তীরে দাঁড়িয়ে আগ্রহের সঙ্গে তাকিয়ে আছে কিশোর গোয়েন্দারা।
আরও দুই জোড়া চোখ এখন আড়াল থেকে তাকিয়ে আছে ফগের দিকে। সেই গালকাটা লোকটা। খুঁজতে খুঁজতে নদীর বাঁক ঘুরে বেরিয়ে এসে ফগের দিকে চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়িয়েছে। একটা ঝোঁপের আড়ালে সরে গিয়ে দেখছে, ফগ কি পায়। তার বোধহয় সন্দেহ হয়েছে, সে যা খুঁজছে, ওই পুলিসের লোকটাও তাই খুজছে।
লোকটা বাকের আড়ালে চলে আসাতে আর দেখতে পাচ্ছিল না বলে ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে দেখা যায় এমন আরেকটা ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়েছে কিশোর। ফাঁকে সেও দেখতে পাচ্ছে।
অনেকক্ষণ ধরে খোঁজাখুঁজি করেও আজেবাজে জিনিস ছাড়া কিছুই পেল না ফগ। নিরাশ হয়ে নৌকা নিয়ে তীরের দিকে রওনা দিল সে।
গালকাটা লোকটাও কিছু না পেয়ে চলে গেল।
ওর পিছু নিয়ে লাভ নেই। ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে কিশোর এসে দাঁড়াল মুসাদের কাছে।
নৌকা থেকে নেমে কিশোরকে দেখে রাগ আর সামলাতে পারল না ফগ। চাকরির মায়া কিংবা ক্যাপ্টেনের ভয় আর করল না। সারারাত ওকে ঠাণ্ডার মধ্যে বসিয়ে রেখে শাস্তি দিয়েছে শয়তানটা। ওকে খানিকটা শিক্ষা না দিলেই আর নয়। নৌকায় ফেলে রাখা লন্ড্রি ব্যাগটা তুলে এনে খপ করে চেপে ধরল কিশোরের কলার। তারপর ঠাণ্ডা ভেজা পোশাকগুলো ঠেসে ভরে দিতে লাগল ওর শার্টের ভেতর। তার মতে, ঠাণ্ডার মধ্যে এরচেয়ে বড় শাস্তি আর হয় না।
বাধা দিতে এল ওয়ালি, এ কি করছেন, মিস্টার ফগর্যাম্পারট! একজন পুলিসম্যান হয়ে
চোপরাও! গর্জে উঠল ফগ।
চুপ হয়ে গেল ওয়ালি।
মুসা আর রবিন এসে টানাটানি করে সরিয়ে আনার চেষ্টা করল ফাঁকে। কিন্তু ফগের গায়ে যেন অসুর ভর করেছে। ব্যাগের সমস্ত জিনিস কিশোরের শার্টের ভেতরে ভরে দেয়ার আগে কোনমতে সরানো গেল না ওকে।
প্রতিশোধ নিতে পেরে রাগ অনেকটা কমল তার। কোনদিকে আর না তাকিয়ে সাইকেলে চেপে চলে গেল।
এক এক করে শার্টের ভেতর থেকে জিনিসগুলো বের করতে লাগল কিশোর। ওকে সাহায্য করল ফারিহা। বিড়বিড় করে বকতে লাগল ফগকে।
থাক, বোকো না, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। অনেক যন্ত্রণা দিয়েছি আমি ওকে। এটা করে খানিকটা মনের ঝাল যদি মেটে, মিটুক। আমাকে এমন করে কেউ ভোগালে আমিও শোধ নিতে ছাড়তাম না।
পানি থেকে তুলে আনা কাপড়গুলোর মধ্যে রয়েছে একটা নীল পাজামা, একটা লাল বেল্ট, একটা নীল টাই, লাল বোতাম বসানো একটা নীল ক্যাপ, একজোড়া মোজা, একজোড়া লাল জুতো, আর একটা লাল
থমকে গেল ফারিহা। জিনিসটা পরিচিত মনে হচ্ছে। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, কিশোর, দেখো দেখো!
দেখল কিশোর। ওরও চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
একটা লাল দস্তানা!
ভালমত দেখার জন্যে ঘিরে এল মুসা আর রবিন। ওরাও চিনতে পারল। হবারের বাড়িতে যে দস্তানাটা পেয়েছিল কিশোর, অবিকল ওরকম আরেকটা। জোড়াটার দ্বিতীয়টা।
হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে গেল কিশোরের মুখ। ফগের ওপর রাগ না করে বরং আমাদের কৃতজ্ঞ হয়ে যাওয়া উচিত। আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে যে কতবড় সূত্র ফেলে চলে গেল, যখন জানতে পারবে, নিজের হাত নিজেই কামড়ে খেয়ে ফেলবে!
এই সময় খেয়াল হলো ওর, টিটু নেই আশেপাশে। উত্তেজনায় কারোরই মনে ছিল না ওর কথা।
মুসা বলল, সেজন্যেই তো বলি, এত নিরাপদে কাজটা সারতে পারল কি করে ঝামেলা! টিটুই নেই। আহা বেচারা, গোড়ালি কামড়ানোর এমন মস্তবড় একটা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো ও। আজ ও ঠিক কামড়ে দিতে পারত। বাধা দিত না তো কেউ…।
কিন্তু ও গেল কোথায়? উদ্বিগ্ন হলো ফারিহা।
এতক্ষণে যেন সংবিত ফিরে পেল ওয়ালি। সকালে ও আজ ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই নানা রকম কাণ্ড ঘটছে। অবাক হতে হচ্ছে বার বার। খানিক আগে ফগের রেগে যাওয়াটা তো রীতিমত বিমূঢ় করে দিয়েছে। ফারিহার প্রশ্নের জবাবে বলল, নিশ্চয় আমার টেরিয়ারটার সঙ্গে মাঠে চলে গেছে। মাঝেমধ্যেই খরগোশ ধরতে যায়। আজ সঙ্গী পেয়ে খুশির ঠেলায় বোধহয় শিকার শেখাতে নিয়ে গেছে তোমাদের কুকুরটাকেও। ভয় নেই, চলে আসবে।
.
১২.
দল বেঁধে কিশোরদের বাড়িতে ফিরে এল সবাই। কিশোরের ঘরে বসে কথা বলতে লাগল।
কিশোরের ধারণা, পুতুলের কাপড়গুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে রহস্যের চাবিকাঠি। অতএব সেগুলো ভালমত খুঁজে দেখা দরকার।
দুপুর হয়ে গেছে। মুসাদের বাড়ি থেকে ফোন করলেন মিসেস আমান। রবিনের মাও খোঁজ নিলেন। অসুস্থ ছেলেরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে সেই সকালে, এখনও ফেরার নাম নেই। দুজনেই অস্থির হয়ে উঠেছেন। মিসেস বারজি এসে প্রায় ধমকের সুরে জানিয়ে গেল সেকথা।
যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াল ফারিহা। বিরক্ত হয়ে বলল, দূর, ফোন করার আর সময় পেল না। যখন আসল কাজটা শুরু করতে যাব তখনই…কিশোর, কথা দাও, আমরা না এলে দেখার কাজটা তুমি শুরু করবে না?
হাসল কিশোর, আচ্ছা, করব না। নিশ্চিন্তে চলে যাও। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে চলে এসো।
কিন্তু মুসারা বেরিয়ে যাওয়ার কয়েক মিনিট পরেই ঝমঝম করে নামল বৃষ্টি। কিছুক্ষণ পর কমল, তবে একেবারে বন্ধ হলো না। কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি, কখনও ঝমঝম করে, পড়তেই থাকল।
আর কোন কাজ না পেয়ে পুতুলের পোশাকগুলো ইলেকট্রিক হিটারে শুকাতে বসল কিশোর। পরীক্ষা করে দেখার জন্যে উতলা হয়ে উঠেছে মন! কিন্তু ফারিহাকে কথা দিয়েছে দেখবে না, তাই দেখল না।