ছোট, মোটাসোটা একটা পুতুলের নাম সিম্বু, রবিন বল। ভয়ঙ্কর চোখ জোড়া কোটর ঠেলে বেরিয়ে আছে বাইরে। এই যে, ছবিও আছে।
তার কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল কিশোর। সিম্বু দুহাত শূন্যে তুলে রেখেছে। প্রতিটি হতে দশটা করে আঙুল। পা জোড়া ফাঁক করা। পায়ে দশটা করে মোট বিশটা আঙুল। কোমরে চওড়া বেল্ট।
বাপরে, চেহারা বটে। মন্তব্য করল কিশোর। তা এই সিম্বুটা আসলে কে?
দুর্লভ একটা চরিত্র, ব্যাখ্যা করল রবিন। সিম্বু তার মনিবের ধনসম্পদ পাহারা দেয়। এ ধরনের পুতুল এখন পাওয়া যায় না বললেই চলে। সগ্রাহকদের কাছে খুবই মূল্যবান বস্তু। ইদানীং সিম্বুর আদলে বেশ কিছু মূর্তি তৈরি করা হয়েছে। তবে কোনটাই আসল সিম্বুর ধারে কাছে যেতে পারেনি। বইটা কিশোরকে দিল ও। নাও, তুমি পড়তে থাকো। আমি এই ফাঁকে গোসলটা সেরে আসি।
কিশোর বসল বই নিয়ে। মুসাকে পড়ে শোনাল, সিম্বুর কাজ হলো সব সময় তার প্রভুর পাশে থাকা, তাকে শয়তানের হাত থেকে রক্ষা করা। কেউ সিম্বুর ক্ষতি কিংবা সে যাকে পাহারা দেয় তার ক্ষতির চেষ্টা করলে, মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ছাড়ে।
একবার হাইতিতে দুটো সিম্বু পুতুল পাওয়া গিয়েছিল। মিউজিয়ামে বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল ওগুলো। তার পর থেকেই ঘটতে শুরু করল অঘটন। যারা ওগুলোকে খুঁজে পেয়েছিল, রহস্যময় ভাবে ভয়ঙ্কর মৃত্যু ঘটল তাদের। তাতেও অঘটন বন্ধ হলো না। মিউজিয়ামের পানির পাইপ বিস্ফোরিত হতে লাগল, হাতের ভারী আস্তর খসে পড়ে কাঁচের বাক্স চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে শেষে যেখান থেকে পুতুল দুটো আনা হয়েছিল, ফিরিয়ে দিয়ে এল মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ। অবশেষে বন্ধ হলো দুর্ঘটনা।
খানিক পরে মুসা আর রবিনকে নিয়ে হোটেলের লবিতে চলে এল কিশোর। রাশেদ পাশা ওখানেই আছেন। কিশোরের হাতে একটা ব্রীফকেস। ওতে তার কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রয়েছে।
তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলেন রাশেদ পাশা। রাস্তায় নেমে হাত তুলে ট্যাক্সি ডাকলেন।
সিলভার স্টারে যাব, জানালেন তিনি ড্রাইভারকে।
কি! চমকে উঠল কিশোর। কোথায় যাচ্ছি?
এই তো কাছের একটা রেস্টুরেন্টে, বললেন রাশেদ পাশা। তোদের পছন্দ হবে। সিলভার স্টারের সী-ফুডও চমৎকার।
তিন গোয়েন্দা আর কিছু না বলে চুপচাপ উঠে বসল ট্যাক্সিতে। রেস্টুরেন্টে ঢুকে কোণের দিকে একটা টেবিল দখল করল। বিকেলের ঘটনাটা চাচাকে জানাল কিশোর।
সাদা গাড়িতে চড়ে নীল চোখো লোক? আনমনা ভঙ্গিতে বললেন রাশেদ পাশা। এক চোখো। মনে হয় বুঝতে পারছি মহিলা কার কথা বলেছে।
কার কথা? অবাক হলো কিশোর।
লোকটার নাম পিয়েরে দুপা, বললেন রাশেদ পাশা। নষ্ট একটা চোখ ঢেকে রাখে সাদা কাপড়ের টুকরো দিয়ে। সাদা মার্সিডিজ চালায়। ঠাণ্ডা মাথার ভয়ঙ্কর এক খুনী।
খাইছে! বলে উঠল মুসা।
যখন পেশাদার গোয়েন্দা ছিলাম, দুপার সাথে বেশ কয়েকবার টক্কর লেগেছে আমার, রাশেদ পাশা বললেন। কিন্তু লোকটা বাইন মাছের মত পিচ্ছিল। ওকে ধরার জন্যে জাল গুটিয়ে এনেছি যতবার, ততবারই ও জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে। ওর বিরুদ্ধে ডাকাতির বহু অভিযোগ এনেছি, লাভ হয়নি। সব সময় ফস্কে গেছে। মহা ধুরন্ধর এক লোক। তার কাজে যে-ই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, পথের কাঁটা দূর করতে দ্বিধা করেনি কখনোই।
ওর বিশেষত্ব কি? জানতে চাইল কিশোর।
অ্যান্টিক চোর, জবাব দিলেন রাশেদ পাশা। বিবেক বর্জিত কিছু সগ্রাহকের কাছে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে, চড়া দামে। ধরা পড়ে যাবার ভয়ে অবশ্য ওসব সংগ্রাহক তাদের সংগ্রহের প্রদর্শনী করার সাহস পায় না কখনোই। কি এক সাংঘাতিক নেশায় যেন তবু কেনে ওরা।
মহিলা জ্যোতিষী সিম্বুর কথা বলেছিল, বলল কিশোর। আর সিম্বু হলো দামী অ্যান্টিক। সব খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে।
মাথা ঝাঁকালেন রাশেদ পাশা। তার কপালে ভাঁজ পড়ল। কিন্তু দুপা কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ। সিম্বুর অভিশাপ থেকে একশো হাত দূরে থাকার কথা তার। অবশ্য প্রচণ্ড লোভ তাকে কোন পর্যন্ত নিয়ে যাবে সেটা অনুমান করা কঠিন।
আঙ্কেল, জ্যোতিষী মহিলা যে সব ভবিষ্যদ্বাণী করল, সেগুলো কি বিশ্বাস হয় আপনার? জিজ্ঞেস করল মুসা।
শ্রাগ করলেন রাশেদ পাশা। কে জানে! হয়তো কিছু ঘটার আভাস পেয়েছে মহিলা। বাস্তব প্রমাণ। অভিশাপ, ভবিষ্যদ্বাণী-এ সব জিনিসে বিশ্বাস নেই আমার। তবে জগতে অব্যাখ্যাত বহু জিনিসই ঘটে। সব কিছুই হেসে উড়িয়ে দেবার উপায় নেই।
সিলভার স্টারে আসার পর থেকেই মনটা খচখচ করছে আমার, দীর্ঘশ্বাস ফেলল রবিন।
আমার ধারণা, কিশোর বলল, দুপা যতই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হোক না কেন, সিম্বুকে পাবার লোভ ছাড়তে পারবে না কিছুতেই।
কিশোরের কথা কানে গেল না রবিনের। সে কিশোরের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে আছে, চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছে বিস্ময়ে। রবিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল কিশোর। হাঁ হয়ে গেল মুখ।
ওই তো সেই লোক? ফিসফিস করল সে। নীল চোখো লোকটা!
রাশেদ পাশাকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে হলো না। দুপা নিজেই এগিয়ে এল তাদের টেবিলের দিকে। মশিয়ে পাশা, আপনাকে আবার দেখে খুব খুশি হলাম, তার গলার স্বর তেলতেলে, বিরস।
কিন্তু তোমাকে দেখে আমি খুশি হতে পারিনি, দুপা, বললেন রাশেদ পাশা। কি চাও?