে দিয়ে আবার ট্যাক্সি নিল কিশোর। হোটেলে ফিরে এল তিন গোয়েন্দা। রাস্তার ওপারে দুপার গাড়িটা দেখতে পেল কিশোর।
লোকটা আসলে চায় কি? মুসার প্রশ্ন।
লোকটা বোধহয় ধরেই নিয়েছে আমরা তার খাম চুরি করেছি। তাই পিছু ছাড়ছে না, কিশোর বলল। লোকটার ওপর আমাদেরও নজর রাখতে হবে।
ট্যাক্সি ভাড়া চুকিয়ে হোটেলে ঢুকল ওরা। রূমে এসে ব্রীফকেসটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলা কিশোর। ওটার দিকে তাকাতেই চোখ স্থির হয়ে গেল রবিনের।
কিশোর! ব্রীফকেসের নিচে কি যেন লেগে আছে। চিৎকার করে উঠল সে। কি এটা?
একটা খাম। আটকে আছে ব্রীফকেসের তলায়।
আরি! কিশোরও অবাক। এটা এল কোত্থেকে!
খামটা খুলে নিল সে। বুঝতে পেরেছি। ব্রীফকেসের গায়ে কোন ভাবে লেগে গিয়েছিল চিবানো চিউয়িং গাম। তাতে আটকে গেছিল খামটা। চেয়ারেই পড়ে ছিল ওটা, মিথ্যে বলেনি দুপা। বড়ই কাকতালীয় ঘটনা। এবং অদ্ভুত।