- বইয়ের নামঃ ৩০০১ : দ্য ফাইনাল ওডিসি
- লেখকের নামঃ আর্থার সি ক্লার্ক
- প্রকাশনাঃ বুক ক্লাব
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
৩০০১ : দ্য ফাইনাল ওডিসি
ক. নক্ষত্র নগরী
৩০০১ : দ্য ফাইনাল ওডিসি – আর্থার সি ক্লাক / অনুবাদ : মাকসুদুজ্জামান খান / প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০৭
অনুবাদকের উৎসর্গ
ডক্টর মুহাম্মদ রহমতউল্লাহ
ছাত্ররা তাকে কত ভয় পায় তা ডিন স্যার জানেন,
কত শ্রদ্ধা করে আর ভালবাসে তা হয়ত তিনি জানেন না।
লেখকের কথা
২০১০ : ওডিসি টু যেমন ২০০১: আ স্পেস ওডিসি’র সরাসরি সিকুয়্যাল নয় তেমনি ২০৬১ : ওডিসি থ্রি ও দ্বিতীয়টার সরাসরি ঝাণ্ডাবাহী নয়। বরং এই সবগুলোকে একই থিমের উপর বিস্তৃতি ধরা যায়, আর সেই অর্থে, সময়কে মাপকাঠি ধরে সিকুয়্যাল বলা যায়। কিংবা, সরলতার জন্য একই নাম ও চরিত্র ঘটনা থাকা সত্ত্বেও যেন একই ঘটনা নয়, বরং সমান্তরাল চলতে থাকা বিভিন্ন ইউনিভার্সে একই ধারার ঘটনা।
মানুষের চাঁদে পা রাখার বছর পাঁচেক আগে, ১৯৬৪ সালে যখন স্ট্যানলি কুবরিক প্রস্তাব রাখলেন, সত্যিকার ভাল সায়েন্স ফিকশন মুভি বানাবেন, তখন ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না। কিন্তু তারপর, এ ধারণায় আগের দুটি বই বিজ্ঞানে সরাসরি অনেক প্রভাব ফেলল, ফলে বলা চলে সেগুলো সার্থক সায়েন্স ফিকশন।
২০১০ লিখতে উৎসাহী হই ১৯৭৯ সালের সফল ভয়েজার অভিযানের পর। কিন্তু বৃহস্পতিয় অঞ্চলে ভয়েজারের অভিযানের পর আরো উচ্চাকাক্ষী অভিযান গ্যালিলিও পাঠানো হয়।
আশায় বুক বেঁধেছিলাম গ্যালিলিওকে নিয়ে, সে যাবে, বৃহস্পতির বাতাবরণে একটা প্রোব ছুঁড়ে দেবে, দু বছর খুঁটিয়ে দেখবে বৃহস্পতীয় উপগ্ৰহজগৎ। এর উৎক্ষিপ্ত হবার কথা ছিয়াশির মে মাসে। ডিসেম্বর আটাশিতে লক্ষ্যে যাবার কথা এবং উনিশশো নব্বইতে নূতন বাণীর স্রোতে ভেসে যাবার কথা আমার।
হায়, চ্যালেঞ্জটা পিছিয়ে গেল, জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরিতে গ্যালিলিও তার ক্লিন রুমে অপেক্ষার প্রহর গুণছে। আরেকটা লঞ্চ ভেহিকলের আশায় তার বসে থাকা। হয়তো নির্ধারিত সময়ের সাত বছর পর সেটা ঠিকই জায়গামতো পৌঁছবে, তদ্দিন আমার ধৈর্য থাকলেই হল।
গ্যালিলিওকে নিয়ে তৃতীয় স্বপ্ন দানা বেঁধেছিল, সেটায় চিড় ধরার আগেই আমি অপেক্ষা বন্ধ করে কলম হাতে নিলাম।
কলম্বো, শ্রীলঙ্কা,
এপ্রিল, ১৯৮৭
শুরুর কথা : ক্ষণজন্মা
ডাকুন তাদের প্রথম-জন্মা নামে। ঠিক মানুষ নয় তারা। রক্ত-মাংসের নশ্বর দেহধারী। মহাকাশের গহিনে চোখ যায়, অনুভব করে তারা কী এক অনির্বচনীয় একাকিত্ব; কী এক অস্থিরতা গ্রাস করে নেয় সমস্ত দেহ-মন-প্রাণ! হতবিহ্বলতায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তারপর–ক্ষমতা এল। অনন্ত নক্ষত্রবীথিতে সঙ্গীর খোঁজে আতিপাতি করে ফেলল নক্ষত্রলোক।
এবার চলার পালা। কত রূপ নিয়ে যে রূপোপজীবী মহাকাশ মাতা প্রাণের দেখা মিলিয়ে দিলেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সহস্র বিশ্বে বিবর্তনের অচিন্তনীয় সব পথের দেখা মিলল। মহাকাশের মহারাত্রির বুকে কী করে জীবনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে, কী করে হারিয়ে যায় বিশালতার বুকে, দেখল তারা।
আর, যেহেতু অযুত পৃথিবীর বুকে, নিযুত ছায়াপথের আলো আধারিতে মনের চেয়ে দামি আর কিছুর সন্ধান পাওয়া গেল না- এই মনের জন্মের পথেই অবদান রাখল। সর্বত্র তারার ভূমিতে চাষি তারা, বুনে চলল মনের বীজ, কখনো কখনো ফসলের কুঁড়ি মুখ তুলল।
কোথাও কোথাও দেখা দিল আগাছা।
বিশালদেহী ডায়নোসরেরা অনেক আগেই ডুবে গেছে কালের অতলে। হাজার বছরের পথপরিক্রমা শেষে এল তারা। এল এখানে। বাইরের জমাট গ্রহগুলোর উপর দিয়ে। মঙ্গলের মরতে বসা মরুভূমির উপর চোখ ফেলল। দৃষ্টি দিল ঠিক এখানটায়। যে জায়গার নাম- পৃথিবী।
নিচে নেমে এল দর্শনার্থীরা। ছড়িয়ে পড়ল। দেখল, প্রাণের মহাসাগর বয়ে চলেছে মৃদুমন্দ ঊর্মিমালা বুকে করে। বছরের পর বছর ধরে সংগ্রহ চলল। চলল হিসাব নিকাশের পালা, গবেষণা। জানার সবটুকু জেনে নেয়া শেষ। এবার হাত দেয়ার পালা। সৃষ্টির উপর হাত রাখার সময় এসেছে। সমুদ্রের বুকে, ভূমির উর্বরতায় এবার অনেক প্রজাতিকে পথ দেখাতে হবে। কিন্তু এ চেষ্টার কোন কোনটা সফল হবে আর কোন কোনটা একেবারে আস্তাকুড়ে পড়ে থাকবে তা জানতে হলে করতে হবে অপেক্ষা; লক্ষ লক্ষ বছরের অপেক্ষা।
ধৈর্য আছে তাদের, কিন্তু এখনো অমরত্ব আসেনি। অনেক কাজ বাকি। শত বিলিয়ন সূর্যের বুকে আরো সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা বাকি। ডাকছে। ডাকছে মহাকাশের বুকে লুকিয়ে থাকা আলোর উৎসরা।
পাল তোলার সময় এসেছে। আর কখনো পিছনে ফিরে আসা যাবে না, জানে তারা। যত্ন করে বোনা ফসলের কাছে ফিরে আসা যাবে না। আসার প্রয়োজনও নেই, পিছনে ফেলে আসা ভূত্যেরা বাকি কাজটুকু করে ফেলবে।
পৃথিবীর বুকে জমাট বাধানো হিমবাহেরা নেমে এল নিষ্ঠুরের মতো। ঝেড়ে মুছে সাফ করে দিল হাজার হাজার প্রজাতিকে। তারপর, অনেক অনেক দিন রাজত্ব করার পর চলেও গেল। কিন্তু এসবের উপরে শান্তভাবে চোখ রাখছে পরিবর্তনহীন চাঁদের বুকে লুকিয়ে থাকা এক অস্তিত্ব। বরফের রাজত্বের চেয়েও অনেক ধীর গতিতে গ্যালাক্সি জুড়ে নেমে এল জীবনের জয়গান। সভ্যতার জলস্রোত। অদ্ভুত, সুন্দর, ভয়ানক সব সাম্রাজ্যের উত্থান দেখা গেল, দেখা যায় তাদের পতনও। পুরনোরা তাদের স্মৃতি আর সাফল্য বয়ে নিয়ে গেল নতুনদের কাছে।
আর এখন, বাইরে, তারায় তারায়, বিবর্তন একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে হাটি হাটি পা পা করে। যারা এসেছিল, পরিবর্তনহচ্ছে তাদের মধ্যেও। শরীরগুলো নশ্বর। ধ্বসে যায় খুব সহজেই। যন্ত্রগুলো তার চেয়ে অনেক ভাল। পরিবর্তন আনতে হবে। যন্ত্রের গায়ে আশ্রয় নিল মস্তিষ্কগুলো। তাতে বেড়ে গেল জীবনকাল, বেড়ে গেল চিন্তার ক্ষমতা, কাজের ক্ষমতা, হিসাবের ক্ষমতা। কিন্তু পরিবর্তন চলবেই। এ ব্যবস্থাও খুব বেশি স্থায়ী নয়। এরপর আর ব্রেইন জায়গা করে নিচ্ছে না যন্ত্রের গায়ে। জায়গা করে নিচ্ছে শুধু ভাবনাগুলো। ধাতু আর দামি পাথরের খোলসই এখন তারা। এ রূপ নিয়ে নিহারিকা থেকে নিহারিকায়, পথ থেকে পথে ছুটে গেল।
এখন আর তারা স্পেসশিপ বানায় না। তারাই মহাকাশতরণী।
কিন্তু যন্ত্র-জীবদের সময় পেরিয়ে গেল খুব দ্রুত। জ্ঞান আহরণের বিরামহীন পথপরিক্রমায় তারা শিখল। শিখল আরো বিচিত্র সব ব্যাপার। শিখল কী করে স্পেসের গায়ে জমা করা যায় জ্ঞান। আলোর জমাট আকৃতিতে তাদের অস্তিত্বকে কী করে স্থান দেয়া যায় তা শিখল।
আর তাই, খাঁটি শক্তিতে রূপান্তরিত করে নিল নিজেদেরকে। হাজার হাজার পৃথিবীতে তাদের ফেলে আসা খোলস ভেসে বেড়াল। পরিত্যক্ত হয়ে রইল অনেক কাল ধরে। মৃত্যু তুর্কি নাচন নাচল তাদের ঘিরে ধরে। তারপর মহাকালই সেগুলোকে ধূলিকণায় পরিণত করে নিষ্ঠুর হাতের ছোঁয়ায়।
এখন, তারা তারার দেশের ভাগ্যবিধাতা। সূর্যের বক্ষভেদ করতে জানে, জানে মহাকাশের মহাস্রোতের ভিতরে তলিয়ে যেতে। অনেক বদল এসেছে, এসেছে অচিন্তনীয় সব পরিবর্তন, কিন্তু আজো সেই সাগরের বুক থেকে চরম বিস্ময়ে চোখ মেলার মুহূর্তের কথা ভুলতে পারে না। আজ আর নেই সে মহাসাগর, নেই সেখানকার উষ্ণতা। কালের অতল গর্ভে তলিয়ে গেছে সেই কবে। কিন্তু অনেক আগে স্থাপন করা তাদের সেসব অসাধারণ সৃষ্টি এখনো বিকল হয়ে যায়নি। এখনো কর্মক্ষমতা ফুরিয়ে যায়নি সেসবের।
হ্যাঁ, মহাকাল থাবা বসিয়েছে। অনেকগুলোই ক্ষয়ে যাচ্ছে।
তার পরও, মাঝে মাঝে, পথ দেখায় সেসব। পথ দেখায় অচেনা মহাকাশে।
ক. নক্ষত্র নগরী
১. ধূমকেতুর রাখাল ছেলে
ক্যাপ্টেন দিমিত্রি চ্যান্ডলার [এম ২৯৭৩.০৪.২১/ ৯৩.১০৬// মঙ্গল// স্পেস এ্যাকাড ৩০০৫] সবচে কাছের বন্ধুদের কাছে “দিম”। বিরক্ত সে। স্পষ্ট বোঝা যায়, চরম বিরক্ত। কারণও আছে। পৃথিবী থেকে মেসেজটা স্পেসটাগ গোলিয়াথ এ আসতে সময় নিয়েছে পুরোদস্তুর ছটা ঘন্টা। গোলিয়াথ এখন নেপচুনের কক্ষপথ ছেড়ে চলে এসেছে। আর মাত্র দশটা মিনিট পরে এলেই কর্ম সারা হয়ে যেত। জবাব দিত সে, স্যরি, এখন আর সম্ভব নয়। আমরা এইমাত্র সানস্ক্রিন ডিপ্লয় করেছি।’
কাজটী মোটেও খারাপ হত না। একটা আগাপাশতলায় পরিপূর্ণ এবড়োথেবড়ো ধূমকেতুকে মাত্র কয়েক অণু পুরু কিন্তু কয়েক কিলোমিটার লম্বা পর্দা দিয়ে পুরোপুরি জড়িয়ে দেয়ার কাজ আধাআধি করা অবস্থায় ছেড়ে দেয়াটা ছেলেখেলা নয়।
এখনো এই বিদঘুঁটে অনুবোধ মেনে চললে আখেরে ভালই হবে। এখন সে সূর্যের অন্যদিকে, পৃথিবী আরেকদিকে। শনির বলয় থেকে বরফ তুলে আনা আর এটাকে শুক্রের দিকে নিয়ে যাবার কাজ শুরু হয় সেই দু হাজার সাতশ সালের দিকে। তিনশ বছর আগের কথা। ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলারের চোখে সেই অতীত আর বর্তমানের মধ্যে তেমন কোনো ফারাক ধরা পড়ে না। সেই সে সময় থেকেই সূর্যের হাত থেকে রক্ষার কাজে সোলার কনসার্ভার ব্যবহার করা হয়। সাধারণ মানুষ এখনো বেঁকে বসে। গত কয়েক শতকের বাস্তুতান্ত্রিক ধ্বংসযজ্ঞের কথা ভুলতে পারে না কিছুতেই। ‘শনি থেকে হাত গুটিয়ে নাও’ ভোটে তারা জিতে যায় স্পষ্ট ব্যবধানে। তাই আজ আর চ্যান্ডলার কোনো রিং রাসলার নয়, বরং এখন সে ধূমকেতুর রাখাল ছেলে।
আলফা সেন্টাউরি থেকে তারা অনেক দূরে, কুইপার বেল্ট অভিশাপ ঝাড়তে পারবে না। এখানে অনেক বরফ আছে, শুক্রকে সাগরে পরিণত করার চেষ্টাও করা যায়। কিন্তু সেখানকার আগুনকে নিভিয়ে দিয়ে প্রাণের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করার স্বপ্ন এখনো সুদূর পরাহত। কথা সত্যি সোলার কনসার্ভারগুলো সে জায়গাকে সূর্যের দোর্দন্ড প্রতাপ থেকে সরিয়ে রাখার কাজ করছে। দু হাজার তিনশো চার সালের উল্কাপাতে ঘটা সুনামির জন্য মারা গেছে লাখো লোক- অথচ কী আফসোসের কথা, একটা ল্যান্ড ইম্প্যাক্ট থাকলে তেমন কোনো সমস্যাই হত না। পুরো মানবজাতিকে জানিয়ে দিয়েছে ঘটনাটা মানুষ আসলে একটা ভর ঝুড়ির মধ্যে অনেক বেশি ডিম রাখার ঝুঁকি নিচ্ছে।
যাক, চ্যান্ডলার নিজেকেই শোনায়, এই প্যাকেজটা জায়গামত পৌঁছতে পৌঁছতে বছর পঞ্চাশেক লেগে যাবে, তাই একটা সপ্তাহের হেরফেরে তেমন কোনো কিছু আসে যায় না। কিন্তু ঘূর্ণনের সমস্ত হিসাব নিকাশ, র আর কেন্দ্রের গাণিতিকতা, থ্রাস্ট ভেক্টর আবার বের করতে হবে। মঙ্গলে ফেরৎ পাঠাতে হবে সমস্ত হিসাব, যেন রিচেক করা যায়। মিলিয়ন টনের বরফকে পাঠানোর আগে হিসাবটা কয়েকবার করে নিলে ভালই হয়, ভুল হলেই উটকো সমস্যা হাজির হবে।
আগেও অনেকবার দেখেছে, ডেস্কের উপরে থাকা ছবিটাকে এখনো দেখছে চ্যান্ডলারের চোখজোড়া। তিন মাস্তুলের একটা বাস্পপোত। জাহাজটার উপর ঝুঁকে আছে হিমবাহ। ঠিক একই অবস্থা এখন গোলিয়াথের। বিশ্বাসই হতে চায় না তার, এই শিপটার নামও ছিল ডিসকভারি তখন শিপগুলো সমুদ্রে চলত বাষ্প ইঞ্জিনে, আর একটা মানুষের জীবনকাল ফুরিয়ে যাবার আগেই একই নামে এই মানবজাতি বৃহস্পতির দিকে স্পেসশিপ পাঠিয়ে দিয়েছিল। শিপটার ব্রিজ থেকে দক্ষিণ মেরুর অভিযাত্রীরা কী ভেবে বাইরে তাকাত তা এখনো সে ভেবে পায় না।
এই এখানে, দিগন্ত বিস্তৃত বরফের মধ্যে মাত্র নব্বই ভাগ বিশুদ্ধ পানির বরফ আর বাকিটা কার্বন-সালফারের যৌগ। লোকে শুধু শুধু বলত না আগের দিনে, ‘ধূমকেতুতে খারাপ বাতাস ভর করে। এখানে আছে খারাপ ধরনের বিস্ফোরক সব গ্যাস। বিপজ্জনকভাবে জমা হয়ে থাকে। কোনটায় কতটুকু ঝুঁকি আগে থেকে বোঝ যায় না।
স্কিপার টু অল পার্সোনেল, ঘোষণা করল চ্যান্ডলার, প্রোগ্রামে সামান্য রদবদল হয়েছে। আমাদের অপারেশনে একটু এদিক সেদিক হবে। আপাতত বন্ধ থাকবে। কারণ একটা টার্গেটের ব্যাপারে স্পেসগার্ড রাডারের কিছু বলার আছে।
‘বিস্তারিত জানা যায় কিছু?’ শিপের ইন্টারকমের গুঞ্জন কমে এলে একজন প্রশ্ন তুলল।
খুব বেশি কিছু না। জানতে পারলাম এটাও মিলেনিয়াম কমিটির কারসাজি।
আরো গুঞ্জন উঠল। সবাই দু হাজারের সময়টাকে বিদায় দেয়ার জন্য উদগ্রীব ছিল। তিন হাজার সালের পহেলা জানুয়ারি কোনো রকম অঘটন ছাড়াই পেরিয়ে যাবার পর সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। মানবজাতি স্বাভাবিক কাজে ফিরে এসেছিল আরেকবার।
‘এনিওয়ে, গতবারের মতো এটাও আরেক ফলস এ্যালার্ম হতে পারে। যত দ্রুত সম্ভব কাজে নেমে পড়ব আমরা। স্কিপার আউট।’
চ্যান্ডলার ভাবে, ক্যারিয়ারে এটা তৃতীয়বারের মতো আলেয়ার পিছনে ছোটা। কত শতাব্দি ধরে সৌরজগতকে চষে ফেলছে মানুষ, তার পরও বিস্ময় দেখা দেয়। স্পেসগার্ডের অনুরোধের জোরালো কারণ থাকে সব সময়। মনে মনে একটাই আশা জাগছে, কোনো কল্পনাবিলাসি বোকার হদ্দ সেই বহুচর্চিত ‘সোনালি গ্রহাণুপুঞ্জ দেখেনিতো! যদি সত্যি সত্যি স্বর্ণালি এ্যাস্টেরয়েডের অস্তিত্ব থাকে–যা চ্যান্ডলার বিশ্বাস করতে চায় না এ মুহূর্তে–তাতে আহামরি কোনো লাভ হয়ে যাবে না। তাল তাল সোনা দিয়ে মানুষ কচুটা করবে। বরং এর চেয়ে অনেক মূল্যবান এই পানির বরফ; একটা খালি অঞ্চলকে প্রাণবন্ত করে তুলতে পারে এটা।
এসবে খুব বেশি কিছু এসে যায় না। এর মধ্যেই মানুষ তাদের রোবট পোব পাঠিয়ে দিয়েছে একশ আলোকবর্ষ দূরে, চতুর্দিকে। টাইকো মনোলিথ আগেই জানিয়ে দিয়েছে যে উন্নততর বা আগে জন্মানো সভ্য প্রাণিরা আগেই সে কাজটা করেছিল। সৌরজগতে অন্য সভ্যতার নিদর্শন এখনো থাকতে পারে যেগুলোর নাগাল পায়নি মানুষ। এর ভিতর দিয়ে যেতে থাকতেও পারে। ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলারের মনে ক্ষীণ সন্দেহ, স্পেসগার্ড তেমন কিছুই ধারণ করে। তা না হলে একটা প্রথম শ্ৰেণীর স্পেসটাগকে তার কাজ ফেলে রেখে রাডারে ধরা পড়া অচিহ্নিত গতিশীল বম্ভর পিছু ধাওয়া করতে বলত না।
ঘন্টা পাঁচেক পর গোলিয়াথ সত্যি সত্যি একটা সিগন্যাল ধরতে পারল। অত্যন্ত শক্তিমান সিগন্যালসময়ের সাথে সাথে আরো তীব্র হচ্ছে। কিন্তু সেই সাথে একটু হতাশার ভাব দেখা দেয়। না, জিনিসটা যাই হোক, খুব ছোট। এবং ধাত। মাত্র মিটার দুয়েক লম্বা। এর অর্বিট দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, গন্তব্য এ সৌর জগতের কোথাও নয়, বাইরে কোথাও।
চ্যান্ডলারের মনে একটা সন্দেহ দেখা দেয়, এটা গত সহস্রাব্দে মহাকাশে মানুষের পাঠানো জিনিসগুলোর কোনো ধ্বংসাবশেষ নয়ত।
এরপর, ভিজুয়াল ইন্সপেক্টরের কল্যাণে কাছে এগিয়ে এল সেটা। বিস্মিত ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার ঠিক ঠিক বুঝতে পারে, এ মূহুর্তে পৃথিবীতে এবং মানুষের অন্যান্য কলোনিতে মহাকাশ ইতিহাসবিদরা আতিপাতি করে মহাকাশ যুগের প্রথম দিকের রেকর্ডগুলো খুঁজে দেখছে। কোনো সন্দেহ নেই।
শিহরণ বয়ে যায় তার শরীরে।
‘গোলিয়াথ থেকে বলছি,’ পৃথিবীর উদ্দেশ্যে গর্ব আর স্থিতার সুরে বলে চলে সে, ‘আমরা হাজার বছরের পুরনো এক এ্যাস্ট্রোনটকে তুলে আনছি। সহজেই অনুমান করতে পারি কে তিনি’
২. কে জানিত আসবে তুমি গো, অনাহুতের মতো
জেগে উঠল ফ্র্যাঙ্ক পোল। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারল না সে। এমনকি নিশ্চিত হতে পারল না নিজের নাম সম্পর্কেও।
অবশ্যই, এ এক হসপিটাল রুম। চোখ বন্ধ, তাতে কী, স্পষ্ট বোঝা যায়, প্রাচীনতম অনুভূতি তাকে বলে দেয়, এখন সে একটা হাসপাতালেই শুয়ে আছে। কেন যেন মনে পড়ছে না কী হয়েছে… তারপর হঠাৎই পুরোটা বুঝে ফেলল সে। অবশ্যই!- এ্যারিজোনার হ্যাঁঙ গ্লাইডিং চ্যাম্পিয়নশিপের সময় ঘটেছিল এ অঘটনটা।
এবার আস্তে আস্তে পুরোটা ফিরে আসছে মনে। আমি ডেপুটি কমান্ডার ফ্র্যাঙ্ক পোল, এক্সিকিউটিভ অফিসার, ইউ এস এস এস ডিসকভারি, বৃহস্পতির পথে একটা টপ সিক্রেট মিশনে আছি
যেন কোনো বরফ শীতল হাত চেপে রেখেছে তার হৃদপিন্ড। আস্তে আস্তে, স্লো। মোশন প্লেব্যাকের মতো করে সব কথা মনে আসতে থাকে… সরে যাওয়া স্পেস পোডট তেড়ে আসছে তার দিকে, ধাতব নম্বরগুলো সামনে বাড়ানো… তারপর নিরবতা, আর সেই নিরবতায় চিড় ধরে যায় স্পেস স্যুটের বাতাস বাইরে বেরিয়ে যাবার সাথে সাথে। তারপর শুধু একটা স্মৃতি, মহাশূন্যে অসহায়ভাবে ডিগবাজি খেতে খেতে ভেসে যাওয়া, ভেঙে যাওয়া এয়ার হোসটাকে আবার লাগিয়ে দেয়ার অর্থহীন চেষ্টা…
স্পেসগোড কন্ট্রোলের যে সমস্যাই হয়ে থাক না কেন, সে এখন নিরাপদে আছে। সম্ভবত ডেভ সময় মতো ই ভি এ ঠিক করেছিল, তাকে তুলে এনেছিল স্পেস থেকে, কোনো বড় ক্ষতি হয়ে যাবার আগেই।
ভাল মানুষ ডেভ। নিজেকে শোনায় সে। আমার ভাবতেই হবে- এক মিনিট। আমি নিশ্চয়ই এখন আর ডিসকভারিতে নেই। নিশ্চয়ই পৃথিবীতে ফিরে যাবার মতো লম্বা সময় জুড়ে অজ্ঞান ছিলাম না।
তার কল্পনার লাগাম ছাড়া ঘোড়া থেমে গেল ম্যাট্রন আর দুজন নার্স আসার সাথে সাথে। তাদের পরনে সেই পুরনো ইউনিফর্ম। সাদা। তারা যেন অবাক হয়ে গেছে। তাহলে কি ফ্র্যাঙ্ক পোল আগেভাগেই জেগে গেল। ভাবনাটা তাকে একটু আমোদিত করে।
‘হ্যালো!’ অনেক চেষ্টা কসরৎ করে বলে ফেলে সে, ভোকাল কর্ডের কী সমস্যা হল কে জানে! “আমার খবর কী?
ম্যাট্রন সুন্দর একটা হাসি দিল। তারপর মেয়েটা নিজের ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে ইশারায় জানাল, খবরদার, কথা বলার চেষ্টা করোনা।
এরপরই নার্স দুজন তাদের পেশাদারি দক্ষতার সাথে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সব চেক করে দেখা শুরু করে। পালস, তাপমাত্রা আর রিফ্লেক্স খতিয়ে দেখে। একজন তার হাতটাকে তুলে ধরে আবার ছেড়ে দিল, পোল টের পেল যে কিম্ভূত কিছু একটা ঘটছে। খুব আস্তে আস্তে পড়ে গেল হাতটা, পৃথিবীর বুকে হলে সেটার ধপাস করে পড়ে যাবার কথা ছিল। নড়ার চেষ্টা করে বাকিটা বুঝে নিল সে।
আমি অবশ্যই কোনো না কোনো গ্রহে বা কৃত্রিম মহাকাশ স্টেশনে আছি যেখানকার গ্র্যাভিটি পৃথিবীর চেয়ে কম।
প্রশ্ন করবে এমন সময় ম্যাট্রন তার গলায় কিছু একটা চেপে দিল। স্বপ্নহীন। ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল সে। অজ্ঞান হয়ে যাবার আগে একটা অন্য চিন্তা মাথায় ঢুকতে পারল কোনোমতে।
কী অবাক ব্যাপার- এতক্ষণ আমার সাথে থাকার সময় তারা একটা কথাও বলল না কেন?
৩. আদ্যিকালের মানুষ
আবার জেগে ওঠার পর দেখল ম্যাট্রন আর নার্স দুজন দাঁড়িয়ে আছে বিছানার পাশে। কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নিল পোল।
‘কোথায় আমি? তোমরা নিশ্চয়ই বলতে পারবে!’
নময় করল। যেন জানে না কী বলতে হবে। এরপর খুব ধীরে ধীরে মুখ খুলল ম্যাট্রন, আলতো করে তুলে আনল শব্দগুলো ধীরলয়ে, সব ঠিক আছে, মিস্টার পোল। প্রফেসর এ্যান্ডারসন এক মিনিটের মধ্যে হাজির হবে এখানে… ব্যাখ্যাটা সেই করবে।
কী ব্যাখ্যা করবে? ভেবে পায় না পোল। যাক, মেয়েটা অন্তত ইংরেজি বলতে পারে, যদিও তার উচ্চারণের আগামাথা ধরতে পারছি না কিছুই…
এ্যান্ডারসন নিশ্চয়ই এগিয়ে আসছে, না হলে দরজা খুলে যাবে কেন! কিন্তু দরজার অন্য প্রান্তে তাকিয়েই শিউরে উঠল পোল। নিজেকে খাঁচায় আটকানো জম্ভ বলে মনে হল। বাইরে থেকে অনেকেই চেয়ে আছে তার দিকে।
প্রফেসর এ্যান্ডারসন বেটেখাটো এক লোক। প্রথম নজরে মনে হতে পারে তার পূর্বপুরুষরা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে- চাইনিজ, পলিনেশিয়ান, নরডিক কোনোটাই পুরোপুরি নয়। ডান হাতের তালুটা তুলে নিল লোকট, হ্যান্ডশেক করল।
‘আপনাকে একটু সুস্থ দেখাচ্ছে দেখে ভাল লাগছে, মিস্টার পোল… দ্রুত আপনাকে উপরে নিয়ে যাব।’
আবারো দ্বিধায় ফেলে দেয়া উচ্চারণ, কোন দেশের কে জানে! কিন্তু সেই কণ্ঠের আড়ালে লুকিয়ে আছে দৃঢ়তা। সব যুগে চিকিৎসকরা যে নিশ্চয়তার সুরে কথা বলে সে সুরের খোঁজ পাওয়া যায়।
কথাটা শুনে ভাল লাগল, কিন্তু আপনি যদি দয়া করে কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দেন তো…’
‘অবশ্যই। অবশ্যই। কিন্তু আমাকে একটু সময় দিতে হবে। এক মিনিট।’
এ্যান্ডারসন নিচু স্বরে খুব দ্রুত কথা বলল ম্যাট্রনের সাথে। মাত্র কয়েকটা শব্দ
চিনতে পারল সে। অনেকগুলোর কোনো মানেই পেল না। এরপর ম্যাট্রন নড করল নার্সদের দিকে ফিরে। সাথে সাথে তারা একটা ওয়াল কাপবোর্ড তৈরি করে নিল। একটা পাতলা ধাতব ব্যান্ড দিয়ে পোলের মাথা মুড়ে দিবে তারা, বোঝা যায়।
‘এটা আবার কীজন্য?’ প্রশ্ন তুলল সে সেসব কঠিন রোগিদের মতো করে যারা সর্বক্ষণ ডাক্তারদের কানের পোকা বের করে ফেলে কী হচ্ছে তাদের সাথে তা জানার জন্য। ই ই জি রিডআউট’।
প্রফেসর, ম্যাট্রন আর নার্সরা বিস্মিত ভঙ্গিতে দৃষ্টি বিনিময় করল।
‘ও- ইলেক্টো… এনচেপ… এলো… গ্রাম, খুব ধীরে বলে সে, যেন স্মৃতির গহিন থেকে তুলে আনতে পারছে না কথাগুলো। ইউ আর কোয়াইট রাইট। আমরা আপনার ব্রেন ফাংশন তলিয়ে দেখতে চাই।’
আমার মস্তিষ্ক তখনি কাজ করবে যখন আপনারা নাছোড়বান্দার মতো আমাকে ধরে না রেখে একটু ভেবে নিতে দিবেন! মনের খেদ লুকিয়ে রাখতে পারছে না পোল। যাক, কোনো একটা সমাধানের কাছে আসছি আমরা।
মিস্টার পোল,’ বলল এ্যান্ডারসন, এখনো কণ্ঠে সতর্কতার ছোঁয়া, যেন কোনো ভিনদেশি ভাষা কচলে তেতো করে ফেলছে, আপনি জানেন, অবশ্যই, যে আপনি আপনি একটা খুব নচ্ছাড় টাইপের এ্যাক্সিডেন্টে পড়েছিলেন… ডিসকভারির বাইরে কাজ করার সময়…’
পোল নড় করল। মনে আছে তার।
‘আমার একটু সন্দেহ হয়, নিরস কষ্ঠ পোলের, ‘সেই “ডিজএ্যাবল” টা আসলে খাটো করে দেখানো হয়েছিল।
দেখেই বোঝা যায়, বেশ হালকা বোধ করছে এ্যান্ডারসন। খুব ক্ষীণ একটা হাসির রেখা ছড়িয়ে যায় তার মুখ জুড়ে।
‘আলবৎ! বলুন দেখি কী হয়েছিল… মানে আপনি কী মনে করেন?
যাক, কী বলব, আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ার পর ডেভ বোম্যান উদ্ধার করে আনল। ডেভ কেমন আছে? কেউ কোনো জবাব দিবে না?’
‘সময়ে থলির সব বিড়াল বেরিয়ে আসবে… সবচে খারাপ হলে কী হতে পারে?
পোলের শিরদাঁড়া বেয়ে যেন শিতল একটা স্রোত নেমে গেল কুলকুল করে। মনে যে চিন্তাগুলো এল সেগুলোকে ঠিক জুড়ে দিতে পারছিল না সে।
সব চেয়ে খারাপ কী হতে পারে? সবচে খারাপ হতে পারে এই যে আমাকে ডেভ উদ্ধার ঠিকই করেছিল, মৃত অবস্থায়। আর এখানে, তা এ জায়গা যেখানই হোক, এখানে অবশেষে আনা হয় এবং কোনো না কোনো প্রক্রিয়ায় সজাগ করা হয়। আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ…’।
‘ঠিক তাই। আপনাকে পৃথিবীর বুকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আসলে… এর খুব কাছাকাছি কোথাও।
মানে? এর খুব কাছাকাছি কোথাও মানে? মাধ্যাকর্ষণের একটা টান যে আছে তা তো সত্যি খুব ধীরে ঘুরতে থাকা মহাকাশ স্টেশনেও একই হাল হবে। চুলায় যাক, আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হবে এখন।
মনে মনে খুব দ্রুত কিছু আঁক কষে নিল পোল। ডেভ যদি তাকে হাইবারনেকুলামে আর সব ক্রুর সাথে শুইয়ে রেখে থাকে, বৃহস্পতির মিশন শেষ করে থাকে- তাতেই বা কী এসে যায়, পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যাবার কথা তার, ফিরে আসতে আসতে।
আজকের তারিখটা ঠিক কত? যথা সম্ভব শান্ত থেকে জিজ্ঞেস করল সে। প্রফেসর আর ম্যাট্রন সাথে সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে। গলার কাছে আবার ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়া টের পায় পোল।
আপনাকে বলতেই হবে, মিস্টার পোল, যে, বোম্যান আপনাকে উদ্ধার করেনি এজন্য তাকে দোষ দেয়ারও কোনো উপায় নেই- আপনাকে জীবিত পাবার কোনো পথ খোলা ছিল না। এদিকে তার নিজের জান নিয়েই মরণপণ টানাটানি পড়ে যায়…
‘আপনি মহাকাশে ভেসে বেড়ালেন, পেরিয়ে গেলেন মহাদেবতা বৃহস্পতির বিশাল জগৎ, এগিয়ে চললেন অন্তহীন তারার দেশে। কিন্তু একটা ব্যাপার অবাক করার মতো, সূর্য থেকে এমনিতেই দূরে ছিলেন, আরো অনেক অনেক দূরে চলে গেলেন, ফ্রিজিং পয়েন্ট থেকে অনেকটা নেমে গেল তাপমাত্রা, এত নিচে, যে কোনো প্রকার মেটাবলিজম চলা সে অবস্থায় অসম্ভব। কিন্তু সবচে অবাক করা ব্যাপার হল, ফিরে পাওয়া গেছে আপনাকে। জীবিত মানুষদের মধ্যে আপনিই যে সবচে ভাগ্যবান সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই- ভুল বললাম, কোনোকালে আপনার মতো ভাগ্যবান কেউ ছিল না।
আসলেই ভেঙে পড়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করে পোল । পাঁচ বছর, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এর মধ্যেতো একটা শতাব্দিও পেরিয়ে যেতে পারে, পেরিয়ে যেতে পারে আরো অনেকটা সময়।
‘লেট মি হ্যাভ ইট, সামলে নিচ্ছে সে।
প্রফেসর আর ম্যাট্রন যেন কোনো অদশ্য দর্শকের সামনে নিজেদের সামলে নিচ্ছে। তাদের কানের সাথে একটা কিছু লাগানো হল। পোল বুঝে নেয়, এখন তারা হসপিটালের নেটওয়ার্কে যুক্ত।
ফ্র্যাঙ্ক, চিরচেনা পারিবারিক ডাক্তারের মতো করে বলল এ্যান্ডারসন, ব্যাপারটা তোমার কাছে খুব বড় শক হয়ে আসবে, কিন্তু আমি জানি, এটা হজম করার ক্ষমতা তোমার আছে- আর যত দ্রুত জেনে যাও ততই ভাল।
‘চতুর্থ সন্ত্রা শুরু করতে যাচ্ছি আমরা। বিশ্বাস কর পৃথিবী ছেড়ে গিয়েছিলে প্রায় এক হাজার বছর আগে।
বিশ্বাস করছি তোমার কথা, একেবারে শান্ত স্বর ফ্র্যাঙ্ক পোলের। তারপর কী যেন হয়ে গেল। চোখের সামনে দোদুল্যমান পুরো ঘরটা। ঘুরছে। কোথায় যেন তলিয়ে গেল সেই প্রাচিন ডিসকভারির ত্রু।
* * *
আবার ফিরে আসছে সচেতনতা। একটু অবাক হয়ে দেখল, এখন আর কোনো হাসপাতালের কামরায় নেই। শুয়ে আছে মনোরম এক স্যুইটে। দেয়ালে দেয়ালে ফুটে উঠছে অসাধারণ সব দৃশ্য। কোনো কোনোটা বিখ্যাত চিত্র, বাকিগুলো। ল্যান্ডস্কেপ আর সমুদ্রের ছবি, সম্ভবত তার সময়কার। কোনো কিছুতেই অপরিচিতের ছাপ নেই। কিন্তু সেগুলো আসবে, ভাবে সে।
কোন সন্দেহ নেই, বর্তমানে তার চারপাশটাকে খুব সাবধানতার সাথে প্রোগ্রাম করা হয়েছে। টেলিভিশনের কাছাকাছি কী আছে এখন? এটাই কিন্তু বিছানার আশপাশে কোনো কন্ট্রোল দেখা যাচ্ছে নাতো। কত চ্যানেল থাকতে পারে তৃতীয় সহস্রাব্দে?
এ নতুন পৃথিবীতে কত কী যে নতুন করে শিখে নিতে হবে তার লেখাজোকা নেই। যেন কোনো বুনো এসে হঠাৎ হাজির হয়েছে উন্নত সভ্যতার সামনে।
কিন্তু প্রথমে তাকে শক্তি ফিরে পেতে হবে- শিখে নিতে হবে ভাষাটা; পোলর জন্মস্থানেই তার সেই জীবনটায় ভাষা কত পাল্টে গেল, উল্টে গেল কত ব্যাকরণ। নিশ্চয়ই আরো হাজার হাজার নতুন শব্দ এসেছে, বেশিরভাগই বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির সাথে সম্পর্কিত, কোনো কোনোটার অর্থ সে মোটামুটি ধারণ করে নিতে পারে।
আরো হতাশাজনক ব্যাপার হল, হাজার বছরে অনেক অনেক নতুন নাম এসেছে। আগাপাশতলা কিছু বুঝে উঠতে পারে না সে। সপ্তাহ ধরে তার কথাবার্তায় বাধা পড়ে পটে আঁকা জীবন-ইতিহাসের সামনে।
আস্তে আস্তে ফিরে আসছে শক্তি, একই সাথে বাড়ছে দর্শনার্থীর সংখ্যা। সেই সাথে শ্যেনদৃষ্টিতে নজর রাখছে প্রফেসর এ্যান্ডারসন। অতিথিদের মধ্যে মেডিক্যাল স্পেশালিস্ট আছে, আছে নানা শাখার তুখোড় সব স্কলার এবং তার সবচে বেশি নজর যাদের দিকে, তারা হল স্পেসক্র্যাফট কমান্ডার।
ডাক্তার আর ইতিহাসবেত্তাদের নতুন করে জানানোর খুব বেশি কিছু নেই, প্রায় সবই এবং তার চেয়েও বেশি জমা হয়ে আছে মানবজাতির অকল্পনীয় বিশাল সব ডাটাব্যাঙ্কে। কিন্তু সে একটা কাজ ভাল করতে পারত, নানা ইতিহাসের বেড়াজালের পথে আটকে পড়া বাদ দিয়ে তার সময়টাকে একেবারে সাদাসিধাভাবে তুলে আনতে পারত।
সবাই দু চোখে গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে তার কথা শোেনন। প্রশ্নের জবাব লুফে নেয়। কিন্তু কিছু জানতে চাইলেই কেন যেন শামুকের মতো গুটিয়ে যায় নিজেদের ভিতরে। পোল আস্তে আস্তে বুঝতে পারে, কালচারাল শক থেকে তাকে অতিমাত্রায় সাবধানতার সাথে দূরে রাখা হচ্ছে। নিজের অজান্তেই যেন পায়তাড়া কষে, এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া চাই। যতক্ষণ একা থাকছে, দেখে অবাক হচ্ছে না যে দরজাটা লক করে রাখা হয়।
এবার আসবে ডক্টর ইন্দ্রা ওয়ালেস। পাল্টে গেল পুরো পাশার দান। মেয়েটার নাম যেমনই হোক, রক্তমাংসের গঠনে জাপানি ভাবটাই বেশি। কল্পনার প্রলেপ মিশিয়ে পোল মাঝে মাঝে তাকে গেইশী ভেবে বসে- যে জাপানি মেয়েরা সেবাকর্মে দক্ষ। একটা ভার্চুয়াল চেয়ার আঁকড়ে থাকা কোনো বিখ্যাত ইতিহাসবিদ, ইউনিভার্সিটি লেকচারারের সাথে তার কল্পনা যে মিলবে না তাতো স্বাভাবিক। মেয়েটার আসার সাথে সাথে সব পাল্টে যাওয়াটা শুধু শুধু নয়। অনর্গল পোলের আমলের ইংরেজি বলে যাচ্ছে সে।
‘মিস্টার পোল, শুরু করল সে, খুব দরকারি আঙ্গিকে, আমাকে আপনার অফিসিয়াল গাইডের কাজ দেয়া হয়েছে- কিম্বা বলা ভাল, মেন্টর। আমার কোয়ালিফিকেশন- আপনার সময়ের উপর বিশেষজ্ঞ আমি। অভিসন্দর্ভের বিষয়, ‘জাতিগত রাষ্ট্রের পতন- ২০০০-৫০’। আমার বিশ্বাস দুজনে দুজনকে দারুণ হেল্প করতে পারব।’
‘আমি নিশ্চিত, পারব। আপনার প্রথম কাজ আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে এ নতুন পৃথিবীটাকে দেখতে দেয়া।
‘ঠিক যেটা আমরা চাই। কিন্তু প্রথমেই আপনাকে একটা আইডেন্ট দিতে হবে। যে পর্যন্ত একটা পরিচিতি না থাকছে সে পর্যন্ত আপনি একজন- কী বলে ব্যাপারটাকে- ননপারসন। কোথাও যেতে পারবেন না, করতে পারবেন না কোনো কাজ। কোনো ইনপুট ডিভাইস আপনার অস্তিত্বের কথা স্বীকারও করবে না।
‘ঠিক এমনি আমি আশা করছিলাম, একটু অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বলল পোল, ‘পদ্ধতিটা আমার সময়েই শুরু হয় হয় করছিল। লোকে ব্যাপারটাকে কী ঘেন্নাইনা করত।
‘কেউ কেউ এখনো করে। হাল ছেড়ে দিয়ে, রণে ভঙ্গ দিয়ে সব ছেড়েছুঁড়ে চলে যায় প্রকৃতির কাছে। বাস করে বনে জঙ্গলে। আপনার শতাব্দিতে যতটা অবারিত প্রকৃতি ছিল এখন তেমন নেই। অরণ্যে ছেয়ে গেছে পৃথিবী। তারা কিন্তু জাতে মাতাল তালে ঠিক। কম্প্যাক সাথে নিয়েই যায়। যে কোনো বিপদের চোরাবালিতে পা পড়ে গেলেই হাউমাউ করে সাহায্য চায়। গড়পড়তায় তাদের ডাক আসে দিন পাঁচেকের মধ্যেই।
‘আফসোসের কথা। মানবজাতির আরো অবনতি হয়েছে।
সে আসলে মেয়েটাকে খতিয়ে দেখছে। দেখছে কতটা সহ্য করে সে, কতটা গভীর তার ব্যক্তিত্ব। বোঝাই যায়, তাদের আরো অনেকটা সময় একত্রে কাটাতে হবে, আরো ভয়ানক ব্যাপার হল, এ মেয়ের উপর তাকে অহর্নিশি হাজারটা ব্যাপারে নির্ভর করতে হবে। এখনো জানে না তাকে ভাল লাগবে কিনা- হয়ত এ মেয়ে তাকে জাদুঘরের বস্তু হিসাবে ধরে নিয়েছে।
অবাক হয়ে দেখে পোল, তার কথায় নির্ভয়ে সায় দিচ্ছে ইন্দ্রা।
কথাটা সত্যি- কোনো কোনো হিসাবে। হয়ত শারীরিক দিক দিয়ে আমরা অনেক দূর্বল কিন্তু এখনকার মানুষ যেভাবে বাস করে ততটা সুখে এবং ঐশ্বর্যে কোনোকালে খুব বেশি মানুষ বাস করেনি।’
ছোট একটা চৌকো প্লেটের কাছে হেঁটে গেল মেয়েটা। দরজার গায়ে আঁটা আছে চৌকো জিনিসটা। ছাপার যুগে এমন সব আকৃতির পত্রিকা বের হত। পোল দেখেছে সব ঘরেই এমন কিছু আছে। সাধারণত ফাঁকা। মাঝে মাঝে সেখানে ধীর গতিতে টেক্সট ফুটে ওঠে, উপরের দিকে চলে যায়। বেশিরভাগ শব্দ পরিচিত হলেও পোলের কাছে সেগুলো কোনো অর্থ বয়ে আনে না। একবার তার ঘরের ঐ ডিসপ্লেগুলো জরুরি ভঙ্গিতে বিপ বিপ করেছিল, গা করেনি পোল, এসব নিয়ে যদি কেউ মাথা ঘামায় তো সে অন্য কেউ, সে নয়। ভাগ্য ভাল, শব্দটা যেভাবে শুরু হয়েছিল সেভাবেই থেমে যায়।
প্লেটটার উপর ডক্টর ওয়ালেস হাতের তালু রাখে, সরিয়ে নেয় কয়েক সেকেন্ড পর। পোলের দিকে কটাক্ষ হেনে বলে, ‘আসুন, দেখুন একবার।
সেখানকার লেখাটুকুর উপর চোখ ফেলে অনেকটাই বুঝে ফেলে পোল । ওয়ালেস, ইন্দ্রা [এফ২৯৭০.০৩.১১/৩১.৮৮৫/হিস্ট.অক্সফোর্ড]
আমার যদ্দূর মনে হয় এফ মানে ফিমেল, তারপর আছে জন্মতারিখ- এগারোই মার্চ, উনত্রিশশ সঙুর- আর আপনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের সাথে যুক্ত। আর আমার যতদূর মনে হয় সেই ৩১.৮৮৫ হল পার্সোনাল আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার, ঠিক তো?”
‘একসেলেন্ট, মিস্টার পোল। আমি আপনাদের সময়কার কিছু ই-মেইল এ্যাড্রেস আর ক্রেডিট কার্ড নাম্বার দেখেছি। এমন সব সংখ্যা আর শব্দ যেগুলো মানুষের মনে রাখতে হলে নাভিশ্বাস উঠে যাবে। কিন্তু আমরা সবাই যার যার জন্মতারিখ জানি আর সে তারিখটা ৯৯,৯৯৯ জনের বেশি লোক শেয়ার করবে না। তাই আপনার প্রয়োজন মাত্র পাঁচটা নাম্বার… আর তাও যদি ভুলে যান, কোনো সমস্যা নেই। দেখতেই পাচ্ছেন, ব্যাপারটা আপনার অস্তিত্বের সাথে যুক্ত।
‘গেঁথে দেয়া?
ইয়েস-জন্মের সাথে সাথে ন্যানোচিপ লাগানো হয় দু হাতে। কিন্তু আপনাকে নিয়ে একটা সমস্যা হবে।’
কী?
‘বেশিরভাগ সময় আপনি যেসব রিডারের সম্মুখীন হবেন তাদের মন-মগজ এত বেশি সরল যে বিশ্বাসই করবে না আপনার জন্মতারিখ। তাই আপনার অনুমতির সাথে জন্মতারিখটা এক হাজার বছর এগিয়ে আনব।’
‘অনুমতি দেয়া হল। আর আইডেন্টের বাকিটুকু?
‘অপশনাল। আপনি এটাকে খালি রাখতে পারেন। বর্তমান কাজ বা আগ্রহ যুক্ত করে দিতে পারেন- গ্লোবাল বা টার্গেটেড পার্সোনাল মেসেজের জন্য ব্যবহার করতে পারেন।
কিছু কিছু ব্যাপার, জানে পোল, হাজার বছরেও বদলায় না। ঐসব টার্গেটেড’ মেসেজের গোপনীয়তাটা এখনো বদলে যাবে না।
জানতে হবে, এত নিরাপত্তা আর একীভূত অবস্থায় মানুষের নৈতিকতা কিছুটা সেরেছে কিনা।
তার আগে ডক্টর ওয়ালেসের সাথে তাকে আরো মিশতে হবে।
৪. দৃষ্টি যায় দূরে
ফ্র্যাঙ্ক- প্রফেসর এ্যান্ডারসন মনে করেন তোমার শরীরে একটু বল ফিরে এসেছে। ইচ্ছা হলে পায়ে দিয়ে হেঁটে যেতে পার কিছুটা।
‘খুব ভাল লাগল কথাটা শুনে। তুমি কি ‘স্টির ক্রেজি’র মানেটা জান?”
না, কিন্তু আন্দাজ করে নিতে পারি।
লো গ্র্যাভিটিতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে পেপাল যে ঠিক ঠিক পা তুলে ফেলতে পারছে। জি’র অর্ধেক, আন্দাজ করে সে। খুব একটা সমস্যা হবে না এখানে। পথে দেখা হয়ে গেল অনেকের সাথে। কেউ পরিচিত নয়। কিন্তু তাদের হাসির ভঙ্গি, মুখের ভাব পরিচিত পরিচিত। ভেবে নেয় পোল, আমি নিশ্চয়ই পৃথিবীর সেলিব্রিটিদের মধ্যে কেউকেটা টাইপের একজন হয়ে গেছি ইতিমধ্যে। বাকি জীবন নিয়ে কী করব সে সিদ্ধান্ত নেয়ার পথে ব্যাপারটা সাহায্য করবে আমাকে। অন্তত
আরো একটা শতাব্দি, যদি এ্যান্ডারসন…
পুরো করিডোরটায় কোনো কিছু নেই, একটু পর পর শুধু দরজায় নাম্বার দেয়া, প্রতিটায় সেই চিরাচরিত রিকগ প্যানেল। ইন্দ্রার পিছনে পিছনে প্রায় দুশো মিটার এগিয়ে গেল পোল। থমকে গেল হঠাৎ করে ব্যাপারটা তার কাছে একেবারেই অপরিচিত।
‘এই স্পেস স্টেশন নিশ্চয়ই ইয়া বড় বিস্ময় লুকাতে পারল না সে। জবাবে মোহনীয় এক হাসি দিল ইন্দ্রা।
‘তোমাদের সময়ে কি একটা কথা প্রচলিত ছিল না, ‘কিছুই এখনো দেখনি বৎস! ইউ এই সিন এনিথিং ইয়েট।’
“নাথিং,” ‘ শুধরে দিল সে, অন্যমনস্কভাবে। বিশাল এ সৃষ্টির সবটুকু খতিয়ে দেখার একটা ইচ্ছা মনে ঘাপটি মেরে আছে। অন্য সব চিন্তা সরে যাচ্ছে দূরে। তার মনে বড়জোর ডজনখানেক সিট ওয়ালা একটা স্পেস স্টেশনের কথা আসে ।
‘অবজার্ভেশন লাউঞ্জ থ্রি, আদেশ দিল ইন্দ্রা, সাথে সাথে চলে গেল তারা টার্মিনাল থেকে।
বিরাট এক রিস্টব্যান্ডে সময় দেখছে পোল; এখনো এর মাথামুণ্ডু খুব একটা বুঝে উঠতে পারেনি। একটা ব্যাপারে একটু আশ্চর্য হয় সে, পুরো পৃথিবীর সময় এখন এক। টাইম জোনের জটিল ব্যাপারস্যাপারগুলো ঝেটিয়ে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। গ্লোবাল কম্যুনিকেশনের পথে এ এক অন্তরায়। সেই একবিংশ শতাব্দিতে এ নিয়ে জোর শোরগোল উঠেছিল। বলা হত সোলার বা সৌর সময়ের বদলে সাইডরিয়েল টাইমের প্রবর্তন করতে হবে। তখন, সূর্য চলবে ঘড়ির কাঁটা ধরে।
যাই হোক, হালে পানি পায়নি সূর্যের একই সময় প্রস্তাবটা। ক্যালেন্ডারের হিসাব বদলে দেয়ার প্রস্তাবও মানা হয়নি। সবাই মেনে নিয়েছিল, টেকনোলজি আরো এগিয়ে যাক, তখন সেসব নিয়ে মাথা ঘামানো যাবে। কোনো একদিন, অবশ্যই, ঈশ্বরের ছোটখাট ভুলগুলো শুধরে নেয়া হবে পৃথিবীর কক্ষপথের সামান্য যে কটিটা তিনি রেখেছিলেন আবহমান কাল থেকে, সেটাকে সারিয়ে নেয়া হবে… তখন, মানুষ বারো মাসে বছর হিসাব করবে, প্রতি মাসে দিন থাকবে কাঁটায় কাঁটায় ত্রিশটা….
গতি আর পেরিয়ে যাওয়া সময়ের হিসাবের সাথে সাথে পোল বুঝতে পারে যানটা তাদের নিয়ে কমসে কম তিন কিলোমিটার পথ পেরিয়ে এসেছে থেমেছে একটা দরজার সামনে। হাট হয়ে খুলে গেল দুয়ার, অটোভয়েস বলে উঠল, হ্যাভ এ গুড ভিউ। আজ পঁয়ত্রিশ ভাগ মেঘ আছে।’
অবশেষে, ভাবে পোল, আমরা আউটার ওয়ালের কাছাকাছি চলে আসছি। কিন্তু বিধি বাম, সেখানেও লুকিয়ে আছে রহস্য। এই এতটা পথ পেরিয়ে আসার পরও গ্র্যাভিটির হেরফের হয়নি, দিকের বদলতো দূরের কথা। এখনো ভাবতেই পারছে না একটা ঘূর্ণায়মান মহাকাশ স্টেশনের জি ভেক্টরের কোনো পরিবর্তনই হয়নি এতটা দূরত্ব পেরিয়ে আসার পরও… নাকি কোনো গ্রহের উপর আছে। কিন্তু সৌরভুবনের বাসযোগ্য যে কোনো গ্রহের অভিকর্য তো অনেক কম হওয়ার কথা।
খুলে গেল টার্মিনালের আউটার ডোের। পোল একটা ছোট এয়ারলকে ঢুকছে। নিশ্চয়ই এটা স্পেস, কোনো গ্রহ নয়। কিন্তু স্পেসস্যুট কোথায়? ব্যগ্রভাবে চারদিকে তাকায় সে, শূন্যতার এত কাছে আসাটা তার স্বভাবের সাথে ঠিক মেলে না একবার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে… দুরস্ত।
‘এইতো, চলে এসেছি প্রায়,’ আশ্বস্ত করার ভঙ্গি ইন্দ্রার কণ্ঠে।
খুলে গেল শেষ দুয়ার। মহাশূন্যের স্তব্ধ করা চির তিমিরে চোখ পড়ল সাথে সাথে। একটা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারা। জানালাটা উপর-নিচ ডান বামে ভিতরের দিকে বাকানো, মাঝের দিক সামনে বাড়ানো। যেন কোনো গোল কাঁচের পাত্রে আটকে পড়েছে ছোট্ট কোনো গোঙফিশ- এমনি অনুভূতি হল পোলের। মনে একটা নিশ্চয়তা কাজ করছে, এ বিশাল কর্মযজ্ঞের দভমুন্ডের বিধাতারা নিশ্চয়ই ঠিক ঠিক জানত কী করছে তারা… পোলের আমলের স্ট্রাকচারাল ম্যাটেরিয়ালের চেয়ে অনেক আধুনিক জিনিসের সাথে নিশ্চয়ই এরা পরিচিত।
দুরে, বহুদূরে তারার দল ঝিকমিক করছে, কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু আলোয় চোখ সয়ে যাওয়া পোল কিছুই দেখতে পায় না মিমিষে কালো ছাড়া।
সামনে এগিয়ে যেতে নিয়েছিল, ইন্দ্রা সেখানেই দাঁড় করিয়ে রাখে।
কী ব্যাপার, ভাল করে তাকাও দেখি। দেখতে পাচ্ছ না কিছুই
চোখ পিটপিট করে পোল, তারপর নিকষ কালো অন্ধকারে চোখ রাখে। ঠিক বিশ্বাস করার মতো ব্যাপার নয়… জানালার গায়ে ফাটল।
একপাশ থেকে আরেক পাশে চোখ বোলায় সে। না, দৃষ্টি বিভ্রম নয়; সত্যি। ইউক্লিডের সেই সংজ্ঞার কথা মনে পড়ে যায়, একটা রেখার দৈর্ঘ্য আছে কিন্তু কোনো প্রস্থ নেই।’
সামনে এগোয় সে। দাগটা এতই হালকা যে একে ঠিক সরুও বলা যায় না। যেন ইউক্লিডের সেই কথা, কোন প্রস্থ নেই।
কিন্তু এখানে অন্য একটা ব্যাপার আছে। অনিয়মিত বিরতিতে রেখার গায়ে বিন্দু বিন্দু পুরুত্ব দেখা যায়, ঠিক যেমনটা হয় কোনো মাকড়শার জালে জলকণা লেগে থাকলে।
জানালার দিকে আরো এগিয়ে যাচ্ছে পোল। দৃষ্টি নিচের দিকে। না, দৃশ্যটা অনেক অনেক পরিচিত। ভেসে উঠেছে পুরো ইউরোপা মহাদেশ, উত্তর আফ্রিকার অনেকটা অংশ। স্পেস থেকে এ দৃশ্য কতবার দেখেছে সে তার ইয়ত্তা নেই। আচ্ছা, তাহলে আর কোথাও নয়, অর্বিটেই আছে সে। সম্ভবত কোনো ইকুয়েটরিয়াল অর্বিটে- হাজার খানেক কিলোমিটার উপরে তো হবেই।
রহস্যমাখা হাসি ইন্দ্রার অধরে।
‘জানালার আরো কাছে যাও,’ মৃদু কণ্ঠে বলল সে, তাহলে সরাসরি নিচে তাকাতে পারবে। আশা করি তোমার উচ্চতাভীতি নেই।’
কোনো মহাকাশচারীকে এ কথা বললে আর কী বলা যায়। নিজেকে শোনায় পোল মনে মনে, সামনে এগিয়ে যেতে যেতে। কখনো ভার্টিগোর সমস্যা থাকলে আমি এ পেশায় পা ফেলতেই পারতাম না…
আর একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে সত্যি সত্যি ভিড়মি খেল সে। চিৎকার করে উঠল, ‘মাই গড! সাথে সাথে সরে এল জানালার সামনে থেকে। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে তাকাল আবার।
একটা সিলিন্ডারের মতো শহরের উপর থেকে চোখ রাখছে সে। এর ভদ্রোচিতভাবে গোল হয়ে যাওয়া প্রস্থ কম করেও কয়েক কিলোমিটার হবে। কিন্তু উচ্চতার সাথে এর কোনো তুলনাই নেই। নেমে গেছে এটা। নিচে, নিচে, আরো আরো নিচে। আফ্রিকার উপরে কোথাও ধোঁয়াশার ভিতরে গেছে হারিয়ে। আন্দাজ করে নেয় পোল, জায়গাটা উপরিতলে কোথাও গিয়ে মিশবে।
কত উঁচুতে আছি আমরা?’ ফিসফিস করে সে। হাজার দুয়েক কে। এবার উপরে তাকাও।
এবার ব্যাপারটা তত বিস্ময় নিয়ে আসে না, কী দেখা যাবে তা আগে থেকেই যেন জানত সে। মহাশূন্যের গায়ে একটা বিন্দুতে পরিণত হবার আগ পর্যন্ত উঠেই গেছে, উঠেই গেছে। কোনো সন্দেহ নেই, চলে গেছে একেবারে জিওস্টেশনারি অর্বিটে; বিষুবের ছত্রিশ হাজার কিলোমিটার উপরে। পোলের আমলে এমন সব ফ্যান্টাসির কথা শোনা যেত; কিন্তু বাস্তবে তা দেখার সৌভাগ্যের কথা কোনো মানুষ সে আমলে স্বপ্নেও ভাবত না।
এবার রেখাটার মানে ধরতে পারে সে। সারা শরীরে শিহরণ খেলে যায়। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছোটাছুটি করে টগবগে রক্ত।
‘ওটা নিশ্চয়ই আরেকটা?
হ্যাঁ- এশিয়ান টাওয়ার। তাদের কাছে আমাদেরকে ঠিক এমনি দেখায়। কটা আছে?
মাত্র চারটা। ইকুয়েটরের গায়ে সমানভাবে ছড়ানো। আফ্রিকা, এশিয়া, আমেরিকা, প্যাসিফিকা। শেষেরটা এখনো প্রায় খালি। মাত্র কয়েকশ লেভেল পূর্ণ হয়েছে। পানি ছাড়া আর কিছু দেখার নেই…’
এই বিবশ করে দেয়া ধারণাটাকে কোনোক্রমে গলাধকরণের চেষ্টায় প্রাণ আইঢাই করছে এমন সময় একটা বিরক্তিকর চিন্তা মনে এল।
আমাদের আমলেই হাজার হাজার স্যাটেলাইট ছড়ানো ছিল সবখানে। তোমরা কী করে সেগুলোর সাথে সংঘর্ষ এড়ালে?
এবার ইন্দ্রার অস্বস্তিতে পড়ার পালা।
‘ইউ নো- আমি কখনো ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিনি এটা আমার ফিল্ড নয়। থামল সে। মনের অলিগলি ধরে সার্চ চালাচ্ছে। এরপর উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখাবয়ব।
যদ্দূর মনে হয় বড়সড় কোনো পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নেমেছিল তারা। এখন স্টেশনারি অর্বিটের নিচে কৃত্রিম উপগ্রহ বলতে কিছু নেই।’
এতেই বোঝা যায়, নিজেকে জানায় পোল। এই চার দানবীয় টাওয়ারই হাজার হাজার স্যাটেলাইটের কাজ করতে পারবে।
‘আর এম্নিতেও কোনো দূর্ঘটনা হয়নি? পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া বা এ্যাটমোস্ফিয়ারে ফিরে আসতে থাকা স্পেসশিপের সাথে ধাক্কা অথবা তেমন কোনো ঘটনা?
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ইন্দ্রা। এক দৃষ্টিতে।
একটু পর বুঝতে পারল ব্যাপারটা। সে সবের কোনো প্রশ্নই ওঠে না আর। উপরের দিকে আঙুল তাক করে, যেখানে থাকা উচিৎ সেখানেই আছে সব স্পেসপোর্ট। উপরে। আউটার রিঙে। পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে শেষ রকেটটা উড়েছে কম করেও চারশ বছর আগে।
ব্যাপারটা হজম করতে করতে আরেক কথা মনে পড়ে যায়। এ্যাস্ট্রোনটের ট্রেনিং নেয়ার সময় তাকে অনেক ব্যাপার শিখানো হয়েছিল। স্পেসে ব্যাপারটা জীবন মরণের খেলা।
সূর্যটাকে দেখা যাচ্ছে না। দৃষ্টিসীমার অনেক উপরে। ঠিক মাথার উপর। কিন্তু কিছুটা সূর্যরশ্মি জানালা ভেদ করে পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ছে। সেখানে আলোর আরো একটা ব্যান্ড চোখে পড়ে। অনেক ক্ষীণ, কিন্তু একজন মহাকাশচারীর কাছে আলোর খেলা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, এ ব্যাপার তার দৃষ্টি এড়াতে পারে না। এ কী করে সম্ভব? ফ্রেমে দ্বৈত ছায়া পড়ছে অবলীলায়।
আকাশে তাকানো প্রয়োজন। দেখতে হবে। হাটু ভেঙে সাথে সাথে বসে পড়ে পোল। এবং জমে যায় তার চোখ। দূরে আরেকটা সূর্য দেখা যাচ্ছে।
‘হোয়াটস দ্যাট? কোনোক্রমে শ্বাস বন্ধ রেখে প্রশ্ন তোলে সে।
‘ও- কেউ তোমাকে বলেনি? ওটা লুসিফার।
‘পৃথিবীর আরেকটা সূর্য আছে?”
‘আসলে, এটা তেমন উত্তাপ দেয় না আমাদের কিন্তু চাঁদের কাজটা বন্ধ করে দিয়েছে আর কী… তোমাদের খোঁজার জন্য যখন দ্বিতীয় মিশন পাঠানো হয় তখনো
সেটার নাম ছিল… নাম ছিল কী যেন? বৃহস্পতি।
স্থাণুর মতো চুপ করে থাকে পোল।
আমি জানি, শিখতে হবে অনেক কিছু এই নতুন পৃথিবীর সাথে তাল মিলাতে হলে। কিন্তু কতটা শিখতে হবে তা জানি না।
৫. শিক্ষা
পোল খুশি হয়েছে টেলিভিশন সেটটাকে ঘরের ভিতরে চাকার মাধ্যমে সরিয়ে এনে খাটের পাশে রাখায়। খুশি হয়েছে, কারণ সে মধ্য-সংবাদ-খরায় ভুগছিল খুব। পরিচিত জিনিস দেখে কার না আনন্দ হয়।
জাদুঘরকে কথা দিয়ে এসেছি আপনার কাজ হয়ে গেলে আবার ফিরিয়ে দিব।’ বলল মার্টন, ‘আশা করি জানেন কী করে ব্যবহার করতে হয়?
রিমোট কন্ট্রোল হাতে নিয়ে স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেল পোল। নস্টালজিয়ার সুতীব্র এক স্রোত কোত্থেকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাকে। মাত্র কয়েকটা জিনিসই বাল্যকালে ফিরিয়ে নিতে পারত। সেসব দিনের টেলিভিশনগুলো যেমন ছিল কালা তেমনি বোকার হদ্দ। কঠের আদেশ বুঝতে পারত না।
‘থ্যাঙ্ক ইউ, মার্টন। কোনটা সবচে ভাল নিউজ চ্যানেল । প্রথমে প্রশ্নটার কিছুই বুঝল না মেয়েটা। তারপর উজ্বল হয়ে উঠল চোখমুখ।
‘ও- বুঝতে পারছি কী বলছেন আপনি। কিন্তু প্রফেসর এ্যান্ডারসন মনে করেন এখনো আপনি পুরোপুরি প্রস্তুত নন। তাই আর্কাইভসকে এভাবে সাজানো হয়েছে। যেন আপনি ভাল বোধ করেন। কোন…’
পোল ভেবে পায় না ডাটার জন্য এ যুগে স্টোরেজের কোন মাধ্যম ব্যবহার করা হয়। তার এখনো কম্প্যাক্ট ডিস্ক এর কথা মনে আছে। আদ্যিকালের মানুষ আল জর্জ খুব গর্বিত ছিল অনেকগুলো এল পির কালেকশন থাকায়। কিন্তু টেকনোলজির এই হাঁটি হাঁটি পা পা করে সামনে এগুনো আর গজ-কচ্ছপের লড়াই নিশ্চয়ই অনেক শতাব্দি আগে হাপিস হয়ে গেছে। সবচে ভাল টেকনোলজি সেই ডারউইনিয় সারভাইভাল ফর দ্য ফিটেস্ট’ নীতি ধরে টিকে গেছে, কোনো সন্দেহ নেই।
তার জন্য মিডিয়াম বেছে নেয়াটা চমৎকার কেউ একজন (ইন্দ্রাঃ) একবিংশ শতাব্দির একেবারে গোড়ার দিকের সাথে পরিচিত, সেই এ ব্যবস্থাটা করেছে। বিরক্ত করার মতো কিছুই নেই। নেই যুদ্ধের ডামাডোল, কাটাকাটি মারামারি নেই। রাজনীতি আর ব্যবসার কপচানি আছে যৎসামান্য। এসবই এখন মান্ধাতা আমলের কথা, বোঝা যায়। কিছু হাকা হাস্যরসের অনুষ্ঠান আছে। আছে স্পোর্টস ইভেন্ট (তারা কী করে জানল যে সে টেনিসের ব্যাপারে পাড় মাতাল?)। ক্ল্যাসিক্যাল আর পপ মিউজিক। আর বন্যপ্রাণির উপর ডকুমেন্টারি।
যেই এগুলোকে একত্র করেছে তার সেন্স অব হিউমারের সুর যে কড়া ধাতে বাধা এটুকু অন্তত নিশ্চিত। নাহলে তারা স্টার ট্রেকের পর্বগুলো এখানে ঢোকাত না। ছেলেবেলায় পোল প্যাট্রিক স্টুয়ার্ট আর লিওনার্দো লিময়ের দেখা পেয়েছিল। কে জানে কী ভেবেছিল তারা সেই সময়টায়। অটোগ্রাফ চাইতে আসা এই পুচকে দস্যি ছেলেটার শেষ গন্তব্যের ব্যাপারে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল কি?
একটা বিবশ করা ভাবনা মনে উঁকি দিল। কোথায় যেন পড়েছিল যে তার সময়টায় তার শতাব্দিতে অর্ধলক্ষাধিক টেলিভিশন ব্রডকাস্টিং কোম্পানির অস্তিত্ব ছিল। এখন সংখ্যাটা কত? মিলিয়ন মিলিয়ন সারাক্ষণ কোটি কোটি ঘন্টার টেলিভিশন প্রোগ্রাম ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে বাতাসে? এত এত অনুষ্ঠান, বিলিয়ন বিলিয়ন সম্প্রচারের ভিড়ে কতগুলো সর্বোচ্চ মান অর্জন করছে, আর সেগুলো কীভাবে চাপা পড়ে যাচ্ছে?
চিন্তাটা এতই বেদনাদায়ক, এত বেশি নীতিহীনতা বয়ে আনে যে সপ্তাহখানেক অজানা চ্যানেলের সাগরে পাড়ি দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পোল সেটটাকে নিয়ে যাবার জন্য অনুরোধ করল। সৌভাগ্য বলতে হয়, জেগে থাকার সময় তার হাতে নিজেকে নিয়ে ভাবার মতো ফুরসত খুব একটা মেলে না। ফলে কখন যে শরীরের হাপিস হয়ে যাওয়া শক্তিটুকু আস্তে আস্তে ফিরে এসেছে তার হদিস পায় না সে।
বোর হয়ে যাবার তো প্রশ্নই ওঠে না। শুধু সিরিয়াস রিসার্চাররাই দল বেঁধে আসছে না, আসছে কৌতূহলী- সম্ভবত সেই সাথে প্রভাবশালী লোকজন। এদের এখানে আসাটাও অনেকটা সাগর সাঁতরে আসার মতো। মার্টন আর প্রফেসর এ্যান্ডারসন ফিল্টারিং প্যানেল বসিয়েছে যাতে কারো কোনো কথায় বা ইনফরমেশনে তার মনে কোনো আঘাত না পড়ে। তারপর, একদিন তার আনন্দই হল টেলিভিশন সেটটা আবার আসায়। উইথড্রয়াল সিম্পটমে ভুগতে শুরু করেছিল সে। এবারের দেখার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সিলেক্টিভ হতে হল।
দামি এ্যান্টিকটার সাথে এগিয়ে এসেছে ইন্দ্রা ওয়ালেসও। মুখে তার হাসির ঝিলিক।
‘তোমার দেখতেই হবে এমন কিছু পেয়েছি, ফ্র্যাঙ্ক। যদ্দূর মনে হয় এতে তুমি এ্যাডজাস্ট করে নিতে পারবে- যাই হোক, তুমি যে ব্যাপারটাকে উপভোগ করবে এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি।’
পোল মনে মনে প্রস্তুত হয়ে নিল, যে বিষয়ে মানুষ একটু প্রশংসা করে সেটা উল্টো বোরিং হয়ে যায়। মাঝে মাঝে তার চেয়েও খারাপ কিছু। কিন্তু প্রথম মুহূর্তটাই আকর্ষণ করল ভীষণভাবে, নিয়ে গেল তাকে সেই পুরনো জীবনে। চিনে ফেলল সে তার আমলের বিখ্যাত কটাকে। ঠিক এ প্রোগ্রামটাই দেখেছে আগে।
আটলান্টা, ডিসেম্বর একত্রিশ, দুহাজার…
‘দিস ইজ সি এন এন ইন্টারন্যাশনাল, নতুন সহস্রাব্দের আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি, নতুন সহস্রাব্দ তার সব প্রতিশ্রুতি, ভাল আর মন্দ দিক নিয়ে আমাদের সামনে এগিয়ে আসছে…
কিন্তু ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর আগে, চলুন এক হাজার বছর পিছিয়ে যাওয়া যাক, প্রশ্ন করা যাক আমাদের: “এক হাজার সালের কোনো লোক কি দূর থেকে আমাদের পৃথিবীর বর্তমান অবস্থা জানতে পারত বা বুঝতে পারত, জাদুমন্ত্রের মাধ্যমে তাকে যদি নিয়ে আসা হত এত দূরে?”
যতটুকু প্রযুক্তিকে আমরা প্রযুক্তি হিসাবে ধরি তার প্রায় পুরোটাই গড়ে উঠেছে এ সহস্রাব্দের শেষ প্রান্তে এসে। বেশিরভাগই গত দুশ বছরে। স্টিম ইঞ্জিন, ইলেক্ট্রিসিটি, টেলিফোন, রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা, এ্যাভিয়েশন, ইলেক্ট্রনিক্স এবং মাত্র একটা জীবদ্দশায়, নিউক্লিয়ার এ্যানার্জি এবং স্পেস ট্রাভেল অতীতের সবচে বড় বড় মনগুলোও এসব দেখেশুনে ভড়কে যেত না কি? কী ভাবতেন তারা? মহান আর্কিমিডিস অথবা লিওনার্দোর জড় উপড়ে যদি কোনোভাবে আমাদের এ সময়ে এনে হাজির করা যেত, কী ভাবতেন তারা?
‘এটা আমাদের ভাবায় যে যদি হাজারখানেক বছর পিছনে চলে যাই তো আমাদের আন্দাজ আর বিস্ময় খুব একটা হেরফের হবে না। কথা সত্যি, মৌলিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো করা হয়ে গেছে; টেকনোলজিতে বড় ধরনের উন্নয়ন হবে, কিন্তু সেখানে কি এমন কোনো ডিভাইস থাকবে যেটা আমাদের কাছে ততটা কাজের আর বিস্ময়ের হবে যতটা আইজ্যাক নিউটনের কাছে একটা পকেট ক্যালকুলেটর আর ভিডিও ক্যামেরা হতে পারে?
হয়ত আমাদের সময়টী সমস্ত অতীতের চেয়ে বর্ণিল। টেলিকমিউনিকেশন্স, ছবি আর শব্দ রেকর্ড করার ক্ষমতা, আকাশ বাতাস আর মহাশূন্যজয় এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যা আদ্যিকালের মানুষ তার সবচে উন্নত স্বপ্নেও দেখতে পায়নি। এবং একই সাথে গুরুত্বপূর্ণ কোপার্নিকাস, নিউটন, ডারউইন আর আইনস্টাইন আমাদের চিন্তা করার পৃথিবীকে এতটাই বদলে দিয়েছেন, মহাবিশ্ব সম্পর্কে ভাবনাকে এতটাই পাল্টে দিয়েছেন যে আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে আমরা একেবারে আনকোরা এক নূতন প্রজাতি হয়ে দেখা দিব।
‘এবং আমাদের বংশধররা, এখন থেকে হাজারখানেক বছর পরে, আমাদের দিকে কি এমন করুণা নিয়েই তাকাবে যেভাবে আমরা তাকাই আমাদের অবহেলিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, রোগে ভোগা, সামান্য সময় বেঁচে থাকা পূর্বপুরুষের দিকে? আমরা জানি এমন সব প্রশ্নের জবাব তাদের দিতে পারব যেগুলোর কথা তারা ভাবতেও পারেননি। কিন্তু তৃতীয় সহস্রাব্দ আমাদের জন্য কী কী চমক নিয়ে অপেক্ষা করছে?
‘ওয়েল, এইতো, চলে আসছে সে মাঝ রাতকে কাঁপিয়ে দিয়ে একটা বিরাট ঘন্টা বেজে উঠল ঢং ঢং করে। রাতের একাকীত্বের বুক চিরে দিয়ে শেষ কম্পনটা হারিয়ে গেল…
এবং এমনই ছিল সেই সহস্রাব্দ গুডবাই, ওয়ান্ডারফুল এ্যান্ড টেরিবল টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি…’
এরপর ছবিটা পরিণত হল অজস্র টুকরায়, ভার তুলে নিল নতুন এক ধারাভাষ্যকার, তার সেই উচ্চারণ কত চেনা! এক টানে নিয়ে যায় অতীতে, হাজার বছর আগে…
‘অবশ্যই, এ দু হাজার এক সালের মানুষ এ মুহূর্তটাকে যেভাবে অনুভব করছে, যেভাবে নতুন সহস্রাব্দকে বরণ করে নিচ্ছে তেমন কিছু করেনি এক হাজার এক সালের মানুষ। আমাদের প্রযুক্তিগত উন্নতির অনেকগুলোর স্বপ্নই হয়ত তারা দেখেছিল; আমরা জানি, স্যাটেলাইট সিটির স্বপ্ন অঙ্কুরিত হয়েছিল তাদের মনের গহিনেও, চেয়েছিল চাঁদ আর অন্য সব গ্রহের গায়ে বাড়ি তুলতে। তারা হয়ত আফসোসও করত এ সময়টাকে দেখে, কারণ আমরা এখনো অমর নই। মাত্র কাছের সূর্যটায় পোব পাঠিয়েছি, এই যা…’
মাঝপথে সুইচ অফ করে দিল ইন্দ্রা।
‘বাকিটা পরে দেখে নিও, ফ্র্যাঙ্ক। ক্লান্ত হয়ে পড়ছ তুমি। আশা করি এটাই তোমাকে এ্যাডজাস্ট করে নিতে সহায়তা করবে।
‘ধন্যবাদ, ইন্দ্রা। এখন হয়ত ঘুমাতে হবে। কিন্তু একটা পয়েন্ট ধরিয়ে দিয়েছে এটা।
কী?
‘আমি অনেকটা আহ্লাদিত যে হাজার বছর বয়েসি করে আমাকে দুহাজার এক সালে পাঠানো হয়নি। কোয়ান্টাম জাম্পের পক্ষে সেটা খুব বেশি অসহ্য হয়ে উঠত… অসম্ভব! কেউ সেটার সাথে মানিয়ে নিতে পারত না। অন্তত আমি ইলেক্ট্রিসিটির ব্যাপারটা জানি, আর আমার সাথে কোনো ছবি কথা বলতে শুরু করলে ভয়ের চোটে আধমরা হয়ে যাব না।
আশা করি, বলল পোল নিজেকেই, এই আত্মবিশ্বাসটা উপযুক্ত। কে যেন বলত, যথাযথ উন্নতি করা প্রযুক্তিকে জাদু থেকে আলাদা করা যাবে না, যদি যায়, তাহলে সেটা উন্নত নয়।
এ ভুবনে আমাকে কি জাদুর মুখোমুখি হতে হবে? আর আমি কি সেটার সাথে মানিয়ে নিতে পারব?
৬. ব্রেইনক্যাপ
‘একটা যন্ত্রণাময় সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে আপনাকে,’ বলল প্রফেসর এ্যান্ডারসন মুখে ঝুলে আছে এমন এক হাসি যাতে কথাটার গুরুত্ব একটু হাল্কা হয়ে যাবে।
‘আই ক্যান টেক ইট, ডক্টর। সরাসরি আমার কাছে দিন, ব্যস।
‘আপনার ব্রেইনক্যাপের জন্য কষ্টকর একটা ব্যাপার যে থাকবে তা আগেই বলে দিয়েছি। আপনাকে টেকো হয়ে যেতে হবে। হয় সব সময়ের জন্য, নয়ত মাসে একবার করে মাথা মুড়িয়ে নেয়াই নিয়ম। এখন, কোনটা বেছে নিবেন তা আপনার সিদ্ধান্ত।‘
স্থায়ী পদ্ধতিটা কী রকম?’
‘লেজার স্কাল্প ট্রিটমেন্ট। গোড়া থেকে ফলিকল মেরে ফেলে।‘
‘হুম… পরে পাল্টানো যায়?’
‘ধরে নিতে পারেন যায় না। কাজটা ভজঘট লাগিয়ে দিবে। ব্যথা ট্যথা পাবেন। সময় লেগে যাবে হপ্তা কয়েক।‘
‘তাহলে আগে দেখতে হবে চুল ছাড়া আমাকে দেখায় কেমন। স্যামসনের কপালে কী ঘটেছিল সেটা ভুলে যাবার চেষ্টা করব।‘
‘কে?’
‘অনেক পুরনো এক বইয়ের চরিত্র। ঘুমিয়ে থাকার সময় তার গার্লফ্রেন্ড কচ করে চুল কেটে দিয়েছিল। জেগে ওঠার পর বেচারা সমস্ত শক্তি খুইয়ে বসে।‘
‘ও, এবার মনে পড়েছে- একেই বলে মেডিক্যাল সিম্বলিজম।‘
‘তবু, দাড়ি হারাতে কোনো আপত্তি নেই আমার। দিনকে দিন শেভ করতে করতে হাপিয়ে উঠেছি।‘
ব্যবস্থা নিচ্ছি আমি। আর কোন ধরনের উইগ পছন্দ করেন?
হেসে উঠল পোল। চারপাশের সবাই যে পাকাপাকিভাবে টাকমাথা সেটা আবিষ্কার করতে পোলের একটু সময় লাগল। সময় লাগল মেনে নিতেও। তার নার্স দুজনেই এর মধ্যে কৃত্রিম চুল সরিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলছে, আরো কয়েকজন টেকো স্পেশালিস্ট তার মাইক্রোবায়োলজিক্যাল টেস্টের জন্য এলে মেয়েগুলো মোটেও অস্বস্তিতে পড়ে না। এত বেশি চুলছাড়া মানুষ আশপাশে আর কখনো দেখেনি সে। জীবাণুর বিরুদ্ধে অশেষ যুদ্ধে এটাই যে মেডিক্যাল সায়েন্সের সর্বশেষ পদক্ষেপ তা বোঝা যায়।
প্রফেসর এ্যান্ডারসন সময় নষ্ট করার মানুষ নয়। সেদিন বিকালেই বিকট গন্ধওয়ালা কী এক ক্রিম পোলের মাথায় মাখিয়ে দিল নার্সেরা। ঘন্টাখানেক পরে সে যখন আয়নায় নিজেকে দেখে, প্রথমে চিনতেই পারে না। আসলে, বলে সে আপন মনে, আমার মনে হয় একটা পরচুলার ধারণা মন্দ নয় মোটেও…
ব্রেইনক্যাপ ফিটিঙে আরো একটু বেশি সময় লাগল। প্রথমে একটা মন্ড বানানো হবে। তাকে বসে থাকতে হবে অনড়, যেন প্লাস্টারটা সেট হয়ে যায়। মনে মনে ক্ষীণ আশা, তারা বলবে পোলের মাথাটা ঠিক শেপে নেই যে ব্রেইনক্যাপ বসানো যাবে।
একটু পর নার্সেরাই নার্ভাস হয়ে যায়- কঠিন সময় পেরিয়ে যেতে যেতে পোল বলে, আউচ- ব্যথা করছে তো!
এবার স্কালক্যাপের পালা। নস্টালজিক চিন্তা ভর করে মনের ভিতরে- আহা, আমার ইহুদি বন্ধুরা এখন যদি দেখতে পেত। কয়েক মিনিট পর এত বেশি স্বাভাবিক লাগে যে সে এটার অস্তিত্বের কথাই ভুলে যায়।
ইন্সটলেশনের জন্য প্রস্তুত সে। সময় এসে গেছে। আধ মিলিয়ন বছরের চেয়েও বেশি বয়েসি মানবজাতির কথা মনে পড়ে যায়।
.
‘চোখ বন্ধ করার কোনো দরকার নেই, টেকনিশিয়ান বলল, লোকটাকে “ব্রেইন ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল, সংক্ষেপে তাদের ব্রেইনম্যান” বলা হয়, সেটআপ শুরু হয়ে গেলে আপনার সমস্ত ইনপুট নিয়ে নেয়া হবে। চোখ ভোলা থাক আর বন্ধ, তাতে কোনো উনিশ বিশ হবে না। কি দেখতে পাবেন না আপনি।
কে জানে, সবাই আমার মতো এতটা নার্ভাস হয়ে পড়ে কিনা, প্রশ্ন তোলে পোল নিজের কাছে। আমার নিজের মনের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখার এই কি শেষ মূহুর্ত? তবু, একালের টেকনোলজির উপর বিশ্বাস রাখতে শিখেছি আমি। অন্তত এখন পর্যন্ত এরা আমাকে ঠকায়নি। অবশ্যই, সেই পুরনো দিনের কথাটা ভুলে গেলে চলবে না, ‘দেয়ার ইজ অলওয়েজ এ ফাস্ট টাইম…’
যেমনটা কথা দেয়া হয়েছিল, সে কি অনুভব করছে না। মাথার খুলি কামড়ে ধরে ন্যানোওয়্যার একটু একটু করে গরম হয়ে উঠছে, টের পাওয়া যায়। এখনো অন্য সব অনুভূতি টনটনে একেবারে স্বাভাবিক। যখন সে পরিচিত ঘরটার খোঁজে চারপাশে তাকায়, দেখা গেল সব ঠিকই আছে।
ব্রেইনম্যানও একটা কালক্যাপ পরে আছে, পোলেরটার মতোই তার লাগানো। সাথে একটা ইকুইপমেন্ট, বিংশ শতাব্দির ল্যাপটপ কম্পিউটারের সাথে গুলিয়ে ফেলা যাবে সেটাকে সহজেই। আশ্বস্ত করার ভঙ্গি তার হাসিতে।
‘রেডি? প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সে।
‘রেডি, যেমনটা আমি সব সময় থাকব। জবাব ছুঁড়ল পোলও।
আস্তে আস্তে নিভু নিভু হয়ে এল আলো। হারিয়ে গেল চোখের আড়ালে। ঝপ করে নেমে এল নিঝুম নিরবতা। টাওয়ারের মৃদু গ্র্যাভিটিও যেন ভুল করে তার উপর থেকে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়েছে মুহূর্তে। যেন কোনো ণ শূন্যতার উপর ভাসছে; পুরোপুরি অন্ধকার নয় চারপাশটা। সে এমন অঞ্চলকে চেনে, আন্ট্রা ভায়োলেট আসার ঠিক আগের যে আলোকে মানুষ কিছু কিছু দেখতে পায়, সে অঞ্চলে আছে যেন। গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের কাছে ডুবতে থাকার সময় একবার সে এমন অভিজ্ঞতার কাছাকাছি পৌঁছেছিল। ক্রিস্টালাইন শূন্যতার ভিতর দিয়ে শত শত মিটার নিচে তাকিয়ে থেকে গুলিয়ে উঠেছিল ভিতরটা। একাকীত্বের অসম্ভব এক যন্ত্রণা মুচড়ে দিচ্ছিল ভিতরটাকে। আতঙ্কটা কেমন করে যেন বেড়ে যাচ্ছিল প্রতি মুহূর্তে। বলাই বাহুল্য, সে কখনো স্পেস এজেন্সির সাইকিয়াট্রিস্টদের কাছে এ কথা ভুলেও উচ্চারণ করেনি…
অনেক অনেক দূর থেকে একটা গমগমে স্বর এসে তার শূন্যতাকে কাঁপিয়ে দিল। কিন্তু কঠটা কানে কানে আসেনি। এসেছে মস্তিষ্কের প্রতিধ্বনির গোলকধাঁধা থেকে।
ক্যালিব্রেটিং স্টার্টিং। শুরু হচ্ছে মান নির্ণয়। একটু পর পর আপনাকে প্রশ্ন করা হবে- আপনি মনে মনে উত্তর দিতে পারেন, আবার পারেন ভোকালি। বুঝতে পারছেন?
হ্যাঁ। বলল পোল । জানে না ঠোঁট নড়ল কিনা তা জানার আর কোনো উপায় নেই।
শূন্যতার বুকে কিছু একটা ফুটে উঠছে। পাতলা রেখার একটা গ্রিড। যেন গ্রাফ পেপারের বিশাল কোনো পাতা। বর্ধিত হচ্ছে উপরে আর নিচে। ডানে আর বামে। দৃষ্টি যতদূরে যায় ঠিক ততদূরে। মাথা নাড়ানোর চেষ্টা করে সে মরিয়া হয়ে। চোখের সামনে থেকে সরে না দৃশ্যটা।
গ্রিডের ওপার থেকে সংখ্যা উঠে আসছে। পড়ার কোনো উপায় নেই, এত দ্রুত। কিন্তু সম্ভবত কোনো একটা সার্কিট তাদের রেকর্ড করে নেয়। পোল না হেসে পারে না। (গাল কি নড়েছিল সে হাসির সময়ে?) এসবইতো পরিচিত! এটাতো সেই কম্পিউটার চালিত চোখ পরীক্ষার মতো যেটা তার আমলের অকুলিস্টরা রোগিদের উপর চালাত।
উবে গেল গ্রিডটা। রঙের পরিচ্ছন্ন শিটে ভরে গেল দৃষ্টিসীমা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেগুলো বর্ণালির সবগুলো রঙে ঝলকে উঠতে লাগল। তোমাদের আগেই বলে রাখতে পারতাম,’ বলল পোল নিরবে, আমার কালার ভিশন খুবি স্বচ্ছ। একেবারে যুতসই। পরের পরীক্ষাটা নিশ্চয়ই শ্রবণশক্তির?
আন্দাজটা ঠিক। প্রথমে মৃদু লয়ে একটা ঢাকের গুড়গুড় আওয়াজ উঠল। আস্তে আস্তে আরো নিচু হয়ে তারপর উঁচু হতে শুরু করল। সবশেষে শ্ৰবণসীমার শেষপ্রান্তে নেমে গেলে, নেমে গেল বাদুড় আর ডলফিনের রাজ্যে।
সরল, সোজাসাপ্টা পরীক্ষার এখানেই ইতি। একটু পরই অনেক ধরনের ঘ্রাণে ভরে গেল মনোজগত। কিছু কিছু খুবি মিষ্টি। বাকিগুলো বীভৎস। এরপর সে পরিণত হল, মনে হয় এমনি, পরিণত হল অদৃশ্য কোনো হাতের পুতুলে।
ধারণা করল সে, নিউরোমাস্কুলার কন্ট্রোল চেখে দেখা হচ্ছে। আশা করছে, এসবের কোনো প্রভাব তার শরীরে পড়বে না। শরীর, হাত, পা নড়বে না। যদি তাই হয় তো বেশ হাস্যকর ব্যাপার। দেখাবে সেন্ট ভিটাসের নাচের টার্মিনাস এন্ডের মতো।
এরপর কী হল সে বুঝতে পারল না। তলিয়ে গেল স্বপ্নহীন ঘুমের জগতে।
নাকি শুধু স্বপ্নে দেখল ঘুমের ব্যাপারটা? জেগে ওঠার আগে কতটা সময় পেরিয়ে গেছে সে সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। মাথায় আর হেলমেটটা নেই। হদিস নেই ব্রেইনম্যান বা তার সেই ল্যাপটপের মতো যন্ত্রটারও।
‘সব চলেছে ঠিকমত।’ বলল মার্টন, কোন সমস্যা যে নেই সেটা বের করতে মাত্র ঘন্টা কয়েক লাগবে। যদি আপনার রিডিং কে. ও. হয়- আই মিন ও. কে. হয়- কালই পেয়ে যাবেন আপনার ব্রেনক্যাপ।
পোল বেচারার আদ্যিকালের ইংরেজি শিখে নেয়ার খাটুনির ব্যাপারটা ঠিক ঠিক টের পেয়ে গেল। তবু, কপাল খারাপ, মার্টনের স্লিপ অব টাং হতেই পারে।
ফাইনাল ফিটিংয়ের সময় চলে এসেছে। পোল যেন কোনো বাচ্চা ছেলে। ফিরে গেল সে ছেলেবেলায়। যেন ক্রিসমাস ট্রির নিচ থেকে কোনো আনকোরা নতুন উপহার তুলে আনবে।
‘আপনাকে আবার সেসব সেটিংআপের সাথে মানিয়ে নিতে হবে না এবার। ব্রেইনম্যান আশ্বস্ত করছে, মুহূর্তেই ডাউনলোড় শুরু হয়ে যাবে। মাত্র মিনিট পাঁচেকের একটা ডেমো দিচ্ছি। আশা করি আপনি উপভোগ করবেন।
শান্ত, নিবিড় হয়ে আসে মিউজিকের লয়, ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাকে। সেই হাজার বছর আগের চির পরিচিত কোনো এক বাজনা। কোনোটা, ধরা যায়শা। চোখের সামনে কুয়াশার ভারি পর্দা। সামনে এগিয়ে যাবার সাথে সাথে সরে গেল সেটা…
তাইতো, সে হাঁটছিল। কল্পনাটা একেবারে বিশ্বাসযোগ্য; মাটিতে পা পড়ছে। তরঙ্গ উঠছে সেখান থেকে। পায়ে মাটির ঈষৎ কোমল অনুভূতি হচ্ছে। কোথায় হারিয়ে গেল বাজনাটা, বোঝা যায় না। চারধারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সুবিশাল বৃক্ষরাজি। ক্যালিফোর্নিয়া রেডউড। কে জানে, এখনো তারা এই পৃথিবীর কোনো না কোনো জায়গায় উন্নত শিরে দাঁড়িয়ে আছে কিনা হাজার বছরের প্রযুক্তিগত বিবর্তনের পথ পেরিয়ে।
আস্তে আস্তে বেড়ে যায় চলার গতি। সময়ও যেন বয়ে যাচ্ছে দ্রুতলয়ে। আরো গতি বাড়ে। আরো, আরো। গতি বাড়ানোর চেষ্টার যে একটা ধাক্কা আছে সেটা গায় লাগছে না। যেন অন্য কোনো মানুষের গায়ে ভর করেছে প্রেতাত্মা হয়ে। উত্তেজনাটা থিতিয়ে এল একটা ভাবনার সাথে, তার এসব কাজে তো নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই! থামা বা দিক বদলানোর চেষ্টা করে কোনো লাভ হল না।
তাতে কিছু এসে যায় না। সে এ মাদকতায় চুর হয়ে যাচ্ছে। এ ছুটাছুটি ভাল লাগছে তার। সেই ‘ড্রিম মেশিন’ যেটার আশায় বুক বেধে ছিল তার আমলের অনেক বিজ্ঞানী, সেটা এখন হাতের মুঠোয়। পোল ভেবে পায় না কী করে মানুষ সারভাইভ করল, তাকে জানানো হয়েছিল যে মানবজাতির বেশিরভাগই টিকে যেতে পারেনি। মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের মস্তিষ্ক জ্বলে গিয়েছিল। হারিয়ে গিয়েছিল তারা অতলে।
অবশ্যই, সেসবের দিন অনেক আগে কেটে গেছে। এখন, এই অসাধারণ যন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে চিনতে হবে তৃতীয় সহস্রাব্দটাকে। কয়েক মিনিটে এমন সব ব্যাপার মাথায় চলে আসবে যেগুলো আগে আয়ত্ত করতে বছরের পর বছর সময় লেগে যেত। অবশ্য, সে মাঝে মাঝে, খুব বেশি প্রয়োজন পড়ে গেলে, ব্রেনক্যাপকে নিখাদ উপভোগের জন্য ব্যবহার করবে….
বনের শেষপ্রান্ত হাজির, সামনে খরস্রোতা এক চওড়া নদী। কোনো প্রকার অস্বস্তি ছাড়াই নেমে পড়ল সেখানে। চারধারে পানি। পানি গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে আস্তে আস্তে। উঠে যাচ্ছে শরীর ছাড়িয়ে উপরে, আরো উপরে। নেমে যাচ্ছে সে অতলে। সেখানেও স্বাভাবিকভাবেই শ্বাস নেয়া যাচ্ছে দেখে একটু অবাক না হয়ে পারল না। আরো অবাক করা ব্যাপার, ভোলা চোখে মানুষ যেখানে খুব একটা বেশি দেখতে পাবে না এমন এক মাধ্যমে সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। এই অবাক করা দুনিয়ায় পাশ কেটে চলে গেল একটা ট্রট মাছ। সেটার গায়ের প্রতিটা অংশ স্পষ্ট দেখা যায়।
মৎস্যকন্যা! আসলে, সে সব সময় এমন কোনো প্রাণির দেখা পেতে চাইত, কিন্তু ধারণা ছিল সেগুলো সামুদ্রিক জীব। হয়ত মাঝে মাঝে, কোনো বিশেষ কারণে তারা স্রোতের বিপরীতে উঠে আসে; স্যামনের মতো করে। বাচ্চাদের পাবার জন্য? কোনো প্রশ্ন করার আগেই চলে গেল মেয়েটা; এই যুগান্তকারী তত্তের তোয়াক্কা না করেই।
একটা অর্ধস্বচ্ছ আলোকিত দেয়ালের কাছে এসে শেষ হয়ে গেল নদীটা। ধাপের পর ধাপ পেরিয়ে এলেই হাজির হয় ধু ধু মরুভূমি। উপরে গনগনে সূর্য দীপ্তি ছড়াচ্ছে। চিড়বিড় করে ওঠে শরীর। জ্বালা ধরে যায় ভিতরে। তার পরও, প্রখর দুপুরের বুক চিরে দৃষ্টি ফেলা সম্ভব।
সব মিলিয়ে গেল মিশকালো অন্ধকারে। ভূতুড়ে বাজনা ফিরে এল আবার। ফিরে এল ঘরের শান্ত, শীতল আবহাওয়া। চোখ খুলল সে (এতক্ষণ এগুলো বন্ধ ছিল তো?)। অবাক ব্যাপার, তার রিএ্যাকশন দেখার জন্য অনেকেই ভিড় করে আছে।
‘ওয়ান্ডারফুল,’ আটকে রাখা দম ছাড়ল সে, কিছু কিছু অংশ বাস্তবের চেয়েও বাস্তব।
এবার ইঞ্জিনিয়ারের কাছে চলে গেল তার দৃষ্টি।
‘অনেক ডাটা দেয়া যায় এর মাধ্যমে, মানি। কিন্তু কীভাবে সেগুলোকে স্টোর করা হয়?
‘এ ট্যাবলেটগুলোয়। আপনাদের অডিওভিজুয়াল সিস্টেম যেগুলো ব্যবহার করত, তেমনি, শুধু অনেক বেশি ক্ষমতাবান।
ব্রেইনম্যান হাতে ধরিয়ে দিল একটা ছোট চৌকো জিনিস, সম্ভবত কাঁচের তৈরি। এক পাশে রূপার পরত দেয়া। যৌবনের কম্পিউটার ডিস্কেটের মতো। পুরুত্ব দ্বিগুণ। সামনে পিছনে নিল সেটাকে পোল। ভিতরের জায়গাটায় রঙধনুর মতো আলোর খেলা। এই সব।
হাতের মুঠোয় হাজার বছরের ইলেক্ট্রো অপটিক্যাল টেকনোলজির সর্বকনিষ্ঠ উপহার। আকৃতিটা নিয়ে প্রথমে একটু খটকা লাগে। আকৃতির খুব একটা হেরফের হয়নি কেন? কিন্তু এরও একটা ব্যাখ্যা থাকে। প্রতিদিনের জিনিসগুলোর একটা নির্দিষ্ট আকৃতি তো থাকবেই। ছুরি, কাঁটাচামচ, বই, হ্যান্ড টুল, আসবাব পত্র- আর কম্পিউটারের রিমুভেবল মেমোরি।
‘এর ক্যাপাসিটি কতটুকু? আমাদের আমলে এটুকু আকৃতিতে টেরাবাইট রাখা যেত। আশা করি আপনারা আরো অনেকটা এগিয়ে নিয়েছেন ব্যাপারটাকে।’
না, যতটা আপনি কল্পনা করতে পারেন, এখানে একটা সীমাবদ্ধতা কাজ করে; নির্ভর করছে বস্তুটার উপর। বাই দ্য ওয়ে, টেরাবাইটটা কী? ভুলে গেছি।
‘শেম অন ইউ। কিলো, মেগা, গিগা, টো… টেন টু দ্য টুয়েত্ব বাইট। তারপর পেটাবাইট- টেন টু দ্য ফিফটি- এর উপরে কিছুর কথা জানি না।
‘মোটামুটি এখান থেকেই আমাদের হিসাব শুরু। এক জীবনে একজন মানুষ যা চায় তার সবটুকু এতেই রেকর্ড করে রাখা সম্ভব।
আশ্চর্য করা ভাবনা। তবু, এতে অবাক হবার মতো তেমন কিছু নেই। কেজিখানেক জেলি যে মানুষ তার খুলির ভিতরে লুকিয়ে রাখে তার চেয়ে অনেক বেশি আছে হাতের তালুতে বন্দি এ জিনিসটার গায়ে। আসলেই, একটু একটু সব চেখে দেখতে গেলেও মানুষের জীবনটা ফুং করে উড়ে যাবে।
এই সব নয়,’ বলে যায় ব্রেইনম্যান, কিছু ডাটা কম্প্রেস করে এটা শুধু মেমোরি স্টোর করতে পারে না- পারে আসল মানুষটাকে জমা করে রাখতে।
আর তাদের রিপ্রোডিউসও করতে পারে?
‘অবশ্যই; ন্যানো এ্যাসেমব্লির কাছে বাঁ হাতের খেল।
তাই আমি শুনেছিলাম, ভাবে সে, কিন্তু কখনো বিশ্বাস করিনি।
তার আমলে এটুকুতেই মানুষ সন্তুষ্ট ছিল যে একজন মানুষের সমস্ত জীবনের কাজ হোট ডিস্কেটে আটকে রাখা যেত।
কিন্তু আজকের দিনে এরা শুধু কাজটাকেই ধরে রাখতে পারে না, চিরঞ্জীব করে তুলতে পারে স্বয়ং শিল্প স্রষ্টাকেও।
৭. ডিব্রিফিঙ
‘আমি খুব খুশি,’ বলল পোল, ‘যে, এই এত শতাব্দি পরেও স্মিথসোনিয়ান এখনো বেঁচে আছে।’
‘আপনি সম্ভবত এটা বুঝে উঠতে পারবেন না,’ বলল নিজেকে ডক্টর এ্যালিস্টার কিম নামে পরিচয় দেয়া এ্যাস্ট্রোনটিক্সের ডিরেক্টর লোকটা, বিশেষত যখন এটাকে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে পুরো সৌরজগত জুড়ে। মূল অফ-আর্থ কালেকশন রাখা হয়েছে চাঁদ আর মঙ্গলের বুকে। বেশিরভাগ এক্সিবিট, যা আসলেই আমাদের মালিকানাধীন, চলে যাচ্ছে তারার রাজ্যে। একদিন তাদের ধরে ফেলব আমরা। তারপর ফিরিয়ে আনব আপন দেশে। এমনকি সৌরজগতের বাইরে মানুষের পাঠানো প্রথম বস্তু পাইয়োনিয়ার টেনের উপর কজা করারও অনেক ইচ্ছা ছিল আমাদের।’
‘মনে হয় আমিও সে কাজই করতে যাচ্ছিলাম, মহাশূন্যে ভেসে ভেসে। তার পরই তো তারা নাগালে পেয়ে গেল আমাকে।
‘আপনার এবং আমাদের সবার সৌভাগ্য। না জানা অনেক ব্যাপারে আলোকপাত করতে পারবেন আপনি নিঃসন্দেহে।
ফ্র্যাঙ্কলি বলতে গেলে, সন্দেহ আছে পারব কিনা। তবে চেষ্টা করব। রানওয়ে পোডটা গলাধাক্কা মেরে বের করে দেয়ার পর আর কিছুই মনে নেই আমার। বিশ্বাস হয় না ব্যাপারটা। তারা তো বলেছিল, হাল নির্ভরযোগ্য।
‘কথা সত্যি। কিন্তু কাহিনীটা অনেক প্যাচানো। বলে বোঝানো যাবে না এক কথায়। আপনি জানেন, ডেভ বোম্যান আপনার জন্য শিপের বাইরে গিয়েছিল? তারপর হাল তাকে ভিতরে ঢুকতে দিতে চায়নি।
‘কেন, ফর গডস সেক?
একটু যেন সঙ্কুচিত হয়ে গেল ডক্টর কিম। আগেও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে পোল।
(ভাষায় সংযত হও, ফ্র্যাঙ্ক পোল। এ যুগে ‘গড’ শব্দটা খুব একটা প্রচলিত নয় বোঝা যাচ্ছে- ইন্দ্রাকে জিজ্ঞেস করতে হয়।)
হালের ইন্সট্রাকশনে একটা বড় ধরনের প্রোগ্রামিং ক্রটি ছিল। মিশনের এমন সব ব্যাপার তার জানা ছিল যা আপনি বা ডেভ বোম্যান কেউ জানতেন না। রেকর্ডিংয়ে সব পাবেন…
যাই হোক, সে একই সাথে তিনজন হাইবারনটের লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমও কাট অফ করে দেয়। তারাই ছিল আলফা ক্রু। বোম্যান তাদের দেহেরও সদগতি করে।
(ওরে বাবা! তাহলে আমি আর ডেভ বেটা কু? দ্বিতীয় স্তরের? আরো একটা ব্যাপার যা সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই…)
‘তাদের কী হল? প্রশ্ন তুলল পোল, আমার মতো করে উদ্ধারের কোনো আশা ছিল না?
‘আই এ্যাম এ্যফ্রেইড, না। চেষ্টার কোনো ত্রুটি করিনি। হালের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কয়েক ঘন্টা পর বোম্যান তাদের ইজেক্ট করে। আপনার অর্বিট থেকে তাদেরটা সামান্য এদিক সেদিক হয়ে গিয়েছিল। বৃহস্পতির গায়ে পড়তে পড়তে ভস্ম হয়ে যাবার জন্য সেটুকুই যথেষ্ট। অথচ আপনার কক্ষপথ কী করল জানেন? বৃহস্পতির অভিকর্ষকে কাজে লাগিয়ে আপনাকে অসম্ভব দ্রুতিতে পাঠিয়ে দিল বাইরের দিকে। আর মাত্র কয়েক হাজার বছর পরই চলে যেতেন ওরিয়ন নেবুলার দিকে…
‘তারপর কী করে যে সব ঠিক ঠিক চালাল বোম্যান তা ভাবতেও অবাক লাগে। সময় মতো বৃহস্পতির অর্বিটে নিয়ে গেল ডিসকভারিকে। দেখা পেল দেখা পেল এমন একটা কিছুর দ্বিতীয় অভিযানে যাকে নাম দেয়া হয়েছিল বিগ ব্রাদার। টাইকো মনোলিথের যমজ। শত শত গুণ বড়।
‘এবং ঠিক সেখানেই আমরা হারিয়ে ফেলি তাকে। বাকি স্পেস পোডটায় চড়ে বেরিয়ে গেল ডিসকভারি থেকে। নেমে গেল বিগ ব্রাদারের দিকে। হাজার বছর ধরে আমরা তার সেই শেষ বাক্যের প্রহেলিকায় আটকে আছি, ‘বাই ডিউস- এ তো তারায় তারায় জা!”
(এইতো, পথে এসেছ! পোল বলল নিজেকেই। ডেভ কখনো এমন কথা বলবে না। সে নিশ্চয়ই বলেছিল, মাই গড- এ তো তারায় তারায় ভরা!)
‘বোঝাই যাচ্ছে, পোডটাকে মনোলিথের ভিতরে কোনো অসম্ভব শক্তিশালী বল টেনে নিয়েছিল। কারণ এটা সম্ভবত বোম্যান- এই প্রচন্ড ত্বরণের হাত থেকেও বেঁচে যায় যদিও তার একেবার চূর্ণ হয়ে যাবার কথা। এবং এটুকুই জানা ছিল আমাদের। দশটা বছর ধরে। পরে এল আমেরিকা আর রাশিয়ার যুক্ত অভিযান লিওনভ মিশন।
ফলে সেটা ডিসকভারির সাথে একটা সংযোগ তৈরি করে আর ডক্টর চন্দ্র হালের সাথে মোলাকাত করে। হ্যাঁ, এটুকু আমার জানা আছে।
ডক্টর কিমকে সামান্য অপ্রতিভ দেখায় এবার।
‘স্যরি- আমি ঠিক জানি না কতটা জানানো হয়েছে আপনাকে এর মধ্যেই। আর ঠিক তখন থেকেই অদ্ভুত সব ব্যাপার ঘটতে শুরু করে।
‘বোঝা গেল, লিওনরে আসার সাথে সাথে বিগ ব্রাদারের ভিতরে কিছু গড়বড় হয়ে যায়। বলা ভাল, সেখানে কোনো ব্যাপার ঘটে। আমাদের কাছে রেকর্ড না থাকলে কেউ কস্মিন কালেও বিশ্বাস করত না ব্যাপারগুলো। আসুন, দেখানো যাক… এখানে আছে ডক্টর হেউড ফ্লয়েড, ডিসকভারিতে রাতের উপর চোখ রাখছে। আগেই পাওয়ার রিস্টোর করা হয়েছিল। অবশ্যই, সবকিছু চিনতে পারবেন আপনি।
(অবশ্যই পারছি, আর অনেক আগে মরে ভূত হয়ে যাওয়া হেউড ফ্লয়েডকে আমারই সিটে বসে থাকতে দেখতে কী অদ্ভুতই না লাগছে! হালের অপলক লাল চোখটা সর্বক্ষণ চেয়ে নেই।)।
একটা মেসেজ দেখা যায় মনিটরে। অলসভাবে প্রশ্ন তোলে ফ্লয়েড, আচ্ছা, হাল, কে কল করছে?
নো আইডেন্টিফিকেশন।
একটু যেন বিরক্ত হল ফ্লয়েড।
‘ভাল। খুব ভাল। মেসেজটা দাও দেখি।’
এখানে থাকা নিরাপদ নয়। পনের দিনের মধ্যে তোমাদের পাততাড়ি গোটাতে হবে।
‘একেবারে অসম্ভব। এখন থেকে ছাব্বিশ দিনের মধ্যে আমাদের লঞ্চ উইন্ডো খুলবেই না। আগেভাগে ডিপারচার নেয়ার মতো যথেষ্ট প্রোপ্যালান্ট নেই।
এসব ব্যাপারে আমি সচেতন। তবু। পনের দিনের মধ্যে তোমাদের চলে যেতে হবে।
‘প্রেরক সম্পর্কে জানার আগে আমি এ মেসেজের কোনো গুরুত্বই দিতে পারব না… কার সাথে কথা বলছি?
আমি ছিলাম ডেভ বোম্যান। আমার কথায় বিশ্বাস করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পিছনে তাকাও।
খুব ধীরে হেউড ফ্লয়েড তার সুইভেল চেয়ারটাকে ঘোরায়। কম্পিউটার মনিটর সুইচ অফ করে দিয়েছে আগেই। পিছনের ভেলক্রো মোড়া ক্যাটওয়াকে তার দৃষ্টি।
(এবার গুরুত্ব দিয়ে দেখুন।বলল ডক্টর কিম।
আহা, এই কথাটাও যেন আমাকে বলা দরকার, ভাবে পোল…)
যতটা মনে পড়ে পোলের, ডিসকভারির অবজার্ভেশন ডেকের শূন্য অভিকর্ষের এলাকাটায় আগে এত ধূলাবালি গিজগিজ করত না। এয়ার ফিট্রেশন প্লান্ট তখনো মনে হয় ঠিক করা হয়নি। ব্রাউনিয় গতির মোক্ষম নিদর্শন দেখানোর জন্যই যেন দূরের সূর্য থেকে আসা আলোর রেখায় বালিকণাগুলো নেচে বেড়াচ্ছে চঞ্চল হয়ে।
আর এবার, এই কণাগুলোর কী যেন হয়ে গেল। খুব অদ্ভুত একটা কিছু। কোনো শক্তি যেন আধিপত্য বিস্তার করেছে তাদের উপর। সবগুলো কণাকে জড়ো করছে একটা জায়গায়। আস্তে আস্তে ফাঁপা একটা গোলকে পরিণত হল সেগুলো। মিটারখানেক প্রস্থের বুদবুদটা কিছুক্ষণ ভেসে থাকে। আস্তে আস্তে যখন সেটার আকার পরিবর্তন হতে থাকে, বদলাতে থাকে আকৃতি, পোল স্তম্ভিত হয়ে যায়। একটু পর মানুষের আদল নেয়ায় আর খুব বেশি বিস্মিত হয় না সে।
কাঁচের বাইরে এমন সব ফিগার সে আগেও দেখেছে। নানা প্রদর্শনী আর বিজ্ঞান জাদুঘরে। কিন্তু এটা একেবারে নিখুঁত কোনো আকৃতি নিল না। অনেকটা যেন ফিনিশিং টাচ দেয়ার আগের এবড়ো থেবড়ো ভাস্কর্য। প্রস্তর যুগে এমন সব গড়ন তৈরি হত। শুধু মাথাটাকে খুব যত্নে গড়ে তোলা হয়েছে। আর সেই মুখাবয়ব, কোনো সন্দেহ নেই, কমান্ডার ডেভিড বোম্যানের।
হ্যালো, ডক্টর ফ্লয়েড। এবার আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে
আকৃতির ঠোঁটগুলো কখনো নড়েনি। পোল বুঝতে পারে, কঠটা অবশ্যই বোম্যানের, তবে আসছে স্পিকার থেকে।
কাজটা আমার জন্য খুব কঠিন। হাতে সময়ও খুব কম। এ সতর্কবাণী দেয়ার অনুমতি জুটেছে কোনোক্রমে। তোমাদের হাতে সময় মাত্র পনের দিনের।
‘কেন- আর তুমি কী?’
কিন্তু এর মধ্যেই ভূতুড়ে আদলটা হারিয়ে যাচ্ছিল। এর ফাঁপা অবয়ব হারিয়ে যাচ্ছিল আশপাশের সাথে মিশতে মিশতে।
বিদায়, ডক্টর ফ্লয়েড। আমাদের আর দেখা হবে না। কিন্তু আরো একটা মেসেজ আসতে পারে যদি সব ঠিকঠাক চলে।
হারিয়ে যায় ইমেজটা। একটু না হেসে পারে না পোল। তার মুখের কোণে ঝিকিয়ে ওঠে হাসি। যদি সব ঠিকঠাক চলে! সেই পুরনো কথা। মহাকাশ অভিযানে এ কথাটা কতবার কতভাবে কতজনকে যে বলতে হত, তার ইয়ত্তা নেই। হারিয়ে গেল ছবিটা। মিশে গেল ধূলিকণার সাথে। ঘুরে তাকাল ডক্টর কিম। যাক, কমান্ডার- কী মনে হয় আপনার?
এখনো আঁকি কাটিয়ে উঠতে পারেনি পোল। জবাব দিতে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে যায়।
‘মুখের আদল আর কষ্ঠ যে বোম্যানের তা আমি কসম কেটে বলতে পারি কিন্তু এটা কী?’
‘ঠিক এ ব্যাপারটা নিয়েই আমরা আজো মাথা কুটে মরছি। একে হলোগ্রাম বলে ডাকতে পারেন। একটা প্রজেকশন, এটুকু নিশ্চিত। কেউ চাইলে সে সময়টাতেও এমন সব মিথ্যা ব্যাপার গড়তে পারত। কিন্তু এ অবস্থায়? অসম্ভব। আর তারপরই, বুঝতে পারছেন কি…?’
‘লুসিফার?’
‘ঠিক তাই। সেই সতর্কবাণীর জন্য ধন্যবাদ। তারা কোনোক্রমে লেজ গুটিয়ে পালায়। আর বিস্ফোরিত হয় বৃহস্পতি।‘
‘তাহলে, সে যাই হোক না কেন, বোম্যানের মতো দেখতে-শুনতে জিনিসটা বন্ধুভাবাপন্ন ছিল। চেষ্টা করেছিল সাহায্য করতে, তাই না?’
‘মনে হচ্ছে তাই। এখানেই তার আনাগোনা শেষ নয়। হয়ত সেই আরো একটা মেসেজ এসেছিল। আমরা যেন ইউরোপায় নাক গলানোর কোনো প্রকার চেষ্টা না করি সে সম্পর্কে জানান দিতে চেয়েছিল সে।‘
‘আর আমরা কখনো সে চেষ্টা করিনি?’
শুধু একবার, তাও দূর্ঘটনায় পড়ে গ্যালাক্সিকে হাইজ্যাক করে জোর দিয়ে নামানো হল। মাত্র ছত্রিশ বছর পরের ঘটনা। সিস্টার শিপ ইউনিভার্স সেটাকে রক্ষার জন্য যায়। সামান্য কিছু জানতে পেরেছি আমাদের রোবট মনিটরের মাধ্যমে। ইউরোপানদের বিষয়ে এই আমাদের সঞ্চয়।
‘দেখার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছি।’
‘তারা উভচর। সব আকার প্রকারে পাওয়া যাবে। লুসিফার তাদের পুরো দুনিয়া জুড়ে থাকা বরফ গলাতে শুরু করল। সাগর থেকে মুখ তুলল তারা। তখন থেকে যে গতিতে উন্নতি করছে, জীববৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা বলা চলে একেবারে অসম্ভব।‘
‘আমার যদ্দূর মনে পড়ে, ইউরোপার বরফে অনেক অনেক ফাটল ছিল। হয়ত তারা তখন থেকে উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করে।
‘এ তত্ত্ব অনেকেই মেনে নিয়েছে। কিন্তু আরো একটা মত আছে। আরো বেশি বিশ্বাস্য এবং যৌক্তিক। মনোলিথ হয়ত সেখানে কাজে লাগছে। এমন কোনো পথে, যার হদিস আমরা পাইনি। এই চিন্তাকে আরো বেগবান করে টি এম এ জিরো। সেটাকে পাওয়া যায় শ পাঁচেক বছর পরে। কোথায় জানেন? পৃথিবীর বুকে। আশা করি সেটার কথা বলা হয়েছে আপনাকে?’
‘ভাসাভাসা। এত কম সময়ে এতকিছু জানতে চেয়েছি আমি। কিন্তু নামটা বিদঘুঁটে, তাই না? এটা তো কোনো ম্যাগনেটিক এ্যানোমালি নয়। তার উপর অবস্থান ছিল আফ্রিকায়, টাইকোর বুকে না।‘
‘আপনার কথা পুরোপুরি সত্যি, কিন্তু নামটার সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে। সমস্যা হল, মনোলিথের পানি যত নাড়তে যাই ততই ঘোলাটে হয়ে ওঠে। অন্তত এখনো পৃথিবীর বাইরের এ্যাডভান্সড টেকনোলজির নিদর্শন তারাই।
ব্যাপারটা আমাকে চমকে দিচ্ছে। আমি মনে করেছিলাম এ্যাদ্দিনে আমরা তাদের কাছ থেকে রেডিও সিগন্যাল পেয়ে গেছি। আমি একেবারে বাচ্চা ছেলে থাকার সময় এ্যাস্ট্রোনোমাররা এ খোঁজ শুরু করে।’
‘আসলে, একটা ইশারা এসেছিল। কিন্তু ইশারাটা এত বেশি ভয়ানক যে আমরা এসব নিয়ে আলাপ করতেও ভয় পাই। কখনো নোভা স্করপিওর কথা শুনেছেন?’
‘মনে হয় না।’
‘তারকারা নোভায় পরিণত হয় সব সময়, আর এটা খুব বেশি ভাল কিছু ছিল । কিন্তু এটা ধ্বসে যাবার আগে এন স্করপিওতে অনেক গ্রহ থাকার ব্যাপারটা ধরা পড়ে।’
‘এবং সেখানে বসবাস করা হত?
‘বলার আর কোনো উপায় নেই; রেডিও সার্চাররা কোনো কিছুই ধরতে পারেনি। এবং এখানেই দুঃস্বপ্নটার শুরু…
‘সৌভাগ্যক্রমে একটা স্বয়ংক্রিয় নোভা প্যাট্রল ব্যাপারটাকে ধরতে পেরেছিল একেবারে গোড়াতেই। ঘটনার শুরু অকল্পনীয়। নক্ষত্রেই হবার কথা, তাই না? তা। হয়নি। হয়েছে একটা গ্রহ থেকে। সেই গ্রহ নক্ষত্রটাকে এবং পুরো জগৎকে ধ্বংস করেছে।’
‘মাই গড… স্যরি! বলে যান।‘
ব্যাপারটাকে কি আপনি ধরতে পারছেন? একটা গ্রহের পক্ষে নোভায় পরিণত হবার কোনো উপায় নেই। কোনোই উপায় ছিল না। পরে… আমরা যেহেতু জানি, একটা উপায় আছে।
‘আমি একবার এক সায়েন্স ফিকশন উপন্যাসে সস্তাদরের কৌতুক পড়েছিলাম সুপারনোভাই (supernovae) হল ইন্ডাস্ট্রিয়াল এ্যাক্সিডেন্ট।
‘না-না। কোনো সুপারনোভা ছিল না। কিন্তু কথাটা হয়ত কৌতুক নয়। সবচে গ্রহণযোগ্য মতবাদ হল, অন্য কেউ ভ্যাকুয়াম এ্যানার্জি ট্যাপ করছিল। তারপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।‘
‘অথবা যুদ্ধ।‘
‘একই কথা; কে জানে, কোনোদিন জানতে পারব কিনা! কিন্তু যেহেতু আমাদের সভ্যতাও একই ধরনের শক্তির উৎস ব্যবহার করে, আপনি বুঝতেই পারছেন কেন এন স্কৰ্প মাঝে মাঝে আমাদের দুঃস্বপ্নের মধ্যে ফেলে দেয়।‘
‘আর আমাদের শুধু গলতে থাকা নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর আছে যা নিয়ে আমরা ভাবিত হতে পারি, তাই না?’
‘এখন আর না, থ্যাঙ্ক ডিউস। কিন্তু আমি আপনাকে টি এম এ জিরোর আবিষ্কারের ব্যাপারে আরো বলতে চেয়েছিলাম, কারণ এটা মানব ইতিহাসের সবচে বড় মোড়ের মধ্যে একটা।
‘টি এম এ এক পাবার পর মানুষ যথেষ্ট ঝাঁকি খেয়েছে। কিন্তু পাঁচশ বছর পর সেটা আরো প্রকট হয়ে দেখা দেয় টি এম এ জিরো আবিষ্কারের সাথে সাথে। এটা বাসার অনেক কাছে। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে, এইতো, নিচে, আফ্রিকার বুকে। রীতিমত আতঙ্কের ব্যাপার, তাই না?
৮. ওলডুভাইয়ে ফিরে দেখা
এই লিকিরা, নিজেকেই শুনিয়ে বলে ডক্টর স্টিফেন ডেল মার্কো মাঝে মাঝে, হয়ত কখনোই এ জায়গাটা চিনতে পারত না, যদিও পাঁচ শতাব্দি আগে লুইস আর মেরি আমাদের প্রথম পূর্বপুরুষকে খুঁড়ে তুলে এনেছিল এখান থেকে মাত্র বারো কিলোমিটার দূরে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং আর ছোট্ট আইস এজটা বদলে দেয় ভূ-চিত্র। যদিও অসম্ভব অগ্রসর টেকনোলজির সহায়তায় সরিয়ে দেয়া হয়েছিল বরফ যুগকে, তবু তার প্রভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেছে চারপাশের দৃশ্যপট। ওক আর পাইন গাছেরা এখনো যুঝছে; জানে না প্রতিকূল পরিবেশে কে টিকে যাবে শেষ পর্যন্ত।
ব্যাপারটা বিশ্বাস করা কষ্টকর যে এই ২৫১৩ সালেও অতি উৎসাহী এ্যানথ্রোপোলজিস্টদের খোঁড়াখুঁড়ির হাত থেকে ওলডুভাইয়ে কিছু বেঁচে আছে। যাই হোক, সাম্প্রতিক ঝড়ো বন্যায়, যা হবার কথা ছিল না, তার কবলে পড়েই, উপরের দিকের কয়েক মিটার মাটি ক্ষয়ে যায়। ডেল মার্কো এ সুযোগটাই নেয়। তারপর, সেখানে সামান্য ডিপ স্ক্যান করে যা দেখতে পায় তা ঠিক বিশ্বাস্য নয়।
এক বছরের চেয়েও বেশি সময় ধরে গহিন খনন চলল, চলল সাবধান পর্যবেক্ষণ, তিলতিল করে। কখনো কল্পনা করতেও যা বাধে তার চেয়ে বেশি অদ্ভুত এই বাস্তবতা, ভেবে হয়রান হয় সে। রোবট ডিগিঙ মেশিনগুলো খুব দ্রুত প্রথম কয়েক মিটার খুঁড়ে ফেলল। এবার ট্র্যাডিশনাল গ্র্যাজুয়েশন ছাত্রদের দাস-দল ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের সাথে কাজ করেছিল চারটা কঙ। দানবীয় কঙ। ব্যাপারটা ভাল চোখে দেখেনি ডেল মার্কো। কিন্তু ছাত্রেরা জেনেটিক্যালি মডিফাইড গরিলাগুলোকে মনে করে নিজেদের দস্যি ছেলে। এমনকি গুজব উঠেছিল যে তাদের এই ভালবাসার খেলাটা পুরোপুরি তুলসী পাতায় বোয়া না।
প্রথম কয়েক মিটারের কথা। পুরো কাজটাই মানুষের হাতের। সামান্য টুথব্রাশ ব্যবহার করেই তাদের মাটি খুঁড়তে হয়। খুঁড়তে হয় বললে ভুল বলা হবে, মাটিকে তোয়াজ করে করে ধুলা উড়াতে হয়। একটু একটু করে। অনেক অনেক সময় নিয়ে। এবার কাজটা শেষ হল; যেন হাওয়ার্ড কার্টার তুতেনখামেনের সমাধিমন্দিরের ভিতরে থাকা স্বর্ণসম্ভারের ঝলক দেখতে পাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই নিশ্চিত হয়ে গেল ডেল মার্কো, মানবেতিহাসের পাতায় পাতায়, মূল্যবোধ আর দর্শনের পথে পথে নতুন মোড় সৃষ্টি হবে। বদলে দিতে হবে অনেক কিছুই।
পাঁচ শতাব্দি আগে চাঁদের বুকে আবিস্কৃত মনোলিথ টি এম এ একের সাথে এর অনেক অনেক মিল। হুবহু একই রকম। কাজেও একই। আলল শুষে নিচ্ছে। বুভুক্ষুর মতো শুষে নিচ্ছে সর্বক্ষণ। লুসিফারের ক্ষীণ আলো কি সূর্যের খরতাপ, কোনোটাই তার গা থেকে বিন্দুমাত্র প্রতিফলন নিয়ে আসতে পারে না।
সে, তার কলিগেরা, পৃথিবীর সবচে বিখ্যাত আধ ডজন জাদুঘরের ডিরেক্টর, উজ্জ্বলতম তিন এ্যানথ্রোপোলজিস্ট, সবচে বড় মিডিয়া সাম্রাজ্যের দুই কর্ণধার সেই গর্তের ভিতরে, একেবারে নিশ্চুপ হয়ে আছে। ডেল মার্কো জানে না এত বেশি দামি মানুষ এতক্ষণ একসাথে চুপ করে কখনো ছিল কিনা।
এখানে, চারপাশে যেখানে মানুষ, আদিম মানুষ, মানুষের পূর্বপুরুষ, নানা আদিম জন্তু জানোয়ার ফসিল হয়ে আছে সেখানে, সেসবের নিচে যাকে পাওয়া গেল তার কথা ভাবা সম্ভব হয় কীভাবে?
এখানেই- সময় এবং স্থানের হিসাবে ঠিক এখানেই- মানব সম্প্রদায়ের পথচলা শুরু হয়েছিল।
আর এই মানবজাতির শত সহস্র ঈশ্বরের মধ্যে এই মনোলিথই প্রথম।
৯. স্কাইল্যান্ড
‘কাল রাতে আমার বেডরুমে ছুঁচো দৌড়াদৌড়ি করেছে,’ মৃদু স্বরে অভিযোগ করল পোল, ‘একটা বিড়াল যোগাড় করা যায় নাকি কোনোমতে?’
ডক্টর ওয়ালেসের চোখেমুখে বিভ্রান্তি। তারপর হঠাৎ হাসির দমকে ভেঙে পড়ল সে।
‘তুমি নিশ্চয়ই কোনো ক্লিনিং মাইক্রোটের আওয়াজ পেয়েছ- আমি প্রোগ্রামিং চেক করে রাখব যেন সেগুলো তোমাকে না জ্বালায়। সাবধান, কোনোটাকে ধরে ফেললে আবার পা দিয়ে চেপে ধরো না। তাহলেই কর্ম সারা। সে সহায়তার জন্য খবর পাঠাবে আর সব বন্ধু চলে আসবে চটজলদি।’
অনেক শিখতে হবে অনেক কম সময়ে। না, ভাবনাটা ঠিক নয়, ধমকায় পোল নিজেকে। সামনে হয়ত আরো একটা শতাব্দি পড়ে আছে- এ যুগের চিকিৎসা বিজ্ঞানকে ধন্যবাদ। দীর্ঘজীবী হয় মানুষ। চিন্তাটা তাকে আনন্দের বদলে বিমর্ষ করে তোলে।
এতদিনে সে অন্তত বেশিরভাগ কথা বুঝে উঠতে শিখেছে, উচ্চারণ করতে শিখেছে এমন সব শব্দ যাতে তার কথা শুধু ইন্দ্রাই বুঝতে পারে না, বুঝে উঠতে পারে আরো কেউ। তার অনেক ভাল লাগে এই জেনে যে এ্যাংলিশ এখনও পৃথিবীর ভাষা যদিও ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান আর মান্দারিন সুপ্ত হয়ে যায়নি, বেঁচে আছে সগর্বে।
‘আমার আরো একটা সমস্যা আছে, ইন্দ্রা- আর যন্দুর মনে হয় একমাত্র তুমিই সহায়তা করতে পার। যখন আমি “গড” শব্দটা উচ্চারণ করি, মানুষ এত কুঁকড়ে যায় কেন?’
ইন্দ্রাকে ততটা অপ্রস্তুত মনে হয় না, বরং হেসে কুটিপাটি হয় সে।
‘কাহিনীটা অনেক জটিল। আহা, আমার পুরনো বন্ধু ডক্টর খান যদি এখানে থেকে তোমাকে ব্যাপারটা বোঝাতে পারত। কিন্তু সে এখন লেগে আছে গ্যানিমিডের পিছনে। সেখানে যে ক’জন সত্যিকারের বিশ্বাসীর খোঁজ পাবে তাদের যত্ন আত্তি করবে। সারিয়ে তুলবে মনের ক্ষত। যখন সব পুরনো ধর্মগুলো ধ্বসে পড়তে শুরু করল- ধরা যাক পোপ বিংশ পিউসের কথা- ইতিহাসের সবচে বড় মানুষদের একজন!- আমাদের এখনো একজন প্রাইম কজকে খুঁজে বের করতে হবে, যে কারণ সৃষ্টি করেছে এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড- যদি কেউ থেকে থাকে আর কী…
‘অনেক সাজেশন এল- ডিও-পিও-জোভ-ব্রাহ্ম- তাদের সবাইকে নিয়ে চেষ্টার কোনো ত্রুটি হল না… কোনো কোনো শব্দ এখনো টিকে আছে আশপাশে। এমনকি আইনস্টাইনের প্রিয় “সেই পুরনো জন” উক্তিটাও চলে ঈশ্বর বোঝতে। কিন্ত কেমন করে যেন ডিউস চলতি ফ্যাশন হয়ে গেল এবার।’
‘মনে রাখার চেষ্টা করব, কিন্তু আমার কাছে এখনো বেখাপ্পা লাগছে যে!’
তুমি অভ্যস্ত হয়ে যাবে। কোনো চিন্তা নেই। আরো কয়েকটা ভদ্রোচিত শব্দ আর প্রকাশ দেখিয়ে দিতে পারব। আস্তে আস্তে সেগুলোও ধাতে সয়ে যাবে…’
বলছ সব পুরনো ধর্ম ধুয়েমুছে গেছে? তাহলে আজকাল মানুষ কী বিশ্বাস করে? যত কম সম্ভব। আমরা সবাই আজকাল ডেইস্ট অথবা থেইস্ট।
‘আমার বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছ। সংজ্ঞা দাও দেখি।
‘তোমাদের আমলে যেমন ছিল সেটা আর এখন এমন নেই। থেইস্ট বিশ্বাস করে একের বেশি ঈশ্বর নেই, ডেইস্টরা মনে করে একের কম ঈশ্বর নেই।’
ব্যাপারটা আমার কাছে খুব বেশি স্পষ্ট হল না তো?
সবার কাছে স্পষ্ট নয়। পাঁচ শতাব্দি আগের কথা শুনে অবাক হবে। কে যেন রিয়াল ম্যাথমেটিক্স ব্যবহার করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে যে থেইস্ট আর ডেইস্টদের মধ্যে অসীম সংখ্যক শ্রেড আছে। যাই হোক, আমেরিকানরা সবচে বেশি পরিচিত ডেইস্ট- ওয়াশিংটন, ফ্র্যাঙ্কলিন, জেফারসন।
‘আমার সময়ের একটু আগে, তুমি বিশ্বাস করবে না, অনেক মানুষই এসব বুঝতে পারত না।’
‘এখন, আমার হাতে কয়েকটা ভাল খবর আছে। জো- প্রফেসর এ্যান্ডারসন অবশেষে দিয়ে দিয়েছে তার ফ্রেজটা যেন কী? ওকে। স্থায়ী কোয়ার্টারে তোমাকে এখন নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।’
খবরটা আসলেই ভাল। এখানে সবাই ভাল ব্যবহার করেছে আমার সাথে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তাই বলে নিজের একটা বাসা চাই না তা কে বলল?
‘তোমার নতুন জামা কাপড় দরকার। কেউ একজন জানিয়ে দিবে কী করে সেগুলো পরতে হয়। প্রতিদিনকার শত শত সময় নষ্ট করা কাজ শিখিয়ে দিবে, সময় নষ্ট করতে যেগুলোর কোনো জুড়ি নেই। তাই তোমার জন্য একজন পার্সোনাল এ্যাসিস্ট্যান্ট যোগাড় করার স্বাধীনতা পেয়েছি। এস, দানিল…’।
মধ্য ত্রিশের কোটার ছোটখাট অবয়বের এক লোক এই দানিল। গায়ের রঙ বাদামি। সে শুধু পাম টু পাম স্যালুটই দিল না, সেই সাথে অটোম্যাটিক ইনফরমেশন এক্সচেঞ্চও করল। বোঝা গেল, দানিলের কোনো আইডেন্ট নেই; কখনো প্রয়োজন পড়লে সে একটা চৌকো প্লাস্টিকের কার্ড তৈরি করে নেয়, একবিংশ শতাব্দিতে যেগুলোকে স্মার্ট কার্ড বলা হত তেমন কিছু আর কী।
‘দানিল তোমার গাইডও হবে- আর কী সেই শব্দটা? কখনো সময়মত মনে পড়ে না- “ব্যালের সাথে কবিতা। সে এ কাজে বিশেষ ট্রেনিং পেয়েছে। আমি নিশ্চিত তার সাথে পুরোপুরি সন্তষ্ট হতে পারবে।
হাসি পেল পোলের। সেই সাথে একটু অস্বস্তিতেও পড়ে গেল। ভ্যালে বা ভদ্রলোকের সহায়ক, সোজা কথায় চাকর রাখার চল সে সময়টাতেই একেবারে কমে এসেছিল। যেন সে বিংশ শতাব্দির প্রথমদিকের কোনো উপন্যাসের চরিত্র।
‘দানিল তোমার যাবার যোগাড়যন্ত্র করতে করতে আমরা একটু উপর থেকে ঘুরে আসব, চলে যাব লুনার লেভেলে।
দারুণ! কত উপরে?
‘ও… প্রায় বারো হাজার কিলোমিটার হবে।
বারো হাজার! ঘন্টার পর ঘন্টা লেগে যাবে!
প্রথমে ইন্দ্রা অবাক হল। হাসল তারপর।
না, যত ভাবছ তত সময় কখনো লাগবে না। তাই বলে ভেবোনা, আমরা স্টার ট্রেক মার্কা ট্রান্সপোর্টার বানিয়ে ফেলেছি- তবু, কাজ চলছে যে সেসব নিয়ে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তো, তোমার এখন বেছে নিতে হবে, অবশ্য আমি জানি, কী বেছে নিবে তুমি… একটা এক্সটার্নাল এলিভেটর ধরে উঠে যেতে পার, দেখতে পার বাইরের দৃশ্যগুলো, কিম্বা ধরতে পার কোনো ইন্টারনাল লিফট। একটু খেয়ে নিতে নিতে কিছু লাইটভিউ দেখতে পার সময়টাতে।
‘কেউ ভিতরে থেকে উঠতে চাইবে তা তো কল্পনাও করতে পারি না আমি।
‘তুমি অবাক হবে। কোনো কোনো মানুষের কাছে ব্যাপারটা এত বেশি উচ্চতাভীতিকর যে তারা আঁৎকে ওঠে। বিশেষ করে যেসব ভিজিটর আসে নিচের তলাগুলো থেকে তাদের কথা বলতে পার। এমনকি পর্বতারোহীদের উচ্চতাগর্বও মিনমিনে হয়ে যায় মাঝে মাঝেই।’
‘আমি এ ঝুঁকিটুকু নিচ্ছি। এর চেয়ে উপরে ওঠার অভিজ্ঞতা আছে আমার।
দু সেট এয়ারলকের ভিতর দিয়ে গিয়ে টাওয়ারের এক্সটেরিয়র ওয়ালে যাবার পর যেখানে গেল তারা সেটাকে খুব ছোট কোনো থিয়েটারের অডিটরিয়াম বলে চালানো যায়। ভিতরে থরে বিথরে সাজানো সিট। বসে আছে অনেকে। পোলের মনে কেন যে লক্ষ কোটি টন বাতাসের চাপের কথা উঠল যেগুলো স্পেসের গায়ে হারিয়ে যাবার জন্য পাগল হয়ে আছে।
জনা বারো প্যাসেঞ্জারকে একেবারে সুস্থ স্বাভাবিক লাগল। তাদের মনের জগতেই যেন সেসব চিন্তা নেই। সবাই চিনতে পারছে তাকে। একটা দ্ৰ হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে ঠোঁটে। একটু নড করেই ঘুরিয়ে নিয়েছে মাথা বাইরের দিকে।
‘ওয়েলকাম টু স্কাইলাউঞ্জ,’ বলল সেই অপ্রতিরোধ্য অটোভয়েস, ‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে আরোহন শুরু হচ্ছে। নিচতলায় রিফ্রেশমেন্ট আর টয়লেট পাবেন আপনারা।
কিন্তু এ ভ্রমণে ঠিক কতটা সময় লাগবে? ভেবে পায় না পোল। আমরা উঠতে আর নামতে গিয়ে বিশ হাজারে বেশি কিলোমিটার পেরিয়ে যাব। আমার পৃথিবীতে এসব কথা ভাবাও পাপ ছিল…
উপরে ওঠা শুরু হবে, অপেক্ষা করছে সে। দু হাজার কিলোমিটার নিচের বিবশ করা চিত্রটার দিকে তাকিয়ে আছে সে। উত্তর গোলার্ধে এখন শীত। কিয় পরিবেশ যে অনেকটা বদলে গেছে তার প্রমাণ, বিষুব রেখার নিচে বরফের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে।
ইউরোপের আকাশে কোনো মেঘ নেই। এত বিস্তৃত দেখা যাচ্ছে সবকিছু যে চোখ আর সহ্য করতে পারে না। একের পর এক বিশাল মহানগরীর চিহ্ন চোখে পড়ে যেগুলো শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে পৃথিবীতে রাজত্ব করেছিল। শহরগুলো ছোট হতে শুরু করে তার সময় থেকেই যখন কম্যুনিকেশন টেকনোলজি পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় এনে দিতে শুরু করে। আরো বিচিত্র সব ব্যাপার চোখে পড়ে। সাহারার বুকে লেক সালাদিন এখন আর কোনো হ্রদ নয়, পুরোমাত্রায় সাগরের মতো বলা চলে।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পোল ভুলে গেল সময়ের কথা। হঠাৎ খেয়াল হয়, পাঁচ মিনিটেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে কিন্তু এলিভেটরের নড়ার নামগন্ধও নেই।
কোনো সমস্যা নাকি? নাকি অন্য কিছুর জন্য অপেক্ষা চলছে।
এরপর সে এমন অদ্ভুত কিছু চোখে দেখতে পেল যা অস্বীকার করার তীব্র ইচ্ছা জাগে প্রথমে। পৃথিবীর ফ্রেমটা উঠে আসছে আস্তে আস্তে। নিচের দৃশ্যগুলো এখন অনেক বেশি বিস্তৃত। তাহলে কি তারা নিচে নামছে।
হেসে ফেলল পোল। স্বাভাবিক ব্যাখ্যাটা মনে পড়ে গেছে চট করে।
“আর একটু হলেই বোকা বানিয়ে ছেড়েছিলে, ইন্দ্রা। মনে করেছিলাম এটা বাস্ত ব, কোনো ভিডিও প্রজেকশন নয়।
চাপা হাসি মুখে নিয়ে তার দিকে চোখ তুলল ইন্দ্রা।
‘আবার ভেবে দেখ, ফ্র্যাঙ্ক। মিনিট দশেক হয়ে গেছে আমাদের চলার। এতক্ষণে আমাদের গতি ঘন্টায় হাজারখানেক কিলোমিটার। যদিও এ এলিভেটরগুলোয় একশ জি’র বেশি উঠে যায় তৃরণ, আমাদেরটা দশের বেশি হবে। না। এত ছোট দূরত্বে এর চেয়ে বেশি ওঠার সুযোগ নেই।
‘অ-অসম্ভব। সেন্ট্রিফিউজে তারা আমাকে বড়জোর ছ জি দিয়েছিল। চিন্তা কর, ওজন বেড়ে গেল দু গুণ! আধ টন ওজন নিয়ে আমার খুব একটা যুত হয়েছিল তা কি বলতে পারি না। ভিতরে ঢোকার পর থেকে যে আমরা নড়িনি এটুকু হলপ করে বলতে পারি।’
পোলের কণ্ঠ একটু উঁচু মাত্রায় চড়ে আবার সরসর করে নিচে নেমে এল। আশপাশের যাত্রিরা কথা না শোনার ভাণ করছে।
‘আমি ঠিক বুঝি না কী করে ব্যাপারটা করল তারা, ফ্র্যাঙ্ক। নাম দিয়েছিল ইনাটিয়াল ফিল্ড। সম্ভবত শার্প নামে ডাকে- এস অক্ষরটা বিখ্যাত রাশিয়ান বিজ্ঞানী শাখাররে প্রতিনিধিত্ব করে- বাকিগুলো যে কী কে জানে।
আস্তে আস্তে ধাতস্থ হয়ে এল পোল। এখানে নিশ্চয়ই জাদু থেকে ভিন্ন করা যাবে না এমন এক টেকনোলজি ব্যবহার করেছে তারা।
‘আমার কয়েকজন বন্ধুর মনে ‘স্পেস ড্রাইভ’ এর স্বপ্ন ছিল- এমন এনার্জি ফিল্ড যেগুলোকে রকেটের বদলে কাজ করবে, এমনভাবে নড়বে যেন গতিবৃদ্ধি টের পাওয়া না যায়। আমরা প্রায় সবাই তাদের পাগলাটে ভাবতাম। কিন্তু তাদের কথাই যে ঠিক তা আমাকে দেখে যেতে হল। এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না… আর, যদি ভুল না হয়ে থাকে তো, আমরা আসলে আস্তে আস্তে ওজন হারাচ্ছি।’
হ্যাঁ- চান্দ্র ভ্যালুর সাথে মানিয়ে নিচ্ছে। বাইরে বেরুনোর পর তোমার মনে হবে আমরা চাঁদের বুকে আছি। কিন্তু কল্যানের কসম, ফ্র্যাঙ্ক- তোমার ইঞ্জিনিয়ার হবার কথাটা ভুলে গিয়ে চিত্রটা উপভোগ কর।
উপদেশটা ভাল। আফ্রিকা আর ইউরোপের পুরোটা এবং এশিয়ার অনেকখানি দেখা যাচ্ছে। মন বিবশ হয়ে যেতে চায়। পোল প্রস্তুত ছিল অনেকটাই। ছত্রিশ হাজার কিলোমিটার লম্বা ও কয়েক কিলোমিটার চওড়া গগনচুম্বী অট্টালিকার কথা ভুলতে পারছে না কিছুতেই।
রকেটের যুগ নিশ্চয়ই কয়েক শতাব্দি আগে হারিয়ে গেছে। প্রোপ্যাল্যান্ট সিস্টেম আর কমবাশন চেম্বার বিষয়ক তার সমস্ত জ্ঞান- আয়ন প্রাস্টার আর ফিউশন রিএ্যাক্টরের সমস্ত অভিজ্ঞতা আজ অন্তসারশূন্য। এসবের দিন আর নেই কিন্তু মাস্তুলে বসে থাকা নাবিক যখন বাতাস পড়ে যেতে দেখে, তখন যেমন আহত হয় তেমনি আহত বোধ করে সে।
আস্তে আস্তে মুড বদলে যায়, নিরব হাসিতে ভরে ওঠে মুখটা। অটোভয়েস বলছে, যাত্রা শেষ হতে আর দু মিনিট বাকি। লক্ষ্য রাখুন, আপনার কোনো জিনিস যেন এখানে না থেকে যায়।
কমার্শিয়াল ফ্লাইটগুলোয় এ কথা কতবার শুনতে পেয়েছে সে? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল, আধঘন্টাও হয়নি যাত্রার। তার মানে গড় গতি ঘন্টায় বিশ হাজার কিলোমিটারের চেয়েও বেশি! গত দশ মিনিট ধরে তারা এত তীব্র গতিতে মন্দনের শিকার হয়েছে যে সেটা বাস্তবে অনুভব করলে পা ঠেকে থাকত ছাদে আর মাথা হয়ে যেত পৃথিবীমুখো।
নিরবে খুলে গেল দরজা। বাইরে পা রেখে পোল সেই ঢোকার মূহুর্তের মতো একটু এলোমেলো অনুভব করল। এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারে সে, ট্রানজিশন জোন দিয়ে পার হয়েছে যেখানে ইনার্শিয়াল ফিডের উপর প্রভাব ফেলছে গ্র্যাভিটি। এখানে সেটা চাঁদের বুকের মতো।
পা দিয়েই থমকে গেল পোল। সামনের বিশাল অঞ্চলটা প্রাকৃতিক। কোনো দেয়াল নেই ভিতরে। পাঁচ কিলোমিটার দূরে আছে অপর প্রান্তের দেয়াল। কোনো মহাকাশবিদের কাছেও এটা বিস্ময় নিয়ে আসবে নিঃসন্দেহে। চাঁদের বুকে, মঙ্গলের বুকে নিশ্চয়ই এর চেয়ে বড় ঘের দেয়া এলাকা আছে, কিন্তু এটুকু বুকে হাত দিয়ে বলা যায়, মানুষের তৈরি মহাকাশের কৃত্রিম এলাকাগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম বৃহত্তম।
আউটার ওয়ালের কাছে পঞ্চাশ মিটার ভিউয়িং প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে তারা। দেখা যাচ্ছে বিচিত্র কিছু গাছ। বিশাল। প্রথমে চেনা যায় না। পরে বোঝা গেল, ওক। কিন্তু এত বড় কেন? চাঁদের মতো অভিকর্ষে খুব দ্রুত বেড়েছে সেগুলো। তাহলে তালগাছের কী দশা হত। আর জায়ান্ট রিডের কথা ভাবতে গেলে…।
মাঝামাঝি একটা হ্রদ দেখা যাচ্ছে। ছোটখাট। ঘাসে মোড়া সমভূমি থেকে কুলকুল করে ক্ষীণ স্রোতস্বিনী নেমে আসছে সেটার বুকে। একটা ব্যাপার চোখ কেড়ে নেয়। বিশাল দানবীয় গাছ ঝাঁকড়া। নিশ্চয়ই বট! কিন্তু পানির উৎস কোথায়? মৃদু ড্রামের আওয়াজ ভেসে আসছে পোলের কানে। বাকানো গোল হয়ে যাওয়া দেয়াল ধরে সামনে তাকাতেই রহস্য ধরা দিল। ছোটখাট নায়াগ্রা থেকে পানি ছিটকে পড়ছে। তার উপরে জলকণা নাচানাচি করে অহর্নিশি। একেবারে নিখুঁত রামধনু ঝিকমিক করছে।
ঘন্টার পর ঘন্টা প্রশংসার দৃষ্টিতে এ দৃশ্যগুলো দেখা যায়। নিচের পৃথিবী ছেড়ে আসার পরও মানুষ যে এ বিশাল কৃত্রিম কফিনে পৃথিবীরই ছোট মডেল গড়ে নিবে তাতে আর অবাক হবার কী হল। মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে উকার বেগে। এগিয়ে যাচ্ছে দূর দূরান্তে। তারপরও, নিজের উৎসটাকে কে ভুলতে চায়? অবশ্যই, তার আমলেওতো প্রতিটা মহানগরীতে ছিমছাম উদ্যান ছিল- কৃত্রিমতার দোষে দুষ্ট তার পরও, মানুষ সেখানে গিয়ে হাপ ছেড়ে বাঁচত। সেই কল্পনাই এখানে পবিত হচ্ছে। এখানে, সেন্ট্রাল পার্ক, আফ্রিকা টাওয়ারে।
‘আর কত দেখবে দূর থেকে। কপট রাগ ইন্দ্রার চোখেমুখে, হাসির ভাজে ভাজে, চটজলদি নেমে পড় দেখি। এখানে তো আর চাইলেই আমি এসে পড়তে পারি না।’
এ কম মধ্যাকর্ষণের জায়গায় হাঁটা কোনো সমস্যাই নয়। টের পাওয়া যায় না। তবু সময় সময় তারা মনোরেলের সুবিধা উপভোগ করে। একটু ঝরঝরে হয়ে নিতে থামে কোনো এক ক্যাফের সামনে। কমপক্ষে পোয়া কিলোমিটার লম্বা রেডউডে বানানো জায়গাটা।
আশপাশে মানুষ নেই। শুনশান প্রকৃতি। সহযাত্রিরা অনেক আগেই হারিয়ে গেছে সুদর্শন এলাকার আড়ালে। এখন যেন এ পুরো স্বপ্নরাজ্য শুধু তাদের। সবকিছু ঠিকঠিক নিয়ন্ত্রণ করা হয় কীভাবে কে জানে! সম্ভবত রোবটদের কোনো সেনাদল আছে সেসব কাজের জন্য। ডিজনি ওয়ার্ল্ডে সেই ছেলেবেলায় যাবার কথা এখনো মনের পর্দায় ভাসে। কিন্তু এ তো তার চেয়ে অনেক অনেক ভাল। লোকজনের ভীড়বাট্টা নেই। নেই কলরোল। সবচে বড় কথা, মানবজাতি আর তাদের বানানো কৃত্রিমতার প্রায় কোনো ছোঁয়াই দেখা যাবে না।
সামনে অর্কিডের চমৎকার এক কালেকশন। কিছু কিছু আকার আকৃতিতে রীতিমত দানবীয়। এসব দেখতে দেখতেই পোল জীবনের সবচে বড় ধাক্কাগুলোর একটা খেল। ছোটখাট চিরাচরিত এক বাগানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তারা। খুলে গেল দরজা- বেরিয়ে এল মালি।
আত্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফ্র্যাঙ্ক পোলের অহঙ্কারের শেষ নেই, কিন্তু একেবারে পুরোদস্তুর বয়েসি হয়ে যাবার পরও আতঙ্কে সে গলা চিরে চিৎকার দিবে সেটা কল্পনাতেও ছিল না। তার সময়কার আর সবার মতো সেও জুরাসিক মুভিগুলো পটাপট গিলেছিল, তাই র্যাপ্টর চিনে নেয়া কোনো কঠিন কাজ নয়। কিন্তু এমন জিনিস যে স্বচক্ষে দেখা যাবে তা ভাবাটা অবশ্যই কঠিন।
‘ও, আই এ্যাম টেরিবলি স্যরি,’ থই পাচ্ছে না ইন্দ্রা, তোমাকে সাবধান করে দেয়ার কথাটা আমার মনেই আসেনি।
পোলের উত্তেজিত স্নায়ুগুলো আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে আসে। অবশ্যই, এ সুন্দর ও গোছানো পৃথিবীতে কোনো রকম ঝুঁকি যে নেই তাতো নিশ্চিত; তবু…
কিন্তু ডাইনোসরের কোনো উৎসাহ নেই তাদের ব্যাপারে। চোখ ফিরিয়ে নিল সে। তারপর সোজা চলে গেল, বাগানের জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে এল আবার। কাঁধের পিছনে একটা ঝোলা ঝোলানো। পাখির মতো ডানা ঝাঁপটানোর ভাব করে চলে গেল সে দূরে। তারপর একবারো পিছনে না ফিরে হাপিস হয়ে গেল দশ মিটার উঁচু সব সূর্যমুখীর পিছনে।
‘আমার একটু ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে, খেই ধরল ইন্দ্রা, যখন সম্ভব, আমরা বায়ো অর্গানিজম ব্যবহার করতে পছন্দ করি। রোবট আর পছন্দ নয়, বুঝতেই পারছ, যত্তসব কলকজার কারবার। আমাদের বিশ্বাস কার্বনের উপর, ধাতুর উপর নয়। কাজে লাগতে পারে এমন মাত্র কয়েকটা প্রাণি আছে আর আমরা তাদের কখনো না কখনো লাগিয়ে বসে আছি।
আর এখানে এমন এক রহস্য লুকিয়ে আছে যেটার সুরাহা কেউ করতে পারেনি। তুমি ভাবতে পার উন্নত করে তোলা হার্বিভোররা, যেমন শিম্পাঞ্জি আর গরিলা- এসব কাজে খুব দক্ষ হবে। আদতে তা মোটেও সত্যি নয়। তাদের ধৈর্যের খুব অভাব।
কিন্তু মাংসাশীরা খুব কাজের। এখানে আমার যে বন্ধুকে দেখলে তার কথাও বলতে পার। খুব সহজেই ট্রেইন্ড করে নেয়া যায়। আরো বড় কথা হল- এখানে একটা প্যারাডক্স আছে। তাদের মডিফাই করে নেয়ার পর আচার আচরণে খুব সভ্য হয়ে যায়। অবশ্যই, তাদের পিছনে কাজ করছে হাজার বছরের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। আর দেখ, এককালের গুহাবাসী মানব হিংস্র নেকড়ের কী দশা করেছে সামান্য ট্রায়াল এ্যান্ড এরর পদ্ধতি অনুসরণ করে।
হাসল ইন্দ্রা মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয়া সুরে, তুমি হয়ত ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারবে না, ফ্র্যাঙ্ক, কিন্তু সেই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়াররা ভাল ভাল বেবিসিটারও তৈরি করে যাদের অনেক পছন্দ করে বাচ্চারা। এ নিয়ে পাঁচশ বছরের পুরনো একটা রসিকতা চালু আছে, ‘তোমার বাচ্চার দেখভালের জন্য যদি কোনো ডাইনোসরকে বিশ্বাস কর তো ভাল, বিশ্বাস করেই দেখ, দেখ পস্তাতে হয় কিনা?”
হাসিতে যোগ দিল পোলও, নিজের ভয়ের ব্যাপারটায় এখনো ধাতস্থ হয়ে নিতে পারছে না। প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য সে অবশেষে ইন্দ্রার কাছে সেই প্রশ্নটা তুলল। যেটার জন্য মন খচখচ করছে।
‘এই এতকিছু নিয়ে কষ্টের প্রয়োজন কী, যখন টাওয়ারের যে কেই একটু চেষ্টা করলেই আসল ভূমিতে গিয়ে দেখে আসতে পারে?
চিন্তান্বিত চোখে চেয়ে থাকে ইন্দ্রা। মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নেয়।
কথাটা আসলে পুরোপুরি ঠিক নয়। ঝুঁকি আছে। আছে বিপদের সম্ভাবনা। ঝক্কি-ঝামেলারও কোনো অভাব নেই। ছত্রিশ হাজার কিলোমিটার এলাকার প্রায় সবটাই হাফ জির কম। আর সেখান থেকে পৃথিবীর বুকে পুরো এক জিসহ নেমে যাওয়াটা কষ্টকর, এমনকি কোনো হোভারচেয়ার থাকলেও সে ঝুঁকি কেউ নিতে চায় না।
‘আমার ক্ষেত্রে কথাটা খাটবে না। আমার জন্মই এক জিতে। বেড়ে ওঠা পৃথিবীর পৃষ্ঠে। সেই হিসাব ঠিক রাখার জন্য ডিসকভারির বুকে এক্সারসাইজ করার কাজে কখনো হেলাফেলা করিনি।’
কথাগুলো বলতে হবে প্রফেসর এ্যান্ডারসনের সাথে। বলার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু তোমার শরীরটা এখনো মানিয়ে নিতে পারেনি, সেটার জৈবঘড়ি এখনো শক্তি পায়নি পুরোপুরি। সেটা কখনো থামেনি এবং তার ধারণা তোমার বয়স পঞ্চাশ থেকে সতুরের মধ্যে। যদিও তোমার শরীর ভালই আছে, তবু এক হাজার বছর হিমশীতলে থাকার পর পুরো শক্তি ফিরে পাবার আশা দুরাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।’
আচ্ছা, একটু একটু বুঝতে পারছি এখন, তিক্তকণ্ঠে নিজেকে শোনায় পোল। এতক্ষণে বোঝা গেল কেন এ্যান্ডারসন তার শরীরের শক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন, কেন পেশিশক্তি নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে অষ্টপ্রহর।
আমি বৃহস্পতির এলাকা থেকে পৃথিবীর মাত্র দু হাজার কিলোমিটারের মধ্যে চলে এসেছি। কিন্তু কী কপাল, আমার সেই হামল্যান্ডের উপরে ভেসে থাকতে পারব সারা জীবন, কখনো তার কোমল ভূমিতে পা ফেলে চলতে পারব না যেমনটী চলেছিলাম একেবারে বাচ্চা একটা ছেলে হিসাবে।
জানি না কী করে ব্যাপারটায় নিজেকে মানিয়ে নিব, জানি না…
১০. ইকারুসের বসতবাড়ি
তার হতাশা কেটে যায় দ্রুত : অনেক অনেক কাজ পড়ে আছে সামনে। দেখার আছে অনেক কিছু। মানবজাতি বিস্ময়ের মেলা বসিয়ে দিয়েছে। হাজারটা পূর্ণ জীবনেও তা দেখে কুলানো যাবে না। যাবে না স্বাদ-গন্ধ নেয়া। এখন ঠিক করার পালা এই বিস্ময় ভুবনের কোন কোন জাদুকে উপভোগ করতে হবে, কোনটাকে যেতে হবে পাশ কাটিয়ে। অযথা বিনোদনগুলোকে পাশ কাটিয়ে যায় সে। চিনতে চায় নতুন যুগের বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে, জানতে চায় সমাজ সভ্যতা আর জ্ঞানের নতুন নতুন দুয়ারের চাবিকাঠির ঠিকানা।
ব্রেইনক্যাপ আর সেই সাথে সেই বই আকারের প্লেয়ারগুলোর (নাম ব্রেইনবক্স) সহায়তা নেয়া চলে দেদার। দ্রুত সে ইন্সট্যান্ট নলেজ ট্যাবলেটের একটা লাইব্রেরি গড়ে ফেলল। প্রতিটায় একটা কলেজ ডিগ্রিতে যা কিছু দরকার তার চেয়ে বেশি জ্ঞান আছে নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট বিষয়ে, সব ধরনের ইন্টার্যাক্টিভ সুবিধা সহ। ব্রেইনক্যাপের আসল মজা সে প্রথমে জানতে পারেনি। এখন পারছে। এটাকে তীব্র গতিতে মাথার সাথে তাক করে নেয়া যায়। মানুষ যে গতিতে পড়ে বা লেখে, তার চেয়ে অনেক দ্রুত এটা ব্যবহারকারীকে আনন্দ বা তথ্য দেয়। শোয়ার আগে ঘন্টাখানেকের জন্য সহনীয় গতিতে সেট করে নাও। যখন খুলবে, তখন দেখতে পাবে জ্ঞানের নতুন নতুন অভাবনীয় দ্বার খুলে গেছে হাট হয়ে। এ যেন কোনো বইপোকা লাইব্রেরিয়ানের মতো যে হঠাৎ দেখতে পায় তার মালিকানায় আরো একটা অজানা বিষয়ের তাক জোড়া বইপত্র আছে।
বড় হিসাবে ধরতে গেলে, তার সময়ের তুলনায় সে ছিল অনেক অগ্রসর আর জ্ঞানী এক লোক। আর সে এখন বেছে বেছে মানুষের কাছে উন্মোচিত হয়। যখনি কোনো সায়েন্টিস্ট, ইতিহাসবেত্তা, লেখক বা শিল্পী আসে যারা মিডিয়ার এমন সব ক্ষেত্রে কাজ করছে যেগুলো এখনো পুরোপুরি প্রকাশ পায়নি বা কুঁড়ি মেলেনি স্বাগত জানায় সে তাদের। চার টাওয়ার থেকে হাজারটা অনুষ্ঠানের দাওয়াত, দেখা করার অনুরোধ উপরোধ আসে অজস্র; প্রতিদিন। খোঁড়াই পরোয়া করে এসবের।
কিন্তু যাদের প্রতিরোধ করা কঠিন এবং যাদের অবহেলাও করা যায় না তারা হল- নিচের মোহময়ী নীলচে গ্রহের মাটির কাছে বাস করা মানুষেরা।
‘অবশ্যই,’ বোঝয় প্রফেসর এ্যান্ডারসন, তুমি নিচে নেমে গেলে, সঠিক লাইফ। সাপোর্ট সিস্টেম নিয়ে গেলে, বাঁচবে, ভালভাবেই বাঁচবে, কিন্তু ব্যাপারটাকে মোটেও উপভোগ করতে পারবে না। সবচে ভয়ের কথা, এটা তোমার নিউরোমাস্কুলার সিস্টেমকে ক্ষত্মিস্থ করতে পারে। হাজার বছরের ঘুম থেকে জেগে উঠে সেটা আগের মতো কার্যকর হবে তা আশা করা ঠিক নয়।’
তার আরেক অভিভাবক ইন্দ্রা ওয়ালেস জানিয়ে দেয় কোন কোন অনুরোধ রাখতে হবে আর কোনটা ভদ্রভাবে করতে হবে প্রত্যাখ্যান। জানিয়ে দেয় অপ্রস্তুত অবস্থা থেকে সরে আসার পথ সম্পর্কে। নিজে নিজে এ অকল্পনীয় জটিল সভ্যতার সামাজিক-সাংস্কৃতিক রীতিনীতি সম্পর্কে থোড়াই জানা সম্ভব। সহায়তা করছে ইন্দ্রা, সহায়তা করছে অগ্রসর প্রযুক্তি।
মানুষের মাঝে আগের মতো আর শ্ৰেণীভেদ নেই, তাতে সহজ কথা, হাজার বছরের পুরনো কথা, তার পরও, কয়েক হাজার সুপার সিটিজেন আছে এ সভ্যতায়। জর্জ অরওয়েলের কথাই বোধহয় সত্যি, কিছু মানুষ বাকিদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে এবং নিয়ন্ত্রণ করবে সব সময়। ভদ্রভাবে তিনি যা বলেছিলেন, কেউ কেউ বাকিদের চেয়ে বেশি ‘সম’ থাকবে।
মাঝে মাঝে একটা দার্শনিক চিন্তা চলে আসে মাথায়। এই এতসব নিয়ন্ত্রণ করে কে? কে এসবের খরচ যোগায়? কোনোদিন কি পোলের সামনে খুব ভদ্রভাবে হোটেলের বিশাল একটা বিল ধরিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু আশ্বস্ত করে ইন্দ্রা, সে আসলে একটা অমূল্য বস্তু। যাদুঘরের এমন বস্তুকে কখনো অবহেলা করা হবে না। যা চায় তার সবই হাজির করা হবে চোখের সামনে, একেবারে অকারণে না চাইলেই হল। পোল ভেবে পায় না এ নিয়ন্ত্রণ সীমাটা কোথায়, কিন্তু কোনো একদিন সেটার মুখোমুখি হতে হবে তা জানে না।
.
জীবনের সবচে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো অযাচিতভাবে হঠাৎ করে ঘটে যায়- এমনি করে একটা ব্যাপার চলে এল পোলের সামনেও। ওয়াল ডিসপ্লে ব্রাউজারকে র্যান্ডম রেখে সে দেখে যাচ্ছিল সামনের নিরব ফ্রেমগুলো। একটা ব্যাপার নজর কাড়ে তখনি।
‘স্টপ স্ক্যান সাউন্ড আপ!’ সে চেঁচিয়ে ওঠে অনেকটা অকারণেই। আস্তে বললেও চলত।
প্রথমেই বাজনাটা পরিচিত মনে হয়। তারপর মনে পড়ে যায় বাকি সবটুকু। সামনের দেয়ালে ফুটে ওঠা মানুষগুলো একে অন্যকে ঘিরে পাক খাচ্ছে অবিরত। তাদের পিঠজোড়া মস্ত ডানা। কিন্তু শেইকোভস্কি সোয়ান লেকের মঞ্চায়ন দেখে অবাক না হয়ে পারতেন না, কারণ চরিত্রগুলো আসলেই একে অন্যকে ঘিরে পাক খাচ্ছে উড়তে উড়তে…
কয়েক মিনিট ধরে তাকিয়ে থাকে পোল, নিশ্চিত হয়ে নেয় এটা কোনো সিমুলেশন নয়। এমনকি তার দিনগুলোতেও মানুষ হলপ করে বলতে পারত না কোনটা সিমুলেশন আর কোনটা বাস্তব। অভিনয়টা নিশ্চয়ই কোনো লো গ্র্যাভিটির পরিবেশে হয়েছে, হয়ত আফ্রিকা টাওয়ারের উঁচুতে থাকা কোনো বিশাল হলরুমে।
এবার একটা সুযোগ নিবেই সে। কিছুতেই ক্ষমা করতে পারবে না স্পেস এজেন্সির সেই কথা। তার প্যারাস্যুট জাম্পিং আর গ্লাইডিং বন্ধ করে দিয়েছিল তারা। হ্যাঁঙ-গ্লাইডিং নিয়ে সেই দূর্ঘটনা… কপাল ভাল ছিল, কমবয়েসি হাড়গুলো সেরে ওঠে খুব দ্রুত।
‘আসলে,’ বলে মনে মনে, ‘আমাকে থামানোর কেউ নেই, যদি প্রফেসর এ্যান্ডারসন বাগড়া দিয়ে বসে তো…’।
বাধা দেয়া তো পরের কথা, লাফিয়ে উঠল প্রফেসর। এক দশমাংশ জি’র লেভেলগুলোয় প্রত্যেক নাগরিকের এভিয়ারি আছে। কিন্তু সোয়ান লেকের মতো পালকওয়ালা ডানা দেয়া হল না পোলকে। দেয়া হল ঝিল্লির মতো ডানা। সেগুলো লাগিয়ে নিয়ে নিজের দিকে তাকাতেই কলজে লাফিয়ে ওঠে। সাক্ষাৎ বাদুড়।
‘চল, ড্রাকুলা!’
কিন্তু এ কথার ঘোড়াই পরোয়া করে ইনস্ট্রাক্টর। সে ভ্যাম্পায়ের নাম-গোষ্ঠিরও হদিস জানে না।
প্রথম দিকে তাকে বেধে রাখা হয় হালকা এক ফিতা দিয়ে, যেন উড়তে যাবার প্রাথমিক শিক্ষাগুলোয় কোনো গলদ থেকে না যায়, উড়তে গিয়ে বেসিক স্ট্রোকগুলোয় কোনো হেরফের না হয়ে যায়। সবচে বড় কথা, স্থিতাবস্থা শিখতে হবে তো! আর সব দক্ষতার মতো এটাও দেখতে যতটা সহজ কাজে তার ধারে কাছেও নয়।
বেধে রাখার ব্যাপারটা বিদঘুঁটে লাগে, সন্দেহ নেই, সেই সাথে এ চিন্তাও মাথায় ঘুরপাক খায়, এক দশমাংশ মধ্যাকর্ষণে মানুষ নিজেকে আর কতটা আঘাত দিতে পারবে পড়ে গিয়ে উইংমাস্টার গর্বের সাথে বলে, আর কাউকে এত সহজে শেখানো যায়নি। কথাটা হয়ত সত্যি; হাজার হলেও, ফ্র্যাঙ্ক পোল একজন সাবেক এ্যাস্ট্রোনট। কিন্তু মিথ্যাও হতে পারে, হয়ত সে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকেই গৎ বাধা কথাটা বলে ইন্সপায়ারড করে। কে জানে!
চল্লিশ মিটার লম্বা চেম্বারে ডজনখানেক ফ্রি ফ্লাইট দিয়ে, আশপাশে উড়তে থাকা ও উঁচু নিচু হয়ে থাকা জিনিসপত্রকে সাবধানে এড়িয়ে প্রথম সলো ফ্লাইটের সার্টিফিকেট পেয়ে গেল পোল। ফ্ল্যাগস্টাফ এরো ক্লাবের এ্যান্টিক সেসনায় উনিশ বছরের টগবগে মন নিয়ে উড়ল সে।
প্রথম উড্ডয়নের জন্য ‘দ্য এভিয়ারি’ নামটা খুব একটা সহায়ক হয়নি। চান্দ্র সীমার ঐ বিশাল অঞ্চলটার মতোই এটাও। গোলাকার। আধ কিলোমিটার উঁচু, চার কিলোমিটার ব্যাস। কোথাও চোখ আটকে যায় না। খটকা লাগে না কোথাও। দেয়ালের রঙ ফিকে নীল, ঠিক যেন দিগন্তের আকাশ। এলাকাটা যেন অসীম।
পোল প্রথমে উইংমাস্টারের কথায় কান দেয়নি। আপনি চাইলে যে কোনো দৃশ্য দেখতে পারেন। কে-ই বা বিশ্বাস করে। পঞ্চাশ মিটার উপর থেকে নিচে তেমন কিছু দেখা গেল না। শুধু ফিচারলেস তারের গোলকধাঁধা। ফ্লেক্সিবল ক্যাবল। পুরো মেঝেটাই যেন পেল্লায় ট্রাম্পোলিন। না উড়েও মানুষ অনেক মজা লুটে নিতে পারবে। এখান থেকে সরাসরি শক্ত কিছুর উপর পড়ে গেলে খারাপ ব্যাপার হবে তাতে সন্দেহ নেই, পৃথিবীর বুকে পাঁচ মিটার উপর থেকে পড়ে কি মানুষ ঘাড় ভাঙেনি।
দু ডানার আলতো ঝাঁপটায় বাতাসে ভেসে এল পোল। একটু পরই দেখতে পেল, উড়ছে সে। উড়ছে। শত মিটার উপরে চলে এসেছে। আসছে আরো আরো উপরে।
‘এবার একটু ধীরে!’ বলল উইংমাস্টার, আমিতো আপনার সাথে পাল্লা দিয়ে পারছি না।
একটু ঢিল দিল পোল। আলতো করে গড়িয়ে দিল শরীরটাকে। বাতাসের উপরে। ডিগবাজি খেল গিরিবাজের মতো। অনেক হাল্কা লাগছে, শরীরের ওজন তো দশ কেজিও নয়। কে জানে, অক্সিজেনের ঘনত্ব বেড়ে গেল কিনা।
ব্যাপারটা অসাধারণ। শুন্য গ্যাভিটির চেয়ে অনেক বেশি ব্যতিক্রমী, একটু শারীরিক চ্যালেঞ্জ আছে। স্কুবা ডাইভিণ্ডের সাথে এর এক আধটু তুলনা করা যেতে পারে।
আহ, যদি পাখি থাকত এখানে যেমন স্কুবা ডাইভিভের সময় রিফগুলোয় দেখা দিয়ে যায় রঙ বেরঙের কোরাল মাছের দল, তেমন।
উইংমাস্টার একে একে ওড়ার বাহারি জাদু শিখিয়ে দিচ্ছে রোলিং, লুপ তৈরি করা, মাথা নিচে রেখে উড়ে যাওয়া, শুধু ডানায় ভর করে ভেসে থাকা… সবশেষে বলল, আর কিছু শিখাতে পারব না। আমার বিদ্যার ঝোলা খালি হয়ে এসেছে। এবার ভিউ উপভোগ করা যাক।
এক মুহূর্তের জন্য যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল পোল, এমনটাই হবে, আশা করেছিল, কারণ, মূহুর্তের ব্যবধানে চারপাশে মাথা তুলে ধরেছে শুভ্র কিরিটি পরা পর্বতগুলো। উন্নতশির। এবড়োথেবড়ো পাথর দাঁত খিঁচিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। উড়ে যাচ্ছে সে দুইটা শিখরের কাছ দিয়ে। খুব কাছ দিয়ে। এগিয়ে যেতে যেতে দেখল একটা ঈগলের বাসা। বাসায় পড়ে আছে ডিম। একটু হলেই ছুঁয়ে দেখতে পারত সেটাকে। কিন্তু সামনে যেতে হবে। আর একটু ফ্রি স্পেস দরকার।
হারিয়ে গেল পর্বতমালা। নেমে এল নিকষ কালো রাত। আকাশে ফুটকি তুলে তুলে জেগে উঠল তারার ফুলেরা। আকাশের খুব বেশি নক্ষত্র তো আর দেখা যায় না! আস্তে আস্তে আরো বেশি কিছু দেখা দিল। দেখা দিল নিহারিকাগুলো, গ্লোবুলার ক্লাস্টার।
এসব বাস্তব হবার কোনো উপায় নেই। যদি জাদুমন্ত্রে কোনো ভিন্ন পৃথিবীতে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়, তবু বিশ্বাস্য নয়। কারণ চোখের সামনে জন্ম নিচ্ছে নক্ষত্ররাজি। তিমির অমানিশা থেকে নক্ষত্রবীথি যেমন ফুটে উঠছে তেমনি হারিয়ে যাচ্ছে, হয়ে যাচ্ছে উধাও। প্রতি পল-অনুপলে লাখ-কোটি বছর যে কেটে যাচ্ছে তা বোঝা যায় বেশ…
মন বিবশ করা দৃশ্যগুলো হারিয়ে গেল, যেমন করে এসেছিল একেবার শূন্য থেকে… এবার খালি এক আকাশের বুকে আবিষ্কার করল পোল নিজেকে। সে আর তার সাথে উইংমাস্টার। সেই পরিচিত সিলিন্ডার, সেই এ্যাভিয়ারি।
‘একদিনের পক্ষে এটুকুই যথেষ্ট, কী বলেন? প্রশ্ন তোলে উইংমাস্টার, ‘পরেরবার এলে কোন ধরনের দৃশ্য চান দেখতে?’
একটুও দ্বিধা নেই পোলের মনে। এক ঝলক হাসি দিয়ে জানিয়ে দিল কী দেখতে চায়।
১১. ড্রাগনের নিঃশ্বাস
এমনধারা কাজ যে সম্ভব তা বিশ্বাস করা কোন মানুষের কম্ম। এ যুগের উন্নতি দিয়েও ঠিক হজম করা যাচ্ছে না। এত বড় একটা ভুবনে কত কত টেরাবাইট… পেরাবাইট কাজে লাগানো হয়েছে? প্রযুক্তির উন্নয়নের ধারা ধরে স্টোরেজ মিডিয়াম এখন কোন পর্যায়ে? এ নিয়ে ভেবে মাথা খারাপ করার মানে হয় না। বরং ইন্দ্রার কথা মেনে চলাই শ্রেয়, তুমি যে একজন ইঞ্জিনিয়ার সেসব কথা মাথা থেকে স্রেফ হাপিস করে দিয়ে উপভোগ করা
এখন সে উপভোগ করছে, আকণ্ঠ পান করছে প্রযুক্তির আশীর্বাদ-অমিয়। সেই সাথে ধেয়ে আসছে নস্টালজিক সব ভাবনা। একেবারে মনমরা করে দিচ্ছে তাকে। সে উড়ছিল প্রায় হাজার দুয়েক কিলোমিটার উচ্চতায়, তার যৌবনের মন মাতাল করা ভূমির উপর। অবশ্যই, অনুভূতিটা কৃত্রিম, এভিয়ারি মাত্র আধ কিলোমিটার উঁচু, তাতে কী, অনুভূতি তো।
উল্কাপাতে তৈরি হওয়া জ্বালামুখের উপর দিয়ে উড়ে গেছে সে মনে পড়ে গেছে এ্যাস্ট্রোনট ট্রেনিঙের সময় কীভাবে এগুলোর আশপাশে যেত সেসব কথা।
পোল নিশ্চিত তার আরামে উড়ে যাবার গতি শ দুয়েক কিলোমিটার নয়, বড়জোর টেনেটুনে বিশ কিলোমিটার হবে। কিন্তু ফ্ল্যাগস্টাফের কাছে পনের মিনিটেরও কম সময়ে যাবার অনুমতি আছে। এইতো, লোয়েল অবজার্ভেটরির ঝকঝকে গম্বুজগুলো! একেবারে কিশোর, দুরন্ত পোল এ জায়গায় কতবার এসেছে তার কোনো লেখাজোকা নেই। এ থেকেই তো এমন একটা কাজ বেছে নেয়ার চিন্তা মাথায় এসেছিল। এখানকার স্টাফরা কি মুখে মধু নিয়ে জন্মেছিল? এ্যারিজোনায়, মঙ্গলিয় ফ্যান্টাসিগুলোর যেখানে জন্ম, সেখানে সেও না জন্মালে এ জন্মে আর এ্যাস্ট্রোনট হওয়াটা কপালে জুটত না। হয়ত স্রেফ কল্পনা, মনে হচ্ছে লোয়েলের সেই বিখ্যাত সমাধি নিচেই কোথাও; কল্পনার লাগাম ছুটিয়ে দেয়া বিশাল সেই টেলিস্কোপটার কাছেই।
কোন সময়টায়, কোন আবহাওয়ায় এ ছবি তুলে আনা হয়েছিল? একবিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে পৃথিবীর বুকে চোরাগোপ্তা দৃষ্টি হানা স্পাই স্যাটেলাইটের তোলা ছবি, এটুকু আন্দাজ করা যায়। তার সময় থেকে খুব বেশি পরে নেয়া হয়নি, হলপ করে বলতে পারে সে; এখানকার আশপাশ যে এমন ছিল তা মনে পড়ে। একটু, আর একটু নিচে নামতে পারলে খোদ নিজেকে দেখা যাবে হয়ত…
কিন্তু বাড়া ভাতে ছাই দেয়ার কোনো ইচ্ছাও নেই। আর নিচে গেলে দৃশ্য ভেঙে যাবে, বেরিয়ে পড়ছে প্রযুক্তির তীক্ষ্ণ দাঁত। পিক্সেলগুলো ভাঙা ভাঙা চলে আসবে। কী দরকার সুখস্বপ্ন নষ্ট করার?
আরে… কী অবাক ব্যাপার! এইতো সেই পার্ক… সেই ছোট্ট পার্ক যেখানে তার জুনিয়র আর হাইস্কুলের বন্ধুদের সাথে সময় কাটিয়েছিল, ডানপিটে সব কাজ করেছিল, খেলেছিল নাওয়াখাওয়া ভুলে। সিটির হর্তাকর্তারা অহর্নিশি এর জিম্মাদারি নিয়ে হা পিত্যেশ করে বেড়াত, পানির সরবরাহ নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। যাক, এটাতো টিকে ছিল ছবি তোলা পর্যন্ত, এই যথেষ্ট।
আরেক ভাবনা চোখ ফাটিয়ে পানি নিয়ে আসে। ঐ সরু গলিগুলো ধরে হেঁটে বেড়াত সে সময় পেলেই। হিউস্টন থেকে বেরুতে পারলে বা চাঁদ থেকে একটু অবসর পেয়ে পৃথিবীতে এলেই পায়চারি করত অনেক আবেগমাখা সেই রোডেশিয়ান রিজব্যাকে। হাতে থাকত একটা ছড়ি আর পোষা কুকুরটা।
বৃহস্পতি থেকে আসার চিন্তার সাথে সব সময় মনে একটা উদ্বেগ থাকত, রিক্তি তার ছোট ভাই মার্টিনের কাছে ভাল থাকবে তো? ভাবনাটা কেমন যেন স্থবিরতা এনে দেয়। কিছু বোঝার আগেই নেমে যায় বেশ কয়েক মিটার। ফিরিয়ে আনতে হয় শক্তি। কী করে নিজেকে বোঝায় যে রিক্কি আর মার্টিন দুজনেই শত শত বছর আগে মিশে গেছে ধূলার সাথে।
ঝাপসা চোখ পরিষ্কার হয়ে এলে এ্যান্ড ক্যানিয়নের কালো রেখা দেখা যায়। এগিয়ে যাবে কিনা ভেবে পায় না। আকাশে একা নয় সে। মানুষ যে উড়ছে না এটুকু বোঝা যায়। একটু বেশিই বড়।
‘যাক,’ বলল সে নিজেকে, এখানে একটা টেরোডাকটাইলের সাথে দেখা হয়ে যাওয়াটা মোটেও আজব নয়। আশা করি প্রাণীটা ফ্রেন্ডলি হবে… ও, নো!
টেরোডাকটাইলের আন্দাজটা একেবারে ভুল নয়। সম্ভবত দশে আট দিয়ে দেয়া যায়। রূপকথার দেশ থেকে পাখা মেলে এগিয়ে আসছে যেটা তাকে ড্রাগন বললে কোনো ভুল হবে না। দৃশ্যটাকে পূর্ণতা দিতে সেটার পিঠে চড়ে আসছে রূপবতী এক মেয়ে।
সৌন্দর্য এতদূর থেকে মেপে নেয়া একটু কঠিন। কল্পনার রঙ চড়িয়েছে পোল। রীতিবদ্ধ চিত্রটায় চিড় ধরেছে একটা বিশেষ কারণে। প্রথম মহাযুদ্ধের বাইপ্লেনের পাইলটরা যেমন পরত, এভিয়েটর গগলে মেয়েটার মুখের বেশিরভাগ ঢাকা।
ভেসে থাকে পোল। বিশাল জটার ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ ওঠে। এগিয়ে আসে সেটা। মাত্র বারো ফুট দূর থেকেও সিদ্ধান্তে আসতে পারে না সে, এটা কোনো মেশিন, নাকি বায়ো-কনস্ট্রাক্ট…হয়ত দুইটাই।
এরপর ড্রাগনের কথা মন থেকে উধাও হয়ে গেল, কারণ মুখ থেকে আবরণ সরিয়ে নিয়েছে মেয়েটা।
এসব কথা আদিকাল থেকে বলে আসছে সাহিত্যিকরা, আর আদিকাল থেকেই সে কথার কোনো মূল্য দেয় না পাঠক মাঝে মাঝে।
কিন্তু প্রথম দেখায় ভালবাসার আবেদন ফুরাবে না কখনো।
.
দানিল কোনো তথ্যই জানাতে পারল না, পোলও খুব বেশি আশা করেনি। কিন্তু পোল যে মানসিকভাবে অনেকটাই স্তব্ধ হয়ে গেছে তা অস্বীকার করে কী করে। এ বায়ো-রোবটটা কাজের নয়- গৃহস্থালির কাজে তার তুলনা নেই, কথা সত্যি, কিন্তু
ভদ্রভাবে কারো ব্যাপারে জানতে চাইলে সে চট করে বলে ফেলতে পারবে না। মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত হয়ে যায় সে, নিজেও কি একটা বায়ো-রোবট?
ইন্দ্রা অবশ্য ঠিকভাবে জবাবটা দিতে পেরেছিল।
‘ও, ড্রাগন লেডির সাথে দেখা হয়েছে তোমার?
‘এ নামেই ডাক নাকি? আসল নামটা কী? আইডেন্ট বের করে দিতে পারবে? হাত স্পর্শ করার উপায় ছিল না তখন।
‘অফকোর্স- নো প্রবলেমো।‘
‘এটা আবার কোত্থেকে কুড়ালে?
ইন্দ্রার চোখেমুখে বিভ্রান্তি।
মনে নেই- হয়ত কোনো পুরনো মুভি বা বই থেকে। কেন, কথাটা কি বেমানান
বয়সটা পনেরর বেশি হলে বেমানান।’
বাদ দাও, মনে রাখব। বলতো, কী হয়েছিল তখন? এর মধ্যেই হিংসা হচ্ছে আমার।
বন্ধুত্বের একটা পর্যায়ে এলে মানুষ সহজভাবে যে কোনো কথা বলতে পারে। এখনো একে অন্যের বিচিত্র সব আগ্রহের কথা খেয়াল করে শোনে। একবার ইন্দ্রা বলেছিল, আমার মনে হয় দুজনে যদি কোনো বিচিত্র গ্রহাণুতে ধ্বসে পড়তাম, একটা না একটা উপায় বের করে ফেলতাম, কী বল?
‘প্রথমে বলতে হবে মেয়েটা কে।
নাম অনোরা ম্যাকঅলি। আরো অনেক ব্যাপারের সাথে সে সোসাইটি ফর ক্রিয়েটিভ এ্যানাক্রোনিজমের প্রেসিডেন্ট। আর তুমি যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাক যে ড্রাকো দেখতে বেশ ভাল, তাহলে বলতেই হয়, তাদের জাতের আরো কয়েকটাকে দেখতে হবে আগে। দেখতে হবে তাদের অন্যান্য সৃষ্টি। যেমন মবি-ডিক আর ডাইনোসরের আত্মীয়স্বজনের বিশাল এক দলকেও দেখতে হবে, দেখে শেষ করতে পারবে না।’
সত্যি হতে হলে এত বেশি ভাল না হলেও চলে, ভাবে পোল।
পৃথিবী গ্রহের বুকে আমিই সবচে বিচিত্র এ্যানাক্রোনিজম।
১২. হতাশা
এখন পর্যন্ত, স্পেস এজেন্সি সাইকোলজিস্টদের সাথে তার বাতচিতের কথা ভুলে বসেছিল সে।
‘আপনি পৃথিবী ছেড়ে যাবেন, যদি যান, কমপক্ষে তিন বছরের জন্য। আমরা আপনাকে একেবারে নির্বিষ, মানে গোবেচারা একটা এ্যানাফ্রোডিসিয়াক ইমপ্ল্যান্ট দিতে পারি। মিশনের শেষ পর্যন্ত থাকরে। আশ্বস্ত করছি, আমরা ব্যাপারটাকে ভালভাবেই শেষ করতে পারব।’
‘নো থ্যাঙ্কস,’ জবাব দিয়েছিল পোল, কথা বলার সময় মুখটাকে স্বাভাবিক রাখার প্রাণান্ত চেষ্টাও চালাচ্ছে, মনে হয় আমি সামলে উঠতে পারব।’
এবং তারা সন্দিহান হয়ে পড়েছিল মাত্র তিন চারটা সপ্তাহ পেরিয়ে যাবার পরই। তারা। সে এবং ডেভ বোম্যান।
‘আমিও ব্যাপারটা খেয়াল করেছি, ডেভ বলে উঠেছিল তখন, ‘ঐ মরার ডাক্তাররা আমাদের খাবারে যে কিছু একটা মিশিয়ে দিয়েছে আগেই বুঝতে পেরেছি।’
সেই কিছু একটা যাই হোক না কেন- যদি আদৌ কিছু মিশিয়ে দেয়া হয়ে থাকে- শেলফের জীবন পার করে এসেছে। কিন্তু এসবে কিছু এসে যায় না। খুব ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়। ভাবা হয়ে পড়ার সময় নেই। তরুণী এবং পুরোপুরি তরুণী নয় এমন অনেক মেয়ের অফার প্রতিনিয়ত ফিরিয়ে দিতে হয়। তার রূপ নাকি মনের দক্ষতা নাকি খ্যাতি- কোনটা তাদের আকর্ষণ করে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই তার। ব্যাপারটা সম্ভবত স্রেফ কৌতূহল, বিশ ত্রিশটা জেনারেশন পার করে আসা মানুষটার প্রতি আগ্রহ।
পোলের মনে বেশ স্বস্তির একটা পরশ বয়ে যায় যখন সে আইডেন্ট থেকে বের করে দেখে যে মিস্ট্রেস ম্যাকঅলি বর্তমানে প্রেমিকদের মাঝেই আছে এবং তার সময় খুব স্বল্প। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে সে চলে গেল অন্য এক অবস্থায়। মেয়েটার সরু কোমরে তার হাত, উড়ে চলেছে পুরোপুরি রোবট এক ড্রাগন, ড্রাকোর পিঠে চড়ে। এভিয়েটর্স গগল পরতে হবে কারণ ড্রাকোর গতি ‘আসল’ ড্রাগনদের চেয়েও অনেক বেশি, যন্দুর মনে হয়।
নিচের চির পরিবর্তনশীল চিত্রে এখন অন্য আবহ। উড়ন্ত কার্পেট থেকে আলি বাবা হাত নাড়ছে খুশি মনে… না, খুশি মনে না, চিৎকার করছে, দেখতে পাও না। নাকি! কোথায় যাচ্ছ?”
সে নিশ্চয়ই বাগদাদ থেকে অনেক দূরে। কারণ নিচে এখন অক্সফোর্ডের চিত্র।
অরোরা নিচে আঙল নির্দেশ করল, ঐ পাবটাতেই ইনটাতেই- লুইস আর টোকিন বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠতেন। আর ঐ নদীটা দেখুন ব্রিজ থেকে মাত্র যে নৌকাটা বেরিয়ে এসেছে না? উপরের ছোট যাজক আর মেয়ে দুইটাকে দেখতে পাচ্ছেন?
‘পাচ্ছি, ড্রাকোর নিঃশ্বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে চিৎকার করে ওঠে সে, এবং ধারণা করছি তাদের একজন এলিস।
অরোরা সাথে সাথে ঘুরে তাকায়। বোঝা যাচ্ছে, বেশ আনন্দিত।
ঠিক তাই। একেবারে নিখুঁত রেপ্লিকা, কী বলেন? আপনার সময়টা পেরিয়ে যাবার পরই মানুষ পড়ার অভ্যাস একেবারে ছেড়ে দেয়।’
উষ্ণ একটা প্রবাহ বয়ে যায় পোলের ধমনীতে।
আশা করি আরো একটা পরীক্ষায় পাশ করেছি, বলে সে নিজেকে। ড্রাকোর পিঠে চড়াটা একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা, কিন্তু আর কী কী বাকি আছে? বিশাল বিশাল তলোয়ারের সাথে লড়াই ।
কিন্তু আর কিছু বাকি ছিল না। তোমার জায়গায়, নাকি আমার ওখানে প্রশ্নটা তুলেছিল পোলই।
.
পরদিন সকালে, স্তব্ধ হয়ে, প্রফেসর এ্যান্ডারসনকে কল করল সে।
‘সব চলছিল ঠিকঠাক। কোনোক্রমে কথাগুলো উগড়ে দিল, তারপর হঠাৎই হিস্টিরিক্যাল হয়ে গিয়ে আমাকে ঠেলে দিল। ভড়কে গেলাম সাথে সাথে, নিশ্চয়ই কোনো না কোনোভাবে আঘাত দিয়েছিলাম–
তারপর রুমলাইট কল করল, আমরা অন্ধকারেই ছিলাম তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বিছানা থেকে। সম্ভবত বোকার মতো শুরু করেছিলাম আমি… সে নিশ্চয়ই তাকিয়ে ছিল…’
‘আমি বুঝতে পারছি। বলে যাও।
কয়েক মিনিট পর একটু রিল্যাক্সড হল। এমন কিছু বলল যা কখনো ভুলতে পারব না।’
অপেক্ষা করছে এ্যান্ডারসন। পোল নিশ্চয়ই নিজেকে সামলে নিয়ে ভালভাবে বলতে পারবে।
বলেছিল, আমি সত্যি সত্যি দুঃখিত, ফ্র্যাঙ্ক। আমরা হয়ত ভাল সময় কাটাতে পারতাম। কিন্তু জানতাম না যে- তুমি মিউটিলেটেড।
শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে প্রফেসর। একটু পরই বুঝতে পারল।
‘ও- বুঝতে পারছি। আমিও দুঃখিত, ফ্র্যাঙ্ক- হয়ত তোমাকে সতর্ক করা উচিৎ ছিল। আমার ত্রিশ বছরের প্র্যাকটিসে মাত্ৰ জনা ছয়েকের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা দেখেছি।
প্রতিটাই মেডিক্যাল কারণে হয়েছিল যা তোমার বেলায় খাটবে না…
‘আদ্যিকালে সারকামসেশন বা শরীরের স্পর্শকাতর অংশবিশেষ সরিয়ে ফেলা অনেক গুরুত্ব বহন করত- এমনকি তোমার আমলেও। অস্বস্তিকর, মরণ ডেকে আনতে পারে এমন বেশ কিছু রোগের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য প্রাথমিক শতাব্দিগুলোয় কাজটা করা হত। তখন হাইজিন খুব একটা উচ্চ স্তরে পৌঁছেনি। কিন্তু তার পরই, সময় এগিয়ে চলল, এর পক্ষে আর কোনো যুক্তি রইল না বরং থাকল বিপক্ষে, নিজেই আবিষ্কার করলে।
‘তোমাকে প্রথম পরীক্ষা করার আগে রেকর্ড চেক করে নিয়েছি। একবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে এত বেশি অপব্যবহার শুরু হয় যে আমেরিকান মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন ব্যাপারটা তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিল। এ বিষয়ের ডাক্তারদের আলোচনা বেশ মুখরোচক।’
‘আমি নিশ্চিত, খুৰ মুখরোচক।’ তিক্ত মুখে বলল পোল।
কিছু কিছু দেশে আরো একটা শতাব্দি ব্যাপারটা চলে। তারপর কোনো কোনো জিনিয়াস দারুণ একটা শ্লোগান তৈরি করে, শব্দের ব্যবহারের জন্য ক্ষমা করবে, ঈশ্বর আমাদের ডিজাইন করেছেন; সারকামসেশন ইজ ব্লাসফেমি। মোটামুটি এটাই এ রীতির পথ রুদ্ধ করে দেয়। কিন্তু তুমি চাইলে একটা ট্রান্সপ্লান্টের ব্যবস্থা করা যায় সহজেই। তুমি কিন্তু মেডিক্যাল হিস্টোরিতে নাম লিখিয়ে ফেলবে না এমন কিছু করলে।
‘আমার মনে হয় না এতে কোনো কাজ হবে। প্রতিবারই হেসে ফেলব।
দ্যাটস দ্য স্পিরিট- তুমি এর মধ্যেই চলে আসছ।
অবাক হয়ে দেখল, পোল সত্যি সত্যি এ্যান্ডারসনের মুখের উপর হেসে ফেলছে।
‘আবার কী হল, ফ্যাঙ্ক?
‘অরোরার সোসাইটি ফর এ্যানাকোনিজমস। আশা করি এতে আমার সুযোগ আরো বাড়বে। আমার কপাল ভাল বলতে হয়, সে এমন এক এ্যানাকোনিজমের মুখোমুখি হয়েছে যা ঠিক পছন্দ করে না।
১৩. আজব সময়ে অচেনা অতিথি
ইন্দ্রা খুব একটা গা করল না সব শুনে, সম্ভবত তাদের সম্পর্কটার মধ্যে কিছু সেক্সয়াল জেলাসি আছে। প্রথম যুক্তিতর্কে নামল তারা এ নিয়েই।
খুব স্বাভাবিকভাবেই রু হয়েছিল। ইন্দ্রা বলল, ‘মানুষ সব সময় আমাকে দোষ দিয়ে বেড়ায়। কোন দুঃখে আমি ঐ ভয়ঙ্কর সময় নিয়ে গবেষণা করে মরছি। কিন্তু আরো ভয়াল একটা ব্যাপার ছিল তো, এ কথাই তা সবটুকুর জবাব নয়।’
‘তাহলে আমার শতাব্দি নিয়ে তোমার এত আগ্রহ কেন?’
‘কারণ তখন থেকেই বর্বরতা আর আধুনিকতার মধ্যে পার্থক্য সুচিত হয়।‘
‘থ্যাঙ্ক ইউ, জাস্ট কল মি কোনান।‘
‘কোনান? কোনান নামে মাত্র একজনকেই আমি চিনি। তিনি শার্লক হোমসের জন্ম দিয়েছিলেন।’
‘নেভার মাইন্ড- স্যরি, বাধা দিয়েছিলাম কথার মধ্যে। অবশ্যই, আমরা তথাকথিত ডেভেলপড শতাব্দিগুলোয় নিজেদের সভ্য মনে করতাম। অন্তত সেসব দিনে যুদ্ধকে আর শ্রদ্ধা করা হত না। জাতিসংঘ সব সময় যুদ্ধ বাধতে নিলেই থামানোর চেষ্টা করত।
‘খুব বেশি সফল যে হত তা কিন্তু নয়। আমি তাদের সে চেষ্টাকে দশে বড়জোর তিন দিতে রাজি। আর আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখি যে তখনকার মানুষ এমনকি দু হাজারের প্রথম দিকেও!- শান্তভাবে এমন সব আচরণকে মেনে নিত এখন যেগুলোকে আমরা বর্বরপূর্ব হিসাবে অভিহিত করি। তারা বিশ্বাস করত মাথা ঘাপলিয়ে—’
‘ঘাবড়ে।’
‘-ননসেন্স। বিশ্বাস করত এমন সব ব্যাপারে আধুনিক মানুষ যেগুলো শুনলে মানুষকে মস্তিষ্কবিকৃত ভাবে।‘
‘উদাহরণ, প্লিজ।‘
‘তোমাদের এসব আচরণের দু একটা উদাহরণই আমাকে এসব নিয়ে গবেষণা করতে বাধ্য করে। তারপর কেঁচো খুঁড়তে কেউটে সাপ বেরিয়ে পড়েছিল। তুমি কি জান কয়েকটা শতাব্দির প্রতি বছর হাজার হাজার বাচ্চা মেয়েকে মিউটিলেট করা হয়েছিল শুধু এ আশায় যে তারা কুমারীত্ব রক্ষা করে চলবে? অনেকেই স্রেফ মারা পড়েছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ যেন একচোখা হরিণ।‘
‘আমি মানি, ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর- কিন্তু এ নিয়ে আমার সরকার কী করতে পারত?
অনেক কিছু যদি ইচ্ছা থাকত। কিন্তু তারা কিছুই করেনি। করেনি কেন? কারণ তাদের তেল সরবরাহকারী এবং অস্ত্র ক্রেতা দেশগুলো নাখোশ হবে, সেসব অস্ত্র, যেমন ল্যান্ড মাইন যেগুলো হাজার হাজার নিরীহ ছা-পোষা মানুষের প্রাণ নিয়েছিল।
বুঝতে পারছ না, ইন্দ্রা। আমাদের হাতে এত বেশি উপায় ছিল না। আমরা পুরো পৃথিবীটাকে বদলে দিতে পারতাম না। কে যেন একবার বলেছিল না, সম্ভাব্যতার শিল্পই রাজনীতি
‘খুব সত্যি- এ কারণেই দ্বিতীয় শ্রেণীর মাথাগুলো এ কাজে যেত। জিনিয়াস অসম্ভবের পিছু ছোটে, পলিটিক্সের নয়।
যাক, আমি খুব আহাদিত যে তোমাদের ভাল মেধার সাপ্লাই আছে, যাতে তোমরা সব ঠিকঠাক রাখতে পার।’
‘আমি কি বিন্দুমাত্র ইশারাতেও সারকামের প্রসঙ্গ তুলেছি? আমাদের কম্পিউটার সিস্টেমকে অনেক অনেক ধন্যবাদ- রাজনীতিকে মাঠে নামানোর আগে আমরা আগাগোড়া সব দেখে নিতে পারি। সব সম্ভাব্যতার প্রয়োগ দেখতে পাই সিমুলেশনে। লেনিনের কপাল খারাপ; বেচারা শত বছর আগেই জন্মেছিল। রাশিয়ান কম্যুনিজম কাজে লেগে যেতে পারত। অন্তত কিছু সময়ের জন্য যদি তাদের হাতে মাইক্রোচিপ নামের কোনো বস্তুর নাম নিশানা দেখা যেত। তাহলে এড়িয়েও যেতে পারত স্ট্যালিনকে।
পোল রাগবে কী, তার শতাব্দির বিষয়গুলোয় ইন্দ্রার দখল দেখে এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্যকে অম্লানবদনে সহ্য করে যাচ্ছে। এদিকে তার সমস্যা ঠিক উল্টে গেছে। একশ বছর বাঁচলেও সে এ জটিল, বর্তমান, মানব সভ্যতাকে বুঝে উঠতে পারবে না পুরোপুরি। এমন সব রেফারেন্স অহরহ টানা হয় যার কোনো কূল-কিনারা করতে পারে না সে। এমন সব কৌতুক বলা হয় অহরহ যেগুলো সোজা মাথার উপর দিয়ে চলে যায়, হৃদয় স্পর্শ করে না। সর্বোপরি, মাঝে মাঝে তাকে রীতিমত ঘর্মাক্ত থাকতে হয় কোন কথা বলে নতুন বন্ধুদের সামনে হেয় হয়ে যায়…।
…এমনি এক ঘটনা ঘটেছিল খাবার সময়। ভাগ্য ভাল, খাচ্ছিল নিজের কোয়ার্টারে। এবং ইন্দ্রা আর প্রফেসর এ্যান্ডারসন ছাড়া আর কেউ ছিল না আশপাশে। অটোশেফ থেকে বের হওয়া খাবার সব সময় অতি উত্তম হয়। শারীরিক-মানসিক অবস্থার সাথে মানানসই করেই পাঠানো হয় সেসব। কিন্তু একবিংশ শতাব্দির এক গেঁয়োর কাছে সেগুলো সব সময় আহাদের হবে এমনটা আশা করাও বোকামি।
তারপর, একদিন, একেবারে সুস্বাদু একটা ডিশ এল। যৌবনের হরিণ শিকার আর বার্বিকিউর স্মৃতি টগবগিয়ে ফুটল মনের ভিতরে। ফ্লেভার আর বাহ্যিক আকৃতিতে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল, সুতাং পোল স্বাভাবিক প্রশ্নটা করেই বসে।
এ্যান্ডারসন হেসেছিল কোনোক্রমে। কিন্তু ইন্দ্রা এমনভাবে তাকিয়ে ছিল যেন সে একেবারে অসুস্থ হয়ে পড়বে। কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, ‘তুমি বলবে তাকে অবশ্যই খাবার পর।
এখন আবার কোন মহাভারত অশুদ্ধ করলাম আমরা? প্রশ্ন করে পোল নিজেকেই। আধঘন্টা পর, একটা ভিডিও ডিসপ্লেতে ঘরের অন্য কোণায় ইন্দ্রা একেবারে ডুবে যাবার পর, তৃতীয় সন্ত্রাব্দের ব্যাপারে আরো একটু অগ্রসর হল পোলের জ্ঞান।
মৃতদেহের খাদ্য এমনকি তোমার সময়েই শেষ হয়ে যাচ্ছিল।’ ব্যাখ্যা করে এ্যান্ডারসন, জীবজ জন্ম দিয়ে- উহ- পাবার জন্য জীবজ জন্ম দেয়ানো অর্থনৈতিকভাবে অসম্ভব হয়ে পড়ে। জানি না একটা গরুকে খাবার দেয়ার জন্য কত একর জমি নষ্ট করতে হত কিন্তু এটুকু জানি ঐ জায়গায় জন্মাতে পারত এমন গাছের উপর অন্তত দশজন মানুষ জীবন চালাতে পারে। আর হাইড্রোপোনিক টেকনিক অবলম্বন করলে নির্বিঘ্নে শ খানেক মানুষ চলে যেতে পারত।
কিন্তু অর্থনীতি নয়, এ ব্যবসাটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল রোগ। ভাইরাসটা প্রথমে চারপেয়ে প্রাণিগুলোর মধ্যে ছড়ায়, তারপর অন্যান্য জম্ভর মধ্যে। ভীষণ এক ভাইরাস। খুব খারাপভাবে মরতে হত মানুষকে। তারপর চিকিৎসা বেরোয়, কিন্তু ঘড়ির কাঁটা উল্টে দেয়ার কোনো উপায় ছিল না। তদিনে সিনথেটিক খাবারের জয়জয়কার। খুব সস্তাও। কোনো জীবাণু থাকার প্রশ্ন ওঠে না। পেতে পার যে কোনো তোরে।
সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে চলা তুষ্ট করার মতো কি মোটামুটি বিস্বাদ খাবারের কথা মনে পড়ে যায় পোলের। ভেবে পায় না সে, এখনো কি মনে স্টেক আর কাবাবের লোভ জেগে আছে।
অন্যান্য স্বপ্ন আরো সমস্যা সৃষ্টি করে। বুঝতে পারে সে, খুব বেশি দেরি নেই, এ্যান্ডারসনের কাছে মেডিক্যাল হেল্প চাইতে হবে। অস্বস্তি বাড়ছে, অস্বস্তি বাড়ছে এই বিচিত্র, জটিল, পরিবর্তিত পৃথিবীর সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করার সাথে সাথে। স্বপ্নে মাঝে মাঝে সে আগের পৃথিবীতে চলে যায়। চলে যায় তার আসল বনে। তারপর যখন বাস্তবটী ফিরে আসে, ফিরে আসে চরম অতৃপ্তি, বেদনা আর কষ্ট। পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে পড়ে।
আমেরিকা টাওয়ারের পথে চলে যাওয়াটা খুব বেশি কাজের হবে বলে মনে হয় না। গিয়ে নিচে তাকালেই যে অনেক কিছু দেখা যাবে তাও ভুল। বাস্তবে, সিমুলেশনকে পাশ কাটিয়ে তার কৈশোর-যৌবনের ভূমিতে চোখ রাখা একেবারে বোকামি হবে। আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে অপটিক্যাল এইড নিয়ে সে আলাদা আলাদা মানুষকে যার যার কাজ করতে দেখবে। দেখবে নিজের পুরনো সব পথঘাট, যদি এখন থেকে থাকে…
এবং এসব চিতা যখন মাথায় আসে, আসে আরো একটা ভাবনা, সে জায়গাটা দেখতে পাবে যেখানে তার ভালবাসার সব মানুষ এক সময় বসবাস করেছিল- মা, বাবা (আরেক মহিলার সাথে চলে যাবার আগে), প্রিয় আঙ্কল জর্জ, লিল আন্টি, ভাই মাটিন- আর একপাল কুকুর যেগুলোর মধ্যে ছিল তার রিকি।
সব ছাড়িয়ে সেখানে ম-ম করত একজনের গায়ের গন্ধ, তার স্মৃতি, মেয়েটার নাম হেলেনা…
এ্যাস্ট্রোট্রেনিঙের গোড়ার দিকে একেবারে সাদামাটাভাবে শুরু হয়েছিল এ্যাফেয়ারটা। সময় বয়ে যায়। আরো আরো সিরিয়াস হয়ে পড়ে সম্পর্ক। বৃহস্পতির পথে যাবার ঠিক আগে সব ঠিকঠাক হয়ে যায়, তারা এ সম্পর্কটাকে স্থায়ীত্ব দিতে যাচ্ছে ফিরে আসার পর।
সে ফিরে না এলেও হেলেনা তার সন্তান ধারণ করতে খুব আগ্রহী ছিল। সেই প্রয়োজনীয় কাজকর্মের, আইনি জটিলতাগুলো কাটিয়ে যখন পদক্ষেপ নিচ্ছে, কী খুশি ছিল তারা।
এখন, হাজার বছর পরে, জানার হাজার আকুতি থাকলেও জানার আর কোনো উপায় নেই হেলেনা কথা রেখেছিল কিনা। তার স্মৃতিতে আছে, হয়ত আছে পৃথিবীর অযুত নিযুত তথ্যভান্ডারের কোথাও। আবার নাও থাকতে পারে। ২৩০৪ সালে এ্যাস্টেরয়েডের প্রভাবে যে তড়িৎচৌম্বক পালস আঘাত হানে তাকে এ গ্রহের সমস্ত উপাত্তের বেশ অনেকটা অংশ হারিয়ে গেছে চিরতরে। ব্যাকআপ আর সেফটি সিস্টেমকে কাঁচকলা দেখিয়েছিল আক্রমণটা। হারিয়ে যাওয়া অসংখ্য এক্সাইটের সাথে তার সন্তানদের তথ্যগুলো সরে গেছে কিনা তাই বা কে জানে। এখনো, এই পৃথিবীর বুকে তার ঔরসের ত্রিশতম বংশধরা হয়ত পা ফেলে বেড়াচ্ছে, শুধু সে চিনতে পারবে না তাদের কোনোদিন।
অরোরার মতো কোনো কোনো মেয়ে যে এখনো তাকে আস্তাকুড়ের আবর্জনা মনে করে তাতেই সে খুশি। এখন আর কাছের সম্পর্ক দানা বাধানোর চেষ্টা করে না। আশাও করে না খুব কাছে চলে আসবে কেউ, আপনজন বলতে যা বোঝায় তা ভাবা যাবে কারো কারো ব্যাপারে। ভাল আছে সে, এসব মাথাহীন কাজকর্ম নিয়ে দিব্যি ভাল আছে।
মাথাহীন-এটাই সমস্যা। এখন আর এ জীবনের কোনো মানে নেই। যৌবনে পড়া বিখ্যাত এক বইয়ের কথা মনে পড়ে যায়, ‘আজব সময়ে আমি এক আজব মানুষ।
মাঝে মাঝে নিচে তাকায় সে। তাকায় সে গ্রহটার দিকে যেখানে আর কখনো হেঁটে বেড়াতে পারবে না। কোনো না কোনো এ্যালার্ম বাজিয়ে দেয় মানুষ এখান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়। বিচিত্র আত্মহত্যা। জ্বলন্ত উদাপিত হয়ে খসে পড়ে মানুষ পৃথিবীর কাছাকাছি আকাশে।
.
‘দ্বিতীয়বার আপনার দেখা পেয়ে ভাল লাগছে, কমান্ডার গোল।
‘আই এ্যাম স্যরি- এত মানুষের সাথে দেখা হয়- মনে পড়ছে না।
‘ক্ষমা চাওয়ার কোনো কারণ নেই। দেখা হয়েছিল নেপচুনের কাছে।
‘ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার- ডিলাইটেড টু সি ইউ। অটোশেফ থেকে কিছু খাবার পরিবেশন করতে পারি আপনার জন্য?
বিশভাগের উপর এ্যালকোহল মিশানো যে কোনো কিছু চলবে।’
‘পৃথিবীতে কী করছেন? তারা বলল কখনো মঙ্গলের আর্বিটের ভিতরে আসেন না আপনি।
কথাটা সত্যি। এখানেই জন্মেছি, কিন্তু আসতে তিতিবিরক্ত হয়ে যাই। মানুষ আর মানুষ। গিজগিজ করছে। আবার বিলিয়ন ছুঁয়ে ফেলবে সংখ্যাটা।’
‘আমার সময়ে দশ বিলিয়ন ছিল। বাই দ্য ওয়ে, আমার থ্যাঙ্ক ইউ মেসেজ পেয়েছেন?
হ্যাঁ- আসলে আগেই আপনার সাথে যোগাযোগ করা উচিৎ ছিল। সূর্যের দিকে আসার অপেক্ষায় ছিলাম। এলামতো। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা।
ড্রিঙ্ক নিয়েছে চ্যান্ডলার। পোল খুঁটিয়ে দেখছে অতিথিকে। এ সমাজে দাড়ি, বিশেষত থুতনিতে সামান্য দাড়ি দেখা যায় না। বিশেষত এ্যাস্ট্রোনটদের মধ্যে এমন কখনো দেখেনি। স্পেস হেলমেটের সাথে মিলবে না। ই ভি এর যুগ অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। বাইরের কাজ এখন রোবট করবে এই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আচমকা বাইরে যাবার প্রয়োজন যে কোনো সময় পড়তে পারে।
আমার প্রশ্নের জবাব কিন্তু দেননি। পৃথিবী ভাল না লাগলে এলেন কেন?
‘ও- বিশেষত বন্ধুদের জন্য। ঘন্টা পেরিয়ে তারপর তাদের কথা শুনতে পাই, দেখতে পাই। ভাল্লাগে না। এই একমাত্র কারণ নয়। আমার বদলাতে হবে। কয়েক সেন্টিমিটার পুরু হয়ে গেলে ঘুমের অত্তি কমে যায়।’
‘আর্মার?’
‘ডাস্ট শিশু। আপনাদের সময়ে এসব ছিল না, তাই না? কি বৃহস্পতির এলাকা বিরক্তিকর। আমাদের গতি সেকেন্ডে কয়েক হাজার ক্লিক। তাই গায়ে সব সময় ময়লা হামলে পড়ে। অনেকটা বৃষ্টির মতো।’
‘ইউ আর জোকিং।’
অবশ্যই। এসব শুনতে পেলে মরেই যেতাম। শেষ দুর্ঘটনা ঘটেছিল বিশ বছর আগে। আমরা প্রধান প্রধান ধূমকেতু স্রোতের খবর রাখি। সেখানেই বেশিরভাগ জল। সাবধানে এড়িয়ে চলি।
যাই হোক, বৃহস্পতির পথে বেড়িয়ে যাবার আগে একবার ঢু মেরে যান না আমাদের এখানে।
আপনি কি বৃহস্পতিবললেন?
আসলে গ্যানিমিড। আনুবিস সিটি। আমাদের অনেকেই সেখানে আপনজন রেখে এসেছে। দেখা পাচ্ছে না অনেকদিন হল।
হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল পোলর।
একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে জীবনের একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পেল সে। একেবারে নিষ্কর্মা বসে থাকার ধাত নেই কমান্ডার ফ্র্যাঙ্ক পোলের। সেকেন্ডে হাজার কিলোমিটার গতি, ধূলির পরশ, উত্তেজনা। হাজারখানেক বছর আগে সে এই বৃহস্পতিয় অঞ্চলে শেষ না করা কিছু কাজ ফেলে এসেছিল।
খ. গোলিয়াথ
খ. গোলিয়াথ
১৪. বিদায়, পৃথিবী
যাই আপনি চান না কেন, কারণ থাকলে চলবে শুনেছিল সে কিছুদিন আগে। এখনো নিশ্চিত নয়, বৃহস্পতির এলাকায় ফিরে যেতে চাওয়ার পিছনে খুব শক্ত কোনো কারণ দাঁড় করাতে পারবে। অন্যান্য চিন্তাও ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার ভিতরে।
পোল এর মধ্যেই আগামী বেশ কয়েক সপ্তাহের কাজ আর এ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে রেখেছে। বেশিরভাগ মিস হয়ে গেলে হাপ ছেড়ে বাঁচে, কিন্তু বাকি কয়েকটা কাজ বাদ পড়ে গেলে আসলে কষ্ট হবে।
ইন্দ্রা আর প্রফেসর এ্যান্ডারসন ভেটো না দিয়ে বরং উৎসাহিত হয়ে উঠলে বেশ অবাক হল সে। বোঝা যায়, তার মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা, পৃথিবী ছেড়ে যেতে পারলে ওষুধের কাজ দিবে ব্যাপারটা।
সর্বোপরি ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার তো আহ্লাদে আটখানা। আপনি আমার কেবিন জুড়ে বসতে পারেন, আমি ফাস্ট মেটকে তারটা থেকে লাথি মেরে বের করে দিব।
সিদ্ধান্তটা একবার নিয়ে নেয়ার পর ঘটনার গতি বেড়ে গেল। খুব সামান্য জিনিসপত্র ছিল, নেয়ার দরকার আরো কম। তার ইস্ট্রেনিক অটার ইগো ও সেক্রেটারি মিস প্রিঙ্গল সবচে গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় কয়েক টেরাবাইট তথ্য।
তার যুগের হ্যান্ডহোল্ড এ্যাসিস্ট্যান্টের চেয়ে খুব একটা বড় নয় মিস প্রিঙ্গল। আগের দিনের কোল্ট ফোর্টিফাইভের মতোই, কোমর থেকে যখন খুশি ড্র করা যায়। মেয়েটা তার সাথে যোগাযোগ করে অডিও বা ব্রেইনক্যাপের মাধ্যমে। মূল কাজ ইনফরমেশন ফিল্টার হিসাবে থাকা, বাইরের পৃথিবী থেকে পোলকে সরিয়ে রাখা। দক্ষ সেক্রেটারির মতো সব সময় সাবধানে কাজ করে সে। কখনো বলে, পরে যোগাযোগের কথাটা জানাব’ অথবা, দুঃখিত, মিস্টার পোল এখন ব্যস্ত আছেন, কোনো মেসেজ থাকলে জানিয়ে দিতে পারেন।
মাত্র কয়েকজনের কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে। রিয়েলটাইম যোগাযোগ সম্ভব হলেও কথাবার্তা চালাবে দুজন প্রকৃত বন্ধুর সাথে জো আর ইন্দ্রা।
পোল অবাক হয়ে দেখে আসলেই সে গৃহপরিচারককে মিস করবে- প্রতিদিনের নানা টুকিটাকি কাজ ভালই সামলে নিতে পারত দানিল- এখন এসব করতে হবে নিজে নিজে। আলাদা হয়ে যাবার সময় ভদ্রভাবে বো করল দানিল, কোনো বাড়তি আবেগ দেখাল না মধ্য আফ্রিকার ছত্রিশ হাজার কিলোমিটার উপরে, পৃথিবী ঘিরে রাখা চাকাটার কাছে।
.
‘ঠিক জানি না আমার তুলনাটা বেখাপ্পা মনে হবে কিনা, দিম, তুমি কি জান গোলিয়াথ শব্দটা কোন স্মৃতি জাগিয়ে তোলে মনে?
এখনো এতটা বন্ধুত্ব হয়ে যায়নি যে পোল ক্যাপ্টেনের ডাকনাম ব্যবহার করবে, কিন্তু আশপাশে কেউ না থাকলে চলে।
‘খুব খুশি হবার মতো কিছু নয় নিশ্চয়ই।
‘ঠিক তা না। ছেলেবেলার কথা, আমার চাচার কাছে একগাদা সায়েন্স ফিকশন পত্রিকা ছিল। তখনকার দিনে ‘পাল্প বলা হত সেগুলোকে, সস্তা যে কাগজে ছাপা হত সেই নামে নাম। আর কী বিচিত্র যে তার কভার! আজব আজব গ্রহ-নক্ষত্র, বুক কাঁপানো জও-জানোয়ার আর ছিল স্পেসশিপ।
‘আস্তে আস্তে বড় হলাম। বুঝতে শিখলাম স্পেসশিপগুলো একেবারে বিদঘুঁটে। সাধারণত রকেট চালিত ছিল স্পেসশিপ, কি প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাঙ্কের নাম গন্ধও নেই। কোন কোনটায় আগাগোড়া জানালার সারি, সাগরের বড় বড় জাহাজের মতো। একটা বেশ ভাল লাগত আমার। বিশাল কাঁচের গম্বুজ ছিল ওটায়। মহাকাশে পাড়ি দেয়া কনজার্ভেটরি…।
কিন্তু শেষ হাসিটা মনে হয় সেই বিদঘুঁটে আর অযৌক্তিক চিত্রগুলোর আঁকিয়েরাই হাসল। এখন সত্যি সত্যি গোলিয়াথে কোনো প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাঙ্ক নেই, নেই সীমিত গতি। শুধু এগিয়ে চলা। মাঝে মাঝে মনে হয় আমিই স্বপ্ন দেখছি।
হাসল চ্যাভলার, বাইরে আঙুল নির্দেশ করে জিজ্ঞেস করল, এটাকে কি স্বপ্ন বলে মনে হয়?
স্টার সিটিতে আসার পর এই প্রথমবারের মতো পোল তাকায় সত্যিকার উপরে, যতটা আশা করেছিল তত দূরে নয়। হাজার হলেও, সে এমন এক চক্রের বাইরের রিমে বসে আছে যার ব্যাস পৃথিবীর চেয়ে সাতগুণ বড়। এ কৃত্রিম স্বচ্ছ ছাদের উপরে দৃষ্টি চলে যাবে অন্তত কয়েকশ কিলোমিটার দূরে…
মনে মনে অঙ্ক কষে ফেলার কাজে তার সময়েই জিনিয়াস ছিল পোল, এখনকার দিনে তো এমন পাওয়া যাবে না। উপরের দূরত্ব মেপে নেয়ার সূত্র খুব সরল।
হিসাব করে ফেলল পোল, পঁচিশ কিলোমিটার… হম! পঁচিশ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা স্পেসপোর্টের
বুকেও ভাবা প্রায় অসম্ভব। এখানে, ছত্রিশ হাজার কিলোমিটার দূরের জিওস্টেশনারি অর্বিটে ওজন টের পাওয়া যায়। বাইরে ভেসে ভেসে কাজ করছে বেশ কয়েকটা রোবট আর স্পেসস্যট পর মানুষ। কিন্তু ভিতরে, গোলিয়াথে মঙ্গলের মাপে ওজন।
মন বদলে নিতে চাও না তো, ফ্র্যাঙ্ক ঠাট্টার সুরে জিজ্ঞেস করে ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার, এখনো পাক্কা দশটা মিনিট বাকি আছে।
বদলে ফেললে আর জনপ্রিয়তা থাকবে না, কী বল? আগের দিনে কী বলত জান? প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছি। প্রস্তুত থাকি আর না থাকি, আসছি চলে।
সব মিলিয়ে মাত্র সাতজন ক্রু। কুরা বেশ শ্রদ্ধা করে তাকে। হাজার বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বার অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ছে সে পৃথিবী ছেড়ে। এবারো লক্ষ্য অজানা।
বৃহস্পতি- লুসিফার সূর্যের অন্য প্রান্তে, গোলিয়াথ যাবার সময় শুক্রের খুব কাছ দিয়ে যাবে।
কয়েক হাজার কিলোমিটার উপর থেকে স্টারসিটিকে পৃথিবীর বিষুবরেখার উপর দানবীয় ধাতব ব্যান্ডের মতো দেখায়। গ্যান্ট্রি, প্রেসার ডোম, আধা তৈরি হওয়া বিশাল বিশাল সব মহাকাশতী দেখায় বিন্দুর মতো। দ্রুত সরে যাচ্ছে দৃশ্য। দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে তারা সূর্যের কাছাকাছি এলাকায়। পৃথিবী ঘিরে থাকা এ বলয় এখনো সম্পূর্ণ নয়, শুধু ধাতব কঙ্কাল আছে বিশাল এলাকা জুড়ে। কখনো কি সেগুলো পুরোপুরি শেষ করা যাবে।
আমেরিকান আর এশিয়ান টাওয়ার দেখা যায়। দেখা যায় প্রকৃতির নীলাভ বর্ণ। বিন মহাকাশ থেকে সূর্যের দিকে ধেয়ে আসা যে কোনো ধূমকেতুর চেয়ে বেশি গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতি পল-অনুপলে গতিবৃদ্ধি করা গোলিয়াথ। এখনো দৃষ্টিসীমা জুড়ে আছে পৃথিবী। নীল পৃথিবী। দেখা যাচ্ছে আফ্রিকা টাওয়ারের পুরোটা। এটাই দ্বিতীয় জীবনে তার বসতবাড়ি। কে জানে, বাকি জীবনটাও হয়ত এখানেই কাটিয়ে দিতে হবে।
পঞ্চাশ হাজার কিলোমিটার দুরে যাবার পর স্টারসিটির পুরোটা চোখে পড়ে। যেন পৃথিবী ঘিরে থাকা ক্ষীণ নতুন চাঁদ। শেষ প্রান্তগুলো তারার রাজ্যে হারানো যেন, এক চিলতে, চুলের রেখার মতো, রূপালি। ভাবতে বিবশ লাগে, মানবজাতি স্বর্গের দেশে কৃত্রিম সর্গ তৈরি করে ফেলেছে।
শনির বলয়ের কথা মনে পড়ে যায় পোলের, আরো বেশি পরিপূর্ণ, আরো মহিমাময়। এ্যাস্ট্রোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে প্রকৃতির অর্জনের সাথে পাল্প দিতে হলে।
প্রকৃতি, নাকি… শব্দটা যেন কী? ডিউস।
১৫. শুক্রের পথে
‘পরদিন সকাল। শুক্রের সাম্রাজ্যে চলে এসেছে তারা। মেঘে ঢাকা চিকণ চাঁদের মতো গ্রহটাই শুধু আগ্রহের বস্তু নয়, গোলিয়াথ ভেসে আছে এক বিশাল সিলভার ফয়েলে মোড়া আকৃতির উপর। উড়ে যাচ্ছে গোলিয়াথ এবড়োথেবড়ো গড়নটার উপর দিয়ে, প্রতি মুহূর্তে সূর্যের আলোয় ঝিকিয়ে উঠছে।
পোলের মনে পড়ে যায় যে তার সময়েই এমন এক শিল্পী ছিল, পুরো বিল্ডিংকে প্লাস্টিক শিট দিয়ে মুড়ে দেয়া ছিল তার শখ। একটা ঝকমকে খামের ভিতরে ভরে রাখা মিলিয়ন মিলিয়ন টন বরফ দেখে তার কীরকম অনুভূতি হত। শুধু এ পদ্ধতিতেই সূর্যের পথে বছরের পর বছর ধরে আসতে থাকা ধূমকেতুর শরীরটাকে রক্ষা করা যায়। রক্ষা করা যায় বাষ্প হয়ে যাবার হাত থেকে।
‘তোমার কপাল ভাল, ফ্র্যাঙ্ক, এমন দৃশ্য আমিও কখনো দেখিনি। এক ঘন্টার মধ্যে ইম্প্যাক্ট হবে। আমরা একে মৃদু একটা ধাক্কা দিতে যাচ্ছি যেন সময় মতো নেমে যায়। কাউকে আহত করতে চাই না।’
অবিশ্বাস ভরা চোখে তাকায় পোল।
ইউ মিন শুক্রের বুকে এমন প্রলয়ঙ্করী মহুর্তেও মানুষ আছে?
‘জনা পঞ্চাশেক আধ পাগলা বিজ্ঞানী। দক্ষিণ মেরুর কাছে। অবশ্যই, খুঁড়ে কেটে ভিতরে ঢোকানো হয়েছে তাদের, কিন্তু আমরা তাদের একটু কাঁপিয়ে দিব, যদিও গ্রাউন্ড জিরো গ্রহের অন্য প্রান্তে। হয়ত বলা ভাল ‘এ্যাটমোস্ফিয়ার জিরো’। কারণ মাটির নিচে শকওয়েভ ছাড়া আর কিছু যেতে কয়েকদিন সময় লেগে যাবে।
মহাজাগতিক হিমবাহ শুক্রের এলাকায় চলে আসার ব্যাপারটা দেখার পর পোলের মনে অন্য এক চিন্তা ঘুরপাক খায়। ছেলেবেলায় ক্রিসমাস ট্রিতে রঙ বেরঙের বাতি আর ঝকঝকে রূপালি জিনিস সাজিয়ে দেয়া হত। তারপর চলত উপহার দেয়া-নেয়ার পালা। এমনি একটা মোড়কে সাজানো উপহার নিয়ে আসছে গোলিয়াথ। পৃথিবীতে পানির কোনো মূল্য নাও থাকতে পারে, এমন ভুবনে, সূর্যের কাছের গ্রহ শুক্রে ফয়েলে মোড়ানো বরফের দাম খুব বেশি।
অত্যাচারিত শুক্রের চিত্র ফুটে ওঠে রাডারে। তারে ঘের জ্বালামুখ, প্যানকেক ডোম, সরু গিরিখাদ, এবড়োথেবড়ো ভূমি। এসবের চেয়ে নিজের চোখকেই বেশি প্রাধান্য দেয় পোল। বিধি বাম, নিচের কোনো দৃশ্যই দেখা যাচ্ছে না মেঘের সাগর ভেদ করে। ধূমকেতু গ্ৰহটার বুকে নেমে আসার সাথে সাথে কী হবে তা দেখার খুব শখ ছিল তার। সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশের মধ্যে নেপচুনের এলাকা থেকে চুরি করে আনা বরফের তালটা সমস্ত শক্তি নিংড়ে দিয়ে প্রলয়কান্ড ঘটিয়ে ছাড়বে…
মুহূর্তের ফ্ল্যাশটা আরো ঘটনাবহুল। বরফের মিসাইল কী করে হাজার হাজার ডিগ্রি বাড়িয়ে দেয় তাপমাত্রা, ভাবাও কষ্টকর। ভয়ানক সব তরঙ্গদৈর্ঘ শুষে নিবে ভিউপোর্টের ফিল্টার, এটাই স্বাভাবিক, তবু নীল আলোর ঝলক দাবি করে যে তাপমাত্রাটা সূর্যের কাছাকাছি।
শান্ত হয়ে যাচ্ছে ছড়ানোর সাথে সাথে হলুদ, কমলা, লাল… শকওয়েভের গতি এখন শব্দের চেয়েও বেশি। আর এ শব্দটা কেমন হবো- মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শুক্রের আনাচে কানাচে ছড়ানোর সময় কেমন হবে চিত্রটা!
এইতো, দেখা যাচ্ছে। ছোট্ট এক কালো রঙের বৃত্ত যেন ধোয়ার পাফ… দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই কেমন নরক নেমে এসেছে সেখানে, কেমন করে ছড়িয়ে দিচ্ছে সাইক্লোন। ছড়ানোর ব্যাপারটা খুব বেশি বোঝা যায় না, মিনিটখানেক অপেক্ষা করে বুঝতে হয়।
মিনিট পনের পর গ্রহের বুকে সবচে বড় ক্ষত রূপে দেখা দিল বৃত্তটা। মিইয়ে আসছে একটু একটু করে এখন ধূলিধূসর। হাজার কিলোমিটার এর ব্যাস। নিচের বিশাল বিশাল পর্বতমালা পেরিয়ে যাবার সময় আকৃতি বদলে যাচ্ছে, নিখুঁত বৃত্তে তৈরি হচ্ছে খুত।
শিপের এ্যাড্রেস সিস্টেম দিয়ে ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলারের কষ্ঠ খসখসে শোনায়।
‘আপনাদের আফ্রোদিতি বেসের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছি। কপাল ভাল বলতে হয়, তারা সাহায্যের জন্য হাত পা ছুঁড়ছে না’
‘-একটু কাঁপিয়ে দিয়েছিল আমাদের, কিন্তু যতটা আশা করেছিলাম ততটুকুই। মনিটর দেখাচ্ছে এর মধ্যেই নকোমিস পর্বতমালার উপর বৃষ্টি হয়ে গেছে এক পশলা; শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে জলদি, কিন্তু এ হল রু। হেক্যাট ক্যাজমে ঝটিকা বন্যা হয়েছিল বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়, চেক করে দেখছি। শেষ ডেলিভারির পর সেখানে ফুটন্ত পানির একটা হ্রদ তৈরি হয়েছিল—’
আমি তাদের হিংসা করি না মোটেও, নিজেকে বলল পোল, কিন্তু অবশ্যই প্রশংসা করি। এই অতি আরামদায়ক, সুবিধার জগতে এখনো যে এ্যাডভেঞ্চারের অবকাশ আছে তা প্রমাণ করে ছাড়ছে তারা।
‘–আর জায়গামত এই ছোট্ট তালটাকে নামিয়ে আনার জন্য ধন্যবাদ। কপাল ভাল থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই আমরা কয়েকটা স্থায়ী সাগর পেয়ে যাব। এরপর কোরাল রিফ বসানোর পালা। লাইম বানাব, বাড়তি কার্বন ডাই অক্সাইড সরিয়ে নিব পরিবেশ থেকে… আহা, ততদিন যদি বাঁচতে পারি।’
আশা করি বেঁচে থাকবেন ততদিন, প্রশংসার সুরে মনে মনে বলে পোল। পৃথিবীর ট্রপিক্যাল সমুদ্রগুলোয় ঝাপাঝাপি করেছে সে, এত বিচিত্র সব প্রাণি দেখেছে, সৃষ্টির এত রূপ দেখতে পেয়েছে চোখে যে মাঝে মাঝে মনে প্র আর সব সূর্যের অযুত নিযুত গ্রহে এমন প্রাণির দেখা মিলবে তো।
সময় মতো প্যাকেজ ডেলিভার করা হয়েছে। পেয়েছি প্রাপ্তিস্বীকারোক্তি। প্রশান্ত সুর ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলারের কণ্ঠে, বিদায়, শুক্র… এইতো, আসছি, গ্যানিমিড।
.
মিস প্রিঙ্গল
ফাইল-ওয়ালেস
হ্যালো, ইন্দ্রা। হ্যাঁ, তোমার কথাটা ঠিক। তোমার সাথে তর্কাতর্কিটাকে সামান্য মিস করছি। চ্যান্ডলারের সাথে সম্পর্ক ভালই, আর শুনে অবাক হবে, ক্রুরা আমাকে অবতারের মতো শ্রদ্ধা করে। আমাকে মেনে নেয়া শুরু করেছে আস্তে আস্তে, শুরু করেছে আমার লেগ পুল করা (এ ইডিয়মটা জান নাকি?)।
সত্যিকার সরাসরি কথা বলতে না পারাটা বেশ বিরক্তিকর মঙ্গলের অটি পেরিয়ে এসেছি আমরা। এর মধ্যেই রেডিও ট্রিপ ঘন্টার উপরে চলে যাবে। কিন্তু এখানে একটা বিশেষ সুবিধা পাচ্ছি, তুমি আমাকে বিরক্ত করতে পারবে না…
বৃহস্পতিতে যেতে মাত্র সপ্তাখানেক লাগলেও মনে হয় আমার হাতে রিল্যাক্স করার মতো সময় থাকবে। আবার স্কুলে ফিরে যাবার ইচ্ছা ঠেকাই কী করে বল। সুতরাং নেমে পড় কাজে। আমি গোলিয়াথের মিনি শাটলে চড়া শুরু করেছি। শুরু করেছি শিখে নেয়া। কে জানে দিম আমাকে একা কিছু করতে দিবে কিনা… ।
এটা ডিসকভারির পোডগুলো থেকে খুব একটা বড় নয় কিন্তু কী পার্থক্য। প্রথমেই বলতে হয়, এর কোনো রকেট নেই, অসীম দূরত্ব আর ভিতরের আরাম আয়েশের সাথে এখনো মানিয়ে নিতে পারিনি। চাইলেই এটা দিয়ে একেবারে পৃথিবীর বুকে ফিরে আসতে পারি কিন্তু লোকে আমাকে বদ্ধ পাগল বলবে। বন্ধ পাগল এর মানে বোঝ তোর
সবচে বড় পার্থক্য কন্ট্রোল সিস্টেমে। হ্যান্ডসফ্রি কন্ট্রোল শিখতে কষ্ট হয়। আর আমার ভয়েজ রিকগনিশন শিখতে হচ্ছে কম্পিউটারটাকে। প্রথমে প্রতি পাঁচ মিনিটে একবার করে প্রশ্ন তুলল, ডু ইউ রিয়েলি মিন দ্যাট? ব্রেইনক্যাপ ব্যবহার করলেই বোধহয় ভাল হয়। আমি মানিয়ে নিতে পারিনি মোটেও। জানি না মনকে পুরোপুরি পড়ে ফেলছে এমন কোনো যন্ত্রের সাথে মানিয়ে নিতে পারব কিনা কোনদিন…
বাই দ্য ওয়ে, শাটলটাকে ফ্যালকন নামে ডাকে ওরা। অবাক ব্যাপার, নামটার সাথে যে এ্যাপোলো মিশনের সংযুক্তি আছে সেটা জানে না কেউ, আমরা যখন প্রথম বারের মতো চাঁদে যাই…
উঁ… হ্যাঁ, আরো অনেক কথা বলার ছিল, কিন্তু স্কিপার ডাকছে। আবার ক্লাসরুমে ফিরে যাও! লাভ এ্যান্ড আউট।
স্টোর
ট্রান্সমিট
হ্যালো ফ্র্যাঙ্ক- ইন্দ্রা কলিং- যদি শব্দটা বেমানান না হয়। আমার নতুন থটরাইটার দিয়ে কল করছি- পুরনোটার নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছে, হা হা হা হাজারটা ভুল করে বসে পাঠানোর আগে যে একটু এডিট করে নিব সে উপায় নেই। আশা করি বুঝতে পারছ ব্যাপারটা।
কমসেট। চ্যানেল ওয়ান, ও থ্রি- সাড়ে বারোটা থেকে রেকর্ড কর কারেকশন- সাড়ে তেটা। স্যরি…।
পুরনো ইউনিটটা সারিয়ে নিতে পারব আশা করি- সেটায় আমার সব শর্টকাট আর এ্যাব্রিভ ছিল- সম্ভবত তোমাদের আমলের মতো করে সাইকো এ্যানালাইজ করতে হবে। জানি না কী করে ফ্রাউডিয়… মানে ফ্রয়েডিয় পদ্ধতিটা কাজ করে। কখনো বুঝতে পারিনি।
গন্ডগোল হচ্ছে থটরাইটারে- স্যরি এ্যাগেইন… আসল পয়েন্টে থাকা কঠিন
এক্স জেড ১২ এল ডব্লিউ ৮৮৮ ৮***** জে এস ৯৮১২ ওয়াই ই বি ডি সি ড্যাম… স্টপ… ব্যাকআপ
তখন কি কোনো ভুল করে ফেলেছিলাম? আবার ট্রাই করছি।
তুমি দানিলের কথা তুলেছিলে… আমরা কোনো গুরুত্ব দেইনি। কারণ আছে। একবার ননপার্সন বলেছিলে না? একেবারে খাঁটি কথা!
আজকের দিনে কী ধরনের অপরাধ হয় জিজ্ঞেস করেছিলে একবার- সাইকিক ব্যাপার স্যাপার। তোমাদের আমলে সাইকো এ্যানালিস্ট টিভি প্রোগ্রামগুলো মাঝে মাঝে গিলার চেষ্টা করে উগলে দিতে হয়েছিল। কয়েক মিনিটের বেশি হজম করতে পারিনি… ডিজগাস্টিং
দরজা- একনলেজ!- ও, হ্যালো মেলিন্ডা- মাফ করো- বস- এইতো, শেষ পর্যায়ে…
কী যেন বলছিলাম? ক্রাইম। কিছু না কিছু তো আছেই সব সমাজে। কমিয়ে এনেছি হারটা, এই আর কী!
তোমাদের সমাধান ছিল- কারাদন্ড। রাষ্ট্রের অর্ধে প্রিভেনশন ফ্যাক্টরি- একজন ইনমেটকে ধরে রাখতে দশটা পরিবারের গড় আয়ের চেয়ে বেশি খরচ হয়ে যায়। একেবারে পাগলাটে, কী বল… কেউ কেউ আরো বেশি জেলখানার জন্য চিৎকার করে সব সময় তাদেরই বরং মনোবিশ্লেষণ করা দরকার। আচ্ছা, ভোলা মনে কথা বলা যাক- ইলেক্ট্রনিক মনিটরিং এ্যান্ড কন্ট্রোল সবার নজরে আসার আগ পর্যন্ত কোনো বিকল্প ছিল না- লোকজন সোৎসাহে জেলখানার দেয়াল ভাঙছে দেখলে তোমারও ভাল লাগত।
হ্যাঁ- দানিল। জানি না তার ক্রাইমটা কী ছিল- জানলেও তোমাকে জানাতাম না– কিন্তু সাইক প্রোফাইল দেখে জানা গেল সে কী বলে শব্দটাকে?- ভাল গৃহপরিচারক হতে পারবে। মানুষকে কোনো না কোনো কাজে লাগানো সহজ কথা নয়। অপরাধের মাত্রা শূন্যে নেমে এলে কেমন হবে কে জানে! যাই হোক, আশা করি সে দ্রুত ডিকন্ট্রোন্ড হয়ে সমাজে ফিরে যাবে।
স্যরি মেলিন্ডা- এইতো শেষ হয়ে যাচ্ছে।
এই সব, ফ্র্যাঙ্ক দিমিত্রির জন্য শুভকামনা- তোমরা নিশ্চয়ই গ্যানিমিডের পথে অর্ধেকটা চলে গেছ কে জানে কখনো তোমরা সময় পেরিয়ে আইনস্টাইনের নিয়ম ভেঙে কথা বলতে পারবে কিনা সরাসরি।
আশা করি মেশিনগুলো আমার সাথে মানিয়ে নিবে দ্রুত- নাহলে বিংশ শতাব্দির আসল এ্যান্টিক ওয়ার্ড প্রসেসরের শরণাপন্ন হতে হবে।
লাভ এ্যান্ড গুডবাই।
.
হ্যালো ফ্র্যাঙ্ক- আবার আমি। শেষটার জবাবের আশায় আছি। অন্তত প্রাপ্তিস্বীকার হলেও চলে…
ভাবতে অবাক লাগে, তুমি গ্যানিমিডে যাচ্ছ, সেখানে আমার পুরনো বন্ধু টেড় খানের সাথে দেখা হবে তোমার। কিন্তু এতে বিচিত্র কিছু নেই, তুমি যে রহস্যের টানে যাচ্ছ সেও একই কারণে গিয়েছিল…
প্রথমেই তার ব্যাপারে কিছু বলে নেয়া ভাল। বাবা মা বিশ্রি একটা ট্রিক্স খাঁটিয়েছিল। নাম দিয়েছিল থিওডোর। কখনো ভুলেও ঐ নামে ডেকো না। কী বলছি বুঝতে পারছ তো?
হয়ত এ নামই তাকে ঐ পথে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। এর আগে ধর্মে আগ্রহী এমন পাগলাটে মানুষ আর দেখিনি। আগেই সাবধান করে দিচ্ছি, সে কিন্তু একটু বোরিং হয়ে যেতে পারে।
বাই দ্য ওয়ে, এখন কেমন হচ্ছে? মনে হয় নতুন থটরাইটারটা কাজে লাগছে ভালই। এখন পর্যন্ত কোনো ভুল করেনি, তাই না?
আমি টেডকে কী নামে ডাকি জান? ‘শেষ জেসাইট।‘ তোমাদের সময়ে এ শ্রেণীর অনেক মানুষ ছিল।
অবাক ব্যাপার, সাজাতিক সাতিক সব লোক চমৎকার সব আবিষ্কারের জনক দারুণ স্কলাররা মাঝে মাঝে কী করে যে-কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে বুঝি না…
এইউইডিএন২কেজেএন প্রিয় ২১ ইআইডিজে ডিডব্লিউপিপি।
ড্যাম নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। এক, দুই, তিন, চার… মানুষ কল্যাণের পথে আসছে, এইতো, ঠিক হয়ে যাবে।
যাই হোক, টেডের মনেও তেমনি উঁচু ইচ্ছা। তার সাথে ভুলেও তর্কে নেমো না– স্টিমরোলারের মতো পিষে ফেলবে তাহলে… দৈহিকভাবে নয়, মানসিকভাবে।
বাই দ্য ওয়ে, স্টিমরোলার জিনিসটা কী? জামাকাপড়ে চাপ দেয়ার যন্ত্র ট?
থটরাইটার তোমার সমস্ত চিন্তা লিখে নিবে, ব্যাপারটা একটু বিদঘুঁটে, সন্দেহ নেই। নিজেকে সামলানোর পদ্ধতিটা শিখে নিতে হয় এক্ষেত্রে… এর আগেও কথাটা বলেছিলাম…
টেড খান… টেড খান… টেড খান।
সে এখনো পৃথিবীতে জনপ্রিয়। তার দুইটা কথাতো বিখ্যাত বলা চলে, সভ্যতা থেকে ধর্মকে আলাদা করা অসম্ভব। আর বিশ্বাস হল এমন কিছুকে মেনে নেয়া যা তুমি সত্যি বলে মনে কর না। আমার মনে হয় না শেষের কথাটা তার নিজের। কারণ কখনো ঠাট্টা তামাশার এতটা কাছে যায় না সে। হাজার চেষ্টা করেও মুখে একটা হাসির রেখা তুলে আনতে পারিনি আমি…
ডিন তার ফ্যাকাল্টিতে অভিযোগ তুলছে, আপনারা সায়েন্টিস্টরা এত বেশি দামের ইকুইপমেন্ট চান কেন? কেন আপনারা ম্যাথ ডিপার্টমেন্টের মতো হতে পারেন না, যাদের প্রয়োজন শুধু একটা ব্ল্যাকবোর্ড আর ওয়েস্টপেপার বাস্কেট যাক, দর্শন বিভাগটা এখনো আমার ভাল্লাগে। তাদের একটা নষ্ট কাগজের বাক্সেরও প্রয়োজন নেই…’ আশা করি টেড কথাটা শুনেছিল। বেশিরভাগ দার্শনিকেরই জানা থাকার কথা….
যাই হোক, তাকে আমার শুভেচ্ছা জানিও, আর, ভালভাবে বলে রাখছি, নো যুক্তিতর্ক।
আফ্রিকা টাওয়ার থেকে ভালবাসা আর শুভকামনা।
ট্রান্সক্রাইব। স্টোর।
ট্রান্সমিট পোল।
১৬. কাপ্তানের টেবিল
গোলিয়াথের ছোট্ট পৃথিবীতে এমন দামি এক লোকের আবির্ভাবে প্রথম দিকে খুব আলোড়ন হলেও আস্তে আস্তে ক্রুরা ভাল রসবোধের সাথে মানিয়ে নিয়েছে। প্রতিদিন ১৮.০০ টায় সব পার্সোনেল একত্র হয় ডিনারের জন্য, ওয়ার্ডরুমে। ঘরটা বেশ বড়, জিরো জি-তে কম করে হলেও ঘরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ত্রিশজনকে ধরে রাখতে পারবে। কিন্তু এখানে বেশিরভাগ সময়েই চাঁদের অভিকর্ষ থাকে, তাই সবাই হেসেখেলে থাকতে পারে। আটজনের বেশি হলে একটু ঝামেলা হবে।
অর্ধবৃত্তাকার টেবিল বেরিয়ে এসেছে অটোশেফ থেকে। সেখানে সাতজন বসে পড়তে পারে সহজে। সমস্যা অন্য কোথাও, এখানে সাতজন ক্রু থাকার কথা। আছে আরো একজন। তাই একজনকে অন্য কোথাও খেতে হয়। এখানে বিচিত্র নাম আছে জিনিসপত্রের। অভ্যস্ত হতে সমস্যা হয়। ‘বোল্টস’ মানে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ‘চিপস’ মানে কম্পিউটার্স এ্যান্ড কম্যুনিকেশনস, ফাস্ট মানে ফার্স্ট মেট, ‘লাইফ’- লাইফ সাপোর্ট এ্যান্ড মেডিক্যাল সিস্টেম, ‘প্রপ’- প্রপালশন আর পাওয়ার, ‘স্টার’ মানে অর্বিট ও নেভিগেশন।
অভিযানের দশদিন কেটে গেছে। এ কদিনে প্রচলিত জোকগুলো বুঝতে শিখছে, চিনছে প্রচলিত গালগল্পের ধারা, পৃথিবীর বুকে থাকতে বর্তমান সৌরজগত সম্পর্কে যতটা জেনেছিল তার তুলনায় জেনেছে অনেক বেশি। নিশ্চুপ আর আগ্রহী শ্রোতা পেয়ে তারা খুশি হলেও পোল তাদের রঙ চড়ানো কাহিনীগুলোর সারসংক্ষেপ ঠিকই। বুঝতে পারে।
চতুর্বিংশ শতাব্দির আলোড়ন তোলা গোল্ডেন এ্যাস্টেরয়েডের গুজব এখন আর নেই। কিন্তু গত পাঁচশ বছরে অন্তত জনা বারো নির্ভযোগ্য লোকের কাছ থেকে যে মাকুরিয়ান প্লাজমোয়িডের কথা এসেছে তার কী হবে?
সব চেয়ে ভাল ব্যাখ্যা হল, সেগুলো বল লাইটনিঙের সাথে সম্পর্কযুক্ত। পৃথিবী আর মঙ্গলের বুকে ইউ এফ ও’র রিপোর্ট এসেছে এদের কারণেই। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করে সেসবে উদ্দেশ্যবহুলতা দেখা যায়। বোকামি, বলত স্কেপটিকরা সামান্য ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক এ্যাট্রাকশন।
সব সময় এসব নিয়ে শক্ত মনোভাব আছে পোলর। এলিয়েনরা আছে আমাদের মাঝেই পাগলামি চূড়ান্তে পৌঁছেছিল তার বাল্যকালে। পরে ২০২০ সাল পর্যন্ত মহাকাশ বিষয় পাগলাটে লোকদের মুখোমুখি হয়। অনেকে দাবি তোলে তারা এলিয়েনদের দেখেছে বা ভিনগ্রহের প্রাণির মুখোমুখি হয়েছে, করেছে যোগাযোগ। কেউ কেউ বিশ্বাস করত। পরে চিকিৎসা সাহিত্যে এ ধরনের মনোভাবের নাম দেয়া হয় ‘এ্যাডামস্কি রোগ।
টি এম এ-এক এর আবিষ্কার এর মুখে কুলুপ এঁটে দিল। মানুষ বিশ্বাস করল, বুদ্ধিমত্তা আছে মহাকাশে, কিন্তু তারা মিলিয়ন বছরের মধ্যে আমাদের ধারেকাছে আসেনি। একই সাথে কুলুপ এঁটে দিল সেসব বিজ্ঞানির মুখে যারা ফণা তুলে বলত ব্যাকটেরিয়ার কাছাকাছি প্রাণ ছাড়া আর কিছু এ গ্যালাক্সিতে পাওয়া সম্ভব নয়, হয়ত পুরো কসমসেও পাওয়া যাবে না।
পোলের আমলের রাজনীতি আর অর্থনীতির ঘোড়াই পরোয়া করে গোলিয়াথের জুরা। তাদের সমস্ত আগ্রহ সে সময়কার টেকনোলজির ব্যাপারে। তার জীবদ্দশায় বিজ্ঞানে যে অকল্পনীয় পরিবর্তন চলে এল হঠাৎ করে, সেসব নিয়ে খুব আগ্রহী। হারিয়ে গেল ফসিল ফুয়েলের যুগ। তেল যুগের মানব সভ্যতা কী করে হাজার হাজার প্রজাতিকে বিলুপ্ত করে, কী করে পরিবেশকে নরকে পরিণত করে তা এখনো তাদের কাছে ঠিক বিশ্বাস্য নয়।
‘আমাকে দোষ দিওনা,’ উত্তপ্ত মনোভাব দেখে আৎকে ওঠে পোল, যাই হোক, বরং দেখ একবিংশ শতাব্দি কী ভয়ানক গন্ডগোল পাকিয়েছিল।’
সাথে সাথে টেবিলের চারপাশ থেকে শোর উঠল, মানে?
‘আসলে, তথাকথিত অসীম ক্ষমতার যুগ যখন থেকে শুরু হয়, প্রত্যেকের হাতে হাতে চলে আসে হাজার হাজার কিলোওয়াটের চিপ, নিখাদ এনার্জি নিয়ে খেলার মাতলামি ভর করে, তখন থেকে কী শুরু হয় বুঝতেই পারছ।
‘ও, তুমি থার্মাল ক্রাইসিসের কথা তুলছ তো? সেটা ঠিক করা হয় তার পরই।
ফলে- তোমরা পৃথিবীর অর্ধেকটা ঢেকে দিলে রিফ্লেক্টর দিয়ে। সূর্যের আলো ফেরৎ পাঠালে স্পেসে। নাহলে এতদিনে পৃথিবীটা শুক্রের মতো হয়ে যেত। ফুটন্ত।
ত্রয়োবিংশ শতাব্দির ব্যাপারে কুদের জ্ঞান এত কম যে গোলিয়াথের বুকে বসে বসে নিজের সময়ের কয়েক শতাব্দি পরের ঘটনা জানিয়ে তাক লাগিয়ে দিল পোল, প্রকাশ করতে থাকল স্টার সিটি থেকে অর্জিত জ্ঞান। ডিসকভারির কাহিনী চিরায়ত স্পেস এজের এক বিস্ময়। তারা এ ঘটনা এমন মন দিয়ে দেখে যেমন মন দিয়ে সে ভাইকিংদের কাহিনী পড়ত।
‘তোমাদের ছিয়াশিতম দিনে, বলল স্টারস, এক বিকালে, তোমরা গ্রহাণু ৭৭৯৪ এর দু হাজার কিলোমিটারের মধ্যে চলে এসেছিলে। ছুঁড়ে দিয়েছিলে একটা পোব। মনে আছে নাকি?
‘অবশ্যই।’ একটু অপ্রস্তুতভাবে বলল পোল, ‘আমার কাছে ঘটনাটা এক বছর আগেরও নয়।
‘উমস্যরি। কালকে আমরা ১৩,৪৪৫ এর আরো কাছে চলে যাব। দেখতে চাও নাকি? অটোগাইডেন্স আর ফ্রিজ ফ্রেমের সাহায্যে দশ মিলিসেকেন্ড চওড়া একটা ফ্রেম পাব।
এক সেকেন্ডের শতভাগের একভাগ। ডিসকভারির ঐ কয়েক মিনিটই অনেক মূল্যবান মনে হয়েছিল আর এখন সব ঘটনা ঘটবে পঞ্চাশগুণ দ্রুত…
কতবড় জিনিসটা?’ প্রশ্ন তুলল পোল।
“ত্রিশ বাই বিশ বাই পনের মিটার,’ জবাব দিল স্টারস, ‘অমসৃণ ইটের মতো দেখাবে।
“স্যরি, এটার দিকে ছুঁড়ে দেয়ার মতো কোনো শামুক নেই আমাদের হাতে, বলল প্রপস, কখনো ভেবেছ ৭৭৯৪ তোমাদের দিকেও কিছু ছুঁড়ে দিতে পারত, সেকথা?
আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু এ্যাস্ট্রোনোমারদের অনেক তথ্য দিয়েছিল। এটুকু ঝুঁকি নিয়ে লাভ হয়েছে দেদার… যাই হোক, এক সেকেন্ডের
একশ ভাগের একভাগ সময়ে কী আর দেখতে পাব, থ্যাঙ্কস।
বুঝতে পারছি। একটাকে যখন দেখেই ফেলেছ, বাকিদের দেখার বাকি নেই তেমন
কথা সত্যি নয়, চিপস। আমি যখন ইরোসে ছিলাম—
‘অন্তত বারোবার বলেছ কথাটা—’
হাজার বছর আগে চলে গেছে পোলের মন। ডিসকভারির শেষ দূর্ঘটনার আগে, শেষ উত্তেজনার কথা মনে পড়ে যায়। যদিও সে আর ডেভ বোম্যান ভালভাবেই জানত যে ৭৭৯৪ একেবারে বিদঘুঁটে প্রাণহীন একটা জিনিস, তবু অনুভূতিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। বৃহস্পতির এলাকায় এতদিনে শুধু এ জিনিসটার সাথেই তার যোগাযোগ হবার সম্ভাবনা ছিল। যেন কোনো অকুল পাথারে চলতে থাকা নাবিকের দল পাথুরে কোনো দ্বীপের দেখা পেয়েছে যেখানে তাদের নামার কোনো সম্ভাবনা নেই। না থাক সম্ভাবনা। মাটির দেখাতে পাওয়া যাচ্ছে।
পাশ থেকে পাশে ঘুরছিল জিনিসটা। সূর্যের ক্ষীণ আলো পড়ছিল গায়ে…।
টার্গেটে আঘাত করে কিনা ভোব তাও একটা উত্তেজনার বিষয়। দু হাজার কিলোমিটার দুরে ঘুরতে থাকা, সেকেন্ডে বিশ কিলোমিটার আপেক্ষিক গতিতে চলতে থাকা তে আঘাত দেয়াও মুখের কথা নয়।
এরপর অন্ধকারাচ্ছন্ন পিঠে হঠাৎ আলোর ঝলক দেখা দেয়। খাঁটি ইউরেনিয়াম ২৩৮ এর সবটুকু তীরবেগে আঘাত হানে গ্রহাণুর গায়ে। সবটুকু পরিণত হয় তাপশক্তিতে। গ্যাসের সামান্য অংশ স্পেসে ছড়িয়ে পড়ে। দ্রুত মিলিয়ে যেতে থাকা বর্ণালির রেখাগুলো ধরে রাখে ডিসকভারির ক্যামেরাগুলো। পৃথিবীর বুকে বসে থেকে মাত্র কয়েক ঘন্টা পরই এ্যাস্ট্রোনোমাররা জানতে পারে গ্রহাণুর গঠন সম্পর্কে। প্রথমবারের মতো খুব বেশি চমক ছিল না, কি কয়েক বোতল শ্যাম্পেন হাতবদল হয়।
খাবার সময় সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার। শুধু একটাই অঘোষিত নিয়ম চালু আছে। খাবার টেবিলে কোনো সিরিয়াস কাজের কথা নয়। কোনো টেকনিক্যাল বা অপারেশনাল সমস্যা থাকলে সেগুলোর সুরাহা করতে হবে অন্য কোথাও। এখানে নয়।
একটা ব্যাপার বেশ ব্যথিত করে পোলকে। গোলিয়াথের নাড়ি নক্ষত্রের ব্যাপারে কুরা খুব বেশি কিছু জানে না। তার সময়ে পুরো স্পেসশিপ সম্পর্কে যেটুকু জ্ঞান রাখত তারা, তার কানাকড়িও রাখা সম্ভব নয়। সবাই রেফার করে লাইব্রেরির কাছে। প্রতিটা সিস্টেম অসম্ভব জটিল আকার ধারণ করেছে আজকের দিনে।
মাস্টাররা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রের যন্ত্রগুলোর কাজ জানে, কাজটা কী করে হয় তা জানে না। সব চেক করতে হয় অটোম্যাটিক, মানুষের হাত পড়লে ভাল হবে না।
সাধারণ এক যাত্রায় পরিণত হয়েছে এখন সৌরজগতের একপাশ থেকে আরেক পাশে যাবার ব্যাপারটা। ড্রাইভার যেমন শুধু তার গাড়ির কাজের ধরন জানে, ধারা জানে না, সেভাবেই চলে এখানকার মানুষেরা।
বিশেষ কোনো ঘটনা ছাড়াই লুসিফার আস্তে আস্তে তার প্রতাপ নিয়ে দেখা দিল আকাশে।
গ. গ্যালিলিওর ভুবনগুলো
(এক্সট্রাক্ট, শুধু টেক্সট, বহিঃসৌরজগতে ভ্রমণকারীদের গাইড, ভলিউম, ২১৯.৩)
এমনকি আজকের দিনেও, এককালে যেটা বৃহস্পতি ছিল সেটার উপগ্রহগুলো মানুষের কাছে এক মহাবিস্ময়ের ব্যাপার। কেন কাছাকাছি আকৃতি ও একই রকম দূরত্বের হয়েও চার উপগ্রহে এত পার্থক্য?
শুধু সবচে ভিতরের উপগ্রহ আইওর ব্যাপারে একটা ব্যাখ্যা দেয়া চলে। বৃহস্পতির এত কাছে এটা যে ভিতরটা একেবারে গলিত। এমনকি উপরিভাগও আধা কঠিন। সব সময় দানব গ্রহের টানে ভীষণ জোয়ার হয় এখানে। এত বেশি অগ্নি উদগিরক, আগ্নেয়গিরিতে রা ভুবন সৌরজগতে আর নেই। আইওর মানচিত্রগুলোর অর্থ জীবন মাত্র কয়েক দশকের। ক্রমাগত পরিবর্তনশীল।
এমন ক্রমপরিবর্তনশীল পরিবেশে কখনো স্থায়ী মানবঘাটি বসানো যায়নি। কিন্তু ল্যান্ডিং হয়েছে অনেকবার। সব সময় মানুষের রোবট মনিটর কাজ করছে সেখানে।
.
(২৫৭১ সালের অভিযানের করুণ পরিণতি জানতে বিগল ৫ দেখুন।)
ইউরোপা বৃহস্পতি থেকে দূরত্বের দিক দিয়ে দ্বিতীয় উপগ্রহ। প্রথমে, আসলে এটা ছিল বরফে মোড়ানো এক ভুবন। কিছু বিশাল বিশাল ফাটলের গোলকধাঁধা ছাড়া আর কোনো বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য ছিল না। আইওর উপর যেভাবে জোয়ার প্রভাব ফেলে ততটা প্রভাব নেই এখানে। আছে তাপ। গলে গেছে সব বরফ, পুরো ইউরোপা জুড়ে এখন সাগর। এখানে বিচিত্র সব প্রাণের উদ্ভব হয়েছে। (দেখুন স্পেসক্রাফট জিয়াং, গ্যালাক্সি, ইউনিভার্স।) বৃহস্পতি ছোষ্ট্র সূর্যে পরিণত হবার পর পুরো ইউরোপা সাগরে পরিণত হলেও অগ্নি উদগিরণে জন্ম নিয়েছে কিছু কিছু দ্বীপ।
সবার জানা একটা তথ্য হল, ইউরোপায় হাজার বছরে কোনো ল্যান্ডিং হয়নি। সর্বক্ষণ নজরদারি চলছে এখানে।
সৌরজগতে গ্যানিমিড সবচে বড় চাঁদ (ব্যাস ৫২৬০ কিলোমিটার)। এখানেও নতুন সূর্যের প্রভাব পড়ে। এর বিষুবিয় অঞ্চলের তাপমাত্রা জীবনের অনুকুল, যদিও আবহাওয়ামন্ডল এখনো শাসপ্রশ্বাসের জন্য ভাল নয়। এখানকার বেশিরভাগ অধিবাসীই বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানকর্মী। সবচে বড় সেটলমেন্ট আনুবিস সিটি (জনসংখ্যা ৪১,০০০) অবস্থিত দক্ষিণ মেরুর কাছে।
ক্যালিস্টোও ভিন্ন প্রকৃতির। এর পুরো উপরিভাগ নানা আকার ও প্রকারের জ্বালামুখ, উল্কার আঘাতে সৃষ্ট ক্ষতে ভর্তি। ক্যালিস্টোর বুকে কোনো স্থায়ী ঘাঁটি না থাকলেও আছে কয়েকটা স্টেশন।
১৭. সেই গ্যানিমিড
বেশি ঘুমানোর অভ্যাস নেই ফ্র্যাঙ্ক পোলর, কিন্তু বিচিত্র সব স্বপ্ন এটুকু সময়েই ধরা দেয়। অতীত-বর্তমান তার স্বপ্নে একাকার হয়ে গেছে। কখনো সে ডিসকভারিতে, কখনো আফ্রিকা টাওয়ারে আবার কখনো ছেলেবেলার পোল ফিরে আসে, খেলা করে বন্ধুদের সাথে।
কোথায় আমি? সাতারুর মতো ঘুম থেকে জেগে উঠে প্রশ্ন করে সে নিজেকেই। বিছানার ঠিক উপরেই একটা গোলাকার জানালা। আলো আসছে পর্দার ফাঁক দিয়েও। বিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়টায় এক ধরনের বিমান ছিল যেগুলোয় আরাম আয়েশের ব্যবস্থা অনেক বেশি থাকত। মানুষ এভাবে ঘুমাতে পারত। সহজে মনে হতে পারে, সে এমনি কোনো যাত্রাপথে আছে।
আসলে তা নয়, বাইরে তাকালেই দেখা যায়। নিচের দৃশ্যটা আটলান্টিকের মতো হলেও দক্ষিণ মেরুতে দুইটা সূর্য একই সাথে উদিত। এমন দৃশ্য পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুতে দেখা যাবে না।
শিপটা ভেসে আছে এমন চষা এক ভূমির উপর। যেন কোনো মাতাল চাষি চষতে গিয়ে সব ভন্ডুল করে দিয়েছে। এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে বরফ। সেই সাথে গোল গোল চিহ্ন। উল্কাপাতের নিদর্শন।
দরজায় কে যেন নক করল, ‘আমি এলে কিছু মনে করবে নাতো?’
জবাবের অপেক্ষা না করেই ঢুকল ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার।
‘নামা শেষ করে তোমার ঘুম ভাঙানোর ইচ্ছা ছিল, পারলাম না সময়মত নামতে। একটু বেশি লেগে যাচ্ছে। কিন্তু বিদ্রোহ করে পথটাকে সংক্ষিপ্ত করে এনেছি।’
হাসল পোল।
‘স্পেসে কখনো বিদ্রোহ হয়েছিল নাকি?’
‘হয়েছে তো অবশ্যই, মাত্র কয়েকটা। আগে। আমাদের আমলে নয়। তুমি মানবে, এ রীতি শুরু করেছিল হাল… স্যরি, আমার মনে হয় বলা উচিৎ হয়নি। ঐ দেখ, গ্যানিমিড সিটি।’
নিচে তাকায় সে। পথঘাট বোঝা যায়। জ্যামিতিক আকারের। সেই সাথে আছে একটা খাল। পোল ভুলেই গিয়েছিল যে গ্যানিমিডের বিষুবিয় অঞ্চলে এখন তরল পানি থাকতে পারে। মনে পড়ে গেল লন্ডনে কাঠ কাটা দেখার একটা স্মৃতির কথা।
একটু মজা পাবার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে চ্যান্ডলার। মহানগরীর আকৃতির কথা মনে পড়ল সাথে সাথে।
‘গ্যানিমিডিয়রা,’ বলল সে শুকনো কণ্ঠে, নিশ্চই আকার আকৃতিতে বিশাল। পাঁচ থেকে দশ কিলোমিটার চওড়া রাস্তা বানানো মুখের কথা নয়।
‘কোথাও কোথাও বিশ। ইমপ্রেসিভ, তাই না? মাতা প্রতি অনেক বিচিত্র সব ব্যাপার ঘটায়। আমি তোমাকে আরো কৃত্রিম দেখায় এমন দৃশ্য দেখাতে পারব, আকারে একটু ছোট হবে, এই যা।
‘আমি বাচ্চা থাকার সময় মঙ্গলের বুকে খোদাই করা মুখ দেখা গেছে এমন কথা উঠেছিল। আসলে ক্ষয়ে যাওয়া পাহাড়। পৃথিবীতেও কিন্তু এমন নিদর্শন পাওয়া যায়।’
‘কেউ কি একবার বলেনি যে ইতিহাস নিজের পুনরাবৃত্তি করে গ্যানিমিড সিটির সাথেও কোনো ধরনের বিচিত্র ব্যাপার ঘটেছিল। কোনো কোনো অর্বাচীন দাবি করে এর নির্মাতা ছিল এলিয়েনরা। আমার ভয়, এটা বেশিদিন টিকবে না।
‘কেন?
‘গলে যাচ্ছে। এর পার্মাস্ট গলিয়ে দিচ্ছে লুসিফার। আর একশ বছর পর গ্যানিমিডকে তুমি চিনতেই পারবে না… ঐতো, ঐটা লেক গ্যানিমিডের প্রান্ত ভালভাবে তাকাও- ডানে
বুঝতে পারছি। হচ্ছেটা কী? পানি নিশ্চয়ই এ নিম্নচাপে ফুটছে না?
ইলেক্ট্রোলাইসিস প্ল্যান্ট। জানি না কত স্কিলিয়ন কেজি অক্সিজেন উৎপন্ন হয় প্রতিদিন। অবশ্যই, আশা করি হাইড্রোজেন উপরে উঠে হারিয়ে যাবে।’
হঠাৎ কণ্ঠটা বদলে যায়, নিচে যত পানি আছে তার অর্ধেকও দরকার নেই গ্যানিমিডের। কাউকে বলোনা, মাঝে মাঝে মনে হয় শুক্রের জন্য কিছুটা নিয়ে গেলে হত।
‘ধূমকেতুর গলায় ফাঁস লাগানোর চেয়ে সহজ?
যতক্ষণ এ্যানার্জির প্রশ্ন ওঠে, ততক্ষণ ঠিক। গ্যানিমিড ছেড়ে যেতে সেকেন্ডে মাত্র তিন ক্লিক প্রয়োজন। কিন্তু অন্যান্য সমস্যাও আছে…’
‘আমারও ভাল লাগছে ব্যাপারটা। তোমরা কি মাস-লঞ্চার দিয়ে শু্যট করবে?
না। আমি যদি করি, তো আবহাওয়ামন্ডল থেকে টোয়ার দিয়ে নিয়ে আসব। পথিবীর শুলোর চেয়ে ছোট হবে। পাম্প করে তুলে আনব পানি। এ্যাবসলুট জিনোর। কাছাকাছি এনে কঠিন করব। কিছুটা যে বাষ্প হয়ে যাবে তা সত্যি, কিন্তু বেশিরভাগ থেকে যাবে। হাসির কী হল?
‘স্যরি- আমি আইডিয়াটা নিয়ে হাসছি না- পারফেক্ট। কিন্তু স্মৃতি বয়ে আনলে তুমি কথাটা তুলে। আমাদের সময় গার্ডেন স্প্রিঙ্কলার ছিল। ঘুরে ঘুরে পানি ছিটাত বাগানে। তোমরাও একই কাজ করছ, শুধু বড় মাত্রায়। পুরো একটা গ্রহ নিয়ে।
আবার আরেক স্মৃতি উসকে এল। এ্যারিজোনার গরম এলাকায় গার্ডেন প্রিলার থেকে পানি বেরোনোয় ঘুরতে থাকা কুয়াশায় রিকি আর সে একে অন্যকে ধাওয়া করত।
ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলারের আবেগ আরো ভাল।
‘ব্রিজে ফিরে যেতে হচ্ছে। আনুবিস নামার পর দেখা হবে।
১৮. গ্র্যান্ড হোটেল
গ্র্যান্ড গ্যানিমিড হোটেল সৌরজগতে হোটেল গ্যানিমিড’ নামে পরিচিত হলেও আসলে ততটা গ্র্যান্ড নয়। পৃথিবীর বুকে এমন একটা হোটেল দেড় তারকা পেত। প্রতিদ্বন্দ্বী হোটেলগুলো হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে হওয়ায় ম্যানেজমেন্টে আলসেমি দেখা যায়।
খুব বেশি অভিযোগ নেই পোলের, অভিযোগ সে জানাবেও না। শুধু দানিলের অভাব বোধ করে। সে থাকলে এখন সেমি ইন্টেলিজেন্ট যন্ত্রপাতিগুলোর কাজকারবার বুঝিয়ে দিতে পারত। একটু আতঙ্কিত হয়ে উঠল সে (মানুষ) বেলবয়ের পিছনে দরজা বন্ধ হয়ে যাবার সাথে সাথে। লোকটা বিখ্যাত অতিথিকে সবকিছু বুঝিয়ে দিতে অত্যুৎসাহী। দেয়ালের সাথে কথা বলে বলে পাঁচটা মিনিট নষ্ট করার পর সে এমন এক সিস্টেমকে কল করল যেটা তার উচ্চারণ আর শব্দগুলো বুঝতে পারবে। অল ওয়ার্ল্ডস নিউজে কী তরতাজা খবর বের হবে, কিংবদন্তির মহাকাশচারী গ্যানিমিড হোটেলরুমে আটকা পড়ে মারা গেছেন।
দম আটকে আসে এখানকার একমাত্র আন্তর্জাতিক সুইটটার নাম দেখেই। এমনি হবার কথা, তবু কেমন যেন ধাক্কা লাগে। ইউনিফর্ম পরা ডেভ বোম্যানের ছবি ঝুলছে দেয়ালে। একই সময়ে একই রকমের আরেকটা ছবি তুলেছিল পোল। হাজার বছর আগে। এ সাইটটার নাম বোম্যান সুইট।
গোলিয়াথের সব তুর কোনো না কোনো প্রিয়জন আছে এখানে। বিশ দিনের বিশ্রামে সবাই যার যার জায়গায় চলে গেছে। এখানে আফ্রিকা টাওয়ার যেন দুরের কোনো স্বপ্ন।
আর সব আমেরিকানের মতো পোলের মনেও একটা ইচ্ছা দানা বাঁধে, এমন কোনো হোত সমাজে যদি থাকা যেত যেখানে সবাই সবাইকে চিনতে পারবে সহজেই, সবার সাথে সবার সম্পর্ক থাকবে বাস্তবে, সাইবারস্পেসে নয়। আনুবিস সে হিসাবে মন্দ নয়।
তিনটা প্রেশার ডোম আছে। প্রতিটা দু কিলোমিটার এলাকাজোড়া। ডোমগুলো একটা বিশাল বরফের চাইয়ের উপর বসানো। বরফ হারিয়ে গেছে দিগন্তে। গ্যানিমিডের স্থানীয় সূর্য কখনো পর্যাপ্ত তাপ দিতে পারবে না। পোলার ক্যাপ গলবে না কস্মিনকালেও। এমন অস্বস্তিকর পরিবেশে আনুবিসকে স্থাপন করার এই আসল কারণ। আগামি কয়েক শতাব্দিতে মহানগরীর ভিত্তি ধ্বসে পড়ার কোনো উপায় নেই।
বোম্যান স্যুইটের সাথে মানিয়ে নেয়ার পর পোল টের পায় পরিবেশপ্রীতি আছে তার। সাগরপাড়ে সারি সারি পামগাছ লাগিয়ে দিয়ে সমুদ্রের গর্জন শুনতে মন্দ লাগত না। হ্যারিকেন এলেও কুছ পরোয়া নেহি। মেরিনার ভ্যালি বা হিমালয়, যে কোনো জায়গায় যেতে পারত ইচ্ছা হলেই।
কিন্তু সৌর জগতের অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়ে এসে অন্য একটা বন ঘোরার নেশা মাথায় রেখে পার্থিব স্মৃতির কষ্টে মুষড়ে পড়ার কোনো মানে হয় না। অলসভাবে কয়েকটা মাস কাটানোর সময় কিছু উপভোগ করাই বরং ভাল।
আফসোসের কথা, কখনো মিশরে যাওয়া হয়নি। গ্রেট পিরামিড বা স্ফিংসের কাছাকাছি বসে উপভোগ করার কোনো তুলনা নেই। এসব স্বপ্নে বিভোর থাকার সময় সে বোম্যান স্যুইটের কার্পেটে ধুত দেখতে পায়।
গিজার বুকে শেষ পাথরটা বসানোর পর গত পাঁচ হাজার বছরে এমন দৃশ্য কেউ কখনো দেখেনি। দেখেনি এমন আকাশ। কিন্তু এটা কোনো কল্পনা নয়, এই হল গ্যানিমিডের চির পরিবর্তনশীল প্রকৃতির দৃশ্য।
লুসিফারের প্রতাপ শুরু হবার পর থেকেই বদলে গেছে এ এলাকার উপগ্রহগুলোর ধরন। এটার অন্যপ্রান্ত, যা কখনো ঘুরে আসে না এবং যে কারণে এখানে কখনো দিন আসে না, সেটাকে নাইটল্যান্ড নামে ডাকা হয়। চান্দ্র এলাকার মতো এখানেও কিছু কিছু এলাকায় আংশিক দিন হয়।
প্রাইমারি অর্বিটে গ্যানিমিড ঠিক এক সপ্তাহ সময় নেয়। সাতদিন তিন ঘন্টা। তাই বলা হত এক মিড দিবস= এক পার্থিব সপ্তাহ। কি এ ক্যালেন্ডার আদ্যিকালে বর্জন করা হয়েছিল। তিন ঘন্টা বাড়তি সময়ই ঝামেলা পাকাতে ওস্তাদ। তার বদলে ইউনিভার্সাল স্টান্ডার্ডে পৃথিবীর দিবস হিসাবে চব্বিশ ঘন্টায় দিন ধরা হতে লাগল।
গ্যানিমিডের নতুন বায়ুমন্ডল এখনো একেবারে চিকণ। মেঘের নাম-নিশানা নেই। তাই সৌরজগতের বড় গড়নগুলো হরদম দেখা দেয় আকাশে। আইও আর ক্যালিস্টোকে পৃথিবীর বুক থেকে দেখা চাঁদের অর্ধেক আকারে দেখা যায় সর্বক্ষণ। কিন্তু আর কিছু সব সময় চোখে পড়ে না। লুসিফারের এত কাছের প্রজা এই আইও যে সেটাকে পাক খেয়ে আসতে সময় নেয় মাত্র দুদিন। মিনিটের ব্যবধানে আইওকে তাই চলতে দেখা যায়। চারগুণ দূরত্বে থাকা ক্যালিস্টো দু মিড দিন সময় নেয়, পৃথিবীর হিসাবে গড়পড়তা মোলদিন।
ক্যালিস্টোর গড়ন মোটেও পাল্টায় না। এর বরফমোড় অঞ্চলগুলো অপরিবর্তনীয়। বৃহস্পতি থাকাকালে লুসিফার শনির সাথে পাল্লা দিয়ে মহাকাশের জিনিসপত্র যোগাড় করত, আটকে রাখত নিজের এলাকায়। সেসব কারণে, শতকোটি বছরের মধ্যে কয়েকটা উস্কাপাতের ঘটনা ছাড়া খুব বেশিকিছু ঘটেনি ক্যাসিস্টোর কপালে।
আইওতে প্রতি সপ্তাহে কোনো না কোনো অঘটন ঘটছেই। এখানকার এক অধিবাসী বলেছিল, লুসিফারের জনের আগে আইও ছিল সাক্ষাৎ নরক, এখন নরকটা আরো উস্কে উঠেছে।
আফ্রিকার চেয়ে বড় এলাকাজুড়ে থাকা আইওর বিশাল জ্বালামুখগুলোর সালফার উদগিরণের কাহিনী বসে বসে জুম করে দেখে পোল, সময় পেলেই। প্রায়ই আগুনের হল্কা উঠে যায় শত শত কিলোমিটার উপরে।
এখানে শুধুই আগুনে রঙের খেলা- লাল, কমলা, হলুদ, খয়েরি। মহাকাশ যুগের আগে মানুষের দুঃস্বপ্নেও এমন ভুবনের কথা আসেনি। মানুষ এখানে নামার ঝুঁকি নিয়েছে কিনা কখনো তা খতিয়ে দেখতে হবে, যেখানে রোবট নামালেই নষ্ট করার শামিল…
অবশ্যই, তার আসল আগ্রহ ইউরোপা নিয়ে। পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহের মতো আকৃতির এক এলাকা, শুধু চান্দ্র আকৃতি পরিবর্তন করে চারদিনে একবার, এই যা…
খালি চোখে তাকিয়েও অবাক হয়ে পোল দেখে, ডিসকভারি বৃহস্পতির এলাকায় আসার পর এক হাজার বছরে কী বিচিত্র পরিবর্তন এসেছে ইউরোপায়! বরফের উপর ফাটলের আঁকিবুকিগুলো উধাও হয়ে গেছে, আছে শুধু দু মেরুতে। অন্য জায়গাগুলোয় সাগর উষ্ণতায় উদ্বেলিত। পৃথিবীর মতো তাপমাত্রা সেখানে।
এ সুযোগে বরফের ভিতরে লুকিয়ে থাকা বিচিত্র সব প্রাণি মাথা তুলছে। এক হাজার বছরে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে তাদের মধ্যে। স্পাই স্যাটেলাইটগুলো এক সেন্টিমিটার এলাকাও চষে ফেলতে পারে। সেসব দিয়ে বোঝা যায়, তাদের উভচর পর্যায় চলছে এখন। কিন্তু বেশিরভাগ সময় সাগরের তলায় কাটানো প্রাণিগুলোর কী বিচিত্র উন্নয়ন। এরমধ্যেই ইউরোপা সরল বিল্ডিং বানানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে।
এক হাজার বছরে লাখ বছরের উন্নয়ন অকল্পনীয় হলেও সবাই মেনে নিয়েছে সেখানকার কিলোমিটার জুড়ে থাকা মনোলিথের কারবার এটা। গ্রেট ওয়াল নামের মনোলিথ পড়ে আছে সি অব গ্যালিলির প্রাতসীমায়।
কোন সন্দেহ নেই, দেখভাল করছে এটা। দেখভাল করছে সে পরীক্ষণের, যেমন পরীক্ষা করেছিল পৃথিবীর বুকে, চল্লিশ লাখ বছর আগে।
১৯. মানবজাতির পাগলামি
মিস প্রিঙ্গল
ফাইল- ইন্দ্রা
প্রিয় ইন্দ্রা- স্যরি, এর মধ্যে তোমাকে ভয়েস মেইলও পাঠাতে পারিনি। একই বাহানা, তাই আর বললাম না।
তোমার প্রশ্নের জবাব- হ্যাঁ। গ্যানিমিড়ে আমার বেশ ভাল্লাগছে। আমার স্যুইটে পাইপ ইন করা আকাশের দিকে আস্তে আস্তে আরো কম সময় দিচ্ছি। কাল রাতে আইও ফ্লাক্স টিউব দারুণ এক দৃশ্য দেখিয়েছে- আইও আর বৃহস্পতির, মানে লুসিফারের মধ্যকার লাইটনিং ডিসচার্জ অসম্ভব এক দৃশ্য। পৃথিবীর মেরুজ্যোতির মতোই বলা চলে, অনেক বেশি উজ্জ্বল। ব্যাপারটা আবিষ্কার করেছিল রেডিও এ্যাস্ট্রোনোমাররা, আমার জন্মেরও আগে।
আগের দিনের কথা বলছি, তুমি জান নাকি, আনুবিসে একজন শেরিফ আছে? পুরনোদিনের কথা মনে পড়ে যায়। আমার দাদা এ্যারিজোনার ব্যাপারে এসব গল্প বলত। মিডদের বলতে হবে গল্পগুলো…
ব্যাপারটা বিচিত্র- আমি এখনো বোম্যান স্যুইটের সাথে মানিয়ে নিতে পারিনি। মাঝে মাঝেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই….
সময় কাটাই কীভাবে? আফ্রিকা টাওয়ারের মতোই। এখানেও স্থানীয় হর্তাকর্তাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ চলছে হরহামেশা। কিন্তু তাদের দাম আরো একটু কম। (আশা করি কেউ বাগিং করবে না আমার এ মেইল…)। শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে যোগাযোগ করছি। ভালই। কিন্তু এ বিপরীত পরিবেশে আর কত ভাল হবে…
কিন্তু এতে আমি বুঝতে শিখছি কেন মানুষ এখানে থাকতে চায়। এখানে উদ্দেশ্য আছে, আছে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। পৃথিবীতে এ ব্যাপারটা খুব বেশি নেই।
কথা সত্যি, বেশিরভাগ মিড জন্মেছে এখানেই, তাই বসতবাড়ি বলতে এ এলাকাকেই চেনে। তারা এখানেই অভ্যস্ত। পৃথিবী তাদের কাছে দূরের এক এলাকা। আমরা টেরিরা (এ নামেই পৃথিবীর লোকদের ডাকে তারা) এ নিয়ে কী করতে পারব? একটা টিনএজ ক্লাসের সাথে মিশেছিলাম আমি, তারা আমাদের জাগাতে চায়। কেউ কেউ গোপনে পৃথিবী জয়ের চিন্তায় মত্ত- আবার বলোনা আমি তোমাদের সাবধান করিনি।
আমি আনুবিসের বাইরে একবার গিয়েছিলাম। তথাকথিত নাইটল্যান্ডে যেখান থেকে কখনো লুসিফারের দেখা পাওয়া যায় না। দশজন ছিলাম। চ্যান্ডলার, আমি, গোলিয়াথের দুজন কু, ছজন মিড- গিয়েছিলাম দূরে। সূর্য ডুবে যাবার আগ পর্যন্ত ছিলাম। তারপর সত্যিকার রাত নেমে আসে। দারুণ। পৃথিবীতে মেরুর শীতের মতো। আকাশটা একেবারে মিশকালো। মনে হয় স্পেসে আছি।
দেখেছি আইওর জাদু। ট্রিপটাকে সেভাবেই সাজানো হয়…
বেশ কয়েকটা ছোট উপগ্রহও চোখে পড়ে। পৃথিবীকে কি মিস করছি? মনে হয় না। মিস করছি সেখানকার নতুন বন্ধুদের…
আর আমি সত্যি স্যরি। এখনো ডক্টর খানের সাথে দেখা হয়নি। আমার জন্য কয়েকটা মেসেজ দিয়েছেন। আমি কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা করব। পার্থিব দিন, মিডের দিন নয় অবশ্যই।
জোর জন্য বেস্ট উইশেস, দানিলের জন্যও শুভকামনা। জান নাকি কী হয়েছে তার? আবার রিয়েল পারসন হয়েছে? আর ভালবাসা তোমার জন্য…
স্টোর।
ট্রান্সমিট।
.
পোলের শতাব্দিতে মানুষের নামের সাথে তার বাহ্যিক গড়নের একটা মিল খুঁজে পাওয়া যেত। এখন সে উপায় নেই। যে কোনো এলাকার, যদি ধর্ম থাকে তো ধর্মের মানুষের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের সাথে নামের মিল নাও পাওয়া যেতে পারে। ডক্টর খান দেখতে মোটেও মধ্য এশিয়ার মানুষের মতো নয়, বরং খাঁটি নরডিক ব্লন্ড। দেখে মনে হয় ভাইকিং। লম্বায় দেড়শ সেন্টিমিটারের চেয়েও কম। একটু মানসিক বিশ্লেষণ না করে পারে না সে, ছোটখাট গড়নের মানুষগুলো বিখ্যাতদের সাথে একটু চরমপন্থি মনোভাব নিয়ে চলে। এমন বাস্তবতা ঘেরা এলাকায় চলতে হলে খানকে সার্টিফিকেট পেতে হবে।
আনুবিস সিটিতে ইউনিভার্সিটি গড়ার মতো জায়গা নেই। অনেকে মনে করে টেলিকমিউনিকেশনের বিপ্লব এসব সমস্যাকে দূর করে দিবে। ইন্দ্রা যে তামাশার সুরে বলেছিল দর্শন বিভাগে ব্ল্যাকবোর্ড ছাড়া আর কিছু দরকার নেই, সেটা একেবারেই বাস্তব নয়।
‘সাতজনকে ধরে রাখার জন্য বানানো হয়েছে এটা,’ খুব বেশি আরামদায়ক যেন না হয় এভাবে বানানো চেয়ারে বসতে বসতে গর্বিত ভঙ্গিতে বলল ডক্টর খান, ‘কারণ এর চেয়ে বেশি মানুষের সাথে ভালভাবে ইন্টার্যাক্ট করা সম্ভব নয় একজন মানুষের পক্ষে। যদি আপনি সক্রেটিসের ভূতের সন্ধান পান, সেও সাতজনের কথাই বলবে।‘
‘ও, গ্রাজুয়েশনের ঠিক আগে আগে আমি একটা ক্র্যাশ কোর্স নিয়েছিলাম ফিলোসফিতে সিলেবাস নিঙের সময় কেউ ঠিক করেছিল আমাদের মতো অসামাজিক ইঞ্জিনিয়ার-জীবদের সংস্কৃতির সামান্য নিদর্শন দেখানো উচিৎ।’
‘ভালতো। এভাবে সবকিছু সহজ হয়ে যায়। জানেন, এখনো আমার ভাগ্যের ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছি না। আপনার দেখা পাবার জন্য পৃথিবীতে যাব ঠিক করেছিলাম। সেই আপনিই কিনা সশরীরে হাজির হলেন! একেই বলে মিরাকল, অলৌকিক ঘটনা। প্রিয় ইন্দ্রা কি আমার- আহ- ভালবাসার কথা বলেছে?
‘না, সামান্য মিথ্যা মিশিয়ে জবাব দিল পোল।
ডক্টর খানের চোখমুখে আনন্দের আভা। নতুন শ্রোতা পেয়ে সে যার পর নাই খুশি।
‘আপনি হয়ত শুনে থাকবেন আমি একজন আস্তিক, কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। আস্তিকতাকে প্রমাণ করা যায় না, তাই একই সাথে এটা খুব বেশি ইন্টারেস্টিংও নয়। যাই হোক, আমরা কখনো নিশ্চিত হতে পারব না যে ঈশ্বর কখনো ছিলেন এবং বর্তমানে তাকে ঠেলে অনেক দূরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে- এমন কোথাও যেখানে তাকে কেউ খুঁজে পাবে না… গৌতম বুদ্ধের মতো আমিও কোনো পক্ষ নিচ্ছি না। আমার আগ্রহের বিষয় ধর্ম নামের সাইকোপ্যাথলজিটা।
‘সাইকোপ্যাথলজি মনোবিকনের বিজ্ঞান? বিচিত্র সিদ্ধান্ড, বলতেই হয়।
ইতিহাসের রসে জারিত। ধরে নিন, আপনি একজন এ্যালিয়েন, সত্যের আপেক্ষিকতার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। আপনি এমন এক প্রজাতির সম্মুখীন হলেন যারা এর মধ্যেই হাজার হাজার গোত্র ও উপজাতিতে বিভক্ত, তাদের সবাই এ বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি ও বিজ্ঞান সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা পোষণ করে। ধরা যাক, তাদের বেশিরভাগ, নিরানব্বইভাগ বিশ্বাসই এক, শুধু একভাগ ভিন্ন, এটুকুর জন্য কত রক্তারক্তি হবে তার ইয়ত্তা নেই।
কীভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যায়? সুক্রেটিস এর ভিত্তিমূলে আঘাত হানলেন। তিনি বললেন, ধর্ম আসলে জন্ম নিয়েছে ভয় থেকে। রহস্যময়, বিরূপ প্রকৃতির বাইপ্রোডাক্ট। মানবজাতির কল্যাণের জন্যই এ ছিল এক প্রয়োজনীয় অকল্যাণ- কিন্তু কেন সেটা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অকল্যাণকর হয়ে গেল আর কেন তখনো টিকে থাকল যখন এর কোনো দরকারই নেই?
‘আমি বলেছি অকল্যাণ- মিন করছি সেটাই, কারণ ভয়ই সব প্রাণিকে নিষ্ঠুরতার দিকে ঠেলে দেয়। এসব সম্পর্কে যার বিন্দুমাত্র ধারণা আছে সে নিজেকে মানবজাতির সদস্য বলে মানতেও লজ্জা পাবে… মানবেতিহাসের সবচে খারাপ বইগুলোর একটা হল হ্যাঁমার অব উইচেস, স্যাডিস্টিক মনোভাবের দুজন মানুষ লিখেছিল। চার্চে অনুমতি দিয়েছে উৎসাহ দিয়েছে- নিরীহ হাজার হাজার বৃদ্ধার উপর অত্যাচার চালানোর জন্য, যেন স্বীকার করে তারা। তারপর পুড়িয়ে মারার নিয়ম ছিল। খোদ পোপ নিজ হাতে এর অনুমতিপত্র দেখে!
দু একটা সম্মানযোগ্য ধর্ম ছাড়া বাকি প্রায় সবগুলোই খ্রিস্ট ধর্মের মতো নিষ্ঠুর… এমনকি আপনার শতাব্দিতেও ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেদের ধরে ধরে লোহার শিকলে বেঁধে রাখা হত যে পর্যন্ত পিউস গিবেরিশ মুখস্ত করতে না পারে সে পর্যন্ত। একটা বাচ্চার কাছ থেকে তার বাল্যকাল কেড়ে নেয়ার মতো নিষ্ঠুর কাজ আর কী হতে পারে। তারপর যাজক হয়ে জলাঞ্জলি দিতে হত যৌবনকে…
সম্ভবত আরো বিচিত্র ব্যাপার হল, শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে পাগল লোকগুলো দাবি করে আসে সে, শুধু সে-ই পেয়েছে ঐশী গ্রন্থ। আর অন্য মানুষের সাথে তাদের ধর্মবিশ্বাসের মাইক্রোস্কোপিক পার্থক্যের কারণে লড়াই করে করে প্রাণপাত করেছে নির্বিধায়।
পোল ভাবে এখন দু একটা কথা নিজ থেকে বলা ভাল।
‘আপনার কথায় আমার বাল্যকালের ছবি ভেসে ওঠে। ঘটনাটা আমাদের শহরের। একজন হলি ম্যান দাবি করে বসে সে মিরাকল ঘটাতে পারে। তারপর মানুষ জুটে যেতে লাগল আশপাশে। এমনকি শিক্ষিত, দামি পরিবারের লোকগুলোও প্রতি রবিবারে তার টেম্পলের বাইরে গাড়ির লাইন লাগিয়ে দিত।
‘এটাকে রাশপুটিন সিন্ড্রোম বলে। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে, সব সমাজে এমন মানুষের সন্ধান পাওয়া যেত। হাজারে মাত্র দশবার এমন সঘ টিকে থাকে দু প্রজন্ম ধরে। এক্ষেত্রে কী হয়েছিল?
‘যা হবার তাই। নামটা মনে পড়ছে না। বিশাল, ভারতীয় নাম। স্বামী কিছু একটা বা… কিন্তু দেখা গেল সে এসেছে আলাবামা থেকে। পাতলা বাতাস থেকে পবিত্র সব জিনিস তৈরি করা ছিল তার এক ট্রিক। বের করে এনে পুঁজারীদের হাতে তুলে দিত। আমাদের স্থানীয় রাব্বি সব ভেদ খুলে দেয় সবার সামনে এসব ট্রিক করে। কোনো পার্থক্য ছিল না। কিন্তু বিশ্বাসীরা বলে বেড়ায় যে রাব্বিরটা ছল চাতুরি হলেও তারটা একেবারে বাস্তব।
‘একবার, বলতে আমার লজ্জাও হচ্ছে, আমার মা লোকটার পাল্লায় পড়ে বাবা চলে যাবার পরের কথা, মার মন বিক্ষিপ্ত। তাকে ফিরিয়ে আনার চিন্তায় অস্থির। আমাকেও একবার এক সেসনে নিয়ে গিয়েছিল। মাত্র দশ বছর বয়সেই মনে হয়েছিল এমন অদ্ভুতদর্শন আর দেখলে খারাপ লাগে এমন লোক আগে কখনো দেখিনি। তার দাড়িগুলো একাধিক পাখির বাসা লুকিয়ে রাখতে পারত, আর রেখেছিল বলেই আমার ধারণা।
স্ট্যান্ডার্ড মডেল বলেইতো মনে হচ্ছে, কদ্দিন টিকেছিল?
তিন চার বছর। তড়িঘড়ি করে শহর ছাড়তে হয়েছিল। লোকটা টিনেজদের সেক্স টিম চালাত। অবশ্য হার মানেনি, দাবি করেছিল যে সে আত্ম রক্ষার কাজ করছে। আর আপনি বিশ্বাস করবেন না
ট্রাই মি।’
স্যরি- তখনো তার দল তার উপর বিশ্বাস হারায়নি। কখনো কখনো পুলিশ তাকে ব্যবহার করত- যখন অপরাধী ধরার আর কোনো উপায় নেই, তখন।
হুম, ওয়েল, আপনাদের ঐ স্বামী খুব টিপিক্যাল। খুব বেশি অবাক বা খুশি হতে পারলাম না। কি একটা কথা প্রমাণ করে দিল সে, মানবজাতি বেশিরভাগ সময়েই ভুলপথে চালিত হয়।
‘প্রায় সব সময়।
‘ঠিক। মানুষ নিজের বিশ্বাস জলাঞ্জলি দেয়ার আগে প্রাণপাত করতে প্রস্তুত। বিশ্বাস না বলে ইস্যুশন বলা ভাল। আমার কাছে অজ্ঞতার ব্যবহারিক সংজ্ঞা এটাই।
‘আপনি কি মনে করেন যে শক্ত ধর্মবিশ্বাসী কোনো মানুষ অজ্ঞ?’
‘খুব কঠিন টেকনিক্যাল সেলে বলতে গেলে- হ্যাঁ- তারা যদি সৎ হয়, এবং কোনো প্রতারণা না করে এ বিশ্বাস নিয়ে। আমার ধারণা নববইভাগ মানুষ এ শ্রেণীতে পড়ে।
আমি নিশ্চিত রাব্বি বেরেনস্টাইন বিশ্বাসে সৎ ছিল। কিন্তু আমার জানা মতে তার মতো সজ্ঞান ও ভালমানুষ দ্বিতীয়টা পাওয়া যাবে না। আপনি কী করে তার জবাব দিবেন? আর আমার জীবনে সবচে দামি জিনিয়াস ছিলেন ডক্টর চন্দ্র। হাল প্রজেক্টের জনক। ঘরের সামনে গেলাম একবার। নক করলাম। কোনো জবাব নেই। মনে হল ঘরটা খালি।
‘সে তখন চমৎকার একদল ব্রোঞ্জের মূর্তির সামনে প্রার্থনায় রত। ফুলে ফুলে সাজানো সেগুলো। একটা দেখতে হাতির মতো… আরেকটার অনেকগুলো হাত… আমি বেশ বিব্রত হয়ে পড়ি, কিন্তু কপাল ভাল বলতে হবে, সে আমার উপস্থিতি টেরও পায়নি। পা টিপে টিপে ভালমানুষের মতো বেরিয়ে গেলাম। আপনি কি বলবেন সেও সজ্ঞান ছিল না?
‘আপনি বেছে বেছে খুব খারাপ কয়েকটা উদাহরণ টেনেছেন। জিনিয়াস মাঝে মাঝেই ইনসেন হয়। ধরে নিই বাহ্যিক জ্ঞান তার ছিল, কিন্তু বাল্যকালের শিক্ষার বাইরে কখনো যেতে পানি। জেসাইটরা দাবি করে আমার কাছে দু বছরের জন্য একটা শিশুকে ছেড়ে দাও, সে সারা জীবন ধু আমার। তারা যদি সময়মত ছোট এক চন্দ্রকে কজা করতে পারত, সে তাহলে ধর্মভীরু ক্যাথলিক হত- কখনোই হিন্দু নয়।
সম্ভবত কিন্তু আমি বিভ্রান্ত আমার সাথে দেখা করার জন্য এত অস্থির ছিলেন কেন আপনি? যদ্দূর জানি আমি কখনোই কোনো জিনিসের জন্য পাগল ছিলাম না। কোনো বিশ্বাসের জন্যও নয়। এতকিছুর সাথে আমার কী সম্পর্ক?
আস্তে আস্তে, মনের সমস্ত ভার নির্ভর করে দিয়ে, ডক্টর খান খুব গোপন একটা কথা বলল তাকে।
২০. এ্যাপোস্ট্যাট
রেকর্ড–পোল
হ্যালো, ফ্র্যাঙ্ক… তাহলে শেষ অবধি টেডের সাথে দেখা হয়েছে তোমার। হ্যাঁ, তুমি তাকে এককেন্দ্রীক বলতে পার, কারণ সেন্স অব হিউমারের খানিকটা অভাব আছে তার মধ্যে। কিন্তু এককেন্দ্রীক লোকেরা কিন্তু বড় ধরনের সত্যের সম্মুখীন হয়। মাঝে মাঝে কিন্তু তাদের কথা শুনতে চায় না কেউ… তুমি মন দিয়েছ তার কথায়, তাতেই আমি খুশি, আশা করি সিরিয়াসলি নিবে।
টেডের এ্যাপার্টমেন্টে সব সময়ের জন্য একজন পোপের ছবি দেখে ভড়কে গিয়েছিলে তুমি, বললে না? তিনিই সম্ভবত তার হিরো। পোপ বিংশ পিউস। তাকে ইমপিউসও বলা হয়। তোমার জন্মের কিছুদিন আগে যেমন ভয়ানক ঘটনাগুলো ঘটে তেমনি ঘটিয়েছিলেন তিনি। তুমি নিশ্চয়ই জান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট গর্ভাচেভ কী করে সমস্ত পাপের বোঝা শেষ করে দিয়েছিল?
তিনি অতদূর যাননি- রিফর্ম করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রক্রিয়াটা দীর্ঘ। এমন ধারণা নিয়েই এগুচ্ছিলেন কিনা তা আর জানা যায়নি। কারণ ইনকুইজিশনের ফাইলগুলো প্রকাশ করে পৃথিবীকে বিস্মিত এবং একই সাথে ভীত করার পরপরই এক কার্ডিনালের হাতে খুন হন….
সে সময়ের মাত্র কয়েক দশক আগে আবিস্কৃত হয় টি এম এ জিরো। ধর্ম সমাজে এর প্রভাব পড়ে ভয়ানকভাবে। বিংশ পিউস এরই প্রভাবে পড়েছিলেন কিনা তা আর জানা যাবে না…
ঈশ্বরের খোঁজে নামার কাজে টেডকে কী করে তুমি সহায়তা করবে তাতো জানালে না। মনে হয় ঈশ্বর এত বেশি দূরে লুকিয়ে আছেন দেখেই সেও পাগলের মতো পিছনে পড়ে গেছে। আমি যে একথা বলেছি তা আবার বলোনা।
কেন বলবে না…
ভালবাসা-ইন্দ্রা।
স্টোর ট্রা
ন্সমিট
.
মিস থিঙ্গল
রেকর্ড
হ্যালো- ইন্দ্রা- ডক্টর টেডের সাথে আরো একটা সেশন হয়ে গেছে। আমি অবশ্য বলিনি কেন তুমি মনে কর সে ঈশ্বরের সাথে এত বেশি রেগে আছে।
কিন্তু দারুণ সব যুক্তিতর্কে নেমেছিলাম- কোনো ডায়ালগ নয়- যদিও তিনি নিজেই কথার ঝুলি উজাড় করে দেন সব সময়, আমার জন্য অপেক্ষাও করেন না… কখনো ভাবিনি এতদিনের প্রযুক্তিবিদ্যার কলকজা ছেড়ে আবার নামব দর্শনশাস্ত্রে। আমার হয়ত আগেই এসবের ভিতর দিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল। জানি না ছাত্র হিসাবে আমাকে কোন শ্রেণীতে ফেলবেন তিনি।
আমি গতকাল ভিন্ন পথে কথা বলেছিলাম, রিএ্যাকশন দেখার জন্য। ডিসকাশনগুলো পাঠাচ্ছি —
মিস প্রিঙ্গল- কপি অডিও ৯৪।
‘আমি নিশ্চিত, টেড, পৃথিবীর বেশিরভাগ শিল্পকর্মই ধর্মের রসে জারিত, ধর্মই তাদের পথ দেখিয়েছে। এতে কি একটা ব্যাপার প্রমাণ হয়ে যায় না?
হ্যাঁ- কিন্তু এতে কোনো বিশ্বাসীর স্বস্তি হবে এমনতো বলছি না। মানুষ সব সময় বৃহত্তম, মহত্তম আর শ্রেষ্ঠদের তালিকা তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকত- আমি নিশ্চিত আপনার আমলে সেটাই পাবলিক এন্টারটেইনমেন্টের ব্যাপার ছিল।
‘নিশ্চই!
যাক, এসব শিল্পকর্মের ব্যাপারে বিখ্যাত কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। এগুলোর কোনো মহাকালীয় মূল্য নেই। কিন্তু এটুকু প্রমাণ করে, মানুষের রুচি কালে কালে যুগে যুগে বদলায়…
‘শেষটা দেখেছিলাম পৃথিবীর আর্টনেটে, কয়েক বছর আগে। স্থাপত্য, মিউজিক, ভিজুয়াল আর্টস সহ আরো নানা ভাগ ছিল সেটায়… মাত্র কয়েকটা উদাহরণ মনে আছে… প্যান্থিয়ন, তাজ মহল… বাঁচের টোকাটা আর ফুগু মিউজিকে সবার আগে ছিল; তারপরই ভার্দির রিকুয়েম মাস। আর্টে মোনা লিসাতো থাকবেই। আর ছিল শ্রীলঙ্কার কোথাও থাকা বুদ্ধমূর্তির সারি, তরুণ রাজা তুতের সোনালি মৃত্যু-মুখোশ।
যদি আর সবও মনে রাখতে পারতাম- অবশ্যই, তা সম্ভব নয়- তাতে কিছু যেত আসত না। তাদের কালচারাল আর রিলিজিয়াস ব্যাকগ্রাউন্ডই আসল। মোটের উপর, মিউজিক ছাড়া আর কোনো ক্ষেত্রে কোনো একক ধর্ম আধিপত্য দেখায়নি। প্রি-ইলেক্ট্রনিক ইন্সট্রুমেন্টের যুগে অর্গান ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি খ্রিস্টধর্মে সবচে বেশি অবদান রেখেছে সম্ভবত এ কারণে যে পশ্চিমা সভ্যতা তখন অগ্রসর ছিল। প্রভাবটা গ্রিক আর চৈনিকদের মধ্যে বেশি পড়ত যদি তারা মেশিনপত্রকে সামান্য খেলনা ভেবে বসে না থাকত।
তবে আমার যতদূর মনে হয় মানুষের শিল্পকলার একক বৃহত্তম নিদর্শন এ্যাঙ্কর ওয়াট। ধর্মটা যুগে যুগে, স্থানে স্থানে পরিবর্তিত হয়েছে, তবু এটুকু অবাক করে, সেখানে একজন ঈশ্বর নিয়ে কারবার করা হয়নি, ছিল শত শত দেবতা!
‘ধর্মের এই বিচিত্র হেরফেরের ব্যাপারে রাব্বি বেরেনস্টাইন ভাল বলতে পারত।’
‘আমার কোনো সন্দেহ নেই। পারত সে। তার সাথে দেখা করতে পারলেও ভাল হত। আর ভেবে ভাল লাগছে যে সে ইসরায়েলের ভাগ্যে শেষমেষ কী ঘটেছিল সেটা দেখার জন্য বেঁচে ছিল না।
এন্ড অডিও
.
এইতো, পেয়ে গেলে, ইন্দ্রা। আশা করি গ্যানিমিডের মেনুতে এ্যাঙ্কর ওয়াটও আছে– আমি কখনো দেখিনি। কিন্তু তুমি চাইলেই এক জীবনে সবকিছু দেখে ফেলতে পারবে না….
এখন, যে প্রশ্নের উত্তর চাইছিলে তুমি… আমি এখানে থাকায় ডক্টর টেড এত খুশি কেন?
সে নিশ্চিত, অনেক রহস্যের জবাব পড়ে আছে ইউরোপার বুকে, যেখানে হাজার বছর ধরে কেউ যায়নি।
সে মনে করে আমি হয়ত একটা ব্যাখ্যা নিয়ে এসেছি। হয়ত আমি নিজেই একটা ব্যাখ্যা। বিশ্বাস করে সেখানে আমার এক বন্ধু আছে। ঠিক ধরেছ- ডেভ বোম্যান, কিম্বা যাই সে হয়ে থাক না কেন এতদিনে…
আমরা জানি বিগ ব্রাদার মনোলিখের ভিতরে চলে গিয়েও সে ঠিক ঠিক বেঁচে আছে, অন্তত পরিবর্তিত হয়ে গেলেও তার অস্তিত্ব রয়ে গেছে। তারপর, পরে কোনো এক সময় চক্কর মেরেছে পৃথিবীর কাছাকাছি। কিন্তু আরো কয়েকটা ব্যাপার খুব কম মানুষ জানে। মিডরা জানাতে চায় না কাউকে, অস্বস্তি বোধ করে…
বছরের পর বছর ধরে প্রমাণ খুঁজেছে টেড খান। এখন সে নিশ্চিত- শুধু ব্যাখ্যা করাটা কঠিন। অন্তত দুবার, শত বছরের ব্যবধানে, বেশ কয়েকজন নিযোগ্য লোক বিচিত্র কিছু একটা দেখে আবির্ভাব- ভৌতিক আবির্ভাব- ঠিক যেমন ফ্লয়েড দেখে ডিসকভারিতে। তাদের কেউ ঘটনাটার কথা জানত না। কিন্তু যখনি ডেস্ত্রে হলোগ্রাম দেখানো হয়, তখনি চিনতে পারে। ছশ বছর আগে ইউরোপার কাছাকাছি যেতে থাকা আরেকটা সার্ভে শিপের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে…
এককভাবে কেউ ব্যাপারগুলোকে সিরিয়াসলি নিবে না, সব একত্র করলে একটা প্যাটার্ন দাঁড়িয়ে যায়। টেড নিশ্চিত ডেভ বোম্যান কোনো না কোনো রূপে বেঁচে আছে, বলা ভাল টিকে আছে, এবং তার সম্পর্ক গ্রেট ওয়াল নামের মনোলিথটার সাথে। এখনো আমাদের ব্যাপারে তার আগ্রহ প্রচুর।
যোগাযোগের কোনো চেষ্টা করে না সে, কিন্তু টেড মনে করে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ হওয়া সম্ভব। তার বিশ্বাস, আমিই একমাত্র মানুষ যে এ কাজ করতে পারবে….
এখনো মনস্থির করতে পারিনি। কাল কথা বলব ক্যাপ্টেন চ্যাভলারের সাথে। তখন জানতে পারবে তুমি। ভালবাসা- ফ্র্যাঙ্ক।
স্টোর
ট্রান্সমিট- ইন্দ্রা
২১. কোয়ারেন্টাইন।
‘তুমি কি ভূতে বিশ্বাস কর, দিম?
‘অবশ্যই নাঃ আর সব মানুষের মতো আমিও তাদের ভয় পাই, এই যা। হঠাৎ এ কথা তুললে যে?
‘ভূত না হয়ে থাকলে আমার জীবনের সবচে বিচিত্র স্বপ্ন, কোনো সন্দেহ নেই। কাল রাতে ডেভ বোম্যানের সাথে আমার কিছু বাতচিত হয়েছিল।’
পোল জানে, সময় এলে ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার তার কথায় মনোযোগ দিবে, হেলাফেলা করবে না। তাকে হতাশ হতে হল না।
ইন্টারেস্টিং- কিন্তু ব্যাখ্যা আছে একটা। তুমি এখন বোম্যান স্যুইটে বসবাস করছ ভায়া, ফর ডিউস সেক! তুমিইতো বললে, মনে হয় জায়গাটা ভূতুড়ে।
‘আমি নিশ্চিত- সত্যি বলতে কী- নিরানব্বইভাগ নিশ্চিত- তোমার কথাই ঠিক, আর প্রফেসর টেডের সাথে কথাবার্তার ফল এটা। আনুবিসে মাঝে মাঝে ডেভ বোম্যান দেখা দেয় একথা শুনেছ তুমি কখনো? প্রায় প্রতি শত বছরে একবার করে? যেমন হয়েছিল ডিসকভারি ঠিক করার পর সেখানে, ডক্টর ফ্রয়েডের সাথে?
কী হয়েছিল? আমি ভাসাভাসা গুজব শুনেছি। কান দিইনি কখনো।
ডক্টর খান দেয়- আমিও- আমি আসল রেকর্ডিংগুলো শুনেছি। আমার পুরনো চেয়ারটায় বসে আছে ফ্লয়েড। ডেভের মুখমন্ডলের আদল নিতে শুরু করল তার পিছনের ধূলাবালি। তখনি তাকে সেই বিখ্যাত মেসেজটা দিল। জানিয়ে দিল, ফিরে যেতে হবে।’
কিন্তু সেটাতো হাজার বছর আগের কথা।
তাতে কী এসে যায়? আমি আর খান গতকাল দেখছিলাম। জীবন নিয়ে বাজি ধরতে পারি, এতে কোনো ছল চাতুরি নেই।’
আসলে, তোমার সাথে আমিও একমত। রিপোর্টগুলোর কথাও শুনেছি…’
চ্যান্ডলারের কষ্ঠ আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে পড়ে, একটু বিব্রত মনে হয়।
অনেক আগে, এখানে, আনুবিসে আমার এক গার্লফ্রেন্ড ছিল। মেয়েটা বলে, তার দাদা দেখেছে ডেভ বোম্যানকে। খুব হেসেছিলাম তখন।’
কে জানে টেডের লিস্টে ঐ লোকটার নামও আছে কিনা! তুমি কি সেই বন্ধুর সাথে টেডের দেখা করিয়ে দিতে পারবে?
উঁ… ঠিক পারব না। অনেক বছর ধরে কোনো কথাবার্তা নেই। এতদিনে সে চাঁদে গিয়ে থাকতে পারে, থাকতে পারে মঙ্গলে- যে কোনো জায়গায়… যাই হোক, প্রফেসর টেডের এত আগ্রহ কেন?’
এ ব্যাপারটা নিয়েই তোমার সাথে কথা বলতে চাই।’
‘ভালইতো! গো এ্যাহেড।’
‘টেড মনে করে ডেভ বোম্যান, বা যাই সে হয়ে থাক না কেন, বসবাস করছে ইউরোপার ধারেকাছে কোথাও।
‘হাজার বছর পর?’
‘আসলে–আমার দিকে তাকাও।‘
‘একটা স্যাম্পল নিয়ে ভাল স্ট্যাটিস্টিক্স হয় না, আমার অঙ্ক প্রফেসর সব সময় বলত। আচ্ছা, বলে যাও।’
কাহিনীটা জটিল। বলা চলে জিস’- যেখানে অনেকগুলো পিস নেই। এটা মেনে নেয়া হয়েছে যে চার মিলিয়ন বছর আগে আফ্রিকায় ঐ কালো মনোলিথ আসার পর আমাদের পূর্বসূরীদের কপালে সাতিক কিছু ঘটেছিল। প্রাক-ইতিহাসের সব দান উল্টে দেয় এ একটা ব্যাপার। টুলস-উইপনস-রিলিজিয়নস… সবকিছুতে পরিবর্তন চলে আসে। আমাদের মধ্যে বিচিত্র কিছু ঘটিয়ে দিয়েছিল মনোলিথটা, তারপর সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পূজা-অর্চনা নেয়ার জন্য অপেক্ষা করেনি…’ ।
‘টেড খুব বিখ্যাত এক প্যালিয়োনটোলজিস্টের কোটেশন পেয়েছে, ‘টি এম এ জিরো আমাদের প্যান্টে কষে বিবর্তনীয় লাথি ঝেড়েছে।’ সে দাবি করে, লাথিটার সব দিক এখনো আমরা বের করতে পারিনি। তার মতে, আমাদের মতো একটা নিষ্ঠুর প্রজাতির উন্মেষ হবার কথা না। আমরা মস্তিষ্কের দিক দিয়ে অপূর্ণ, নাহলে সব সময় যুক্তির পথে চলতাম। সব প্রজাতিই বাঁচার জন্য কোনো না কোনো নিষ্ঠুর পন্থা বেছে নেয়, আমাদেরটা অনেক বেশি অমানবিক, অনেক বেশি খারাপ কাজ করেছি যা না করলেও চলত। আর কোনো জানোয়ার নিজ প্রজাতিকে এতটা কষ্ট দেয় না যেমনটা মানুষ মানুষের সাথে করে। এটা কি বিবর্তনের দূর্ঘটনা নয়, জেনেটিক বিপর্যয় না?
‘এখন কথাটা পরিষ্কার, টি এম এ-ওয়ান চাঁদে বসানো হয়েছে এ প্রজেক্টের উপর বা এক্সপেরিমেন্টের উপর নজরদারির জন্য। এটা বৃহস্পতিতে রিপোর্ট পাঠাবে। বৃহস্পতির আকাশই তখন এ সৌরজগতের কন্ট্রোলরুম। সেজন্যই সেখানে আরেক মনোলিথ, বিগ ব্রাদার অপেক্ষা করেছিল চল্লিশ লাখ বছর ধরে। আমরা সেখানে ডিসকভারি পাঠানো পর্যন্ত এটা কাজ করে গেছে, এ পর্যন্ত সব ঠিক তো?
হ্যাঁ। আমি সব সময় মনে করতাম এটা সবচে ভাল থিওরি।
‘এখন, আরো বিস্তারিত আসা যায়। হেউড ফ্লয়েড দ্বিতীয় ও তৃতীয় অভিযানে এসব নিয়ে আরো মাথা ঘামায়। বয়স তখন একশোরও বেশি, তবু তার কথা ঠিক ধরে নেয়া যায়, ঠিক আছে?
সেতো বুড়ো হাবড়াদের মতো বিহেভ করে থাকতে পারে।
‘সব রেকর্ড দেখলে তা কিন্তু মনে হয় না। একই সাথে তার নাতি ক্রিস গ্যালাক্সির সাথে বাধ্য হয়ে ইউরোপায় নামার পর এমন ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিল। ঠিক সেখানেই এখনকার মনোলিথটা আছে। চারপাশে বাসা বেঁধেছে ইউরোপানরা…’ ।
‘এখনি দেখতে পাচ্ছি ডক্টর টেডের লক্ষ্যবস্তু। ঠিক এখানেই আমরা এসেছিলাম। এভাবেই পুরো বৃত্ত শুরু করছে তার কাজ।
তাই! তাই। প্রতিটা বিষয় খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। বৃহস্পতিকে শেষ করে দেয়া হয় তাদের উত্তাপ দেয়ার জন্য, কাছাকাছি একটা নক্ষত্র দেয়ার জন্য, বরফের ভিতর থেকে টেনে তোলার জন্য। আমাদের দূরে থাকতে হবে- দূরে থাকতে হবে কারণ আমরা তাদের উন্নয়নে নাক গলাতে পারি…’
ফ্র্যাঙ্ক, কোথায় আইডিয়াগুলো পেয়েছিলাম প্রথমে মনে পড়ছে। তোমার সময়কার কথা। স্টার ট্রেকের সিরিজগুলোয়।
‘একজন অভিনেতার সাথে দেখা হয়েছিল আমার, বলেছি নাকি? এখন আমাকে দেখলে তারা ভিড়মি খেত… যাই হোক, আফ্রিকায় ফলাফলটী ভাল হয়নি। বিপর্যয়কর রেজাল্ট…’
‘তাহলে পরেরবার ভাল হোক- ইউরোপা!
হেসে ফেলল পোল।
‘খান ঠিক এ কথাটাই বলেছিল।
‘তাহলে এখন আমাদের কী করা উচিৎ বলে মনে করে সে? সবচে বড় কথা, এসবের মধ্যে তুমি এলে কোত্থেকে?
প্রথমেই-ইউরোপার বুকে কী ঘটছে সে ব্যাপারটা আমাদের বের করতে হবে। কেন ঘটছে? স্পেস থেকে নজরদারি করাই সব নয়।
‘তাহলে আর কী করতে পারি আমরা? মিড যত ভোব পাঠিয়েছে তার সবই ল্যান্ডিংয়ের আগে জ্বলে যায়।
আর গ্যালাক্সি পাঠানোর পর থেকেই যে কোনো মনুষ্যবাহী জাহাজকে ফোর্স ফিল্ডের মাধ্যমে সরিয়ে দেয়া হয়। কী সেই ফোর্স ফিল্ড, কেউ জানে না। প্রমাণ হয়ে যায়, নিচে যা-ই নিয়ন্ত্রণ করুক না কেন, সে ধ্বংস চায় না। মৃত্যু চায় না। এখানেই আসল কথা। যাই থাক না কেন, সে স্ক্যান করতে পারে, জেনে ফেলতে পারে এগিয়ে আসা কোনো স্পেসশিপে মানুষ আছে আর কোনোটায় রোবট- কোনোটা জীবনবাহী আর কোনোটা নির্জীব- সব চিনতে পারে।
‘আমার চেয়ে ভাল পারে তাহলে বলে যাও।
‘এবং, টেড মনে করে সেখানে এমন কেউ আছে যে তার মানুষ বন্ধুকে চিনতে পারবে, একজনকেই নামতে দিবে।
ক্যাপ্টেন দিমিত্রি চ্যান্ডলার একটা লম্বা, নিচু লয়ের শিষ দেয় সাথে সাথে।
‘আর তুমি এ ঝুঁকিটা নিবে স্বেচ্ছায়?
হু। হারানোর কিছু নেই।’
একটা দামি শাটল ক্র্যাফট হারাবে। যদি তুমি ঠিকমত বলতে পারকী করবে… এজন্যই তুমি ফ্যালকন চালাতে শিখছ?
‘তুমি যখন বলেই ফেললে… আইডিয়াটা আমার মাথাতেও এসেছিল।
‘ভাবতে দাও। আমি যদি রাজিও হই, নানা ঝক্কি-ঝামেলা আছে। বুঝতেই পারছ..
যদ্দূর চিনি, তুমি চাইলে পথে সেসব কাটা থাকবে না।
২২. গ্যানিমিড থেকে ভালবাসা
মিস প্রিঙ্গল- পৃথিবী থেকে আসা প্রায়োরিটি মেসেজগুলো লিস্ট কর
রেকর্ড
প্রিয় ইন্দ্রা- নাটুকেপনা করতে চাই না, কিন্তু গ্যানিমিড থেকে এটাই সম্ভবত আমার শেষ মেসেজ। তুমি এটা হাতে পেতে পেতে আমি থাকব ইউরোপার পথে।
সিদ্ধান্তটা হঠাৎ নেয়া। সব যে হয়ে যাবে তা ভাবিনি। কিন্তু আগুপিছু ভেবেছি অনেক। তোমার সন্দেহ ঠিক, পিছনে থেকে কলকাঠি নেড়েছে টেড খান… আমি আর ফিরে না এলে সে-ই সব ব্যাখ্যা করবে।
ভুল বুঝোনা, প্লিজ- আমি এটাকে কোনো অর্থেই সুইসাইড মিশন হিসাবে ধরছি না। আবার এক জীবনে এমন সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করতেও রাজি নই। সম্ভবত বলা উচিৎ ছিল দু জীবনে একবার সুযোগ…
গোলিয়াথের ওয়ান পারসন শাটল ফ্যালকনে চেপে বসব- আহা, স্পেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশনে যদি একবার চালিয়ে দেখাতে পারতাম! দূর্ঘটনা তেমন ঘটবে না। বড়জোর ইউরোপার কাছ থেকে ফিরিয়ে দেয়া হবে… এতেও অনেক শিক্ষা হতে পারে।
আর যদি সেই মনোলিথ- মহাপ্রাচীর সিদ্ধান্ত নেয় আমি একটা রোবট, তাহলে কপালে পুড়ে মরা ছাড়া আর কিছু নেই। এ ঝুঁকি নিজ দায়ে নিচ্ছি।
থ্যাঙ্ক ইউ ফর এভরিথিং, শুভকামনা রইল জোর জন্য। গ্যানিমিড থেকে ভালবাসা আর আশা করি, অচিরেই ইউরোপা থেকে পাবে…
স্টোর
ট্রান্সমিট
ঘ. সালফারের রাজত্ব
২৩. ফ্যালকন
‘এ মুহূর্তে গ্যানিমিড থেকে ইউরোপার দূরত্ব চার হাজার কে, ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার জানিয়ে দিল পোলকে, তুমি যদি গ্যাস প্যাডালে ঠিকমত চাপ দিতে পার- ফ্রেজটা শিখানোর জন্য ধন্যবাদ পৌঁছে যাবে এক ঘন্টার মধ্যে। কিন্তু আমি এতটা গতি চাই না। এত দ্রুত কিছু আসতে দেখে পুরনো বন্ধু ভড়কে গেলে সব ভেস্তে যাবে।’
মানলাম। আমাকে আরো একটু ভাবতে হবে। অত কয়েক ঘন্টা বেশি সময় নিব। এখনো আশা করি…’নিরবতায় হারিয়ে গেল পোলের কণ্ঠ।
কী আশা কর?
‘যে ডেভের সাথে কোনো না কোনোভাবে যোগাযোগ হবে। নামার আগেই।
‘দাওয়াত ছাড়া কোথাও যাওয়া খারাপ। সব সময় খারাপ- তা পরিচিত মানুষের বাসায় হোক আর অপরিচিত… কিছু উপহার নিয়ে গেলে কেমন হয়? আদ্যিকালের সমুদ্রচারীরা কী নিয়ে যেত নতুন নতুন এলাকায়? আয়না আর গয়না?
হাল্কা কথাবার্তা চ্যান্ডলারের মনের উদ্বেগ ঢাকতে পারছে না। পোলের জন্য উদ্বেগ, দামি যানটার জন্য উদ্বেগ।
‘এখনো ভেবে পাচ্ছি না। তুমি ফিরে এলে তো মস্ত বীর, তোমার আলোয় আমার গায়েও একটু ছাট টাট লাগবে। আর যদি ফিরে না আস? ফ্যালকন আর তোমার জীবন গেলে আমার কী হবে? কেউ এ কাহিনী কিনবে না। গ্যানিমিডের ট্রাফিক কন্ট্রোল খুব কড়া- এমনি হবার কথা, তাই না? যদি উড়তে শুরু কর, এক মাইক্রোসেকের মধ্যে- বলা ভাল মিলিসেকের মধ্যে পিছু নিবে। সময়ের আগে ফ্লাইটপ্ল্যান না করলে কোনো উপায় নেই।
তাই এখন পর্যন্ত এটুকু অফার করতে পারি।
‘তুমি ফ্যালকন নিয়ে যাচ্ছ ফাইনাল কোয়ালিফিকেশন টেস্টের জন্য সবাই জানে, এর মধ্যেই সলো করে ফেলেছ। তুমি ইউরোপার দু হাজার কিলোমিটার উপরে যাবে। এখানে কোনো আপত্তি নেই। মানুষ এসব করছে অহরহ, লোকাল অথরিটির নাকের ডগা দিয়েই।
‘পুরো ফ্লাইট টাইম পাঁচ ঘন্টার দশ মিনিট আগে-পরে। তুমি যদি ফিরে আসার সময় এদিক সেদিক কর, কারো কিছু করার নেই। অন্তত গ্যানিমিডে কেউ কিছু করতে পারবে না। অবশ্যই, আমি একটু চেঁচামেচি করব। চিৎকার করে বলব এমন অপারেশনাল সমস্যার কথা আগে ভাবিনি ইত্যাদি, ইত্যাদি। কোর্ট অব ইনকোয়ারিতে কাজে দিবে।
কাজ হবেতো? আমি তোমাকে কোনো বিপদে ফেলতে চাই না।’
‘বাদ দাও। এখানে খানিকটা উত্তেজনা চেখে দেখা যাবে। কিন্তু ভুলেও আর সব কুর কথা ভোলা যাবে না। তারা একেবারে চোখ কান বাধা অবস্থায় আছে।
“থ্যাঙ্কস, দিম। তোমার কাজের প্রশংসা করছি, সত্যি সত্যি। আমাকে গোলিয়াথে ফিরিয়ে আনতে তোমার কোনো সমস্যা হবে না।’
.
সন্দেহ দূর করতে পারল না পোল। ফ্যালকনকে ঠিকঠাক করার সময় ক্রুরা একটু আধটু গন্ধ পায়। চেপে রাখে পোল আর চ্যান্ডলার।
হাজার হলেও, হাজার বছর আগে সে আর ডেভ বোম্যান যেমন একেবারে অজানার উদ্দেশ্যে পাল তুলে দিয়েছিল তেমনটা হবে না এবার। শাটলের মেমোরিতে ইউরোপার হাই রেজুলেশন ম্যাপ আছে। মাত্র কয়েক মিটারের ডিটেইলও পাওয়া যাবে সেখানে। সে জানে কোথায় যেতে হবে। আশা একটাই, হাজার বছরের কোয়ারেন্টাইন যেন ভাঙা যায়।
২৪. এস্কেপ
‘ম্যানুয়াল কন্ট্রোল, প্লিজ।‘
‘তুমি নিশ্চিত তো, ফ্র্যাঙ্ক?’
‘পুরোপুরি, ফ্যালকন… ধন্যবাদ।‘
অযৌক্তিক হলেও সত্যি মানবজাতির বেশিরভাগ মানুষ তাদের তৈরি কৃত্রিম যান্ত্রিক সন্তানদের সাথে নিজের অজান্তে দ্র ব্যবহার করে। সাইকোলজির বড় বড় বইগুলো (কী করে আপনার কম্পিউটারের অনুভূতিতে আঘাত দেয়া থেকে বিরত থাকবেন; আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স- রিয়েল ইরিটেশন টাইপের নাম দেয়া হয় এসব বইয়ের) এখন লেখা হয় মানুষ-যন্ত্র যোগাযোগের ব্যাপারে। আগেই ধরে নেয়া হয়েছিল, রোবটের সাথে খারাপ ব্যবহার যা ফলই বয়ে আনুক না কেন, ব্যাপারটাকে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
অর্বিটে চলে এসেছে ফ্যালকন। ফ্লাইট প্ল্যান অনুযায়ী, ইউরোপার দু হাজার কিলোমিটার উপরে। সামনের আকাশ জুড়ে আছে দানবীয় চাঁদের চিকণ গড়ন। সব দেখা যায়, স্পষ্ট। পরিকল্পনার জায়গাটা দেখা সরাসরি। কোনো বাড়তি জিনিসের সহায়তা নিতে হবে না। গ্যালিলি সাগরের পাড় এখনো বরফ ছোঁয়া। এখানে নামা প্রথম স্পেসক্র্যাফটের কঙ্কাল দেখা যাচ্ছে। চৈনিক যানটার সব ধাতু তুলে নিয়েছে তারা। ইউরোপানরা। কঙ্কালটা পড়ে আছে নিঃসাড়। এর চারপাশে গড়ে ওঠে সৌর জগতের প্রথম এ্যালিয়েন নগরী। জিয়াংভিল।
পোল প্রথমে নেমে আসবে সমুদ্রের উপর। তারপর ধীরে ধীরে উড়ে যাবে জিয়াংভিলের দিকে। কারো কাছে যেন এগ্রিসিভ না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কাজটা যে খুব বেশি ভাল হবে তা না। কিন্তু এর চেয়ে ভাল কোনো উপায় ভেবে বের করতে পারেনি সে।
তারপর, হাজারখানেক কিলোমিটার নামার পরই, বাধা এল। যেমন আশা করেছিল, তেমনি।
‘দিস ইজ গ্যানিমিড কন্ট্রোল, কলিং ফ্যালকন। আপনি ফ্লাইট প্ল্যানের বাইরে চলে গেছেন। কী হচ্ছে জানিয়ে এ্যাডভাইস পাঠান দ্রুত।
এমন জরুরি ভঙ্গিতে আসা মেসেজ এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কিন্তু পোল এড়িয়ে গেল।
ঠিক ত্রিশ সেকেন্ড পর, ইউরোপার একশ কিলোমিটারে আসার সাথে সাথে আবার সেই মেসেজ। অবহেলা করল পোল, কি জবাব দিল ফ্যালকন।
তুমি নিশ্চিত তো, ফ্র্যাঙ্ক’ শাটল প্রশ্ন তুলল। সে জানে না ঠিক শুনেছে কিনা, ফ্যালকনের কঠে যেন উদ্বেগের ছোঁয়া।
‘একেবারে নিশ্চিত, ফ্যালকন। আমি ভাল করেই জানি কী করছি।’
কথাটা সত্যি নয়। সবটুকু সে জানে না।
কন্ট্রোল বোর্ডের পাশে ইন্ডিকেটর লাইট জ্বলছে। স্বস্তির হাসি পোলের মুখে। সব চলছে পরিকনামাফিক।
দিস ইজ গ্যানিমিড কন্ট্রোল! আমাকে রিসিভ করছেন, ফ্যালকন? আপনি ম্যানুয়াল ওভাররাইডে অপারেট করছেন, আপনাকে চালাতে পারছি না আমি। হচ্ছেটা কী? এখনো নেমে যাচ্ছেন ইউরোপার দিকে। মেসেজ প্রাপ্তি স্বীকার করুত, প্লিজ।
মহিলার কষ্ঠ চিনতে পারছে পোল। আনুবিস আসার পর পর মেয়রের দেয়া এক সংবর্ধনায় তার সাথে দেখা হয়েছিল। মহিলা নিশ্চয়ই অথৈ সাগরে পড়েছে।
হঠাৎ সে বুঝতে পারল, তার উদ্বেগ দূর করা যায় সহজে। চেষ্টা করে দেখা যাক, ক্ষতি নেই কোনো কাজ হলেও হতে পারে।
‘দিস ইজ ফ্র্যাঙ্ক পোল, কলিংফ্রম ফ্যালকন, আমি ঠিক আছি পুরোপুরি ঠিক আছি। মনে হয় কন্ট্রোল নিয়ে নিয়েছে অন্য কেউ। শাটলটাকে নামিয়ে আনছে ইউরোপার বুকে। আশা করি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন। যতদূর সম্ভব মেসেজ দিয়ে যাব।
কন্ট্রোলারের সাথে মিথ্যা কথা বলছে না সে। কোনো একদিন হয়ত সৰ ব্যাখ্যা করে বলার সময় আসবে।
নিয়মিত যোগাযোগ করে গেল সে, যেন কোনো ভুল করছে না, ভুল হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে।
আবার বলছি, দিস ইজ ফ্র্যাঙ্ক পোল এ্যাবোর্ড দ্য শাটল ফ্যালকন, নেমে যাচ্ছি। ইউরোপার দিকে। মনে হয় বাইরের কোনো শক্তি আমার শাটলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। নিরাপদে ল্যান্ড হতে পারে।
‘ডেভ- আমি তোমার পুরনো শিপমেট ফ্র্যাঙ্ক। আমাকে নিয়ন্ত্রণ করা অস্তিত্ব কি তুমিই? তুমি ইউরোপায় সেটা বিশ্বাস করার কারণ আছে।
তা হয়ে থাকলে আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করতে চাই, যেখানে, যেভাবেই থাক না কেন?
প্রথমে কয়েক মুহূর্ত আর কোনো আওয়াজ নেই। এমনকি গ্যানিমিড কন্ট্রোলও স্তব্ধ হয়ে গেছে।
অন্য দিক দিয়ে সে একটা জবাব পেয়ে যায়। এখনো গ্যালিলি সাগরে নেমে যাচ্ছে ফ্যালকন।
ইউরোপা মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার নিচে। কালো লম্বা জিনিসটা, সব মনোলিথের চেয়ে বড় মনোলিথ, পড়ে আছে জিয়াংভিলের পাশেই। শুয়ে আছে।
হাজার বছরে আর কোনো মানুষকে এতটা কাছে আসতে দেয়া হয়নি।
২৫. ছাইচাপা আগুন
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এটা পানির রাজ্য। নিচে পানি, উপরে শূন্যতা, মাঝখানে শক্ত বরফের প্রাচীর। বেশিরভাগ জায়গায় বরফের আস্তরণটা কিলোমিটারের চেয়ে বেশি পুরু। কয়েক কিলোমিটার পুরু। কোথাও কোথাও ভাঙা অঞ্চল ছিল, বরফের বিশাল ফাটল উন্মুক্ত করে দিত পানি আর শূন্যতার মাঝের বরফকে। সৌরজগতের আর কোথাও দু বিপরীত অস্তিত্ব একত্রিত হয়নি এখানকার মতো। এ যুদ্ধে সব সময় দু পক্ষই জিতে যেত। বাপীভূত হত কিছুটা পানি, বাকিটা জমে গিয়ে পার্থক্য রচনা করত।
বৃহস্পতির টান না থাকলে পুরো ইউরোপার অনেক আগেই জমে বরফ হয়ে যাবার কথা। এহরাজের টান সব সময় হোট এ ভুবনের মধ্যবিন্দুতে টালমাটাল করে রাখে। আইওকে অগ্নিকুন্ড করে ফেলা শক্তি এখানেও কাজ করে, অনেক কম বল নিয়ে। গভীরে, সর্বত্র এ মহাগ্রহ-উপগ্রহ টানাপোড়েনের চিহ্ন। মাটির নিচে ভয়ানক সব ভূমিকম্প চলছে। এসবের গুরুগুরু আওয়াজ উঠে আসে উপরে। ভিতর থেকে উথলে ওঠে গ্যাসের প্রবাহ। ইউরোপার সমুদ্রের সাথে তুলনা করলে পৃথিবীর জীবন সঙ্গীত গাওয়া সমুদ্রগুলোও বোবা।
এখানে সেখানে, সাগরের তলায়, জন্ম নেয় মরুদ্যানেরা। যে কোনো পার্থিব জীববিদকে টানবে এ জগৎ। নিচ থেকে উঠে আসা তাপ আর মিনারেলে ভরা চিমনি ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের কয়েক কিলোমিটার জুড়ে। কখনো কখনো দুর্গের মতো গড়ন গড়ে ওঠে আপনা-আপনি। সেখান থেকে দমকে দমকে বের হয় কালো স্রোত। ধীর, কালো স্রোত। যেন কোনো শক্তিমানের হৃদয় স্পন্দিত হচ্ছে। রক্তের মতো সেগুলোই জীবনের বার্তাবাহী তরল।
উপর থেকে আসছে শিতলতা, পানি তাই একেবারে ঠান্ডা। নিচ থেকে আসছে উত্তাপ, উঠে আসা তরল তাই ফুটন্ত। ফলে এসব জায়গায়, সাগরতলে, তাপমাত্রার বিচিত্র ভারসাম্য থাকে।
নিচ থেকে উঠে আসছে তির প্রাণ-রসায়নের সমস্ত উপাদান। এমন সব উর্বর মরুদ্যানে খাবার আর উত্তাপের কোনো অভাব নেই। বিংশ শতাব্দির অভিযাত্রীরা পৃথিবীর সমুদ্রের বুকেও এমন সব পানির তলার দ্বীপের সন্ধান পেয়েছিল। এখানে এগুলোর আকার অনেক বেশি বড়, বৈচিত্রও বেশি।
গাছের মতো গড়ন নিয়ে, মাকড়শার মতো গড়ন নিয়ে উদ্ভিদ জাতীয় জীবেরা জন্ম নেয় জ্বালামুখের কাছাকাছি। এমন ছোট ছোট বন দাপড়ে বেড়ায় আরো বিচিত্র পোকামাকড়। কোনো কোনোটা গাছ থেকে খাদ্য নিচ্ছে, কোনো কোনোটা নিচ্ছে সরাসরি খনিজ দ্রব্য থেকে। আরো একটু দূরে বসত করে কাকড়ার মতো প্রাণিরা।
একটা ছোট মরুদ্যান দেখতে দেখতে সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে জীববিজ্ঞানীর বাহিনী। পোলিওজোয়িক পার্থিব সমুদ্রের মতো এখানকার মরুদ্যানগুলো সুস্থির ও চিরস্থায়ী নয়। বিবর্তন এখানে বিদ্যুৎ গতিতে বয়ে চলে। অকল্পনীয় সব গড়ন জন্ম নেয়। তারপর, তারা সবাই, আজ অথবা কাল, হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অতল তলে, কারণ মাতা ইউরোপা তার ইচ্ছামত উদগিরণের পথ সরিয়ে আনে, স্তিমিত করে ফেলে প্রাণ-তরলের উৎসগুলোকে। থিতিয়ে পড়ে ফোয়ার, স্তিমিত হয়ে যায় প্রাণের খেলা। ইউরোপার সাগরতলে, সর্বত্র এ নিদর্শন দেখা যায়। গোলাকার এলাকা ছড়িয়ে আছে যত্রতত্র, ছড়িয়ে আছে মৃত ঝর্ণা, ছড়িয়ে আছে বিচিত্র সব প্রাণি আর উদ্ভিদের কঙ্কাল, বিবর্তনবিদ্যার এক একটা মূল্যবান অধ্যায় একেবারে অপঠিত থেকে যায়, হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। কোথাও পড়ে আছে মানুষের চেয়েও বড় আকৃতির অস্থিময় গড়ন, বাইভালভ এমনকি ট্রাইভালভও চোখে পড়ে চোখে পড়ে কয়েক মিটার লম্বা সর্পিল পাথুরে গঠন যারা ক্রিটেশিয়াস যুগে পৃথিবীর বুক থেকে আচমকা বিলুপ্ত হয়ে পড়েছিল।
ইউরোপান জগতের আরেক বিস্ময় আগ্নেয়গিরি থেকে বেরিয়ে আসা লাভার নদী। সাগরের এত নিচে প্রচন্ড চাপের কারণে লাভার স্পর্শ পাবার সাথে সাথে পানিগুলো বাষ্পে পরিণত হতে পারে না। দুইটা বিপরীত অস্তিত্ব বয়ে চলে পাশাপাশি।
সেখানে, অন্য এক পৃথিবীতে মিশরের মতো কাহিনী রচিত, অভিনীত হয় ভিনগ্রহী অভিনেতাদের দ্বারা মানুষের জন্মের অনেক আগেই। সরু নীলনদ যেমন উষর মরুর বুকে জীবনের জয়গান নিয়ে আসে, তেমনি ইউরোপার গহীনে এ নদীগুলো কাজ করে চলে অবিরত। নদীর দু পাড়ে, মাত্র কয়েক কিলোমিটার পুরুত্ব নিয়ে, প্রাণের বীজতলা গড়ে ওঠে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম নানা রকম প্রাণি জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে, উন্নয়ন ঘটায়, তারপর থিতিয়ে পড়ে নদীর প্রাণ যাবার সাথে সাথে। কেউ কেউ রেখে যায় স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ- তাদেরই অস্থি দিয়ে।
কেউ কেউ এমন স্থাপত্য রাখে যা দেখলে বুদ্ধিমত্তার কথা মনে পড়তে পারে।
এ সরু সরু নদীর দু পাড়ে, লম্বা এলাকা জুড়ে কত সমাজ আর সভ্যতার বীজ বুনে দেয়া হয়েছিল, কতগুলোর চারা গজিয়েছে, কত সাম্রাজ্যের উত্থান পতন হয়েছে তা এখন আর জানা যাবে না। হয়ত ইউরোপান ট্যামারলেন আর নেপোলিয়ানরা দাপটের সাথে মার্চ করিয়েছে- সাঁতার কাটিয়েছে সেনাবাহিনীকে। নদীর দু পাড়ের এলাকা বাদ দিলে পুরো বনের বাকিরা সেসবের কোনো সন্ধান পায় না। কারণ এখানে উষ্ণতা আছে শুধু আশপাশের এলাকায়। মরুদ্যান বা নদীর বাইরে চলে গেলে শীতলতা জীবনকে গ্রাস করে নিবে। এক একটা পানির তলার দ্বীপ যেন ভিন্ন। ভিন্ন গ্রহ, ভিন্ন দুনিয়া। তাদের ইতিহাসবেত্তা বা দার্শনিক থেকে থাকতে পারে, তারা হয়ত মনে করেছে সৃষ্টি জগতে আর কেউ নেই।
মরুদ্যানগুলোর মাঝের এলাকা একেবারে বিরান নয়। ইউরোপান সাগর আর পার্থিব সমুদ্রের মাছের মধ্যে অনেক পার্থক্য। তাদের কোনো ফুলকা নেই, কারণ অক্সিজেনের নাম-নিশানাও পাওয়া যাবে না বরফের নিচের এ সাগরে। পৃথিবীর জিওথার্মাল ভেন্টের মতো এরাও সালফার-যৌগ-নির্ভর প্রাণি।
সবার চোখ ছিল না। খুব কম দেখা যায়। এত গভীরে আলোর কোনো চিহ্ন নেই। তাই চোখেরও প্রশ্ন ওঠে না। শুধু উন্নত ধরনের জীবেরা সঙ্গী বা শিকারের খোঁজে মৃদু আলোর রেখা দেখায়।
ভিতরের উদ্গিরণ সব সময় থাকবে না, আস্তে আস্তে জোয়ারের টানও কমে আসছে। বুদ্ধিমত্তার উন্মেষ ঘটলেও তারা ফাঁদের বাইরে বেরুতে পারত না। জীবন আটকে পড়েছে বরফ আর আগুনের মাঝামাঝি।
কোন অলৌকিকের ছোঁয়া না পেলে টিকে থাকার উপায় নেই।
লুসিফার সেই অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে ছাড়ল।
২৬. জিয়াংভিল
শেষ মুহূর্তে সমুদ্রের উপর দিয়ে চলতে থাকে সে, মাত্র একশ কিলোমিটার গতিতে। তীরে এসে তরী ডুবে কিনা তাই নিয়ে চিন্তিত পোল। কিন্তু কিছুই হল না। এমনকি কালো, নিষিদ্ধ দেয়ালের উপর দিয়ে যাবার সময়ও কিছু হয় না।
স্বাভাবিকভাবে এর নাম দেয়া হয়েছিল ইউরোপান মনোলিথ। চাঁদ বা পৃথিবীর মনোলিধের মতো এটা দাঁড়িয়ে নেই। দেয়ালের মতো করে শোয়ানো। লম্বায় বিশ কিলোমিটারের চেয়েও বেশি। টি এম এ-জিরো ও টি এম এ-ওয়ানের তুলনায় বিলিয়ন গুণ বড় হলেও অনুপাতে কোনো ভুল নেই। ১:৪:৯। হাজার বছর ধরে এ মৌলিক অনুপাত নিয়ে মানুষ প্রাণপাত করেছে।
মাটি থেকে উচ্চতায় প্রায় দশ কিলোমিটার হওয়ায় এটা জিয়াহুভ্যালিকে গ্যালিলি সাগরের দুর্দান্ত জলরাশির হাত থেকে রক্ষা করে। রক্ষা করে মাতাল বাতাসের হাত থেকে। এখন সাগর আর তেমন সর্বগ্রাসী নয়, কিন্তু লুসিফারের জন্মের পর পর, নতুন ইউরোপার আবহাওয়া অস্থির থাকার সময় বছরের পর বছর ধরে এ ভূমি সাগর থেকে উঠে আসা প্রাণের অনুকূলে ছিল না।
প্রায় সর্বজয়ী মহাকাশচারী ফ্যাৰু পোল স্বচক্ষে কখনো কোনো টি এম এ দেখেনি। যখন সে বৃহস্পতির পথে পা বাড়ায় তখনো চাঁদের বুকের টি এম এ ওয়ান ছিল টপ সিক্রেট, সেটার কথা জানত শুধু ডিসকভারিতে শীতস্তম্ভে ঘুমিয়ে থাকা অভিযাত্রীরা, সে বা ডেভ বোম্যান, যে দুজন জেগে ছিল, তারা জানত না। পরে যখন বোম্যান তখনকার বৃহস্পতির বাইরে পাক খেতে থাকা বৃহস্পতিয় টি এম এর দেখা পায়, (লিওনভের যাত্রিরা পরে, দু হাজার দশ সালে যার নাম দিয়েছিল বিগ ব্রাদার) ততদিনে পোল চলে গেছে ডিসকভারির বাইরে, মৃত অবস্থায় চলে যাচ্ছে শনির দিকে। কয়েক শতাব্দি পর, পৃথিবীর বুকে আবিস্কৃত হল টি এম এ জিরো। ফিরে এল পোল, কিন্তু হাজার বছর জমে থাকার কারণে পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ সহ্য করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই পৃথিবীর এত কাছে থাকা সত্ত্বেও দেখতে পায়নি পৃথিবীর বিস্ময়কে। এই প্রথম, সে কোনো টি এম এ দেখছে। দেখছে অচিন মহাকাশচারীদের বানানো বিস্ময়-বস্তু।
টি এম এ নিয়ে কম পাগলাটে তত্ত্ব আসেনি। এক মতবাদ অনুসারে, সত্যিকার মনোলিথ আছে মাত্র একটা, বাকিগুলোর আকার আকৃতি যেমনি হোক না কেন, সেগুলো শুধু প্রথমটার ইমেজ প্রজেকশন। মহাপ্রাচীরের মসৃণ, দাগহীন, চিত্রহীন, মিষকালো আকৃতি দেখতে দেখতে স্থাণুর মতো হয়ে যায় সে। এত শতাব্দির ধকল পেরিয়ে এসে এখনো এটা চিরযুবা। যেন ইউন্ডোক্লিনারের বাহিনী সব সময় প্রতি বর্গসেন্টিমিটারে ধুয়ে মুছে যত্ন করে পালিশ করে রেখেছে।
টি এম এ-ওয়ান আর জিরো দেখতে আসা সব মানুষের মতো তার মনেও একই অনুভূতি জন্মে। একবার ছুঁয়ে দেখতে হবে। কেউ কখনো পারেনি। তবু একবার দেখতে হবে। আঙুল, হিরার ছুরি, লেজার- সব ফস্কে ফস্কে যায় এখানে। কোনো চিহ্ন পড়ে না। অথবা, আরেক বিখ্যাত থিওরি মেনে নিতে হয়- এগুলো এ ব্রহ্মান্ডের বস্তু নয়। এক বিন্দুও ছুঁয়ে দেখা যাবে না।
একবার ধীর গতিতে সে পাক খায় গ্রেট ওয়ালের চারপাশে। এরপর, এখনো ম্যানুয়াল কন্ট্রোলে রেখে, জিয়াংভিলের প্রাক্তসীমায় নামানোর চেষ্টা করে শাটলটাকে। অটো কন্ট্রোল রাখতে সাহস হয় না। গ্যানিমিড যদি উদ্ধারের চেষ্টা করে তাহলে সব ভেস্তে যাবে।
সামনে, ফ্যালকনের ল, প্যানারমিক জানালা দিয়ে তাকায় সে। গ্যানিমিডে বসে বসে এ চিত্র অনেকবার দেখেছে। কখনো ভাবেনি সত্যি সত্যি এসে পড়বে। মনে হচ্ছে ইউরোপাদের নগরবিদ্যার কোনো ধারণা নেই। ধার ধারে না তারা সেসবের। ইগলুর মতো ঘরবাড়ি গড়ে উঠেছে শত শত। মোটামুটি এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়ানো। কোনো কোনোটা এত ছোট যে বাচ্চা ছেলেমেয়েরাও অস্বস্তি বোধ করবে। কোনো কোনোটা বড়সড় পরিবার ধরে রাখতে পারবে। উচ্চতা পাঁচ মিটারের বেশি নয়।
সবগুলো এক জিনিস দিয়েই তৈরি। দুই সূর্যের আলোয় সাত দিনে ভূতুড়ে সাদা দেখায় সেগুলোকে। মেরুদেশে এস্কিমোরা জমে যাবার হাত থেকে বাঁচার জন্য জমাট জিনিসই বেছে নিয়েছিল, ইউরোপানরাও তাদের ইগলুর জন্য একই জিনিসের আশ্রয় নেয়। বরফ।
কোন পথ নেই, রাস্তা নেই। আছে খাল। এখানকার প্রাণিরা এখনো আংশিক উভচর। সম্ভবত ঘুমানোর জন্য পানিতে ফিরে যায়। হয়ত খাবার জন্য, একত্রিত হবার জন্য সেখানেই যেতে হয় তাদের। এর চেয়ে ভাল কোনো হাইপোথিসিস দাঁড় করানো যায়নি।
জিয়াংভিলকে বরফঘেরা ভেনিস নামে ডাকে অনেকে। একটাই অমিল, আশপাশে কোনো ভেনেশিয়ানের চিহ্ন নেই। যেন এ নগরী প্রাণহীন অনেক বছর ধরে।
আরো এক রহস্য ধরা দেয় এখানে লুসিফার দূরের সূর্যের তুলনায় পঞ্চাশগুণ উজ্জ্বল হলেও, আকাশের এক কোণায় সব সময় প্রতাপ নিয়ে টিকে থাকলেও ইউরোপারা দিন আর রাতের চক্রকে অনেক মূল্য দেয়। আংশিক দিন-রাত হওয়ার এলাকায় সূর্যাস্তের সময় নেমে যায় সমুদ্রে, তারপর সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ফিরে আসে। অথচ আলোর উজ্জ্বলতা মাত্র কয়েক শতাংশ বাড়ে-কমে। পৃথিবীর অনেক প্রাণির মতোই তারা, সেখানেও অনেক প্রাণি চাঁদের উপর নির্ভ করে, তাদের দৈহিক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রিত হয় চাঁদ দ্বারা, দোর্দণ্ডপ্রতাপ সূর্য সেখানে সামান্য এক নিয়ামক।
এক ঘন্টার মধ্যে সূর্যোদয় হবে। ফিরে আসবে ইউরোপারা। আলসে ভঙ্গিতে দৈনন্দিন কাজে নেমে পড়বে। ইউরোপার সালফার ভিত্তিক জৈবরসায়ন পৃথিবীর বিশাল ক্ষেত্রে জন্ম নেয়া অক্সিজেন ভিত্তিক জীববিজ্ঞানের সাথে মিলবে না। এমনকি ধীর গতির একটা সুথও ইউনোপাদের ভড়কে দিতে পারবে, কারণ তাদের কাছে সেটাও ভয়ঙ্কর। খবরটা ভাল হলেও, খারাপ দিক আছে, যে কোনো যোগাযোগের চেষ্টা কষ্টকর হবে, সন্দেহ নেই।
সময় এসেছে, এবার গ্যানিমিডে রিপোর্ট করা যায়। তারা নিশ্চয়ই অকূল পাথারে পড়েছে- এখন ষড়যন্ত্রের আরেক মন্ত্রণাদাতা ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার কী করে সামলায় তা দেখতে হবে।
ফ্যালকন কলিং গ্যানিমিড। আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন, আমি- মানে আমাকে টেনে আনা হয়েছে জিয়াংভিলের উপরে। কোনো সহিংসতার চিহ্ন নেই। এখনো এখানে সৌররাত। ইউরোপারা পানির নিচে। মাটিতে নামার সাথে সাথে কল করব।
দিম নিশ্চয়ই পোলকে নিয়ে গর্বিত হবে, কারণ সে ম্যানুয়াল কন্ট্রোলে থেকেও বরফের উপর আলতো করে নামতে পেরেছে। এখন ফ্যালকনকে রাখতে হবে এভাবে, যেন ওজনের কারণে বরফ ভেঙে পড়ে না যায়, আবার একটু উড্ডীন থাকার কারণে বাতাসে ভেসে না যায়। সে সমস্যাও মিটে গেল।
সে এখন ইউরোপার বুকে। হাজার বছরে প্রথম মানব। আর্মস্ট্রং আর অনি কি এমনি অনুভব করেছিল ঈগল চাঁদের বুকে নামার পর? সম্ভবত তারা তাদের যানের প্রাচীণ ও নির্বোধ অংশগুলো খতিয়ে দেখার কাজে বিডোর ছিল।
এসব কাজের ভার ফ্যালকনের উপর। ইঞ্জিনের প্রায় অক্ষত গুঞ্জন ছাড়া পুরো কেবিন স্তব্ধ। হঠাৎ চ্যান্ডলারের রেকর্ড করা কণ্ঠস্বর সচকিত করে দেয় তাকে।
‘তাহলে পারলে শেষ পর্যন্ত। কগ্রাচুলেশন্স! তুমিতো জান, আগামি সপ্তাহে আবার উড়ছি। সে পর্যন্ত সময় দেয়া যায়।
‘পাঁচদিন পর, ফ্যালকন জানে কী করতে হবে। সে বাসায় ফিরে আসবে, তোমাকে নিয়ে, অথবা তোমাকে ছাড়াই। গুডলাক।’
মিস প্রিঙ্গল
এ্যাক্টিভেট ক্রিপ্টো প্রোগ্রাম
স্টোর
হ্যালো, দিম- মেসেজের জন্য ধন্যবাদ। এ প্রোগ্রাম ব্যবহার করার জন্য একটু খারাপ লাগছে। আমার জন্মের আগে দারুণ জনপ্রিয় সব স্পাই থ্রিলারের গোপন মিশনে আমি যেন এক গুচর। এখনো আমি কিছু প্রাইভেসি রাখব, ব্যাপারটা খুব দরকার। আশা করি মিস প্রিন্সল ঠিকমত ডাউনলোড করেছে. অবশ্যই, মিস পি, আমি ঠাট্টা করছি।
বাই দ্য ওয়ে, সারা সৌরজগতের নিউজ মিডিয়ার কল্যাণে জেরবার হয়ে যাব একটু পরই। তাদের সবাইকে ডক্টর টেডের কাছে ডাইভার্ট করে দাও, সে বেশ উপভোগ করবে ব্যাপারটা….
গ্যানিমিড ক্যামেরায় সব দেখছে। কী হয় না হয় সেসব বলে আর দম নষ্ট করছি না। নাটকের আসল দৃশ্য অভিনয় হবে আর একটু পরই। ইউরোপারা উঠে আসবে। আমাকে এখানে শান্তিতে বসে থাকতে দেখবে। তারপর দেখা যাবে আমাদের অভিযানটা ভুল ছিল, নাকি সঠিক…
যাই ঘটুক, হাজার বছর আগে আসা ডক্টর চ্যাং আর তার কলিগদের মতো বিমূঢ় হয়ে যাব না মোটেও! গ্যানিমিড ছাড়ার আগ মুহূর্তে তার সেই বিখ্যাত মেসেটা আবার চালিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কী, তখনি আমার মাথায় বোমা পড়েছিল, ভাবতে বসেছিলাম আবার তেমন কিছু দেখতে হয় কিনা… বেচারা চ্যাং যেভাবে নিজেকে অমর করেছিল সেভাবে আমার অমর হবার কোনো শখ নেই… ।
অবশ্যই, অঘটন ঘটতে নিলে আমি পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলব… দারুণ একটা চিন্তা এইমাত্র মাথায় এল… কে জানে, ইউরোপাদের কোনো ইতিহাস আছে কিনা যে কোনো ধরনের রেকর্ড হতে পারে… এখান থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার নিচে হাজার বছর আগে কী হচ্ছিল তার কোনো স্মৃতি থাকলে ব্যাপারটা দারুণ হয়, তাই না?
২৭. শূন্যতায় জমাট জল
‘…দিস ইজ ডক্টর চ্যাং কলিং ফ্রম ইউরোপা, আশা করি আপনারা আমাকে শুনতে পাচ্ছেন, বিশেষত ডক্টর ফ্লয়েড- আশা করি শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা… জানি আপনি লিওনভে… বেশি সময় নেই হয়ত… আমার স্যুট এন্টেনা দেখে মনে হয়…’
‘…প্লিজ এ তথ্য পৃথিবীতে রিলে করবেন। জিয়াং তিন ঘন্টা আগে ধ্বংস হয়ে গেছে। একমাত্র আমিই জীবিত। আমার স্যুট রেডিও ব্যবহার করছি জানি না এটার যথেষ্ট রেঞ্জ আছে কি না কিন্তু এটাই একমাত্র সুযোগ। প্লিজ, মনোযোগ দিয়ে নুন। ইউরোপায় জীবন আছে। আমি আবার বলি, ইউরোপার জীবনের অস্তিত্ব আছে…’
‘…স্থানীয় মধ্যরাতের ঠিক পরে। আমরা নিয়মিত পাম্প করছিলাম। প্রায় অর্ধেক ভরে গেছে ট্যাংকগুলো। ডক্টর লি আর আমি পাইপ ইনসুলেশন চেক করার জন্যে বাইরে গিয়েছিলাম। জিয়াং দাঁড়িয়ে আছে- দাঁড়িয়ে ছিল- এ্যান্ড ক্যানেলের সীমানার প্রায় ত্রিশ মিটার দূরে। পাইপগুলো সরাসরি এখান থেকে নেমে নিচের বরফের মধ্যে ঢোকে। বরফ আবার খুব পাতলা হাঁটার মতো নিরাপদ নয়। পাইপের পানি অবশ্য গরম…’।
..কোন ব্যাপার না- পাঁচ কিলোওয়াট আলো জ্বালিয়ে জাহাজের উপর টানালাম। ক্রিস্টমাস ট্রির মতো সুন্দর চককে আলো ঠিক বরফের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছিল নিচের পানিতে। চমৎকার রঙ। লি-ই প্রথম দেখে-এক বিশাল কালো পিন্ড গভীর থেকে উঠছে উপরের দিকে। প্রথম প্রথম আমরা মনে করেছিলাম মাছের বিরাট কোনো ঝাক হবে- একক প্রাণিসত্তার হিসেবে খুব বড় তো- তারপর জিনিসটা এগিয়ে এল বরফের ভিতরে দিয়ে জোর করে পথ বানিয়ে নিয়ে।
‘ডক্টর ফয়েড, আশা করি আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন। আমি প্রফেসর চ্যাং-আমরা মিট করেছিলাম দু হাজার দু সালে, বোস্টন আই. এ. ইউ. কনফারেলে।
‘…ভেজা সমুদ্রশৈবালের চুলের মতো হামাগুড়ি দিচ্ছিল বরফের উপর। লি ক্যামেরা আনার জন্যে জাহাজের পেছনে যায়- আমি লক্ষ্য করছি, একই সাথে রিপোর্ট কহি রেডিওতে। জিনিসটা এত আস্তে আস্তে চলছিল যে আমি দৌড়ে একে ছাড়িয়ে যেতে পারতাম সহজে। সতর্ক হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি উত্তেজিত ছিলাম। ভাবলাম এটা কী ধরনের প্রাণি আমি জানি। ক্যালিফোর্নিয়ার কাছাকাছি বড় সামুদ্রিক গুলু বনের ছবি আমার দেখা কি আমার খুব বড় ভুল হয়ে গিয়েছিল।
‘… প্রাণিটার কোনো না কোনো সমস্যা ছিল, আমি শিওর। এর সাধারণ পারিপার্শ্বিক অবস্থার চেয়ে একশ পঞ্চাশ ডিগ্রী কম তাপমাত্রায় বেঁচে থাকা অস । সামনে আসার সময় জমে কঠিন হয়ে গিয়েছিল- ছোট ছোট টুকরো আলাদা হয়ে যাচ্ছিল কাঁচের মতো। কিন্তু তখনো জাহাজের দিকে এগুচ্ছেই। কালো সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস সব সময়ই মহর মনে হয়।
‘আমি তখনো এত বিস্মিত যে সোজাসুজি চিন্তা করতে পারিনি। কল্পনাই করতে পারিনি এটা কী করার চেষ্টা করছে…’
‘…জাহাজের উপর উঠে এগিয়ে যাবার সাথে সাথে তৈরি করে বরফের এক সুড়ঙ্গ। সম্ভবত জিয়াংয়ের উষ্ণতা দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চায়-মাটির ছোট করিডোরে উইপোকা যেমন আটকা পড়ে যায়, তেমন করে শিপও এর ঘোরটোপে পড়ে গেল।’
‘…জাহাজের উপর টনকে টন বরফ জমেছে। রেডিও এন্টেনা বন্ধ হয়ে গেছে প্রথমবারের মতো। তারপর দেখতে পেলাম নামতে থাকা পাগুলো সৰ কুঁচকে যেতে শুরু করে; দুঃস্বপ্নের মতো ধীর গতিতে।
শিপ নড়বড় হয়ে পড়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমি বুঝতেই পারিনি জিনিসটা কী করার চেষ্টা করছে তখন আর সময় নেই। ঐ লাইটগুলো বন্ধ করে দিলেই নিজেদের আমরা রক্ষা করতে পারতাম।’
‘সম্ভবত প্রাণিটা আলোতে সক্রিয় হয়, এবং বায়োলজিক্যাল আবর্তনে সূর্যের আলো পড়লে হয়ত এ অদ্ভুত জিনিসটা হিংস্র হয়ে পড়ে। সেই আলো বরফের মধ্য দিয়ে বিশোধিত হয়ে প্রবেশ করে ভিতরের জগতে। আলোর প্রতি পতঙ্গের মতো আকৃষ্ট হতে পারে এটা। আমাদের ফ্লাডলাইট অবশ্যই ইউরোপা এ পর্যন্ত যা দেখেছে তার চেয়ে অনেক অনেক উজ্জ্বল…’
‘তারপর ভেঙে গেল শিপ। আমি নিজের চোখে জাহাজের কাঠামো লৰালৰিভাবে টুকরা হতে দেখলাম। তুষার ফলকের এক মেঘ ঘন ঘন আর্দ্র করে তোলে চারপাশকে। দু মিটার উপরে ক্যাবলে ঝুলছিল একটা বাতি। বাকি সবগুলো নিভে গেল সামনে পেছনে দুলতে দুলতে।’
‘জানি না কী হল এর পর। আমার আর কী করণীয়? জাহাজের ধ্বংসস্তূপের পাশে লাইটের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। সূন্স ফ্রেশ বরফের পাউডারে আমি আবদ্ধ। এর মধ্যে আমার জুতার ছাপ খুব স্পষ্ট দেখতে পেলাম। অবশ্যই সেখানে হেঁটেছি সম্ভবত মাত্র এক বা দুমিনিট পর। হিতাহিত জ্ঞান ছিল না।’
‘চারাগাছটা- আমি এখনো এটাকে ঝাকড়া চারাগাছ হিসেবে ভাবি। জিনিসটা ছিল স্থির। অবাক চোখে দেখি এটা ধ্বংস হচ্ছে আঘাতে আঘাতে, বড় বড় কাটা অংশ মানুষের হাতের মতো ঘন টুকরো টুকরো হয়ে শাখা প্রশাখার মতো ছিটকে পড়ল।
‘তারপর আবার চলতে শুরু করে প্রধান কাভটা। স্পেসশিপের কাঠামো থেকে নিজেকে টেনে বের করে আমার দিকে হামাগুড়ি দিতে শুরু করলে আমি নিশ্চিতভাবে জানলাম যে সেটা আলোতে প্রতিক্রিয়াশীল। দাঁড়িয়ে ছিলাম হাজার ওয়াট বাতির ঠিক নিচে। জিনিসটা এখন বন্ধ করেছে নিজেকে দোলানো।
‘একটা ওক গাছের সাথে এর মিল এখনো দেখতে পাই যেন, কোনো বটগাছ বহুশাখা এবং মূল নিয়ে মধ্যাকর্ষণে চিড়েচ্যাপ্টা হলে যেমন দেখায় তেমন। বরফ ঘেঁষে চুপিসারে চলতে চেষ্টা করছিল জিনিসটা। আলোর পাঁচ মিটারের মধ্যে পৌঁছে আমার চারদিকে এক নিখুঁত বৃত্ত তৈরি করে নিজেকে ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। বোঝাই যায় সে এলাকাই ওটার সহ্যক্ষমতার সীমা- আরো সামনে তার আলোক আকর্ষণ হয়ত অরুচিকর। তারপর কয়েক মিনিটের জন্যে কিছুই হয়নি, আমি বরং ভাবছি মরে জমে কঠিন হয়ে গেল কিনা।’
তারপর দেখলাম বিরাট বিরাট মুকুল গঠিত হতে শুরু করেছে অনেক শাখা প্রশাখা সহ। অনেকক্ষণ। ফুল ফুটতে দেখার মতো ধৈর্য নিয়ে বসে থাকতে হল আমাকে। আসলে ভাবছিলাম আকৃতির কথা। এক একটা ফুল মানুষের মাথার মতো বড়। কোমল, সুন্দরভাবে রঙিন ঝিল্পি ভাজ ভাঙ্গতে শুরু করে। এমনকি তখনও মনে হল যে, কোনো মানুষ বা প্রাণী এর আগে এমন রঙ কক্ষনো দেখেনি। এত রঙের অস্তিত্বই থাকত না যদি আমাদের লাইট-আমাদের প্রাণনাশক লাইট এ দুনিয়ায় বয়ে না আনতাম।
চারদিকে আস্তে আস্তে দুলছে পুংকেশর… জীবন্ত দেয়ালের উপর দিয়ে হাঁটলাম যাতে ব্যাপারটা ঠিকমত দেখতে পারি। আমি ঐ প্রাণীকে সামান্যতম ভয় পাইনি কখনোই। শিওর ছিলাম, এটা পরশ্রীকাতর না- যদি তাই হয়ে থাকে তবে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করত। ও আমার অস্তিত্ব টের পায় ভালভাবেই।’
‘বড় ফুলগুলোর স্তরে স্তরে ভাজ ভাঙার খাজ। এবার এরা মনে করিয়ে দেয় প্রজাপতির কথা, যা এইমাত্র শুয়োপোকার আবরণ থেকে বেরুল- ডানায় ভাজ ভাজ চিহ্ন, এখনো ক্ষীণ- আমি কমেই সত্যের কাছাকাছি যাচ্ছিলাম।’
মুকুলগুলোর মধ্যে কিছু কিছু যত তাড়াতাড়ি গঠিত হয় জমেও যায় তত তাড়াতাড়ি যায় মরে। তারপর মূল মুকুল থেকে একের পর এক ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে এগুলো কনো ভূমিতে মাছের আঁশের মতো ভেঙ্গে পড়ল এলোপাথাড়ি। চারদিকে। অবশেষে বুঝতে পারলাম এগুলো কী। ঐ ঝিল্লিগুলো পাপড়ি না- জলজপ্রাণির ডানা বা তার সমমানের একটা কিছু। মুক্তভাবে সাঁতার কাটার জন্যে ঐ প্রাণীর একটাত্তর। অনেকটা ডানার মতো। হয়ত জীবনের বেশিরভাগ কাটিয়ে দেয় সগর্তে শিকড় গেড়ে, তারপর এ চলমান বাচ্চাদের নতুন এলাকা খুঁজে বের করার জন্য পাঠায়। ঠিক যেমনটা করে পৃথিবীর মহাসাগরের প্রবাল।
‘ছোট্ট প্রাণির একটাকে কাছে থেকে দেখার জন্যে আমি হাঁটু গেড়ে বসলাম। সুন্দর রঙ ম্লান হচ্ছিল তখন। বৈচিত্র্যহীন বাদামি রঙ বেরিয়ে পড়ে। পাপড়ি-ডানার কিছুটা হঠাৎ করে জমে যাওয়ায় ভেঙে পড়ে ভঙ্গুর মাটির পাত্রের মতো। প্রাণীটা তখনো ক্ষীণভাবে নড়ছিল, এমনকি আমি সামনে গেলে আমাকে এড়িয়ে গেল। আমিতো অবাক! এটা কীভাবে আমার উপস্থিতি বোঝে?’
তারপর দেখতে পাই পুংকেশরগুলো… এ নামেইতো ডেকেছিলাম- এদের ডগার উপরে উজ্জ্বল নীল ফোঁটা ধরে রেখেছে। দেখতে ঠিক ছোট উজ্জ্বল নীল রঙা তারার মতো অথবা ঝিনুকের আবরণের সাথে নীল চোখের মতো সেগুলো আবার আলো থেকে সাবধান, কিন্তু সত্যিকারের মুড নিতে পারেনি। তারপর উজ্জ্বল নীল ম্লান হয়ে যায়, সাধারণ পাথরের মতো…’
‘ডক্টর ফ্লয়েড অথবা অন্য যে কেউ শুনছেন… আশা করি কেউ না কেউ শুনতে পাবেন আমার কথা, হাতে খুব একটা সময় নেই, বৃহস্পতি কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সিগন্যাল ব্লক করবে। আমার কথা অবশ্য প্রায় শেষ।
‘জানি এরপর আমার কী কাজ। হাজার ওয়াট বাতির তারটা ঝুলছিল মাটির কাছাকাছি। হ্যাঁচকা টান দেয়ার পর লাইটটা নিভে গেল একটু স্পার্ক করে। অনেক দেরি হয়ে গেছে কিনা ভেবে আমি ভয় পেয়েছি কিছুটা। কিছুক্ষণ কিছুই হয়নি। সুতাং মনের ঝাল ঝাড়তে চারদিকের জট পাকানো শাখাপ্রশাখার দেয়ালের উপর হাঁটতে হাঁটতে লাথি লাগালাম কষে।
ধীরে ধীরে প্রাণিটা শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে নেয় গ্র্যান্ড ক্যানেলে ফিরে যাওয়ার জন্য। অনেক আলো থাকার কারণে আমি সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। বৃহস্পতির দু উপগ্রহ গ্যানিমিড আর ক্যালিটো আকাশে ভাসে আর গ্রহরাজ বৃহস্পতি দেখায় পাতলা এক চাঁদের মতো। আইওর ঘুরতে থাকা শেষপ্রান্ত বৃহস্পতির দিকে ফিরানো। উপগ্রহটার রাতের আকাশে মেরুজ্যোতির ফুলঝুরি ফুটেছিল। কোনো প্রয়োজন ছিল না আমার হেলমেট লাইট ব্যবহার করার। আমি বেশ আগ্রহের সাথে দৌড়াই জীবটার পিছনে। একটু ধীর হয়ে এলেই লাথিও দিই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে; অনুভব করি বুটের নিচে বরফ ভাঙার কড়মড় শব্দ… ক্যানেলের কাছাকাছি যেতেই মনে হল এটা শক্তি পেয়েছে আরো। ঠিকই, সে ফিরছে নিজের বাড়িতে। ভয় পাচ্ছিলাম এবার একটু একটু। আবার মুকুল সৃষ্টির জন্য বেঁচে থাকতে পারে। শত্রু এলাকায় কিছু মৃত লার্ভা রেখে সে চলে গেল পানির উপর দিয়ে। খোলা পানিতে কিছুক্ষণের জন্য বুদবুদ উঠল যে পর্যন্ত বরফের একটা চাদর পানির স্তরটাকে শূন্যতা থেকে সরিয়ে না আনে। দৃষ্টি সরিয়ে ফিরে গেলাম শিপের কাছে। যদি কেউ বেঁচে থাকে… এ নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। আমার শুধু দুইটা অনুরোধ আপনার কাছে, ডক্টর। যখন ট্যাক্সোনমিস্টরা প্রাণীটাকে শ্রেণীভুক্ত করবে, আশা করি নামটা হবে আমার নামে।
আর… ডক্টর… প্লিজ… পরের শিপ আসার সময় তাদের একটু বলে দেখবেন- আমাদের কঙ্কাল যাতে চীনে নিয়ে যায়। মাইনাস একশো পঞ্চাশ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে আমরা পচে যাব না। আর… আমার বাসায় আছে ছোট্ট… না, থাক। যা বলছিলাম, বৃহস্পতি আমাদের ধ্বংস করে দিবে কয়েক মিনিটের মধ্যে। আশা করি এবং আমার বিশ্বাস কেউ না কেউ আমার কথাগুলো শুনছে। যাই হোক, যোগাযোগ করার সুযোগ পেলে এ মেসেজ আবার পাঠাব- অবশ্য আমার স্পেস স্যুট যদি তখনো টিকে থাকে।
ইউরোপা থেকে প্রফেসর চ্যাং মহাকাশ যান জিয়াং ধ্বংসের প্রতিবেদন দিচ্ছি। আমরা ল্যান্ড করলাম গ্র্যান্ড ক্যানেলের পাশে। আমাদের পাম্পগুলো বসানো হয় বরফের কিনারায়…’
২৮. ছোট্ট সূর্যোদয়
মিস লিঙ্গল
রেকর্ড
সূর্য আসছে উঠে। অবাক ব্যাপার কী দ্রুত এ উঠে আসা ধীর গতির স্বনে। অবশ্যই, এ ছোট দুনিয়ায় সূর্য দ্রুত উঠবে… আপনারা এদিকে তাকিয়ে আছেন বলেই অন্যদিকে আলো দেখতে পান না, নাহলে বোঝা যেত, আলোর তেমন হেরফের নেই।
আশা করি ইউরোপারা টের পায়। ছোই সূর্যোদয়ের পর এগিয়ে আসতে সময় নেয় তারা মোটামুটি মিনিট পাঁচেক। কে জানে আমার উপস্থিতি ধরা পড়ে গেছে কিনা- তারা আসতে ভয় পাচ্ছে কিনা…
না- হয়ত অন্য পথ ধরেছে। আগন্তককে দেখার ইচ্ছা জেগেছে মনে… আশা করি আর কী!
আসছে তারা! আসছে। আপনাদের স্পাইস্যাট দেখছে তো? ফ্যালকনস ক্যামেরা রেকর্ডিং..
কী ধীর তাদের গতি। আমি নিশ্চিত, তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টাটা অনেক বিরক্তিকর হবে, আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেও….
জিয়াকে মুড়ে দেয়া প্রাণিটার মতোই, আকারে অনেক ছোট,.. ঠিকই, ছোট গাছের কথা মনে পড়ে যায়। আধ ডজন ছোট কান্ড দিয়ে এগিয়ে আসছে। শত শত শাখা। আরো বিভক্ত, আরো বিভক্ত… আরো। আমাদের জেনারেল পারপাস রোবটের মতো বলা চলে…
মানুষের আকৃতি নকল করা যে অকার্যকর তা ভেবে বের করতে আমাদের কত সময় লাগল। কাজের গতি পেতে হলে অনেক অনেক হোট প্রত্যঙ্গ লাগবে। আমরা যখনি কোনো কিছু আবিষ্কার করে গর্বিত হই, তখনি দেখতে পাই প্রকৃতি মাতা আগেই তা করে রেখেছে….
হোটগুলো কী কিউট, তাই না? ঝাঁকড়া ঝোঁপের মতো। কীভাবে প্রজনন করে? বাডিংয়ের মাধ্যমে আগে বুঝিনি, কী সুন্দর তারা। কোরাল রিফের মাছের মতোই বর্ণিল, রঙিন। সম্ভবত একই কারণে… সঙ্গীর খোঁজে, অথবা ক্ষুধার তাড়নায়…
বলেছিলাম নাকি, তারা ঝোঁপের মতো দেখতে? কথাটাকে বদলে নিন, গোলাপের ঝাড়। গায়ে কাঁটার মতো অংশ আছে, কারণও আছে এর পিছনে, আমরা জানি না…
হতাশ হলাম। আমাকে খোঁড়াই পরোয়া করছে তারা। সবাই চলছে নগরীর দিকে, যেন স্পেসক্রাফট দেখে দেখে চোখ বিষিয়ে গেছে, আর দেখে কী হবে… একটু বামে… হয়ত এবার কাজে লাগবে… আশা করি শব্দতরঙ্গ চিনতে পারে বেশিরভাগ সামুদ্রিক প্রাণিই পারে- কে জানে, এ পাতলা বায়ুমন্ডল আমার কণ্ঠকে বেশিদূর নিয়ে যাবে কিনা…
ফ্যালকন- এ্যাটারনাল স্পিকার…
.
হ্যালো, শুনতে পাচ্ছ আমাকে? নাম আমার ফ্র্যাঙ্ক পোল… উহ.. আমি শাক্তি নিয়ে এসেছি সমগ্র মানবজাতির পক্ষ থেকে…
আমি কি বোকা বনে গেলাম? এর চেয়ে ভাল আর কোনো পথ পাচ্ছি না। যোগাযোগের। রেকর্ডের জন্য ব্যাপারটা ভালই…
কারো কোনো উত্তেজনা নেই। বড়-ছোট সবাই এগিয়ে যাচ্ছে ইগলুর দিকে। সেখানে গিয়ে কী কর্মটা করে কে জানে! সম্ভবত ফলো করতে হবে আমাকে সম্ভবত কোনো ভয় নেই, আমি তাদের তুলনায় অনেক বেশি গতিশীল
হঠাৎ স্মৃতি এল মনের গহিন থেকে। সব দায়িত্ব ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে নেয়ার আগের কথা মনে পড়ে। সব প্রাণি এক দিকে যাচ্ছে- অফিস-বাসা অফিস-বাসা করা ছকবাঁধা জীবনের মানুষের মতো লাগছে তাদের।
সবাই হারিয়ে যাবার আগে আরেকবার চেষ্টা করা যাক…
.
হ্যালো দেয়ার-ফ্র্যাঙ্ক পোল বলছি, পৃথিবী নামের এক সবুজ গ্রহ থেকে এসেছি আমি। শুনতে পাচ্ছ আমার কথা?
আমি তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি, ফ্র্যাঙ্ক। দিস ইজ ডেভ।
২৯. মেশিনে ভূত
প্রথম মুহূর্তে ফ্র্যাঙ্ক পোল বিস্ময়ে থ বনে যায়। তারপরই শিহরণ বয়ে যায় শরীরে। আসলে যোগাযোগের ব্যাপারে মনে কখনো নিশ্চয়তা ছিল না। ইউরোপাদের সাথে, মনোলিথের সাথে বা ডেভ বোম্যানের সাথে যোগাযোগের কোনো আশাই ছিল না। কিছুক্ষণ আগেও আক্ষেপের সাথে চিৎকার করেছিল মহাপ্রাচীরের দিকে তাকিয়ে, বাড়িতে কেউ আছেন?
হ্যাঁ, এত অবাক হবার f, কোনো না কোনো বুদ্ধিমত্তা নিশ্চয়ই তার গ্যানিমিড থেকে আসার ব্যাপারটা টের পায়। এখানে নামার অনুমতি দেয়। টেড খানের কথা আরো সিরিয়াসভাবে নেয়া উচিৎ ছিল।
‘ডেত, ধীরলয়ে বলে সে, সত্যি তুমি?
আর কে হবে? মনের এক অংশ প্রতিবাদ করে। তবু, প্রশ্নটা একেবারে বোকার মতো করা হয়নি। কণ্ঠে একটু যান্ত্রিকতার সুর, যেন কোনো মানুষের কথা নয়,
অর্পিত ব্যাপার। আসছে ফ্যালকনের ছোট কন্ট্রোল বোর্ভ স্পিকার থেকে।
হ্যাঁ, ফ্র্যাঙ্ক, আমি ডেভ।
একটু নিরবতা। তারপর একই কষ্ঠ কথা বলে ওঠে।
হ্যালো, ফ্র্যাঙ্ক। আমি হাল।
* * *
মিস প্রিঙ্গল
রেকর্ড
আসলে- ইন্দ্রা, দিম- আমার ভাল লাগছে, সব রেকর্ড করেছিলাম, নাহলে কখনোই আমার কথা বিশ্বাস করতে না…
মনে হয় এখনো ধাতে সয়নি ব্যাপারটা। হাজার হলেও, আমি কী করে এমন কাউকে বন্ধু ভেবে নিই যে আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল প্রায় সফলভাবে, হোক হাজার বছর আগে…এখন বুঝতে পারি, হালকে দোষ দেয়া যায় না। দোষ দেয়া যায় না কাউকে। ভাল ধরনের এক উপদেশ আমি সব সময় মনে রাখি, ‘অসম্পূর্ণতাকে কখনো দোষ দিওনা।
আমি কী করে অজানা অচেনা প্রোগ্রামারদের দোষ দিই?
ঠিক ধাতস্থ হতে পারিনি। কিছুক্ষণের জন্য ডেকে চলে যেতে বলেছিলাম, তার সাথে দেখা করার জন্য এত অন্যায়, ষড়যন্ত্র আর কষ্ট করার পরও। মনে হয় না আঘাত দিয়েছি, ভিন্ন কিছুতে পরিণত হবার পর তার ভিতরে ফিলিংস বলে কিছু আছে, তা হতে পারে না…
সে কী- ভাল প্রশ্ন। সে আসলেই ডেভ বোম্যান- কি অনেকটা বইয়ের সারাংশের মতো। তুমি জান একটা এ্যাবস্ট্রাক্ট কী করে সব তথ্য বহন করতে পারে কিন্তু লেখকের মনোভাবের বিন্দুমাত্র চিহ্ন বহন করে না। কিন্তু কখনো কখনো মনে হয়েছে। পুরনো ডেভের ছিটাফোঁটা মনে হয় আছে তার ভিতরে। আমার সাথে দেখা হওয়ায় তার ভাল লেগেছে কিনা তা বলতে পারব না, একেই বলে সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া। একটু সন্তুষ্ট… এটুকু বোঝা যায়। আর আমার কথা বলতে গেলে? আমি এখনো কনফিউজড। একবার ভেবে দেখ, অনেকদিন পর দেখা হল পুরনো বন্ধুর সাথে, তারপর উপলব্ধি করলে, সে আর সেই মানুষটা নেই। বদলে গেছে। আমাদের সময় পার্থক্যওতো হিসাবে ধরতে হবে- হাজার বছর। তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার সামান্য সামান্য অংশ নিয়ে কথা বলেছে। আমার মাথা গুলিয়ে গেছে আরো।
আর হাল- সেও এখানে ছিল, সন্দেহের প্রশ্ন ঠে না। বেশিরভাগ সময় আমি ধরতে পারিনি কে কথা বলছে। কোনো কোনো মেডিক্যাল রেকর্ডে মাল্টিপল পার্সোনালিটির কথা থাকে না? ব্যাপারটা তেমন।
প্রশ্ন করেছিলাম কী করে এমন হল- আর সে- তারা- ড্যামইট। হালম্যান ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। আগেই বলে রাখি, ভুল হতে পারে, কিন্তু এ হাইপোথিসিসে এসে পৌঁছেছি।
অবশ্যই- এ মনোলিথগুলোই চাবি। না ভুল বললাম, শুধু চাবি না। তাদের কাজ আরো ব্যাপক। কে যেন বলেছিল, এরা কসমিক সুইস আর্মি নাইফ? সকল কাজের কাজি? তোমরা এখনো এগুলো ব্যবহার কর, আমি দেখেছি, যদিও সুইজারল্যান্ড আর তার সেনাবাহিনী অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। এ হল জেনারেল পারপাস ডিভাইস। যা দরকার তার সবই করতে পারে। অথবা যা করার জন্য প্রোগ্রাম করা হয়েছে তার সবই…।
আফ্রিকায় ফিরে যাও, মোটামুটি চল্লিশ লাখ বছর আগে, এটাই আমাদের কোমরে বিবর্তনের সাথি কষিয়েছিল, তা কাজটা ভাল হয়ে থাক আর খারাপ… তারপর আমরা দোলনা থেকে বেরিয়ে আসব, এসে চাঁদে তার সঙ্গীকে খুঁড়ে বের করব, সে আসায় ঘাপটি মেরে বসে ছিল। আন্দাজ করেছি আগেই, পরে ডেভ স্বীকার করল আর কী!
বলেছি না, মানবিক অনুভূতিগুলো তেমন আর নেই, তোতা হয়ে গেছে একটা ব্যাপার কিন্তু এখনো নষ্ট হয়নি, বরং বেড়েছে- সে শিখতে চায়। অনেক শিখতে চায়। শিক্ষার কী বিচিত্র সুযোগ এখন তার হাতে।
বৃহস্পতির মনোলিথ তাকে শুষে নেয়ার পর ভাল কোনো শব্দ পেলাম না, শুষে নেয়াই থাক অনেক কিছু পেয়ে গেল। এটা তাকে ব্যবহার করেছিল দখল করা জিনিসের মতো–পৃথিবীকে বিশ্লেষণ করার উপায় হিসাবে। সেও এটা ব্যবহার করছে। হালের সহায়তা নিচ্ছে। হাল ছাড়া সুপার কম্পিউটারের ধারা আর কে ভালভাবে বুঝবে? দুজনে মিলে মনোলিথের সমস্ত স্মৃতি চষে ফেলছে, উদ্দেশ্য খুঁজে বের করবে। বের করবে লক্ষ্য।
এখন, একটা ব্যাপার বিশ্বাস করা কষ্টকর। মনোলিথ অসম্ভব শক্তিমান যন্ত্র বৃহস্পতির কী হাল করেছে একবার ভেবে দেখ!- কিন্তু এই সব। চলছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। কোনো চেতনা নেই। নেই কোনো জৈব অস্তিত্ব আমরা যাকে মন বলি আর কী- তা নেই। আমি যে গ্রেট ওয়ালকে কষে লাথি দেয়ার চিন্তা রেখে বলতে চাই, কেউ আছে এখানে।
আসল জবাব হল, কেউ ছিল না। হাল আর ডেভ ছাড়া কোনো অস্তিত্ব নেই সেখানে…
আরো খারাপ খবর হল, এর কিছু কিছু সিস্টেম বিগড়ে যাওয়া শুরু করেছিল; ডেভ সিদ্ধান্তে পৌঁছে, জিনিসটা অকাটমূর্থে পরিণত হচ্ছে। কারণ, চার মিলিয়ন বছর মুখের কথা নয়, এখন একবার সার্ভিস চেক করা উচিৎ।
তার সিদ্ধান্ড, মনোলিথ একবার হলেও ভুল কাজ করেছে। শব্দটী জুতসই নয়, হয়ত তার বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তে সামান্য হেরফের হয়ে গেছে…
যে হিসাবেই দেখ না কেন, খবরটা ভীতিকর। হাজার বছর আগের কথায় আবার ফিরে যাই। লিওনভ উড়ে গেল বৃহস্পতির এলাকায়। এত সময়ের মধ্যে কেউ ধারণাও করেনি…
আমাকে ব্রেইনক্যাপের সাথে যুক্ত করে দেয়ায় অনেক ধন্যবাদ। অবশ্যই, জিনিসটা অমূল্য, এ ছাড়া জীবনের কথা এখন ভাবা যায় না। কিন্তু এখন, এটা এমন এক কাজ করছে যা করার কথা ছিল না, যা করার জন্য ডিজাইন করা হয়নি। কিন্তু কাজটা করছে ভালভাবেই।
হালম্যানের দশ মিনিট সময় লেগে গেল এর কাজের ধারা বের করে একটা ইন্টারফেস যোগ করতে। এখন আমাদের যোগাযোগ হচ্ছে মন থেকে মনে। এখন কাজের গতি বেড়ে গেল, বেড়ে গেল বোঝার গতি। সেই সাথে বেড়ে গেল তাদের কথার গতি। বারবার থামিয়ে থামিয়ে আমি মনে করিয়ে দিলাম, আরো ধীরে কথা বলতে হবে…
এখানেই আসল ব্যাপার। আমার মনের মধ্যে ডেভ ঢুকিয়ে দিল মনোলিথের সেই স্মৃতি যখন সে ডেভকে গ্রাস করছে। মনোলিথের সমস্ত চিন্তা-চেতনা কর্মপদ্ধতি চলে এল। আবার জিজ্ঞেস করোনা কী করে করল তারা কাজটা! পাঠিয়ে দিয়েছি তোমার ব্রেইনক্যাপে, পাঠিয়ে দিয়েছি গ্যানিমিডে। এবার তোমরা সেসব নিয়ে ভেবে মরা ডাউনলোড করতে গিয়ে আবার বিষম খেয়োনা।
ওভার টু ডেভ বোম্যান এট জুপিটার, আর্লি টুয়েন্টি ফাস্ট সেঞ্চুরি…
৩০. তাসের ঘর
লাখ কিলোমিটার লম্বা চৌম্বক শক্তির রেখা, বেতার তরঙ্গের আচমকা বিস্ফোরণ, পৃথিবীর চেয়ে চওড়া ইলেক্টিফাইড প্লাজমার ঝর্ণা- এসবই তার কাছে এত স্পষ্ট যতটা স্পষ্ট দেখা যায় নানা রঙে বর্ণিল মেঘে ঢাকা গ্রহের আকাশ। জটিল গড়নগুলো বুঝতে পারে সে, বুঝতে পারে এদের মধ্যকার সম্পর্ক। কেউ কখনো ভাবেনি এতটা সুন্দর আর বিচিত্র হতে পারে বৃহস্পতি।
গ্রেট রেড স্পটের গর্জন করতে থাকা হৃদয়ের ভিতরে চলে যায়। চারপাশে পাক খাচ্ছে মহা লাল বিন্দু সৌরজগতের বৃহত্তম ঝড়, যার ভিতরে তিনটা পৃথিবী রেখে দেয়া যায়। ভিতরে মহাদেশের মতো বিশাল বিশাল সব আলোর ঝলক খেলে যাচ্ছে। জানে, কেন এটা শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে তান্ডব চালাচ্ছে, কেন পৃথিবীর হ্যারিকেনগুলোর মতো থিতিয়ে পড়ে না। হাইড্রোজেন বাতাসের পাতলা চিৎকার হারিয়ে যায় সে আরো নিচে নামার সাথে সাথে। সেখানে হাইড্রোকার্বনের মোমের মতো, ফাপা বিশাল বিশাল সব পর্বত। উপর থেকে ভারি জৈবযৌগ নেমে আসে। থিতু হয় এসব পর্বতমালার গায়ে। তরল পানি থাকার মতো উত্তাপ আছে, কিন্তু সমুদ্রের কোনো অস্তিত্ব নেই। পুরো গ্যাসিয় জগন্টায় পানির জন্য নেই কোনো স্থান।
একের পর এক মেঘস্তর পেরিয়ে যাচ্ছে সে। নেমে যাচ্ছে অনেক নিচে। এরপর এমন এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছল যেখানে মানুষের চোখও হাজার কিলোমিটার চষে ফেলতে পারবে। এটাই গ্রেট রেড স্পটের গভীরতম বিন্দু। মানুষ ধারণা করেছে, কিন্তু জানতে পারেনি কী আছে এখানে।
পাহাড়ের পাদদেশে চড়ে বেড়ায় মোটামুটি এক আকৃতির, ছোটখাট মেঘখন্ড। লাল আর ধূসর রঙ তাদের। বৃহস্পতিয় হিসাবে একেবারে ছোটছোট। এক একটা ছোট নগরীর আকারের।
তারা জীবন্ত। দেখেই বোঝা যায়। এগিয়ে যাচ্ছে। স্বচ্ছন্দ্যে সামনে যাচ্ছে ধীরলয়ে। বৃহস্পতির ভাঙ্গাগড়ার আওয়াজ ছাপিয়ে মিটার ব্যান্ডে পরস্পরের ডাকাডাকি টের পাওয়া যায়।
জীবন্ত গ্যাসব্যাগ। এরা উড়ার মতো উচ্চতায় থাকতে পারে, সীমার বাইরে না আবার নামতে পারে কিছুটা নিচে, বেশি নামলে ওজনের চাপে প্রাণ হারাবে। কিন্তু এ সামান্য এলাকাই পৃথিবীর সমস্ত জীবজগতের চেয়ে বড়।
শুধু তারাই নেই এখানে। তাদেরই মাঝে চড়ে বেড়াচ্ছে দ্রুতগামী আরেক ধরনের জীব। আকারে অনেক ছোট। পৃথিবীর বিমানের মতো হবে। তারাও জীবন্ত। সম্ভবত শিকারী, হয়ত পরজীবী, হয়ত নিয়ম্ভা- কে জানে।
ইউরোপার বিস্ময় যেমন নতুন, তেমনি বিবর্তনের একেবারে নতুন এক অধ্যায় খুলে যাচ্ছে চোখের সামনে। পার্থিব সমুদ্রের স্কুইডের মতো জেট প্রোপেন্ড টর্পেডো আছে, ছিঁড়েখুঁড়ে দিচ্ছে বিশাল বিশাল গ্যাসব্যাগগুলোকে। কিন্তু বেলুনগুলোও অসহায় নয়, তাদের কারো কারো আছে ইলেক্ট্রিক শক দেয়ার ক্ষমতা, কিলোমিটার লম্বা চেইনস’র অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আছে।
জ্যামিতির প্রতিটা সম্ভাবনা অনুসারে আছে আরো বিচিত্র সব আকৃতি। অসামঞ্জস্যপূর্ণ গড়ন, ঘুড়ি, চতুর্ভুজ, ছ-তলকীয়, বহুতলকীয়, ভজ খাওয়া ফিতা… বৃহস্পতিয় বায়ুমন্ডলের দানবীয় প্যাটনগুলো উপরে উঠতে থাকা বিদ্যুতের প্রবাহের সাথে উঠে যায়। সেখানেই প্রজন্মান্তর ঘটে, তারপর নেমে আসে কখনো কখনন, মৃত্যুর সময় হলে। বিভাজিত হয়ে যায়, মিশে যায় প্রকৃতির সাথে, তারপর আবার কাজে লাগে প্রাণ সৃষ্টিতে।
পৃথিবীর এলাকার চেয়ে শতগুণ বিস্তৃত এক জগত দেখছিল সে। অনেক বিস্ময় থাকলেও বুদ্ধিমত্তার ঝিলিক নেই কোথাও। বিশালবপু গ্যাসবেলুনগুলোর রেডিও ভয়েস ভয় আর সতর্কতা বহন করে, এর চেয়ে বেশি কিছু না। এমনকি শিকারিগুলোর আরো উন্নত হবার কথা থাকলেও আদতে তারা পৃথিবীর হাঙরগুলোর মতোই। মাথাহীন শিকারী।
শ্বাসরুদ্ধকর বিশালতা থাকলেও বৃহস্পতিয় জগতের সবকিছুই একেবারে ভজুর। কুয়াশা আর ফোমের আধিপত্য এখানে। সিল্কের মতো জৈববস্তু, কাগজের মতো পাতলা টিস্যু পাওয়া যাবে এখানে অনেকটাই তৈরি হয় উপরের বজ্রের কারণে। বেশিরভাগই সাবানের ফেনার মতো। পার্থিব মাংসাশির এক থাবায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে মুহূর্তে।
ইউরোপার মতো এটাও একই সাথে জন্মভূমি আবার কবরখানা। কখনো সভ্যতার উন্মেষ দেখা যাবে না। একেবারে খাঁটি বায়বীয় সংস্কৃতি জন্ম নিতে পারে, কিন্তু যেখানে আগুন জ্বলে ওঠা অসম্ভব, যেখানে কঠিন বস্তু থাকবে না, সেখানে সভ্যতা দূরের কথা, প্রস্তর যুগও আসবে না কখনো।
৩১. নার্সারি
মিস প্রিঙ্গল
রেকর্ড
আসলে, ইন্দ্রা- দিম- আমি জানি না এখনো কী ভাবতে হবে। বিশ্বাস করা এখনো কষ্টকর। কী বিচিত্র প্রাণি ছিল সেগুলো। আমরা তাদের দেখা পেতাম কোনো
কোনো কালে। অন্তত রেডিও ভয়েস ধরতে পারতাম একবিংশ শতাব্দিতেই বুঝতে পারি আর না পারি। বৃহস্পতিকে একটা সূর্যে পরিণত করার জন্য সব ঝেড়েমুছে সাফ করে দেয়া হল।
এখন আমরা জানি, কেন। ইউরোপাদের সুযোগ করে দেয়ার জন্য। কী বিচিত্র যুক্তি বুদ্ধিমত্তাই কি একমাত্র আরাধ্য? আমি দেখতেই পাচ্ছি, টেড খানের সাথে অনেক যুক্তিতর্ক হবে এসব নিয়ে
পরের প্রশ্ন হল, ইউরোপারা কি জাতে উঠতে পারবে? নাকি বাকি সময়টা কাটিয়ে দিবে কিন্ডারগার্টেনে- বলা ভাল নার্সারিতে হাজার বছর খুব বেশি সময় না হলেও মানুষ কিছু না কিছু উন্নয়ন আশা করতেই পারে। কিন্তু ডেভের কথা অনুসারে এখনো তারা সমুদ্র ছাড়ার সময়ের পর্যায়েই পড়ে আছে। সম্ভবত এটাই সমস্যা, এখনো সমুদ্রে একটা পা- থুড়ি, একটা গুঁড়ি দিয়ে বসে আছে।
আরো একটা ব্যাপারে খটকা লাগে। আমরা মনে করেছিলাম তারা সমুদ্রে যায় ঘুমানোর জন্য। উল্টো ব্যাপার। সেখানে যায় খাবার জন্য। ভূমি শুধু ঘুমানোর জায়গা। সেই খালের নেটওয়ার্কগুলো আর কিছুই না, প্ল্যাঙ্কটন ফিডার…
ডেভকে প্রশ্ন করেছিলাম, তাহলে ইগলুগুলো যে বানাল সেগুলো কি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন না?
জবাব এল, ঠিক তা না। সাগরের বুকে যে গড়ন গড়ে সেটারই অনুকরণ। নানা শিকারীর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার উপায় মাত্র। বিশেষত উড়ন্ত কার্পেটের মতো একটা প্রাণি আছে, আকারে ফুটবল মাঠের সমান, সেগুলো খুব সমস্যা করে…
মাত্র একটা ক্ষেত্রে তারা কাজের কাজ দেখিয়েছে, আমরা সেগুলোকে সৃষ্টিশীলতাও বলতে পারি। তারা ধাতব বস্তুর প্রতি আগ্রহী। কারণ হয়ত এই যে এগুলো সাগরের বুকে চোখেও দেখে না। এজন্যই জিয়াং কালে পরিণত হয়েছে। একই হাল হয় মনুষ্যবিহীন যানগুলোর।
যোগাড় করা তামা, টাইটানিয়াম, বেরিলিয়াম দিয়ে কী করে? কাজের কাজ কিছুই না। সবটুকু তূপ করে রাখে এক জায়গায়। চমৎকার এক গোল আকৃতি বানায়, সেটার গড়ন বারবার বদলাতে থাকে। সম্ভবত শিল্পসম্মত সৌন্দর্যজ্ঞান বিকশিত হচ্ছে তাদের ভিতরে। মডার্ন আর্টের মিউজিয়ামে এমন দেখেছিলাম আমি… আরো একটা তত্ত্ব মাথায় উঁকি দেয়। কার্গো কান্টের কথা কখনো শুনেছ? বিংশ শতাব্দিতে কিছু কিছু আদিম গোত্র নিজেদের নিজস্বতা বজায় রেখে টিকে ছিল। তারা বাঁশ দিয়ে বিমানের আকৃতি তৈরি করত। একটাই আশা, আকাশ থেকে যে বিচিত্র গর্জনশীল পাখি তাদের উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে উপহার পাঠায় সেগুলোকে আকৃষ্ট করা যাবে। সম্ভবত ইউরোপাদের মধ্যে এ ধারণাই দানা বাঁধছে।
এখন, যে প্রশ্ন করছ তোমরা সর্বক্ষণ… ডেভ কী? আর কী করে সে এবং হাল এমন হল?
আমার সহজ উত্তর, তারা দুজনেই মনোলিথের দানবীয় স্মৃতিতে ডেভ বোম্যান আর হালের সিমুলেশন। বেশিরভাগ সময়ই তারা অকার্যকর থাকে। তার ভাষায়, ঘুমিয়ে থাকে। রূপান্তরিত হবার পর থেকে হাজার বছরের মধ্যে মাত্র বছর পঞ্চাশেক জেগে ছিল।
যখন আমি জিজ্ঞেস করি, এ জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয় কিনা। জবাব দেয়, ‘কেন বীতশ্রদ্ধ হব? আমি আমার কাজ একেবারে ঠিকমত করছি। জবাবটা হালকে মানায়, ডেভ বোম্যানকে নয়, তাই না?
সুইস আর্মি নাইফের সাথে তুলনার কথা মনে আছে তোমাদের? এ মহাজাগতিক ছুরির অসংখ্য অংশের একাংশ এই হালম্যান।
কিন্তু সে একেবারে অকেজো যন্ত্র নয়- জেগে থাকলে, কিছু কিছু নিজস্বতা দেখা দেয়, দেখা যায় স্বাধীনতা- সম্ভবত মনোলিথের নিয়ন্ত্রণের রাশ একটু হাল্কা হয়। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে সে বৃহস্পতি-বিশ্লেষণের যন্ত্রাংশ হিসাবে কাজ করছে। নজর রাখছে গ্যানিমিডের উপর, সর্বোপরি পৃথিবীর উপর। ডেভের পুরনো গার্লফ্রেন্ড, তার মা আর নানাজনের রিপোর্টের ভিত্তি এটাই। আনুবিসেও সেই ঘটনা ঘটিয়েছে।
আরো একটা রহস্যের সুরাহা হয়ে যায় কিন্তু। আমি ডেভকে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলাম, বাকি সবাইকে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে সরিয়ে রাখা হলেও আমাকে ইউরোপায় নামতে দেয়া হল কেন? আমি কিন্তু এটাই আশা করছিলাম।
জবাবটা বোকাটে, একেবারে সরল। মনোলিথ ব্যবহার করেছে ডেভকে হালম্যানকে সময়ে সময়ে। ব্যবহার করেছে আমাদের উপর চোখ রাখার জন্য। আমার উদ্ধারের ব্যাপারটা জানত ডেভ- এমনকি পৃথিবী আর গ্যানিমিড়ে দেয়া আমার মিডিয়া ইন্টারভিউর কিছু কিছু দেখেছে। সত্যি বলছি, আমি এখনো একটু আহত, সে যোগাযোগের কোনো চেষ্টাই করেনি! যাক, আমি আসার পর লালগালিচা তো বিছিয়ে দিয়েছে…
দিম- ফ্যালকন আমাকে নিয়ে বা ছেড়ে উড়ে যাবার আগে আমার হাতে আরো আটচল্লিশ ঘন্টা আছে। আমার মনে হয় না সে সময়ের প্রয়োজন আছে, আমি হালম্যানের সাথে যোগাযোগ করে ফেলেছি; আমরা যে কোনো জায়গায় দেখা করতে পারি। যোগাযোগ করতে পারি আনুবিসে বসেও… সে যদি চায়।
যত দ্রুত সম্ভব গ্যানিমিডে ফিরে যেতে চাই। ফ্যালকন ভাল যান, কিন্তু ভিতরে এর মধ্যেই একটু একটু গন্ধ আসছে, আমার শরীরও চুলকাচ্ছে একটা শাওয়ার নেয়ার জন্য।
আশা করি দেখা হবে তোমাদের সাথে, অচিরেই- বিশেষত টেড খানের সাথে। পৃথিবীতে ফিরে যাবার আগে অনেক কথা বলতে হবে আমাদের।
স্টোর
ট্রান্সমিট
ঙ. সমাপ্তি
ঙ. সমাপ্তি
পরের হাজার চেষ্টা
শুরুর ভুলগুলোকে আর শুধরে দেয় না;
অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে সাগরের বুকে,
তবু সিন্ধুর লবণ কমে না।
এ ই হাউসম্যান
মোর পয়েমস
৩২. সময় এক বহতা নদী
সব মিলিয়ে আগ্রহজাগানিয়া কিন্তু বিশেষ কোনো ঘটনাবিহীন তিন দশকের কথা। সময় আর ভাগ্য মানবজাতির জন্য অনেক কিছু নিয়ে এসেছে। ছিনিয়ে নিয়েছে অনেক কিছু। গ্যানিমিডের জন্য পৃথিবী ছেড়ে যাবার পর অনেক স্রোত বয়ে গেছে সৌরজগতের জগতগুলোর নদ-নদীতে।
প্রচলিত একটা কথায় অনেক সত্য লুকিয়ে আছে অনুপস্থিতি মনকে আরো নরম করে দেয়। ইন্দ্রা ওয়ালেসের সাথে আবার দেখা হবার পর দুজনেই বুঝতে পারে, এত সব যুক্তিতর্ক, কথা কাটাকাটির পরও কেমন করে যেন অনেক কাছে চলে এসেছে তারা। তাদের সম্মিলিত চেষ্টা এখন ডন ওয়ালেস আর মার্টিন পোলের ধমনীতে বয়ে যায়।
হাজার বছর পর একটা পরিবার গড়ে তোলা অনেক ঝক্কি-ঝামেলার ব্যাপার। প্রফেসর এ্যান্ডারসন ব্যক্তিগতভাবে সায় দেয়নি…
‘তুমি অনেক দিক দিয়ে ভাগ্যবান, বলেছিল সে পোলকে, রেডিয়েশন ড্যামেজ সামান্য অবাক হয়েছি দেখে, ইনট্যাক্ট ডি এন এ থেকে অনেক রিপেয়ারের কাজ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু আরো কিছু টেস্ট না করে জেনেটিক ইন্টেগ্রিটির নিশ্চয়তা দিতে পারি না। উপভোগ কর সঙ্গ, কিন্তু আমরা ওকে করার আগে পরিবার শুরু করোনা।
টেস্টগুলোয় আরো অনেক সময় লাগে। প্রফেসর এ্যান্ডারসনের ভয় ছিল, আরো রিপেয়ার করতে হবে। ভয় ছিল সর্বক্ষণ। এ্যান্ডারসনের মতে পোল আর কিছুদিন পরে এলে হয়ত রেডিয়েশন ড্যামেজ মারাত্মক হত। দেখা গেল মার্টিন আর ডন একেবারে নিখুঁত। নির্দিষ্ট সংখ্যক মাথা, হাত, পা আছে। বেশ বুদ্ধিমান আর স্মার্ট হয়েছে, বাবা-মায়ের আদর পেয়ে মাথায় ওঠেনি। পনের বছর পর দুজনেই স্বাধীনতা চায়, তার আগ পর্যন্ত মা বাবাই তাদের বেস্ট ফ্রেন্ড। সোশ্যাল এ্যাচিভমেন্ট রেটিং ভাল হওয়ায় তাদের আরো একটা সন্তান নেয়ার জন্য রীতিমত উৎসাহ দেয়া হয়। কিন্তু বিচিত্র সৌভাগ্যের উপর র করে আরো একবার ঝুঁকি নেয়ার কোনো মানে হয় না।
পোলের জীবনে একটা দূর্ঘটনা পুরো সৌর সমাজকে নাড়া দিয়েছিল। ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার আর তার ক্রু গোলিয়াথে থেকে যথারীতি ধূমকেতুর কোর সংগ্রহ করার সময় বিস্ফোরিত হয় তাদের যানটা। শতছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে কালো মহাকাশে। খুব নিচু তাপমাত্রায় থাকা অস্থিতিশীল অণুর বদৌলতে এমন দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। ধুমকেতু সগ্রাহকদের মাথার উপর খড়গ হিসাবে সব সময় এ ঝুঁকি থাকে। চ্যান্ডলারের ক্যারিয়ারেই বেশ কয়েকবার এমন হয়েছে। কেউ জানে না এমন দূর্ঘটনা কখন ঘটতে পারে।
চ্যান্ডলারকে সাজ্জাতিক মিস করে পোল। জীবনের এতটা অংশ জুড়ে যে মানুষ থাকতে পারে তা ভাবা যায় না। এখন, আর একজনই এ শূন্যতা পূরণ করতে পারত, ডেভ বোম্যান। তারা আবার স্পেসে যাবার পরিকল্পনা করেছিল। একেবারে ওর্ট মেঘের কাছে। অনেকটা অজানা এ অঞ্চলের বরফরাজ্যে যাবার আশা যে কোনো এ্যাস্ট্রোনোমারের কাছে সুখস্বপ্ন। পরিকল্পনায় হরদম বাগড়া দিয়েছে শিডিউলের ঝামেলা, সবশেষে স্বপ্নটা অধরা থেকে গেল।
আরো একটা দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান ঘটেছে- ডাক্তারদের হাজার মানা থাকা সত্ত্বেও। পৃথিবীর বুকে নেমে গেছে পোল একবার। একবারই যথেষ্ট।
তার আমলের শারীরিক প্রতিবন্ধি লোকজন যে ধরনের জিনিসে যেত, হুইলচেয়ার, তেমনি একটা যানে করে পৃথিবীর মাটির স্পর্শ নেয় সে। জিনিসটা মোটোরাইজড, গাড়ির টায়ারের মতো বাতাস ভরা চাকা আছে। মোটামুটি মসৃণ এলাকায় চলতে পারে। উড়তেও পারে জিনিসটা বিশ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে। উড়ে যাবার কাজটা চালায় নিচের দিকে বসানো শক্তিমান ফ্যানের বাতাসে সৃষ্ট এয়ার কুশন। পোল প্রথমে আশ্চর্য হয়ে যায়, এত পুরনো টেকনোলজি এখনো পৃথিবীতে আছে। কিন্তু ইয়ার্শিয়া-কন্ট্রোল ডিভাইস দিয়ে সূক্ষ্ম যাতায়াত সম্ভব নয়।
হোভারচেয়ারে আরাম করে বসে সে বাড়তি ওজন তেমন টের পায়নি। নেমে গেছে আফ্রিকার হৃদপিন্ডে। শ্বাস নিতে একটু কষ্ট হলে কী হবে, এ্যাস্ট্রোনট ট্রেনিঙের সময় এর চেয়ে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। সূর্যের তাপ সহ্য করা যাচ্ছিল না সকালেই, দুপুরে কী হবে কে জানে!
পৃথিবীর, মাটির যে একটা নিজস্ব ঘ্রাণ আছে সে কথাও মনে ছিল না। বিচিত্র সব গন্ধ মনটাকে চনমনে করে তোলে।
চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল পোল, খোলার আগে ঘাড়ের কাছে লকলকে কীসের যেন স্পর্শ পায়।
‘এলিজাবেথকে হ্যালো বলুন, বলেছিল গ্রেট হোয়াইট হান্টার গ্রাব পরা গাইড, ‘সে আমাদের অফিশিয়াল গ্রিটার।’
চেয়ার ঘুরিয়ে পোল একটা বাচ্চা হাতি দেখতে পায়।
‘হ্যালো, এলিজাবেথ,’ একটু আড়ষ্ট ভঙ্গিতে স্বাগত জানায় সে। সাথে সাথে স্যালুট করে এলিজাবেথ, গুড়টাকে উঁচিয়ে। এমন একটা আওয়াজ ওঠে তার কণ্ঠ চিরে, সভ্য সমাজে যেটাকে ঠিক স্বাগত জানানোর মতো মনে হয় না, কিন্তু সে নিশ্চিত, এটাই এ বন্ধুভাবাপন্ন প্রাণির বন্ধুত্ব করার রীতি।
পৃথিবী নামক নীলচে সবুজ গ্রহটায় সব মিলিয়ে ঘন্টাখানেক সময় ব্যয় করে সে। কৃত্রিমতা ছাড়াই সিংহগুলোর হুঙ্কার দেখে সে, দেখে হাজার হাজার বছর ধরে অপরিবর্তিত অকৃত্রিম আফ্রিকার কুমিরগুলোকে।
টাওয়ারে যাবার আগে পোল একটু ঝুঁকি নিয়ে পা বাড়ায় মাটির দিকে। দু- এক কদম হেঁটে নেয়। কিন্তু সিদ্ধান্তটা ঠিক ছিল না। আরো কম তাপমাত্রায় চেষ্টা করা উচিৎ। আবার চেয়ারের নরম গদিতে তলিয়ে গিয়ে নিজেকে ঠিক করে নেয় সে।
‘অনেক হয়েছে, কাতর গলায় বলে সে, এবার টাওয়ারের দিকে ফিরে যাওয়া যাক।
এলিভেটর লবির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আসার সময় চোখে পড়েনি এমন এক সাইনে চোখ পড়ে যায়:
আফ্রিকায় স্বাগতম!
“বনানীতেই পৃথিবী সংরক্ষিত।”
–হেনরি ডেভিড থোরিউ(১৮১৭-১৮৬২)
আগ্রহ দেখে হাইড জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি তাকে চেনেন?
এমন সব প্রশ্ন সব সময় শুনে এসেছে পোল। প্রায়ই জবাব খুঁজে পায় না।
মনে হয় না, বলল সে একটু বিতৃষ্ণা নিয়ে।
তার ঠিক পরের মুহূর্তেই পিছন থেকে বন্ধ হয়ে গেল বিশাল দরজা। বন্ধ হয়ে গেল আদি বসুধামাতার রূপ, রস, গন্ধ, রঙ। নেমে গেল মানুষের আদি নিবাসের ঝাঁপ।
লেভেল দশ হাজারের এ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসার পর পৃথিবী দেখার ফল ফলল। অবশ্য গায়ের নানা জায়গায় ব্যথা-বেদনার কোনো মূল্য নেই তার কাছে। এ গণতান্ত্রিক সমাজেও তার এ্যাপার্টমেন্টের অবস্থানটা অভিজাত। ফিরে আসা পোলকে দেখে ভড়কে গেছে ইন্দ্রা। সোজা বিছানার পথ দেখিয়ে দিয়েছে।
‘এন্থেউসের মতো হাল হয়েছে- বিপরীত আর কী! ইন্দ্রা বলল মুখ কালো করে।
মাঝে মাঝে স্ত্রীর সাথে সে কথায় পারে না। অনেক রেফারেন্সই মাথার উপর দিয়ে চলে যায়।
‘কার মতো?’
‘পৃথিবী-দেবী গায়ার ছেলের মতো। হারকিউলিস তার সাথে লড়েছিল। কিন্তু যতবার মাটিতে পড়ে যায়, ততবার শক্তি ফিরে পায় এহেউস।
তারপর? কে জিতল?
হারকিউলিস, অবশ্যই। এন্থেউসকে বাতাসে, মাটির উপর ধরে রাখে যেন মা ছেলের ব্যাটারি চার্জ করে দিতে না পারে।
যাক, আমার ব্যাটারি চার্জ হতে বেশি সময় নিবে না। একটা শিক্ষা হয়ে গেছে। আরো অভিজ্ঞতা না নিলে হয়ত এক সময় চান্দ্র এলাকায় গিয়ে হাপ ছাড়তে হবে।
পেপালের মনোভাব পুরো এক মাস ঠিক থাকে। প্রতি সকালে ঝাড়া পাঁচ কিলোমিটার হাঁটে সে। প্রতিদিন আফ্রিকা টাওয়ারের এক একটা লেভেল ধরে নেয়। কোনো কোনো লেভেল এখনো ফাঁকা। খা খা শূন্য ধাতব গড়নে মরুভূমির হাহাকার। কখনো ভরে উঠবে কিনা এ জায়গা কে জানে। অন্য লেভেলগুলোর আলাদা আলাদা সৌকর্য আছে। আছে ভিন্নতর স্থাপত্যশৈলি, প্রকৃতি। অনেকগুলো অতীত থেকে সংস্কৃতি ধার করেছে। কোনো কোনোটা ভবিষ্যতের পথ দেখায়। সেগুলোকে এড়িয়ে যায় সে। অনেক জায়গাতেই হাঁটার সময় সম্মানজনক দূরত্ব রেখে কৌতূহলী ছেলেমেয়েরা ভিড় জমায়। সাধারণত বেশি সময় তার সাথে হেঁটে পারে না।
একদিন পুরনো দিনের কায়দায় সাজানো এক লেভেলে হাঁটতে হাঁটতে পরিচিত মুখের সামনে পড়ে যায়।
দানিল!
কোন সাড়া নেই, লোকটা চলেই যাচ্ছে। কিন্তু পরিচয় নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই পোলের মনে।
দানিল। আমার কথা মনে নেই? এবার তাকায় সে। চোখেমুখে বিস্ময়।
“স্যরি,” বলল লোকটা, আপনি নিশ্চয়ই কমান্ডার ফ্র্যাঙ্ক পোল, কিন্তু আমাদের তো আগে কখনো দেখা হয়নি।’
এবার পোলের অস্বস্তিতে পড়ার পালা।
‘বোকামি করেছি, মাফ চাওয়ার ভঙ্গি পোলের কথায়, কিন্তু বেশিরভাগ লোকই আর একজনের সাথে আপনাকে গুলিয়ে ফেলবে। হ্যাভ এ গুড ডে।’
দেখা হওয়ায় তার পরও খুশি সে। খুশি এই দেখে যে দানিল ফিরে গেছে স্বাভাবিক জীবনে। অতীত জীবনে একজন মানুষের সাথে যে সে থেকেছিল, সহায়তা করেছিল, সেসব কথা লেখা বইগুলো এখন হারিয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে স্মৃতির দুয়ার। যৌবনে দেখা চোর-পুলিশ ছায়াছবিগুলোকে মাঝে মাঝে মিস করে সে। এখন এসবের প্রতি আগ্রহ নেই তেমন।
মিস প্রিজলের সহায়তা নিয়ে সে এমন একটা শিডিউল তৈরি করে নেয় যেন অবসর সময়গুলো নানা ঝক্কি-ঝামেলার যোগাযোগ কাটিয়ে ব্রেইনক্যাপ পরে নিয়ে র্যান্ডম সার্চ করা যায়। পরিবারের বাইরে তার আগ্রহের সীমা বৃহস্পতি/লুসিফারের চাঁদগুলো। এখন সে ইউরোপা কমিটির সদস্য।
হাজার বছর আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়া হয়েছে বৃহস্পতির চাঁদগুলোর ব্যাপারে। সেখানে মানুষ কী করবে আর না করবে তা নতুন কোনো ব্যাপার নয়। ১৯৭৯ সালের ভয়েজার উড্ডয়ন আর ১৯৯৬ সালের গ্যালিলিও অভিযানের সময় থেকেই এ ইতিহাসের শুরু।
বেশিরভাগ দীর্ঘদিন টিকে থাকা সংস্থার মতো ইউরোপা কমিটিও আস্তে আস্তে ফসিলায়িত হয়ে যাচ্ছে। নতুন কোনো চমক না থাকলে খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ হয় না। হালম্যানের আবির্ভাবের পর চাঙা হয়ে উঠেছিল, নতুন একজন টগবগে চেয়ারপার্সন নিয়োগ দেয়া হয় পোলকে সহায়তা করার জন্য।
এর মধ্যে রেকর্ড হয়নি এমন নতুন তথ্য খুব বেশি দিতে পারেনি সে, তবু কমিটিতে থেকেই সে খুশি। এসব কাজে নিজেকে জড়িত রাখাকে দায়িত্ব মনে করে, তার উপর কোনো না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পদ না থাকলে খারাপ লাগে। আগে সে ছিল একজন জাতীয় বীর’, পরে ব্যাপারটা খুব অস্বস্তিকর হয়ে পড়ে। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায়, যুদ্ধবিধ্বস্ত সমাজের তুলনায়, সামরিক ক্ষেত্রে সব টাকা ঢালা দেশগুলোর তুলনায় এবং প্রযুক্তি ও উপভোগের সুবিধার তুলনায় এ সমাজ অনেক অনেক অগ্রসর হলেও নিজের অস্তিত্বকে কোনো কিছুর সাথে যুক্ত করতে না পারলে জীবনটা একঘেয়ে হয়ে যায়।
আরো একটা প্রয়োজন মাঝে মাঝে মনে দানা বাঁধে, যা নিজের কাছে স্বীকার করতেও ভাল লাগে না তার পরেও হালম্যান তার সাথে কথা বলেছে, সংক্ষেপে। পোল জানে, চাইলেই আবার এমন করা যায়। মানুষের সাথে কথা বলার ইচ্ছা কি আস্তে আস্তে উবে যাচ্ছে? তা যেন না হয়।
থিওডোর খানের সাথে এখনো কথা হয়। ধান এখন ইউরোপা কমিটির গ্যানিমিড রিপ্রেজেন্টেটিভ। সে পৃথিবীতে ফিরে আসার পর থেকে সর্বক্ষণ খানের প্রাণান্ত চেষ্টা- আর একবার যেন বোম্যানের সাথে যোগাযোগ হয়। ইতিহাস আর দর্শনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন পড়ে আছে সামনে।
মনোলিথ কি তোমার বন্ধু হালম্যানকে সব সময় এত ব্যস্ত রাখে যে সে আমার সাথে একটু সময় দেয়ার মতো সময়ও পাবে না? পোলের কাছে তার চিরদিনে আক্ষেপ, এত সময় জুড়ে কী করে ব্যাটা?
খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন। জবাব এল পরিষ্কার আকাশে বঙ্খপাতের মতো। জবাব দিয়েছিল ডেভ বোম্যান। একটা ভিডফোন কল করে।
৩৩. কন্ট্যাক্ট
হ্যালো, ফ্র্যাঙ্ক। ডেত বলছি। তোমার জন্য খুব জরুরি একটা মেসেজ নিয়ে এসেছি। মনে হয় এখন তুমি আফ্রিকা টাওয়ারে নিজের স্যুইটে। যদি সেখানে থেকে থাক, তাহলে প্লিজ নিজেকে নির্দেশিত কর আমাদের অর্বিটাল মেকানিক্সের ইন্ট্রাক্টরের নাম বলে। আমি ষাট সেকেন্ড অপেক্ষা করছি। জবাব না এলে আরো এক ঘন্টা পর কল করব।
শক কাটিয়ে ওঠার জন্য এক মিনিট খুব কম সময়। প্রথমে আনন্দ, তারপর বিস্ময়, তারপর অন্য এক অনুভূতি গ্রাস করে তাকে। আনন্দ হয় ডেভের কাছ থেকে কল আসায়, আর উদ্বেগ আসে খুব জরুরি একটা মেসেজ’ এর কথা শুনে।
কপাল ভাল, ভাবে পোল, যে কয়েকটা নাম আমার মনে থাকে তার একটা বলতে বলেছে সে। কে গ্লাসগো উচ্চারণের একজন স্কটের কথা ভুলে যেতে পারে যার উচ্চারণ বুঝতে বুঝতে পুরো একটা সপ্তাহ কেটে গিয়েছিল শিক্ষার সময়টায়? কিন্তু লেকচারার হিসাবে তার তুলনা নেই। সবচে সহজে মানুষের মনের ভিতরে কথা ঢুকিয়ে দিতে পারার গুণ ছিল।
‘ডক্টর জর্জ ম্যাকভিটি।
‘এ্যাকসেপ্টেড। এখন প্লিজ তোমার ব্রেইনক্যাপ রিসিভারটার সুইচ অন কর। মেসেজটা ডাউনলোড হতে তিন মিনিট সময় নিবে। মনিটরিংয়ের চেষ্টা করোনা। আমি দশভাগের একভাগ কমপ্রেস করে পাঠাচ্ছি। শুরু করার আগে দু মিনিট অপেক্ষা করব।’
কীভাবে কাজটা করছে সে জানে না পোল। এখান থেকে বৃহস্পতি/লুসিফার পঞ্চাশ আলোকমিনিট দূরে। তাহলে নিশ্চয়ই মেসেজটা অন্তত এক ঘন্টা আগে পাঠানো হয়েছে। নিশ্চয়ই বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন কোনো প্রোগ্রামের সাথে এসেছে গ্যানিমিড-আর্থ বিমের মধ্য দিয়ে। ইন্ট্রাক্টরের নাম বললেই প্যাকেজটা অন হবে।
ব্রেইনবক্সের ইন্ডিকেটর লাইট জ্বলছে নিভছে- রিসিভ করছে মেসেজটা।
যে কম্প্রেশনে হালম্যান পাঠাল, তাতে পুরো মেসেজ দেখতে পাকা আধঘন্টা লাগবে পোলের। কিন্তু তার শান্তিময় জীবনে পরিবর্তন আসতে মাত্র দশ মিনিট বাকি।
৩৪. বিচার
‘অবিচ্ছিন্ন, সর্বব্যাপী যোগাযোগের ভুবনে কোনো বিষয় খুব বেশিক্ষণ গোপন করে রাখা যায় না। তাই এ ব্যাপারে মুখোমুখি আলোচনার সিদ্ধান্ত নেয় পোল।
ইউরোপা কমিটির সদস্যরা ভেঙে পড়ে পোলের এ্যাপার্টমেন্টে। সাতজন। লাকি নাম্বারটা এসেছে চন্দ্রকলার সাতদিন থেকে। কমিটির তিনজন সদস্যের সাথে পোলের এই প্রথম দেখা, যদিও ব্রেইনক্যাপের আগের যুগে সে এত ভালভাবে কাউকে জানতে পারত না…
‘চেয়ারপার্সন ওকনর, কমিটির সদস্যগণ- ইউরোপা থেকে পাওয়া এ মেসেজ আপনারা ডাউনলোড করার আগে আমি কিছু কথা বলতে চাই- সামান্য কিছু, প্রমিজ করছি। কথাগুলো মুখে মুখে বলতেই ভাল লাগবে- এটাই আমার কাছে বেশি ন্যাচারাল। মনে হয় কখনো মনের সাথে মনের যোগাযোগের ব্যাপারটা ভালভাবে নিতে পারব না।
‘আপনারা সবাই জানেন, ডেভ বোম্যান আর হালকে ইউরোপার মনোলিথে ইমুলেশন হিসাবে স্টোর করে রাখা হয়েছে। সময়ে সময়ে মনোলিথ হালম্যানকে
এ্যাক্টিভেট করে। এ্যাকটিভ করে আমাদের উপর চোখ রাখার জন্য।
হালম্যান কিন্তু পুরোপুরি যান্ত্রিক অস্তিত্ব নয়। ডেভ অংশটা এখনো মানবীয় কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছে। সামান্য আবেগও আছে তার। একসাথে ট্রেনিং নিয়েছি, বছরের পর বছর ধরে একে অন্যের সমস্ত অনুভূতি জেনেছি- তাই আর যে কোনো মানুষের সাথে যোগাযোগ না করে আমার সাথে কম্যুনিকেট করতে ভালবাসে সে। সম্ভবত এভাবে কাজ করতে গিয়ে উপভোগ করে, কথাটা বেশি শক্ত হয়ে গেলেও…’
‘সে আগ্রহী, উৎসাহী, বন্ধুভাবাপন্ন। যেন বুনো একটা নমুনা তুলে এনেছে মনোলিথ তার কাজের জন্য। টি এম এর স্রষ্টাদের কাছে আমার হয়ত এখনো বুনো।
কিন্তু সেই বুদ্ধিমত্তা এখন কোথায়? হালম্যান জানে জবাবটা। সেই জবাব আমাদের হাড়মাংস জমিয়ে দিবে।
‘আমরা সব সময় যা অনুমান করে এসেছিলাম- মনোলিথ আসলে গ্যালাক্টিক নেটওয়ার্কের টুল। আর কাছের নডটা- যেটা মনোলিথকে নিয়ন্ত্রণ করে সেটা সাড়ে চারশ আলোকবর্ষ দূরে।
‘স্বস্তির জন্য যথেষ্ট কাছে। তার মানে একবিংশ শতাব্দিতে আমাদের ব্যাপারে যে রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে সেটা পৌঁছে গেছে আধ-সহস্রাব্দ আগেই। যদি সেই মনোলিথের- আচ্ছা, তাকে সুপারভাইজার বলা যাক- সাথে সাথে জবাব পাঠিয়ে থাকে, সেটা এসে পৌঁছবে এমনি এক সময়ে। বর্তমান সময়ে।
‘এবং এখন হয়ত তেমন কিছুই ঘটছে। গত কয়েকদিন ধরে মনোলিথ অসংখ্য তথ্যের স্রোত রিসিভ করে। এখন নতুন প্রোগ্রাম সেটআপ করা হচ্ছে, সম্ভবত এসব তথ্যের ভিত্তিতেই।
‘দুর্ভাগ্যবশত হালম্যান শুধু আন্দাজ করতে পারে। মনোলিথের অসংখ্য সার্কিট আর মেমোরি ব্লকের সামান্য কয়েকটায় যাতায়তের সুযোগ আছে তার। চাইলে এর সাথে আলোচনা করতে পারে। আমি এখনো মেনে নিতে পারি না যে এত বেশি ক্ষমতা থাকার পরও মনোলিথের আলাদা কোনো সচেতনতা নেই- এমনকি সচেতনতা সম্পর্কেও তার ধারণা নেই।
এ সমস্যার ঘূর্ণাবর্তে পড়ে আছে হালম্যান হাজার বছর ধরে। অন ও অফ। আমাদের মতো একই সিদ্ধান্তে এসেছে। তার আভ্যরীণ জ্ঞানের জন্য এ সমাপ্তি অনেক বেশি ওজন বহন করে।
‘আমাদের সৃষ্টি করায় নাকি বলব আমাদের পূর্বপুরুষদের মন ও জিন নিয়ে খেলার ফলে যে সমস্যাই হয়ে থাক না কেন এখন সে পরের ধাপ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিবে। হালম্যানের মনে হচ্ছে আমাদের কপালে ভাল কিছু নেই। মানুষের মানবজাতির টিকে থাকার সমস্যাটা তার কাছে আগ্রহোদ্দীপক একটা ব্যাপার, এর চেয়ে বেশি কিছু না। আর সে সেজন্য আমাদের সহায়তা করতে চায়।
স্তব্ধ হয়ে থাকা শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে একটু চুপ করে গোল।
‘অদ্ভুত ব্যাপার, আমার একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেল… এতে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্লিজ, খেয়াল করুন…’
‘আমি আর ডেভ একদিন হাঁটছিলাম সাগরপাড়ে, উড্ডয়নের দিন কয়েক আগের কথা। দেখি বালির উপরে একটা বড়সড় বিটল পোকা উল্টে পড়ে আছে। প্রায়ই এমন দেখা যায়, পা উপরে, নাড়াচ্ছে সর্বক্ষণ, সোজা হওয়ার চেষ্টা করছে।
‘গা করলাম না- জটিল কিছু টেকনিক্যাল আলোচনায় মেতে আছি আমরা। সামনেই উড়তে হবে। চিতি। ডেভ কিন্তু খেয়াল করল- সরে গিয়ে পা দিয়ে সোজা করে দিল।
‘আমি প্রশ্ন তুললাম, ‘কাজটা কি ঠিক হল? এখনি এটা উড়ে গিয়ে কারো না কারো মূল্যবান জিনিসের বারোটা বাজিয়ে দিবে। হাসল ডেভ, ‘হয়ত, হয়ত না। আমি এটাকে বেনিফিট অব ডাউট দিয়েছি।’
মাফ চাচ্ছি, আমার মাত্র কয়েকটা কথা বলা উচিৎ ছিল। কিন্ত ঘটনাটা মনে পড়ে যাওয়ায় ভাল লাগছে। এখন দেখুন, হালম্যানের মেসেজের মর্মার্থ এখানেই।
সে মানবজাতিকে বেনিফিট অব ডাউট দিতে চায়…’
‘এখন, প্লিজ, আপনাদের ব্রেইনক্যাপ চেক করুন। রেকর্ডিংটা হই ডেনসিটি ইউ ভি ব্যাঙের উপরে। চ্যানেল একশ দশ। স্বস্তি নিয়ে দেখুন, শুরু করছি…’
৩৫. সাজ সাজ রব
কেউ দ্বিতীয়বার দেখতে চায় না। একবারই যথেষ্ট।
প্লেব্যাক শেষ হবার পর প্রথমে কেউ কোনো কথা বলল না। তারপর চেয়ারপার্সন ডক্টর ওকনর ব্রেইনক্যাপ খুলে ফেলে মাথা দলাই মলাই করতে করতে বলল:
‘আপনার সময়ের একটা ফ্রেজ আমাকে শিখিয়েছিলেন। সেটা কাজে লাগবে। দিস ইজ এ ক্যান অব ওয়ার্মস।
‘কিন্তু শুধু বোম্যান- হালম্যান এটাকে খুলেছে।’ বলল কমিটির এক সদস্য, মনোলিথের মতো জটিল জিনিসের অপারেশন বুঝতে পারা কি তার পক্ষে সম্ভব? নাকি এসব কল্পনাপ্রসূত
মনে হয়না তার খুব একটা কল্পনাশক্তি আছে, জবাব দিল ডক্টর ওকন, ‘সবকিছু ভালভাবেই চেক করেছে। আর নোভা স্করপিওর রেফারেন্স আছে যখন… আমাদের ধারণা ছিল সেটা কোনো দূর্ঘটনা। এখন দেখা যাচ্ছে- বিচার।
‘প্রথমে বৃহস্পতি, তারপর স্করপিও, ডক্টর কাউসম্যান বলছে, আইনস্টাইনের সাথে টক্কর দেয়ার জন্য সে খুব বিখ্যাত এক পদার্থবিদ, ‘এখন লাইনে কে থাকবে?
‘আমরা সব সময় ধারণা করেছি,’ বলল চেয়ার, যে টি এম এ গুলো আমাদের দেখভাল করে, এক মুহূর্তের জন্য থামে সে, তারপর শক্তি দিয়ে বলে, কী দূর্ভাগ্য কী চরম দূর্ভাগ্য- মানবজাতি তার খারাপ অধ্যায়গুলো শেষ করে এসে এ রিপোর্ট পাঠাল নিজ হাতে।
আবার নিরবতা। সবাই জানে যে বিংশ শতাব্দিকে অত্যাচারের শতাব্দি বলা হয়।
কোন বাধা না দিয়ে শুনছে পোল। আবারো কমিটির মান নিয়ে সন্তুষ্ট হয় সে। কেউ নিজের নিজের তত্ত্ব কপচানোর বা তর্ক তোলার চেষ্টা করছে না। আত্মম্ভরিতা প্রকাশেরও অবকাশ নেই। তার সময়ে এমন সব বিচিত্র তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যেত সবার মধ্যেই স্পেস এজেন্সি ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে এ্যাডমিনিস্ট্রেটরদের, কংগ্রেশনাল স্টাফ আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এক্সিকিউটিভদের মধ্যে…
সত্যি, মানবজাতির উন্নতি হয়েছে। ব্রেইনক্যাপ শুধু অকেজো ধারণাগুলোকে বাতিল করে দেয়নি, শিক্ষার ব্যবহারের হার বাড়িয়ে দিয়েছে সাঘাতিকভাবে। একটু সমস্যাও আছে এতে, এখনকার সমাজে খুব বেশি ব্যতিক্রমী চরিত্র দেখা যায় না। মাত্র চারজনের কথা সে মনে করতে পারে- ডক্টর খান, ইন্দ্রা, ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলার আর ড্রাগনলেডি।
চেয়ারপার্সন প্রথমে সবার কথা শুনল, সবাইকে সবটুকু প্রকাশ করতে দিল, এরপর যোগবিয়োগের পালা।
‘প্রথমেই যে প্রশ্নটা এসে পড়ে- এ হুমকিকে আমরা কতটা সিরিয়াসলি নিব সময় নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট আছে এখানে। মিথ্যা এ্যালার্ম বা ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ থাকলেও ব্যাপারটা এত বেশি জটিল যে আমাদের সিরিয়াসলি নিতে হবে। সত্যি বলে ধরে নিতে হবে। বিপরীত কোনো বিষয় নিয়ে প্রমাণ পাওয়ার আগ পর্যন্ত এটাই আমাদের করণীয়, সবাই রাজি?’
‘ভাল। আর আমরা জানি না কতটা সময় আছে হাতে। সুতরাং ধরে নিতে হবে বিপদ ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে। হয়ত পরেও হালম্যান নতুন কিছু জানাতে পারে, তদ্দিনে দেরি হয়ে গেলে?
তাই এখন সিদ্ধান্তে আসতে হবে: কী করে আমাদের টিকিয়ে রাখতে পারি? বিশেষত মনোলিথের মতো শক্তিমান কিছুর বিরুদ্ধে বৃহস্পতির কপালে কী
জুটেছিল একবার ভেবে দেখুন! আর নোভা স্করপিও’….
জানি না কোনো ক্ষমতা প্রয়োগ করে লাভ হবে কিনা। তবু, খতিয়ে দেখতে হবে। ডক্টর ক্রাউসম্যান, একটা সুপারব বানাতে কতদিন সময় লাগবে?
‘আশা করি ডিজাইনগুলো এখনো আছে, তার মানে রিসার্চ করতে হবে না উ… সম্ভবত হপ্তা দুয়েক। থার্মোনিউক্লিয়ার উইপন বানানো সহজ, সেখানে কমন ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করা হয় হাজার হলেও, জন্ম নিয়েছিল দ্বিতীয় সহস্রাব্দে। কিন্তু আরো ভাল কিছু চাইলে- যেমন এন্টিম্যাটার ব, অথবা ছোট ব্ল্যাকহোল- তখন কয়েক মাস লেগে যেতে পারে।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ। দেখাশোনা শুরু করে দিতে পারবেন কিন্তু আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, এতে কাজ হবে না। এত শক্তিশালী জিনিস যারা তৈরি করবে তারা কাছাকাছি প্রযুক্তির ধ্বংস-ক্ষমতার জিনিসের হাত থেকে রক্ষার ব্যবস্থাও করবে। তাহলে আর কোনো সাজেশন?
‘আমরা কি মধ্যস্থতা করতে পারি? খুব বেশি আশা না রেখেই প্রশ্ন তুলল এক কাউন্সিলর।
কীসের সাথে… বা কার সাথে? জবাব দিল কাউসম্যান, আমরা এর মধ্যেই আবিষ্কার করে ফেলেছি, মনোলিথটা একেবারে খাঁটি মেকানিজম। যা করার কথা শুধু তাই করছে। প্রোগ্রামে ফ্লেক্সিবিলিটি থাকতেও পারে। আছে কি নেই সেটা আমরা জানি না। আর হেড অফিসের কাছে আপিল করার উপায়ও নেই- মাত্র সাড়ে চারশ আলোকবর্ষ দূরে সেটা।
কোন বাধা না দিয়ে শুনছিল পোল; এ আলোচনায় কাজে লাগবে এমন কথা বলতে পারবে না সে। বেশিরভাগই মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। এখন, এ কথা যদি বাইরে প্রকাশ পেয়ে যায়, আর ভুল হয়, তাহলে সমস্যা আছে। ল না হলে মানবজাতির মঙ্গল হোক।
পরিচিত একটা বাক্যাশং শোনার আগ পর্যন্ত এসব ভাবনায় মগ্ন ছিল সে।
কমিটির সাধারণ এক সদস্য, নামটা এত বড় তার যে পোল কখনো মনে রাখতে পারে না, শুধু দুইটা শব্দ ঢেলে দিল আলোচনায়।
‘ট্রোজান হর্স!
প্রথমে সবাই নিশ্চুপ, তারপর একজন বলে উঠল, ‘প্রেগন্যান্ট।’
সবাই একবাক্যে বলা শুরু করল, ইস! আমার মনে কেন আগেই এল না কথাটা!”
‘অবশ্যই।
দারুণ আইডিয়া।
অবশেষে প্রথমবারের মতো সবাইকে চুপ করতে বলল চেয়ারপার্সন।
‘ধন্যবাদ, প্রফেসর থিরুগনানাসাম্পায়ামূর্তি!’ বলল সে, একটুও ভুল না করে, ‘আরো একটু খুলে বলবেন কি?
‘অবশ্যই। যদি মনোলিথ সবার ধারণা অনুযায়ী সত্যি সত্যি একটা অনুভূতিহীন যন্ত্র হয়ে থাকে এবং সেলফ মনিটরিং সিস্টেম যদি সীমিত হয়ে থাকে তাহলে আমাদের হাতে এর মধ্যেই এমন কিছু অস্ত্র আছে যা কাজে লাগবে। ভন্টে লুকানো আছে সেটা।
‘এবং একটা ডেলিভারি সিস্টেম হালম্যান!
‘ঠিক তাই।
‘জাস্ট এ মিনিট, ডক্টর টি, আমরা কিছুই জানি না একেবারে কিস্যু জানি না মনোলিথের স্থাপত্যের ব্যাপারে। এর বিরুদ্ধে আমাদের ব্যবস্থা কাজে লাগবে কী করে?
‘পারব না–কিন্তু মনে রাখুন, মনোলিথ যতই জটিল আর আধুনিক হোক না কেন, একে সৃষ্টি জগতের যৌক্তিক নিয়ম মেনে চলতে হবে। মেনে চলতে হবে শত শত বছর আগে এ্যারিস্টটল আর বোলের গেঁথে দেয়া রীতি। আর এজন্যই এটা হয়ত- না, এটার উচিৎ!- ভল্টে লুকানো জিনিসগুলোর দাম দেয়া। আমরা সেগুলোকে এভাবে এ্যাসেম্বল করব যেন অন্তত দুইটার একটা কাজে লাগে। এছাড়া আর কোনো আশা নেই- কেউ কি এর চেয়ে ভাল বিকল্পের সন্ধান দিতে পারবে?
‘এক্সকিউজ মি, ধৈর্য হারিয়ে পোল বলল, কোন একজন কি আমাকে দয়া করে বলবেন এই মহামূল্যবান ভল্টটা কী এবং কোথায় আছে?
৩৬. আতঙ্কের কুঠুরি
ইতিহাস দুঃস্বপ্নে ভরা। দুঃস্বপ্নের কোনো কোনোটা প্রাকৃতিক, কোনো কোনোটা মানবসৃষ্ট।
একবিংশ শতাব্দির শেষ প্রান্তে প্রাকৃতিকগুলোর বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে বসন্ত, কালোমৃত্যু, এইডস, আফ্রিকার বন-বাদাড়ে থাকা অন্যান্য বীভৎস ভাইরাস। কোনো কোনোটাকে অবলুপ্ত না করে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের সামনে এগিয়ে চলার সাথে সাথে মানুষের গায়ে তাদের অনেকের কার্যকারীতা বন্ধ হয়ে গেছে। তবু, প্রকৃতিমাতার সৃষ্টিশীলতাকে ছোট করে দেখার কোনো উপায় নেই। কে জানে, ভবিষ্যতের প্রকৃতি হয়ত আরো ভয়ঙ্কর সব রহস্য লুকিয়ে রেখেছে।
তাই সব ধরনের আতঙ্কজনক জিনিসের স্পেসিমেন রেখে দেয়া হয় রেখে দেয়া হয় সায়েন্টিফিক রিসার্চের জন্য। সাবধানে পাহারা দেয়া হয় সেগুলোকে, অবশ্যই। বেরিয়ে এসে মানবজাতির উপর আবার ছড়ি ঘুরাবে এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কিন্তু কেউ কি নিশ্চিত করে বলতে পারে যে এই লুকিয়ে রাখা জিনিসগুলো বিপদ বয়ে আনবে না?
বিংশ শতাব্দির শেষভাগে স্মলপক্সের শেষ জীবাণুগুলোকে আমেরিকা আর রাশিয়ার কাছে রাখার সিদ্ধান্ত হলে তাই শোরগোল পড়ে গিয়েছিল সর্বত্র। ভয় ছিল
ভূমিকম্প, যান্ত্রিক গোলযোগ বা সন্ত্রাসী দলের আক্রমণে বেরিয়ে পড়তে পারে জিনিসগুলো।
সবাইকে একটা সমাধান সম্ভষ্ট করে (একেবারে নিখাদ পাগলাটে চরমপন্থি কয়েকজন ছাড়া), এগুলোকে চাঁদে পাঠিয়ে দেয়া হবে। আলাদা করা পিকো পর্বতের ভিতরে একটা ল্যাবরেটরিতে রাখা হবে। এখানে মানবজাতির আরো অনেক পাগলামির নিদর্শন রাখা হয় পরে।
এমন সব গ্যাস আর কুয়াশা ছিল যার এক বিন্দুই মৃত্যুর কারণ হতে পারে। কোনো কোনো ধর্মীয় সন্ত্রাসীদল বিজ্ঞানে অগ্রসর হয়ে এসব আবিষ্কার বা পুনরাবিষ্কার করে। তাদের বেশিরভাগই বিশ্বাস করত পৃথিবীর শেষ সময় চলে এসেছে এবং তাদের অনুসারীরাই শুধু মুক্তি পাবে)। হয়ত ঈশ্বর সময়ের কথা ভুলে গিয়েছিলেন, তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয় তাকে মনে করিয়ে দিতে হবে।
প্রথম দিকে তাদের লক্ষ্য ছিল সাবওয়ে ট্রেন, আন্তর্জাতিক মেলা, স্টেডিয়াম, পপ কনসার্ট… লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা পড়ে, আহত হয় আরো অনেকে। একবিংশ শতাব্দির প্রথম দিকে নিয়ন্ত্রণে আনা পর্যন্ত এসব চলতেই থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে খারাপের ভিতর থেকে ভাল বেরিয়ে আসে- আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো পরস্পরকে সহায়তা করতে থাকে সেভাবে, যেভাবে আর কখনো করেনি। এমনকি এও নির্ধারিত হয়ে যায় যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এমন আচমকা বিচিত্রভাবে আসবে না।
এসব এ্যাটাকে ব্যবহৃত কেমিক্যাল ও বায়োলজিক্যাল উইপনগুলোও পিকোর সংগ্রহে জমা হয়। সেখানেই জমা হয় তখন আবিস্কৃত এ্যান্টিডোটগুলো। আশা করা হয়েছিল এসব জিনিসের সাথে মানুষের আর কোনো সংশ্রব থাকবে না। কিন্তু বিশেষ কিছু প্রয়োজনে যদি কাজে লাগে, সে আশায় এখনো পাওয়া যায় মাটির তলায়। চাঁদে।
পিকো ভল্টের তৃতীয় ক্যাটাগরির আইটেমগুলোকে প্লেগ হিসাবে গণ্য করা গেলেও কখনো কাউকে সরাসরি আহত করেনি। বিংশ শতাব্দির শেষভাগের আগে তাদের অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু মাত্র কয়েক দশকে হাজার কোটি টাকার সমতুল্য ক্ষতি করে ফেলেছে। ক্ষতি করতে পারত যে কোনো রোগের সাথে পাল্লা দিয়ে। এরা কোনো প্রাণি নয়, বস্তু নয়, শুধুই ক্ষমতা। মানবজাতির সবচে দামি সেবক, কম্পিউটারের রোগ তারা।
নামগুলো নেয়া হয়েছে মেডিক্যাল ডিকশনারি থেকে ভাইরাস, প্রিয়ন, টেপওয়ার্ম আর তাদের কাজও সেই জীবন্ত জিনিসগুলোর মতোই। কোনো কোনোটা একেবারে নির্মল সামান্য জোক নিয়ে আসে, কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের কাছে নিয়ে আসে আচমকা আনন্দ বা বিরক্তি।
বাকিরা সত্যিকার ধ্বংসাত্মক। স্রেফ অকল্যাণ বয়ে আনাই সেগুলোর উদ্দেশ্য।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো ব্যবহৃত হয় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কম্পিউটার চালিত ও নিয়ন্ত্রিণ ব্যাঙ্ক বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কজা করার জন্য। সেসব প্রতিষ্ঠান জানতে পারে, তাদের সমস্ত ডাটা উধাও হয়ে যাবে, বিপুল অঙ্কের ডলার একটা এ্যানোনিমাস এ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিলেই রক্ষা। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ঝুঁকি নিতে চায় না। অধোবদনে দিয়ে দেয় তারা, চুপিসারে। মানুষের কাছে বা ব্যক্তিগতভাবে খাটো হবার ভয় থাকে মনে।
এমন সুযোগ পেয়ে মাথায় ওঠে ইনফরমেশন হাইওয়ে জিনিয়াসরা। বাগে পায় সবাইকে। ধরা পড়লেও তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করার উপায় নেই। তারা জিনিয়াস, দ্র, মার্জিত। সর্বোপরি, কাউকে আহত করেনি, করেছে।
তারপর, ছোটখাট সাজার মেয়াদ শেষ হলে কেঁচো থেকে তারা কেউটের রূপ নেয়। যে বা যারা ধরা পড়ার জন্য দায়ী তাদের কম্পিউটার সিস্টেমের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে। কেউ কেউ যে ভাল হয়ে যায় না তা নয়….
সাধারণত তারা উঠতি বয়সের ছেলেপেলে, একেবারে একা একা কাজ করে, গোপনে। ওয়ার্ল্ডওয়াইড কেবল আর রেডিওর কল্যাণে সৃষ্টি করে- এটুকুতেই অনেকের আনন্দ। ছড়িয়ে পড়ে ডিস্কেট আর সিডিরমে। তারপর পৃথিবীজোড়া চিৎকার শুনে শুনে হেসে কুটিপাটি হয়।
মাঝে মাঝে এসব জিনিয়াসকে ক্যাক করে ধরে জাতীয় নিরাপত্তা এজেন্সিগুলো। তারপর তাদের নিজস্ব গোপন কাজে বেগার খাটায়। সাধারণত শত্রুদের ডাটাব্যাঙ্কে আঘাত হানাই মূল উদ্দেশ্য।
এখন গ্যাস আর জীবাণুর চেয়ে কার্যকর অস্ত্র হাতে, বস্তুতান্ত্রিক যুদ্ধের সময় শেষ।
২০০৫ সালে নিউইয়র্ক-হাভানা ব্যাঙ্ক ভেঙে পড়া, ২০০৭ সালে ভারতীয় পারমাণবিক মিসাইলের আঘাত হানা (কপাল ভাল, ওয়্যারহেড এ্যাক্টিভেট হয়নি), ২০০৮ সালে প্যান ইউরোপিয়ান এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল ধ্বসে যাওয়া, উত্তর আমেরিকার টেলিফোন সিস্টেমের প্যারালাইসিস- সবই ধ্বংসদিবস চাওয়া গোপন সংস্থাগুলোর কাজ। কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স আর জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান আস্তে আস্তে এসব স্তিমিত করে দেয়।
অন্তত তাই বিশ্বাস করে লোকে। শতাব্দির পর শতাব্দি পেরিয়ে গেছে, সমাজের ভিত্তিমূলে এখনো কোনো আঘাত আসেনি। বিজয়ের পথে অন্যতম প্রধান অস্ত্র ছিল ব্রেইনক্যাপ। অনেকে মনে করে এসব এ্যাচিভমেন্ট এসেছে অনেক বেশি মূল্যের বিনিময়ে।
সেই প্লেটো আর সক্রেটিসের সময় থেকে মানুষ আর রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে কথাবার্তা চলে আসছে। ধীরে ধীরে সবাই রাষ্ট্রের অধীনে চলে আসে তৃতীয় সহস্রাব্দে। সাধারণত ধরে নেয়া হয় সমাজতন্ত্রই সবচে ভাল রাষ্ট্রব্যবস্থা; এর একটা মহড়া দেয়া হয় শতকোটি প্রাণের বিনিময়ে সামাজিক পোকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর রোবট সহ আরো কিছু স্তরে দেখা হয়। সবশেষে দেখা গেল মানবজাতির জন্য সবচে কম অকল্যাণকর পদ্ধতির নাম গণতন্ত্র।
ব্রেইনক্যাপ সাধারণ মানুষের নাগালে আসার পর থেকে কিছু উচ্চবুদ্ধিসম্পন্ন একই সাথে উচ্চঈর্ষাসম্পন্ন মানুষের কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়ে, এটা আগেই ওয়ার্নিং সিস্টেম হিসাবে কাজ করতে পারে। ভয়ানক হয়ে পড়ার আগেই অনেক ধরনের সাইকোসিস ধরা পড়ে যায়। মানুষের মানসিক বিকৃতির পধ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। তার পরও, কেউ খারাপ কাজ করলে বা মানসিকভাবে অসুস্থ হলে ইলেক্ট্রনিকভাবে ট্যাগ করে রাখা হয় বেশি হলে সরিয়ে নেয়া হয় সমাজ থেকে। ব্রেইনক্যাপ দিয়ে তখন এসব কাজই বেশি করা হত। কিন্তু আস্তে আস্তে পার্সোনাল টেলিফোনের মতো জরুরি জিনিসে পরিণত হল এটা- অবিচ্ছেদ্য। পুরো সমাজের সাথে যে-ই খাপ খাইয়ে নিতে ব্যর্থ হয় সেই সন্দেহের মুখে পড়ে। ফলে চিকিৎসাও হয় ত্বড়িৎগতিতে।
পরে যখন শত্রুদের মতানুসারে, ‘মাইপ্রোবিং’ পুরোপুরি সচল হল, তখন থেকে মানুষ শোর তোলে, ব্রেইনক্যাপ নাকি ব্রেইনকপ?
অনেকে মেনে নেয়, এ ধরনের নজরদারির ফলে অনাগত বহু বিপর্যয় রোধ করা যাবে। গড়া যাবে সুন্দর সমাজ। তারপর মানসিক স্বাস্থের উন্নয়নের সাথে সাথে অবলুপ্তির পথ পায় ধর্মীয় পাগলামি।
সাইবারনেট ক্রিমিনালদের সাথে চলা লম্বা যুদ্ধ শেষপর্যায়ে এলে বিজয়ীরা দেখতে পেল হাতে পর্বতপ্রমাণ জঞ্জাল জমেছে। হাজার হাজার কম্পিউটার ভাইরাস, বেশিরভাগই ধরতে পেরে শেষ করে দেয়া কঠিন। আর আছে এমন কিছু অস্তিত্ব যার কোনো সমাধান নেই, সমাধানের পথও নেই…।
বেশিরভাগই মহান মহান গণিতবিদ-সম্পর্কিত, যারা তাদের আবিষ্কারের ফলে আসা ধ্বংস দেখে বিস্মিত হতেন। হ্যাকার আর ভাইরাসের জনকরা একের পর এক গাণিতিক আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যায় গডেল গ্রেমলিন, ম্যান্ডেলট মেজ, কম্বিনেটোরিয়াল ক্যাটাট্রফি, ট্রান্সফিনিট ট্র্যাপ, কনওয়ে কোনানড্রাম, তুরিং টর্পেডো, লরেঞ্জ ল্যাবিরিন্থ, বুলিয়ান বৰ, শ্যানন স্নের, ক্যান্টর ক্যাটাক্লিজম…
কোনো সাধারণ নিয়মে ফেলতে পারলে বোঝা যেত এসব গাণিতিক ভয়াবহতা এক নিয়মে কাজ করে। এগুলোর কাজ মেমোরি ইরেজার আর কোড ব্রেকার হিসাবে যতটা, আর কোনো ক্ষেত্রে ততটা নয়। এমন কোনো কাজ দিবে, এমন কোনো প্রোগ্রাম শুরু করতে বাধ্য করবে যা বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের শেষ দিনেও শেষ করা সম্ভব নয়। ক্ষতির দিক দিয়ে ম্যান্ডেট মেজ এক কাঠি বাড়া। বাস্তবেই এটা অসীম কতগুলো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করছে।
পাই বা তেমন অসীম কোনো সংখ্যার মান বের করা তেমনি এক উদাহরণ। যাই হোক, একেবারে বোকার হদ্দ কোনো কম্পিউটারও এমন সহজ ফাঁদে পা দিবে না। কম্পিউটার এত বেশি এগিয়ে গিয়েছিল হাজার বছর আগে যে শূন্যের নিচে মান বের করতে গেলে কম্পিউটার সংখ্যাটাকে পিষে ফেলে একটা ফল দেখিয়ে দিবে…
এখন, চালাক প্রোগ্রামারদের টার্গেট সেট করতে হবে এভাবে, যেন সংখ্যাটা নির্দিষ্ট কোনো সময়ে শেষ হয়।
আসলে, সিদ্ধান্ত একটাই, ডিজিটাল অকল্যাণের প্রতিনিধিদের বায়োলজিক্যাল আর কেমিক্যালদের সাথেই বসিয়ে রাখতে হবে। আশা করা যায় চিরদিনের জন্য। পিকো ভন্টে।
৩৭. অপারেশন ডেমোক্লেস
পোল মানুষ আশা করে কখনো ব্যবহার করতে হবে না- সেই অস্ত্র এ্যাসেল করা লোকদের সাথে খুব বেশি যোগাযোগ করেনি। অপারেশনটার নাম দেয়া হয় ডেমোক্রেস। ব্যাপারটা এত বেশি উচ্চ স্তরের যে সে খুব বেশি অবদান রাখতে পারবে না। টাস্কফোর্সের যে রূপ সে দেখেছে, তাতে স্পষ্ট মনে হয় তারা মানুষ নয়, এ্যালিয়েন। একজন পাগলাগারদের ছিল, এখনো এ জিনিসের অস্তিত্ব আছে ভেবে অবাক হয় পোল। চেয়ারপার্সনের অভিমত অবশ্য স্নি, একজন কেন, অত আরো দুজনকে সেখানে পাঠানো উচিৎ।
‘এনিগমা প্রজেক্টের কথা কখনো শুনেছ নাকি? মন নষ্ট করা একটা সেশনের পর জিজ্ঞেস করে মহিলা পোলের দিকে তাকিয়ে।
মাথা ঝাঁকায় পোল।
বলে যাচ্ছে চেয়ারপার্সন, ‘আমি ভেবে অবাক হই তোমার জন্মের মাত্র কয়েক দশক আগের কথা। ডেমোক্রসের জন্য আমি এসব ঘেঁটেঘুঁটে এসেছি। সমস্যার ধরণ মোটামুটি একই রকম- তোমাদের আমলের এক যুদ্ধে শত্রুদের কোড ভাঙার জন্য একদল মেধাবী গণিতবিদকে একত্র করা হল, অত্যন্ত গোপনে… ঘটনাক্রমে, কাজটাকে বাস্তবরূপ দিতে তারা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সত্যিকার কম্পিউটারটা বানিয়ে ফেলে।
‘এ নিয়ে দারুণ গল্প আছে একটা আশা করি ঘটনাটা সত্যি, কারণ এতে আমাদের টিমে দারুণ উৎসাহ জাগবে- একদিন প্রধানমন্ত্রী ভিজিটে এল, তারপর এনিগমার ডিরেক্টরকে বলল: “দুনিয়া ছেনে ফেলে হলেও কাজের লোক নিয়ে আসুন, যখন বলেছিলাম, ভাবিনি সত্যি সত্যি আমার কথাটাকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন।’
প্রজেক্ট ডেমোক্লেসের জন্যও দুনিয়া ছেনে ফেলা হয়েছে। সবচে বড় কথা, এ প্রজেক্টের লোকেরা জানে না কখন কাজে লাগবে এটা- কয়েকদিন পর, কয়েক মাস পর, নাকি বছর কয়েক পর… প্রথম দিকে তাড়া দিয়েও কাজ হচ্ছিল না। খুব একটা গা করছিল না গবেষকরা। গোপনীয়তাও সমস্যা সৃষ্টি করে। তথ্য এখন যে কোনোভাবে যে কোনো জায়গায় পৌঁছে যেতে পারে বলে এ ডোমোক্র প্রজেক্টের কথা আর কেউ জানে না সংশ্লিষ্ট পঞ্চাশজন ছাড়া। কিন্তু এসব লোকের হাতেই সর্বময় ক্ষমতা- যে কোনো তথ্য লুকাতে পারবে, যে কোনো তথ্য প্রকাশ করতে পারবে, যে কোনো শক্তি প্রয়োগ করতে পারবে, একাই পিকো ভল্ট খুলতে পারবে পাঁচশ বছর পর…
ক্রমবর্ধমান ফ্রিকোয়েন্সিতে গ্রেট ওয়ালের ডাটা পাবার কথা হালম্যান প্রকাশ করার পরই ধারণা করা হয় কোনো একটা গন্ডগোল আছে। এই কদিন ব্রেইনক্যাপের এন্টি-ইনসমনিয়া প্রোগ্রাম নিয়েও পোলের ঘুমাতে সমস্যা হয়েছে। অবশেষে ঘুমাতে গেলে মনে প্রশ্ন জাগত, আর জেগে ওঠা হবে তো? কি অবশেষে অস্ত্রের সমস্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়ে গেল। অস্পৃশ্য, অদৃশ্য, অকল্পনীয় এক মারণাস্ত্র। ঢুকিয়ে দেয়া হয় বিশালবপু এক ক্রিস্টালাইন বস্তুতে, ধাতব আবরণে ঢেকে কিছুতকিমাকার করা হয়।
পোল অনিশ্চয়তার সাথে গ্রহণ করে জিনিসগুলো। কে জানে, হিরোশিমার জাপানি ঘাঁটিতে ফেলার জন্য পারমাণবিক বোমা বহনকারী পাইলটেরও এমন লেগেছিল কিনা। তাদের সব ভয় যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে দায়িত্ব আরো বেড়ে যাবে, কমবে না।
মিশনের প্রথম ভাগ সফল হবে কিনা তাও জানা নেই। কারণ কোনো সার্কিটই পুরোপুরি নিখাদ হতে পারে না। হালম্যানকে এখনো প্রজেক্ট ডেমোক্লেসের ব্যাপারটা জানানো হয়নি। গ্যানিমিডে ফিরে আসার সময় কাজটা করবে পোল।
এখন শুধু একটাই আশা- হালম্যান ট্রয়ের ঘোড়র কাজ নিবে এবং, হয়ত, এ পদ্ধতির শিকার হয়ে মিলিয়ে যাবে শূন্যে।
৩৮. প্রিম্পটিভ স্ট্রাইক
এত বছর পর হোটেল গ্যানিমিডে ফিরে আসাটা বিচিত্র লাগে- সবচে অবাক ব্যাপার, সবকিছু একেবারে অপরিবর্তিত মনে হয় এত ঘাত-প্রতিঘাতের পরও। ঘরে প্রবেশ করে পোল। আবারও খুব অস্বস্তি হয়, এ সুইট এমন এক লোকের নামে যে তার সফরসঙ্গি ছিল তখন পর্যন্ত মানব ইতিহাসের সবচে বড় অভিযানে। ছবির ভিতর থেকে তাকিয়ে আছে ডেভ বোম্যান। অন্যদিকে বোম্যান/হালম্যান অপেক্ষা করছে ইউরোপার বুকে।
স্যুইটের পুরনো ধাচের ভিডফোনে পরিচিত মুখাবয়ব ফুটে উঠল।
ফ্র্যাঙ্ক! চিৎকার করে কান ঝালাপালা করে দিতে চায় যেন থিওডোর খান, আসবে সেকথা আমাকে আগে বলনি কেন? ভিডিওতে আর কাউকে দেখা যাচ্ছেনা কেন? তোমার সাথে ল্যান্ড করা পোশাকি অফিশিয়াল ধাচের লোকগুলোই বা কে
প্লিজ, টেড। হ্যাঁ, আমি দুঃখিত, কি বিশাস কর, এসবের পিছনে কারণ আছে, খুবই ভাল কারণ আছে। পরে ব্যাখ্যা করব। যা, সাথে আরো একজনতো আছেই। যত দ্রুত সম্ভব কল করছি। গুডবাই।
‘ডু নট ডিস্টাব সাইন অন করে দেয়ার পর মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, স্যরি এ্যাবাউট দ্যাট- তুমিতো জানই লোকটা কে, তাই না?
হ্যাঁ- ডক্টর খান। মাঝে মাঝে আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টায় মরিয়া হয়ে যায়।
“আর তুমি কখনো জবাব দাওনি। কেন, জানতে পারি কি? আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকতে এ প্রশ্নটা না করে পারে না পোল।
শুধু আমাদের চ্যানেলটা ভোলা রাখতেই ভাল লাগে। মাঝে মাঝে দূরে চলে যাই। কখনো বছরের পর বহর দুরেই থাকি।’
এ কথায় একটু অবাক হয় পোল। এমনটা হবার কথা ছিল না। জানে, হালম্যানের অস্তিত্বের কথা বারবার নানা জায়গায় উঠেছে, তবু, বছরের পর বহর দূরে থাকা? সে সবত অনেকগুলো নবজগৎ ঘুরেছে- হয়ত এ কারণেই নোভা স্করপিওর ব্যাপারটা জানে। জানার কথা, জায়গাটা মাত্র চরিশ আলোকবর্ষ দূরে, মহাজাগতিক হিসাবে প্রতিবেশী। কি একেবারে নডের কাছে গেছে, তা হতে পারে না। গিয়ে ফিরে আসতে আসতে নশ বছর লেগে যাবে।
কপাল ভাল, প্রয়োজনের সময় তোমাকে এখানে পেলাম।
জবাব দেয়ার আগে হালম্যান সাধারণত ইতস্তত করে না। এবার করছে। তিন তিনটা লম্বা সেকেন্ড পেরিয়ে গিয়ে জবাব আসে, তুমি কি নিশ্চিত যে ব্যাপারটা স্রেফ ভাগ্য?
মানে?
‘এসব নিয়ে কথা বলতে চাইনি। কিন্তু আমি… অন্তত দুবার এমন অস্তিত্বের সন্ধান পেয়েছি যা মনোলিথের চেয়ে শক্তিমান; সম্ভবত তারাই মনোলিথের জন্মদাতা। হয়ত আমাদের কল্পনার চেয়ে কম স্বাধীনতা ভোগ করতাম…’ ।
ভাবনাটা আসলেই ভয় ধরিয়ে দেয়। জোর করে এসব চিন্তাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে সমস্যায় মনোনিবেশ করে পোল।
‘আশা করা যাক আমাদের স্বাধীনতা অনেক বেশি। আশা করা যাক প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারব। কে জানে প্রশ্নটা বোকাটে কিনা… আমাদের দেখা হবার কথা জানে নাকি মনোলিথ সন্দেহ করতে পারে?
‘এমন আবেগ নেই সেটার। অসংখ্য ফল্ট প্রটেকশন ডিভাইস আছে, কোনো কোনোটা বুঝতে পারি আমি। এই সব।
‘এখন আমাদের উপর নজরদারি করতে পারবে?
মনে হয় না।’
আশা করি আমার আশাটাই ঠিক, সে সিম্পলমাইন্ডেড সুপার জিনিয়াস। ব্রিফকেস খুলল সে। একটা ট্যাবলেট বের করল। এ সামান্য গ্র্যাভিটিতে এর ওজন একেবারে সামান্য। কে সন্দেহ করবে মানবজাতির ভাগ্য এখন এ ট্যাবলেটের ভিতরে
‘তোমার কাছে একটা সিকিউরড সার্কিট পাঠানোর কোনো উপায় ছিল না আমাদের হাতে। ডিটেইলে যেতে পারিনি এজন্যই। এ ট্যাবলেটে এমন সব প্রোগ্রাম করা আছে যার ফলে মানুষকে ধ্বংস করে দেয়ার মতো যে কোনো আদেশ পালন করতে বাধা দিবে। মানবজাতির ইতিহাসে ডিজাইন করা সর্বশ্রেষ্ঠ বিশটা ভাইরাস আছে এখানে। বেশিরভাগের কোনো এ্যান্টিভোট নেই, এমনকি বিশ্বাস করা হয় কোনো এন্টিডোট তৈরি করাও যাবে না। প্রত্যেকটার পাঁচটা করে কপি। আমরা চাই প্রয়োজন পড়লে তুমি এগুলো রিলিজ করে দিবে। ডেভ হাল- কখনো কারো কাঁধে এত বড় দায়িত্ব দেয়া হয়নি। কী করব, অন্য উপায় যে নেই।
আবারো, জবাবটা ইউরোপা থেকে আসতে সময় নেয়, তিন সেকেন্ডের চেয়েও বেশি।
‘আমরা এমন কিছু করলে মনোলিবের সমস্ত ফাংশন সিজড় হয়ে যাবে। জানি না তখন আমাদের ভাগ্যে কী ঘটবে।
‘আমরা আগেই বিবেচনায় নিয়েছি ব্যাপারটা, অবশ্যই। কি সে সময়ের মধ্যে তোমার হাতে আরো অনেক ফ্যাসিলিটি চলে আসবে। কোনো কোনোটা আমরা বুঝতেই পারব না। সেই সাথে একটা পেটাবাইট মেমোরি ট্যাবলেটও পাঠাচ্ছি। এই টেন টু দ্য ফিফটিন্থ বাইট অনেক জীবনের পূর্ণ স্মৃতি ধরে রাখতে পারবে। তোমাদের জন্য যথেষ্ট। জানি, পালানোর অন্যান্য পথও তৈরি করে রেখেছ তোমরা নিজেরা।
‘ঠিক। কোনটা ব্যবহার করতে হবে সে সিদ্ধান্ত নিব সময়মত।
একটু হাপ ছেড়ে বাঁচে পোল- এমন পরিস্থিতিতে যতটা পারা যায় ততটা। হালম্যান সহায়তা করতে চায়, তার উৎসের সাথে মনের যোগাযোগ আর ভালবাসা আছে এখনো, এটাই অনেক কিছু।
‘এখন, ট্যাবলেটটা তোমাদের কাছে দিয়ে আসতে হবে আমাকে- ভার্চুয়ালি নয়, ফিজিক্যালি। কনটেন্টগুলো এতই ঝুঁকিপূর্ণ যে রেডিও বা অপটিক্যাল কোনো চ্যানেল দিয়ে পাঠানো সম্ভব নয়। জানি, বস্তুর উপর অনেক দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ আছে। তোমাদের: একবার অর্বিটে ভাসতে থাকা বোমা নষ্ট করে দিয়েছিলে না? এটাকে কি ইউরোপায় নিয়ে যেতে পারবে? বিকল্প ভাবা আছে- অটোক্যারিয়ারে পাঠাতে পারি, যেখানে বলবে সেখানেই।
‘এটাই ভাল হয়: জিয়াংভিল থেকে সংগ্রহ করে রাখব। কোঅর্ডিনেট দিচ্ছি…’
.
চিন্তায় ডুবে আছে পোল… ডুবে আছে চেয়ারে এমন সময় বোম্যান স্যুইট মনিটর জানাল পৃথিবী থেকে আসা ডেলিগেটদের হেড অপেক্ষা করছে তার জন্য। কে জানে কর্নেল জোন্স আসলেই কর্নেল কিনা, অথবা তার নাম জোন্স কিনা। এসব সামান্য রহস্য নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই পোলের। সংগঠক হিসাবে যে তার তুলনা নেই, অপারেশন ডেমোক্লেসকে যে সূচারুভাবে চালিয়েছে এই যথেষ্ট।
ফ্র্যাঙ্ক, পথে নেমে গেছে এটা। এক ঘন্টা দশ মিনিটের মধ্যে ল্যাভ করবে। কিন্তু এখনো জানি না কী করে হালম্যান হ্যান্ডল করবে- ঠিক আছে তো হ্যান্ডল করবে কথাটা?- ট্যাবলেটগুলো।
ইউরোপা কমিটির কেউ ব্যাখ্যা করলে পরিষ্কার হতে পারে। খুব বিখ্যাত একটা কথা আছে না কম্পিউটার সম্পর্কে আমাদের সময়ে প্রচলিত ছিল না। যে কোনো কম্পিউটার যে কোনো কম্পিউটারকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই আমি নিশ্চিত হালম্যান করণীয় সম্পর্কে জানে। সব ঠিক না থাকলে কখনোই রাজি হত না।’
‘আশা করি, আপনার কথা ঠিক, জবাব দিল কর্নেল, যদি ভুল হয় তাহলে কোনো বিকল্প আছে কিনা আমার জানা নেই।
ঝপ করে একটু নিরবতা নেমে আসে। দুশ্চিন্তা কমানোর জন্য প্রসঙ্গ পাল্টায় পোল।
আমাদের আসা নিয়ে যে ভাল গুজব ছড়িয়েছে সে সম্পর্কে জানেন নাকি
।‘কোন গুজবটা?
‘যে আমরা এখানে পাঠানো বিশেষ তদন্তকারী দল- ছোট শহরটার অপরাধ দুর্নীতি খতিয়ে দেখব।মেয়র আর শেরিফের লেজ তুলে পালানোর দশা হয়েছে।
‘আহা! তাদের হিংসা করতে ইচ্ছা হচ্ছে, আফসোসের সুরে বলে কর্নেল জোন্স, সামান্য কোনো কারণে চিন্তিত হতে পারতাম যদি তাদের মতো।
৩৯. অমানিশা
আনুবিস সিটির আর সব অধিবাসীর মতো (এখন জনসংখ্যা ৫৬,৫২১) ডক্টর থিওডোর খানও স্থানীয় মাঝরাতে জেনারেল এ্যালার্মের আওয়াজে জেগে যায়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াটা স্বাভাবিক, আবার কোনো বরফ-ভূমিকম্প নয়ত, ফর ডিউস সেক।
জানালার কাছে ছুটে গিয়ে ‘ওপেন এত জোরে বলল যে ঘরটা বুঝতেই পারল । কী আর করা, উত্তেজিতভাব চেপে রেখে শান্ত সুরে আবার বলে সে কথাটা। লুসিফারের আলোর মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে বর্ণিল নকশা তৈরি করার কথা। পৃথিবী থেকে আসা মানুষের কাছে এ মহা দুর্লভ দৃশ্য, তীব্র নকশার এক মিলিমিটারও স্থানান্তর হয় না মিনিটের পর মিনিট চলে গেলেও…
সেই চিরাচরিত আলোর বন্যা নেই। আনুবিস ডোমের বিশাল, স্বচ্ছ বুদবুদের ভিতর থেকে উপরে তাকায় থিওডোর খান। তাকায় চরম অবিশ্বাস নিয়ে। হাজার বছর ধরে গ্যানিমিডের এমন আকাশ দেখা যায়নি। আকাশ শুধু তারায় তারায় ভরা, লুসিফার নামের কোনো নক্ষত্রের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।
তারপরই, আরো আত জাগানো একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে খান। যেখানে লুসিফার থাকার কথা সেখানে কিছুই নেই। এমনকি ওপারের তারাগুলোও দেখা যায় না। সম্ভবত লুসিফার ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়েছে। আর এ কৃষ্ণগহ্বরের করাল থাবায় এরপর যে পড়বে তার নাম গ্যানিমিড।
গ্যানিমিড হোটেলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পোলও একই দৃশ্য দেখছিল, আরো জটিল ভাবনা চলছে তার মনে। জেনারেল এ্যালার্মের আগেই তার কমসেক জাগিয়েছে, হালম্যানের কাছ থেকে মেসেজ নিয়ে এসে।
ঘটনার এখানেই শুরু। আমরা মনোলিথকে ইনফেক্টেড করেছি। কিন্তু একটা… সম্ভবত একাধিক ভাইরাস আমাদের সার্কিটগুলোতেও ঢুকে পড়েছে। জানি না তোমার দেয়া মেমোরি ট্যাবলেটে ঢুকতে পারব কিনা। সফল হলে জিয়াংভিলে দেখা হবে।
এরপরই সে বিচিত্র কথাগুলো আসে যার মানে নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অনুভূতি নিয়ে বিতর্ক থাকবে না মানবজাতির ইতিহাসে।
যদি ডাউনলোড করতে না পারি, মনে রেখ আমাদের।’
তার দরজার পিছনে মেয়রের কণ্ঠ শোনা যায়। আনুবিসের ঘুমভাঙা মানুষগুলোকে অভয় দেয়ার চেষ্টায় প্রাণপাত করছে লোকটা।
জানি না কী ঘটছে, কিন্তু লুসিফার এখনো স্বাভাবিকভাবে জ্বলছে। আমি আবার বলছি, লুসিফার এখনো জ্বলন্ত! ইন্টারঅবিট শাটল এলসায়নের কাছ থেকে খবর পেয়েছি। মাত্র আধঘন্টা আগে ক্যালিস্টোর উদ্দেশ্যে সেটা ছেড়ে গেছে। এখানে ভিডিওগুলো দেখানো হল।
বারান্দা ছেড়ে পড়িমড়ি করে ভিডক্রিনের সামনে চলে আসে পোল। লুসিফার পূর্ণ প্রতাপ নিয়ে ভেসে আছে আকাশে।
আসলে, কোনো এক কারণে সাময়িক গ্রহণ হচ্ছে’ বলে মেয়র, ভালভাবে দেখার জন্য জুম ইন করব… ক্যালিস্টো অবজার্ভেটরি, কাম ইন প্লিজ…’।
আমি কী করে বিশ্বাস করি যে এ গ্রহণটা সাময়িক স্ক্রিনে আসতে থাকা পরের দৃশ্যের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ভাবে পোল।
হারিয়ে গেল লুসিফার। আকাশজোড়া নক্ষত্রের রাজ্য। মেয়রের কঠ স্নান করে আরেকটা কষ্ঠ বলে উঠল।
‘–দু-মিটার টেলিস্কোপ, কিন্তু প্রায় যে কোনো ইনমেন্টেই কাজ চলবে। নিখুঁত কালো জিনিসে ঘেরা একটা ডিস্ক দেখা যাচ্ছে। দশ হাজার কিলোমিটারের সামান্য বেশি এলাকা জুড়ে আছে ডিটা। এত পাতলা যে এর কোনো দৃশ্যমান পুরুত্ব নেই। এটা এমনভাবে সাজানো যেন গ্যানিমিডে কোনো আলো আসতে না পারে ।
‘আরো জুম ইন করছি, কোনো ডিটেইলস দেখা যায় কিনা দেখতে হবে, যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে আশা করি না যে…’
ক্যালিস্টোর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায় ডিস্কটা অর্ধবৃত্তাকার। ডিমের খোসা অর্ধেক করলে যেমন হয় তেমন। যতটা চওড়া তার দ্বিগুণ লম্বা। পুরো ক্রিনজুড়ে আসার আগ পর্যন্ত ছড়াতে থাকে কিন্তু জুম করা হয়েছে কিনা বোঝার কোন উপায় নেই, কারণ গড়নটায় কোনো হেরফের হয়নি, একটুও ডিটেইল দেখা যায় না।
‘যেমন ধারণা করেছিলাম, কোনো কি দেখা যাবে না। জিনিসটার প্রান্তে প্যান করা যাক…’
তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। ভুবনজোড়া চাকতির একপ্রান্তে উদিত হয়েছে নক্ষত্রবীথি। যেন তারা কোনো মসৃণ, বায়ুমন্ডলহীন গ্রহের উপর কালো রাত দেখছে। না, একেবারে মসৃণ নয়…। ইন্টারেস্টিং ব্যাপারতো…’ মন্তব্য করল এ্যাট্রোনোমার, যার এতক্ষণের কথাবার্তায় মনে হচ্ছিল এমন ঘটনা হরদম ঘটে। প্রান্তগুলো যেন অসমান জিগজ্যাগ- কিন্তু নিয়মিত ঠিক যেন করাতের কিনারা…’
বৃত্তাকার করাত, পোল গুঙিয়ে ওঠে। আমাদের ঘিরে ফেলবে নাতো! বিচিত্র সব ভাবনা আসে এমন সময়ে…
সরণের জন্য চিত্র নষ্ট হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত এটুকুই দেখতে পারি আমরা প্রসেস করে পরে আরো ভাল চিত্র পাওয়া যাবে আশা করি।’
চিত্রটা এখন এত বড় যে চাকতিটাকে সমতল দেখাচ্ছে। ভিডক্রিনজুড়ে কালো ফিতা দেখা যায়। প্রান্ডটা এত বেশি নিখুঁতভাবে ত্রিকোণ অবয়বে জানো যে চাইলেও করাতের কথা ভোলা যায় না। মনের গহিনে কী চিতা যেন ঘাই দিচেহ…
গ্যানিমিডে থাকা সবার মতো সেও এখন ত্রিকোণ পর্বতের আড়ালে থাকা তারাগুলোর আসা যাওয়া দেখতে পায়। সম্ভবত সে সিদ্ধান্তে আসার আগে আরো অনেকে চলে এসেছে।
যদি কেউ চতুষ্কোণ ব্লক দিয়ে একটা বৃত্ত গড়তে চায়- অনুপাত ১:৪:৯ হোক আর যাই হোক- প্রান্তগুলো সম্ভবত মসৃণ হবে না। অবশ্যই, ছোট ছোট রক ব্যবহার করে প্রায় মসৃণ করা যাবে, কিন্তু গাণিতিক হিসাবে সত্যিকার নিখুঁত বৃত্ত গড়া যাবে না। বাইরের প্রান্ত একটু এবড়োথেবড়ো থাকবেই। কি উদ্দেশ্য যখন সূর্য আড়াল করার মতো স্ক্রিন তৈরি করা, তখন কে নিখুঁত করার ঝামেলায় যাবে?
মেয়রের কথা সত্যি, ক্লিনটা সাময়িক। কি সৌরসময়ের হিসাবে এ সাময়িক সময়টা কত ল তা জানা সম্ভব নয়।
আরো জুম করা হয়েছে। আরো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে লুসিফার আড়াল করা জিনিসটার গাঠনিকতা। ঠিকই, অসংখ্য একক দিয়ে গঠিত। সম্ভবত ইউরোপার মহাপ্রাচীরের সমান লাখ লাখ ক’ দিয়ে গড়া। এখন তারা সরে যাচ্ছে। আলো আসহে ফাঁকফোকড় দিয়ে। যেন দানবীয় এক জিগস পাজলকে এলোমেলো করে দেয়া হচ্ছে আস্তে আস্তে।
এলোমেলো আলো এসে পড়হে গ্যানিমিডের বুকে। আস্তে আস্তে বাশীভূত হচেই চতুষ্কোণগুলো, যেন একত্রে থাকলেই ব্লক করে রাখতে পারত, এখন আর সম্ভব নয়।
আনুবিস সিটির মানুষের কাছে যেন ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কেটে গেল, আসলে পুরো ব্যাপারটা ঘটে মাত্র পনের মিনিটে। পুরো ব্যাপারটা ফুরিয়ে যাবার আগে কেউ ইউরোপার দিকে মন দিতে পারেনি।
সেখানে মহাপ্রাচীরের কোনো অস্তিত্ব নেই। ঘন্টাখানেক পর পৃথিবী, মঙ্গল, চাঁদ থেকে খবর এল, সূর্যও সামান্য সময়ের জন্য মিটমিটে হয়ে গিয়েছিল, আবার আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে।
খুব সাবধানে বেছে নেয়া হয়েছিল চন্দ্রকলার মতো গড়নগুলোকে উদ্দেশ্য মানবজাতি। সৌরজগতের আর কোথাও অন্য কিছু টের পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের পর মানুষ টের পায়, টি এম এ-জিরো আর টি এম এ-ওয়ান নেই। টাইকো আর আফ্রিকার বুকে রেখে গেছে তাদের চরিশ লাখ বছরের স্মৃতিচিহ্ন।
.
হয়ত এই প্রথম ইউরোপানরা তাদের মাঝে মানুষের সন্ধান পেল। কিন্তু বজ্রগতিতে চলতে থাকা বিশালবপু প্রাণিগুলোকে দেখে তারা না পাচ্ছে ভয়, না হচ্ছে অবাক।
এই বিচিত্র পাতা ও প্রশাখাহীন ছোট গাছগুলোকে দেখে তাদের কী অনুভূতি হয় তা জানা সহজ নয়। যোগাযোগের কোনো মাধ্যম আছে কি তাদের?
তারা যদি এলসায়ন নামার পর সেখান থেকে অভিযাত্রীদের বেরুতে দেখত, তাহলে গুটিশুটি মেরে ইগলুতে গিয়ে লুকাত এতে কোনো সন্দেহ নেই।
ফ্যাৰু পোল স্পেসস্যুটের ভিতরে থেকে উজ্জ্বল তামার তারের উপহার নিয়ে যেতে যেতে ভাবে, ইউরোপারা কী ভাবছে সাম্প্রতিক এ ঘটনার ব্যাপারে তাদের সাপেক্ষে ইউরোপায় কোনো গ্রহণ হয়নি, কিন্তু মহাপ্রাচীরের অন্তর্ধান নিশ্চয়ই অবাক করেছে। স্মৃতিরও আগে থেকে জিনিসটা এখানেই ছিল, বর্ম হিসাবে, প্রতিরক্ষা হিসাবে, এবং আরো অনেক কিছু হিসাবে যা তারা বুঝতে শিখেনি; তারপর, আচমকা চলে গেল সেটা, এমনভাবে চলে গেল যেন কোনোদিন ছিলই না…।
পেটাবাইটের ট্যাবলেটটা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে, জিনিসটার চারপাশে জটলা পাকাচ্ছে একদল ইউরোপা, এই প্রথম দেখল, আগ্রহ দেখাচ্ছে তারা কোনো বিষয়ে। কে জানে, হালম্যান তাদের বলে দিয়েছে কিনা এটার কথা, বলে দিয়েছে কিনা দেখভাল করার কথা- সে আসার আগ পর্যন্ত।
এখন এটাকে সরিয়ে নিতে হবে। সরিয়ে নিতে হবে এর ভিতরে থাকা বন্ধু সহ, ভিতরে থাকা এমন আতঙ্ক সহ, যার সমাধান করবে ভবিষ্যতের কোনো মানবসমাজ, তারপর মুক্ত করবে ভিতরের অস্তিত্বটাকে। সে পর্যন্ত রেখে দিতে হবে বিশেষ এক জায়গায়…
৪০. মধ্যরাত্রি : পিকো
এর চেয়ে বেশি শান্তিময় দৃশ্যের কথা কল্পনা করা কঠিন, ভাবে পোল। গত কয়েক সপ্তাহের ঝক্কি-ঝামেলার পর এখন মন জুড়ে আছে অবসাদ। পূর্ণ পৃথিবীর আলোয় ভাসছে জলহীন বৃষ্টিসাগর।
চান্দ্রযানের ছোট্ট বহর পিকো পর্বতের ভল্টটার সামনে অর্ধবৃত্ত রচনা করে দাঁড়ানো। পর্বতটা মোটামুটি গোলাকার, আর সব পাহাড়ের মতো খাড়া তীক্ষ্ণ চূড়া নেই। স্থানীয় বাইসাইকেল রাইডাররা তীব্রগতিতে চলে যায় বিভিন্ন প্রতিযোগিতার সময়, এর উপর দিয়েই। তারা কল্পনাও করতে পারবে না এর ভিতরে কী লুকানো আছে। জানলে তাদের স্বাস্থসম্মত এসব চর্চা কোথায় উবে যেত কে জানে!
ঘন্টাখানেক আগের কথা। মনের যন্ত্রণা লুকাতে পারে না পোল। গ্যানিমিড থেকে সোজা চাঁদে নিয়ে আসার পথে জিনিসটাকে একবারও চোখের আড়াল করেনি সে।
‘বিদায়, প্রিয় বন্ধুরা, নিচু স্বরে বলে সে, ভাল কাজ করেছ। হয়ত পরের কোনো এক প্রজন্ম জাগাবে তোমাদের। কিন্তু সব মিলিয়ে আমার খুব একটা আশা নেই।
সে ভালভাবেই জানে কেন হালম্যানের স্মৃতি প্রয়োজন। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো মেসেজ চলে গেছে নিয়ন্ত্রকের কাছে। কপাল ভাল, জবাব পৌঁছতে সাড়ে নয়শ বছর লাগবে।
আগের দিনে পোল মাঝে মাঝেই আইনস্টাইনকে অভিশাপ দিত। এখন দেখা যাচ্ছে মনোলিথের পিছনে যে বিপুল শক্তিমত্তা কাজ করে তারাও আলোর গতি ভেদ করতে পারেনি। তাই মানবজাতির হাতে আরো হাজারখানেক বছর আছে পরের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার পথে- যদি আদৌ যুদ্ধ থেকে থাকে। হয়ত ততদিনে প্রস্তুতি ভালভাবেই নেয়া হয়ে যাবে।
সুড়ঙ্গ থেকে কী যেন বেরিয়ে আসছে- ট্যাবলেটটাকে ভন্টে নিয়ে গিয়েছিল যে সেমি-হিউম্যানয়েড রোবট, সেটা। এই বায়ুমন্ডলহীন চাঁদের বুকে একটা রোবটকে আইসোলেশন স্যুট পরা অবস্থায় দেখলে হাস্যরসাত্মক মনে হতে পারে পুরো ব্যাপারটা। কিন্তু কেউ কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। ভিতরের অসংখ্য ক্যামেরা থাকার পরও যে কোনো সময় যে কোনো ক্যানিস্টার লিক হয়ে যাবার বা কোনো দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। চান্দ্ৰপরিবেশ অনেক স্থিত, কিন্তু অনেক আগে এখানে ভূকম্পন আর উল্কাপাতের ঘনঘটা দেখা যেত।
সুড়ঙ্গের মুখ থেকে অর্ধশত মিটার দূরে এসেই থেমে যায় রোবটটা। যে বিশাল পাগটা এটাকে ধরে রেখেছিল সেটাই এক সময় ঘুরতে শুরু করে।
‘ডার্ক গ্লাস পরেননি এমন সবাই রোবটের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন। চান্দ্রযানের ভিতর থেকে রেডিওতে চিৎকার করে ওঠে এক ড্রাইভার।
সাথে সাথে মুখ ঘুরিয়ে নেয় পোল। একই সাথে দেখতে পায়, আমোর একটা ঝলক খেলে যাচ্ছে যানগুলোর উপর দিয়ে।
ফিরে তাকায় রোবটটার দিকে। জলছে সেটা। চাঁদে বাতাস নেই, তাই পাক খেয়ে খেয়ে ধোয়া উঠে যায় না উপরদিকে, তবু, ব্যাপারটা না দেখলে কেমন যেন অস্বস্তি হয়।
‘স্টেরিলাইজেশন কমপ্লিট। ঘোষণা করল একজন, লোকটা মিশন কন্ট্রোলার, ‘ধন্যবাদ সবাইকে। এখন প্লেটো সিটিতে ফিরে যাচ্ছি আমরা।’
কী অবাক ব্যাপার! মানবজাতি তারই তৈরি করা অকল্যাণের কারণে আজ বেঁচে গেল। এ থেকে কোনো নীতিকথা বের করে নিবে মানুষ?
সুন্দর, নীল এক গ্রহ ভেসে আছে আকাশে। পৃথিবী। উপরে পাক খেয়ে বেড়ায় মেঘের দল। মহাকাশের হিমশীতলতা থেকে রক্ষা করে। সেখানে, আর কয়েক মাস পর, প্রথম দৌহিত্রকে কোলে তুলে নেয়ার আশা করে পোল।
তারার রাজ্যের আড়ালে ঈশ্বরতুল্য যে ক্ষমতাবানরাই থাক না কেন, মনে করিয়ে দেয় পোল নিজেকে, সাধারণ মানুষের জন্য দুইটা ব্যাপারই সবচে বড় ভালবাসা আর মৃত্যু।
শরীরের বয়স এখনো একশ হয়নিঃ দুইটার জন্যই অনেক সময় পড়ে আছে।
সমাপ্তি
তাদের হোট সৃষ্টিজগত এখনো নবীন। এর ঈশ্বর এখনো শিশুতুল্য। কিন্তু তাদের নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আসছে শেষ দিনগুলোতে আমরা ফিরে এলেই সিদ্ধান্ত নিব কোনটাকে রক্ষা করতে হবে।
চ. উৎস ও কৃতজ্ঞতা
উৎস
অধ্যায় ১: ধূমকেতুর রাখাল ছেলে।
ক্যাপ্টেন চ্যান্ডলারের শিকারভূমির ব্যাপারটা আমি আবিষ্কার করেছি ১৯৯২ সালে। দেখুন, জেন এক্স লু ও ডেভিড সি জেউইট লিখিত ‘দ্য কুইপার বেল্ট (সায়েন্টিফিক আমেরিকান, মে, ১৯৯৬)।
অধ্যায় ৪ : দৃষ্টি যায় দূরে
জিও স্টেশনারি অর্বিট (জি ই ও) তে পৃথিবীর চারধারে একটা আঙটি তৈরি করা যেতে পারে বিষুবিয় অঞ্চলে গড়ে তোলা কয়েকটা আকাশভেদী টাওয়ারের মাধ্যমে। প্রাথমিকভাবে ধারণাটা একেবারে অযৌক্তিক মনে হলেও বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা আছে। এটাই সেন্ট পিটার্সবার্গ ইঞ্জিনিয়ার ইউরি আর্টমুটানভ প্রস্তাবিত ‘স্পেস এলিভেটরের প্রবর্ধিত ধারণা। এ বিজ্ঞানীর সাথে আমার দেখা করার সৌভাগ্য হয়েছিল ১৯৮২ সালে, তখন তার সিটির নাম ছিল স্নি।
ইউরি নির্দেশ করেন, তাত্ত্বিকভাবে পৃথিবী ও বিষুবের উপর ভাসতে থাকা একটা স্যাটেলাইটের মধ্যে তারের সংযোগ দেয়া সম্ভব- যদি কৃত্রিম ভূ-স্থির উপগ্রহটা জি ই ও তে থাকে, বর্তমানের বেশিরভাগ কমনিকেশন স্যাটেলাইট যে উচ্চতায় আছে। শুরুতে একটা স্পেস এলিভেটর (ইউরির কথা অনুযায়ী কসমিক ফানিকুলার) বানানো সম্ভব যেটা জি ই ও পর্যন্ত ইলেক্ট্রিক্যাল এনার্জির সাহায্যে বস্তু নিয়ে যেতে পারবে। যাত্রার বাকি অংশটুকুর জন্যই শুধু রকেট প্রোপালশন প্রয়োজন।
পৃথিবীর বুক থেকে রকেট ছাড়তে যে ঝুঁকি, পরিবেশ দূষণ আর শব্দ-কম্পনের ভীতি আছে তার হাত থেকে বাঁচার জন্যও এটা করা যায়। করা যায় অনেক খরচ বাঁচানোর জন্য। বিদ্যুৎ সস্তা। একজন মানুষকে অর্বিটে পৌঁছে দিতে খরচ পড়বে সাকুল্যে মাত্র একশ ডলার। রাউন্ড ট্রিপের জন্য খরচ? মাত্র দশ ডলার। আবার নিচের দিকে যাত্রা হলে বেশিরভাগ খরচই উঠে আসবে, কারণ এ্যানার্জি গেইন করা যাবে। (আর টিকিটের সমস্ত রাহা-খরচ চলে আসবে খাবার দাবার, ইনফ্লাইট মুভি থেকেই। ভাবা যায়, মাত্র হাজারখানেক ডলার দিয়ে জি ই ও তে গিয়ে আবার ফিরে আসা সম্ভব!)
তত্ত্বে কোনো ত্রুটি নেই, কিন্তু এমন পদার্থ পাব কী করে যেটা পৃথিবীর বুক থেকে ছত্রিশ হাজার কিলোমিটার দূর পর্যন্ত যেতে পারবে বাড়তি অ নিয়েও? ইউরি তার পেপার লেখার সময় এই শক্তি দিতে পারত মাত্র একটা বস্তু। ক্রিস্টালাইন কার্বন, আমরা যাকে হিরা নামে চিনি। দূর্ভাগ্যবশত খোলাবাজারে এত মেগাটন হিরা পাওয়া কল্পনামাত্র। ২০৬১: ওডিসি ঐ তে আমি দেখাই যে এ হিরা আসবে বৃহস্পতির কেন্দ্রবিন্দু থেকে। আর দ্য ফাউন্টেইনস অব প্যারাডাইস এ আরো সহজ উৎস নির্দেশ করি- অর্বিটিং ফ্যাক্টরি, যেগুলোকে জিরো গ্র্যাভিটিতে হিরা ফলানো সম্ভব।
১৯৯২’র অগাস্টে স্পেস এলিভেটরের পথে প্রথম পদক্ষেপ নেয়া হয়। শাটল আটলান্টিসে একুশ কিলোমিটার উপর পর্যন্ত পেলোড তোলার চেষ্টা করলেও মাত্র কয়েকশ মিটার গিয়েই পেয়িং আউট মেকানিজম জ্যাম হয়ে পড়ে।
আমি খুব খুশি হয়েছিলাম আটলান্টিসের কুরা অবিটাল প্রেস কনফারেন্সে দ্য ফাউন্টেন অব প্যারাডাইস তৈরি করায়। মিশন স্পেশালিস্ট জেফ্রি হফম্যান অটোগ্রাফ করা কপি দিয়েছিলেন আমাকে পৃথিবীতে ফিরে আসার পর।
১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি। দ্বিতীয় পদক্ষেপ। আরো একটু বেশি সফল। পেলোড শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ইনস্যুলেশনের ভুলের কারণে মালামাল শেষ পর্যও তোলা যায়নি। (আশা করি এটা সৌভাগ্যজনক দূর্ঘটনা, কারণ বস্ত্রপাতের সময় ঘুড়ি ওড়ানোর চেষ্টার মতো কোনোকিছু ঘটেনি।)।
অন্যদিকে কার্বনের তৃতীয় রূপ বাকমিন্সটারফুলারেন (সি সিক্সটি) স্পেস এলিভেটরের সম্ভাবনাকে আরো জোরদার করে। ১৯৯০ সালে রাইস ইউনিভার্সিটি ও হিউস্টনের একদল কেমিস্ট কার্বন সিক্সটির নলাকার ফর্ম আবিষ্কার করেন হিরার চেয়েও অনেক শক্ত বও। দলনেতা ডক্টর স্মলি দাবি করেন বিব্রহ্মান্ডে এর চেয়ে শক্ত আর কোনো বস্তুর অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয়। আরো বলেন, স্পেস এলিভেটর তৈরি হবে এটা দিয়েই। (আমি জেনে খুব খুশি যে ডক্টর স্মলি ১৯৯৬ সালের নোবেলপ্রাইজ ছিনিয়ে এনেছেন এ কাজের জন্য, কেমিস্ট্রিতে।)
বাকমিনিস্টার ফুলার ১৯৮৩ সালে মারা যান। বাকিবল আর বাকিটিউব দেখেননি কখনো, যা তাকে মৃত্যুর পর আরো অনেক খ্যাতি এনে দেন। পৃথিবী ঘোরার পথে তিনি সস্ত্রীক শ্রীলঙ্কায় এসেছিলেন, আমি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দ্য ফাউন্টেইনস অব প্যারাডাইসের জায়গাগুলো দেখিয়েছি। পরে আমি একটা বারো ইঞ্চি এলপি রেকর্ড করেছিলাম সেটার, তিনি ভিনোট লেখেন। সেখানে আরো কয়েকটা কথা ছিল যা আমাকে নক্ষত্ৰনগরীর পথে উৎসাহ যোগায় :
১৯৫১ সালে আমি পৃথিবীর চারপাশে, বিষুবিয় অঞ্চলের উপর একটা মুক্ত ভাসমান রিঙের কথা লিখেছিলাম। এ হলোব্রিজের ভিতরে পৃথিবী ঘুরতে থাকবে।
আমার কোনো সন্দেহ ছিল না মানবজাতি যদি এমন কোনো বিনিয়োগের কথা মাথায় রাখে, তাহলে স্টারসিটি বানানো সম্ভব। তাহলে মানুষের পরবর্তী কলোনিগুলো, যেমন মঙ্গল ও চাঁদ, যেখানে গ্র্যাভিটি কম, সেখান থেকে পৃথিবীতে আসার পথে কম গ্র্যাভিটির স্থান নক্ষত্ৰনগরীতে প্রতি নেয়া যাবে। আবার বহির্জাগতিক সমস্ত রকেট্রির কাজে লাগবে জায়গাটা পৃথিবীকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করবে, একই সাথে যাতায়াতের খরচ কমে যাবে। (আশা করি সেসব দিনে মাঝে মাঝে কেপ কেনেডিতে মানুষকে দেখানোর জন্য বিশেষ বিশেষ সময়ে উড্ডয়নের আয়োজন করা হবে। মানুষ তখন মহাকাশ যুগের প্রথম দিকগুলোর কথা ভেবে উদ্বেলিত হবে।)
অবশ্যই, বেশিরভাগ জায়গা থাকবে খালি, সামান্য কোথাও কোথাও থাকবে প্রযুক্তিগত ঘাঁটি। কারণ প্রতিটা টাওয়ার হবে এক কোটি স্কাইস্ক্র্যাপার ফ্লোরের সমতুল্য। যদি পুরো জায়গাটা ভরে যায়, তাহলে পৃথিবীর বিশাল, অকল্পনীয় জনসংখ্যা নিয়েও ভাবতে হবে না। মাতা বসুমতাঁকে রাখা যাবে আর সব জীবের ন্য।
অধ্যায় ৫: শিক্ষা
১৯ জুলাই ১৯৯৬’র স্থানীয় পত্রিকা দেখে অবাক হয়েছিলাম। ব্রিটিশ টেলিকমের আর্টিফিশিয়াল লাইফ টিমের প্রধান ডক্টর ক্রিস উইন্টার বলেন, আমি এ অধ্যায়ে যে ক্ষমতাসম্পন্ন মেমোরি ডিভাইসের কথা বলেছি সেটা চলে আসবে ত্রিশ বছরের মধ্যে! (১৯৫৬ সালের উপন্যাস দ্য সিটি এ্যান্ড দ্য স্টার্স এ আমি এ সংখ্যাটা বিলিয়ন বছর পরে দিয়েছিলাম… কল্পনার কী ব্যর্থতা!) ডক্টর উইন্টার বলেন এর ফলে আমরা, একজন মানুষকে শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে, আবেগিকভাবে আবার তৈরি করতে পারব। ধারণা করেন এতে মেমোরি লাগবে মোটামুটি দশ টেরাবাইট (টেন টু দ্য পাওয়ার পার্টিন বাইট), পেটাবাইটের (টেন টু দ্য পাওয়ার ফিফটিন বাইট) কথা বলেছিলাম আমি, তার চেয়ে দু ধাপ নিচেই।
ভেবেছিলাম ডক্টর উইন্টারের নামে ডিভাইসটার নাম দেব, এতে আরো বিতর্ক বাড়তে পারে। দেখুন নবম অধ্যায়ের নোট।
আমার বিশ্বাস আমি তৃতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত পাম-টু-পাম ট্রান্সফার ইনফরমেশন ধারণাটা দিয়েছি। দেখা গেল নিকোলাস নিগ্রোপটে আর তার এম আই টি মিডিয়া ল্যাব এ নিয়ে অনেক বছর ধরেই গবেষণা করছে…
অধ্যায় ৭: ডিব্রিফিঙ
জিরো পন্টিং ফিল্ড (কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন্স বা ভ্যাকুয়াম এ্যানার্জি নামেও পরিচিত) এর শক্তি যদি একবার আবিষ্কার করা যায় তাহলে আমাদের সভ্যতার খোল নলচে পাল্টে যাবে। শক্তির বর্তমানে ব্যবহৃত সব উৎস- তেল, কয়লা, নিউক্লিয়ার, হাইড্রো, সোলার একেবারে অকিঞ্চিৎকর হয়ে পড়বে। একই সাথে পরিবেশ নিয়ে আমাদের চিন্তারও অবসান ঘটবে। শুধু একটা চিন্তা আসবে মাথায় তাপ দূষণ। সব এ্যানার্জি সবশেষে তাপে পরিণত হয়। সবার হাতে যদি কয়েক মিলিয়ন কিলোওয়াট নিয়ে ছেলেখেলা করার সুযোগ চলে আসে তাহলে পৃথিবীটা দ্রুত শুক্রের পথ ধরবে- কয়েকশত ভিগ্রি বেড়ে যাবে তাপমাত্রা।
যাক, চিত্রের ভাল একটা দিকও আছে, পরবর্তী বরফযুগের চিন্তা থাকবে না, যা ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। (সভ্যতা আসলে বরফযুগগুলোর মাঝের বিরতি উইল ডুরান্ট, দ্য স্টোরি অব সিভিলাইজেশন।)
এমনকি এখন যে আমি লিখছি, তখনো অনেক প্রতিযোগী ইঞ্জিনিয়াররা পৃথিবীজুড়ে এ শক্তিকে দখল করার আশা করছেন, দাবি করছেন। ফিজিসিস্ট রিচার্ড ফিম্যান বলেছিলেন একটা কফির মগে যেটুকু এ্যানার্জি থাকবে তা পৃথিবীর সব সাগরের পানিকে উবিয়ে দিতে পারবে।
এ চিন্তা একটা সিদ্ধান্তে নিয়ে আসে। নিউক্লিয়ার এ্যানার্জি ড্যাম্প হওয়া ম্যাচক্সের সমতুল্য।
আর কতগুলো সুপারনোভা, অবাক হয়ে ভাবি মাঝে মাঝে, আসলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এ্যাভিডেন্ট
অধ্যায় ৯ : স্কাইল্যান্ড
স্টারসিটির যোগাযোগের সবচে বড় সমস্যা হল দূরত্ব। পরের টাওয়ারে থাকা কোনো বন্ধুর সাথে আপনি যদি দেখা করতে চান (ভার্চুয়াল রিয়েলিটি যতই সর হোক না কেন কখনোই ক্যুনিকেশন সরাসরি স্পর্শের জায়গা নিতে পারবে না…) তাহলে যাত্রাটা পৃথিবী-চাঁদের যাত্রার মতো হবে। দ্রুততম এলিভেটরে যেতেও কয়েকদিন লেগে যাবে, ঘন্টা কয়েক নয়। এসব দ্রুতি লো গ্র্যাভিটির মানুষদের জন্য সমস্যাসঙ্কুল।
‘ইনার্শিয়ালেস ড্রাইভের’ ধারণাটা এমন এক প্রোপালশন সিস্টেমকে নির্দেশ করে যা মানুষের দেহের প্রতিটা অণুর উপর কাজ করবে। এ ধারার জনক সম্ভবত স্পেস অপেরার মাস্টার ই ই স্মিথের কাছ থেকে এসেছে ১৯৩০ সালে।
আপনি যদি পৃথিবীর কাছাকাছি মুক্তভাবে পড়তে থাকেন (বাতাসের প্রভাবকে পাশ কাটিয়ে) তাহলে আপনার গতি বাড়বে সেকেন্ডে দশ মিটারের একটু নিচে, প্রতি সেকেন্ডে। কিন্তু তখন ওজনহীনতার অনুভুতি হবে যদিও দেড় মিনিটের মধ্যে গতি বেড়ে যাচ্ছে এক কিলোমিটার।
এ কথাও সত্যি, বৃহস্পতির বুকে মুক্তভাবে পড়তে থাকলে (পৃথিবীর টানের চেয়ে মাত্র আড়াইগুণ বেশি) বা সাদা বামন অথবা নিউট্রন স্টারের কাছে পড়তে থাকলেও (শত কোটি গুণ বেশি) আপনি কিছুই অনুভব করবেন না। কিন্তু সে সময় একটা সমস্যা হবে, শরীরের প্রতিটা বিন্দুতে একই ধরনের কাজ করবে না আকর্ষণ ক্ষমতা, ফলে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে দেহ। আরো বিস্তারিত দেখুন আমার ছোটগল্প নিউট্রন টাইড’ (স্য উইন্ড ফ্রম দ্য সানএ)।
একটা ইনার্শিয়ালেস ড্রাইভ,’ যেটা নিয়ন্ত্রণযোগ্য গাড়িটি ফিল্ড হিসাবে কাজ করবে, তার ব্যাপারে সায়েন্স ফিকশনের পাতার বাইরে এ পর্যন্ত কখনো সিরিয়াসলি আলোচনা হয়নি। কিন্ত ১৯৯৪ তিন আমেরিকান ফিজিসিস্ট ঠিক এ কাজটাই করেন, মহান রাশিয়ান পদার্থবিদ আন্দ্রে শাখার ধারণার উপর ভর করে।
বি হাইশ্চ, এ রুয়েডা এবং এইচ ই পুটহফ লিখিত ইনার্শিয়া এজ এ জিরোপয়েন্ট ফিল্ড লরেও ফোর্স একদিন মাইলফলক পেপার হিসাবে বিবেচিত হবে। কল্পকথায় আমি সেটাই ব্যবহার করেছি। এটা এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কথা তুলছে যেটা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরাও কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলবেন, ‘এভাবেইতো সৃষ্টিজগৎ তৈরি।
এইচ, আর ও পি যে প্রশ্নটা তুলেছেন তা হল, কোন ব্যাপারটা একটা বস্তুকে র (বা ইনার্শিয়া) দেয় যার কারণে এটাকে চলা শুরু করতে চেষ্টা করতে হয় এবং আসল অবস্থায় ফিরে আসতে আবার ঠিক ততটুকু কষ্ট করতে হয়?
তাদের কাঙ্ক্ষিত উত্তর নিন্দ্র করে বিচিত্র এবং পদার্থবিদদের আওতার বাইরে খুব কম জানা একটা ব্যাপারের উপর। তথাকথিত শূন্য এলাকা আসলে টগবগিয়ে ফুটতে থাকা শক্তির প্রবাহ জিরো পয়েন্ট ফিল্ড (আগে উল্লিখিত)। এইচ আর ও পি প্রস্তাব করেন, ইনার্শিয়া ও গ্র্যাভিটি দুইটাই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক অবস্থা, এ ক্ষেত্রগুলোর সাথে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার ফলে সৃষ্টি হয়।
অসংখ্য চেষ্টা করা হয়েছে, একেবারে ফ্যারাডের আমলে ফিরে যেতে হয়েছে মহাকর্ষ আর চৌম্বকত্বকে মিলাতে গিয়ে। অনেক পরীক্ষার পরই সাফল্যের দাবি এসেছিল, কোনোটাই আবার যাচাই করে প্রমাণিত হয়নি। যদি এইচ আর ও পির তত্ত্ব প্রমাণিত হয় তাহলে এন্টি গ্র্যাভিটি স্পেস ড্রাইভ বানানো সম্ভব হবে; এমনকি ইনার্শিয়ার মতো বিশাল ব্যাপারকে নিয়ন্ত্রণও সম্ভব। দারুণ কিছু ব্যাপার ঘটতে পারে ফলশ্রুতিতে- ধরা যাক আপনি কাউকে একটু স্পর্শ করলেন, সাথে সাথে সে ঘন্টায় কয়েক হাজার কিলোমিটার গতিতে সরে যাবে, দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে আবার ফিরে আসবে মাত্র কয়েক মিলিসেকেন্ডের ব্যবধানে। সুসংবাদ হচ্ছে, তখন যানবাহনের দূর্ঘটনা অসম্ভব হয়ে পড়বে অটোমোবাইল এবং যাত্রিরা যে কোনো গতিতে পরস্পরের সাথে ধাক্কা খেলেও বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না।
ওজনহীনতার ব্যাপারটা আজকে শুধু স্পেস মিশনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও পরবর্তী শতাব্দিতে লাখ লাখ ট্যুরিস্ট ব্যাপারটা উপভোগ করবে। আমাদের গ্র্যান্ডপ্যারেন্টদের কাছে কিন্তু অকল্পনীয় স্বপ্ন ছিল এসব। কিন্তু জড়তার আংশিক বা পুরোপুরি বিলোপ ভিন্ন ব্যাপার, হয়ত একেবারেই অসম্ভব। (১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে ফিনল্যান্ডের কিছু বিজ্ঞানী দাবি করেন, একটা দুরন্ত সুপারকভাক্টিং ডিস্কের উপর সামান্য [১% এরও কম গ্র্যাভিটি কমার ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন। মিউনিখের ম্যাক্স প্যাক ইন্সটিটিউট এমনি ফলাফলের ইঙ্গিত দিয়েছিল। যদি একথা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে অনেক প্রতিক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে।)
চিন্তাটা ভাল। টেলিপোর্টেশনের সমান ব্যাপার হবে সেটা। আপনি পৃথিবীর বুকে যে কোনো জায়গায় চলে যেতে পারবেন এক সেকেন্ডের ব্যবধানে। সত্যি বলতে কী, স্টারসিটি এছাড়া কী করে কাজ করবে তা জানি না… ।
এখানে, বিশেষত এ উপন্যাসে আমি একটা কথাকে সত্যি ধরে নিয়েছি আইনস্টাইনের কথা মতো, কোনো কিছুই আলোর চেয়ে বেশি গতিতে যেতে পারবে না। সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী গাণিতিক পেপারে এ সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। অন্যদিকে সায়েন্স ফিকশন লেখকরা এখনো আশা করছেন, গ্যালাক্টিক হিচহিকারদের এ বিরক্তিকর সমস্যার মুখে পড়তে হবে না।
সব মিলিয়ে, আমি আশা করি তাদের কথাই ঠিক। কিন্তু এখানে মৌলিক কিছু সমস্যা দেখা দেয়। যদি এফ টি এল সব হয়, এত সব হিচহিকাররা কোথায়? অs ত ট্যুরিস্টদের দেখা পাওয়া যেত।
একটা জবাব হল, কোনো অনুভূতি সম্পন্ন ই টি বা ভিনগ্রহী ইন্টারস্টেলার ভেহিক্যল বানাবে না, যে কারণে আমরা কয়লা চালিত উড়োজাহাজ বানাই না- সে কারণেই কাজটা করার মতো আরো ভাল উপায় আছে।
.
একজন মানুষকে প্রকাশ করার জন্য যে সামান্য বিট প্রয়োজন, অন্য কথায় তার সারা জীবনের সমস্ত স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা ধরে রাখতে যা প্রয়োজন সেটা নিয়েই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় রয়্যাল এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির ত্রৈমাসিক জার্নালের ৩৫ তম বছরের দ্বিতীয় সংখ্যায় [জুন ১৯৯৪] প্রকাশিত লুইস কে শেফারের ‘মেশিন ইন্টেলিজেন্স, দ্য কস্ট অব ইন্টারস্টেলার ট্র্যাভেল এ্যান্ড ফার্মিস প্যারাডক্স’ শীর্ষক জার্নাল থেকে। এ পেপার নিঃসন্দেহে প্রতিষ্ঠানটার মন অস্থির করা লেখাগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এখানে দেখানো হয় পুরোপুরি সুস্থ, স্মৃতিসম্পন্ন একশ বছর বয়সী মানুষের স্মৃতি ধরে রাখা যাবে এক পেটাবিটে। এমনকি আজকের দিনের অপটিক্যাল ফাইবারগুলোও এক মিনিটের মধ্যে এ তথ্য আদানপ্রদান কতে পারবে।
স্টারট্রেকের ট্রান্সপোর্টার ৩০০১ সালেও আবিকৃত হবে না, এটাই মনে করি আমি। মহাজাগতিক কোনো ট্যুরিস্ট এখনো এখানে আসেনি এভাবে, তার একটাই কারণ, পৃথিবীর বুকে এখনো ট্রান্সপোর্টারের রিসিভার বসানো হয়নি।
অধ্যায় ১৫: শুক্রের পথে
এ অধ্যায়ের কৃতীত্ব এ্যাপোলো ১৫’র কুদের দিতে পেরে আমার ভাল লাগছে। চাঁদ থেকে ফিরে এসে তারা আমাকে লুনার মডিউল ফ্যালকনের ল্যান্ডিং সাইটের রিলিফ ম্যাপ দিয়েছিল, আমার অফিসে এখনো দেখানোর মতো জিনিস হিসাবে টানানো আছে সেটা। এখানে তিনবারের অভিযানে লুনার রোভারের পথনির্দেশ করা ছিল। একবার সে যানটায় করে তারা গিয়েছিল পৃথিবী-জোছনার জ্বালামুখে। ম্যাপটায় লেখা আছে, এ্যাপোলো ১৫র অভিযাত্রীদের পক্ষ থেকে আধার কার্কের প্রতি, আপনার মহাকাশ ভিশনারি আমাদের সহায়তা করেছে। ডেভ স্কট, আল ওয়ার্ডেন, জিম অরউইন।
আমিও তাদের উৎসর্গ করেছিলাম কিছু লিখে।
সি বি এস স্টুডিওতে ওয়াল্টার ক্রনকাইট আর ওয়ালি শিরার সাথে এ্যাপোলো ১৫ ল্যন্ডিং কভার করার পর মিশন কন্ট্রোলে উড়ে গিয়েছিলাম রেন্ট্রি আর স্প্যাশউড দেখার জন্য। আল ওয়ার্ডেনের ছোট মেয়েটা প্রথম লক্ষ্য করে তিন প্যারাস্যুটের একটী ডিপ্রয় করতে পারেনি। ব্যাপারটা ভাবিত করে আমাদের, কিন্তু বাকি দুজনেই কাজ করার জন্য যথেষ্ট।
অধ্যায় ১৬ : কাপ্তানের টেবিল
প্রোবের ইম্প্যাক্ট জানার জন্য ২০০১: আ স্পেস ওডিসি’র ১৮ অধ্যায় দেখুন।
সেখানে বলেছিলাম, ৭৭৯৪ গ্রহাণু আবিস্কৃত হয়েছে চান্দ্র অবজার্ভেটরিতে, ১৯৯৭ সালে! যাক, ঘটনাটাকে ২০১৭ সাল, আমার শততম জন্মদিনে নিয়ে যাচ্ছি।
জেনে আনন্দিত হয়েছি যে গ্রহাণু ৪৯২৩ এর নামকরণ হয়েছে ক্লার্ক, প্রজেক্ট স্পেসগার্ডের স্মরণে (রঁদেভু উইথ রামা, দ্য হ্যাঁমার অব গড)।
জেনে মন খারাপ হয়েছে যে এ আইনস্টাইনের স্মরণে গ্রহাণু ২০০১ এর নাম দেয়া হয়েছিল; সেটা হারিয়ে গেছে। দুঃখজনক, দুঃখজনক…।
এ জেনে খুব ভাল লেগেছে যে এ্যস্টেরয়েড ৫০২০ আবিস্কৃত হয় ৪৯২৩ এর সাথে, একই দিনে, সেটার নাম দেয়া হয় আজিমভ- কিন্তু কষ্টের ব্যাপার এই যে, আমার এ পুরনো বন্ধু সে খবর জেনে যেতে পারলেন না।
বিদায়বাণী আর ২০১০: ওডিসি টু এবং ২০৬১; ওডিসি থ্রি’র অথর নোটে ব্যাখ্যা করেছি যে উচ্চাকাক্ষার গ্যালিলিও মিশনে বৃহস্পতি আর বৃহস্পতিয় উপগ্রহ চষে ফেলা যাবে, আমরা অনেক বেশি জ্ঞান অর্জন করতে পারব; মাথা ঝিম ধরানো সব ছবি দেখতে পাব এসব অজানা রহস্যপুরীর।
যাক, অনেক দেরি করে হলেও গ্যালিলিও অবশেষে প্রথম লক্ষ্যের দিকে চলে গেছে- স্বয়ং গ্রহরাজ বৃহস্পতিতে- কাজও করছে ভালভাবে। কিন্তু, হায়, এখানে একটু সমস্যাও আছে- কোনো এক কারণে মূল এ্যান্টেনা আর ভোলা যায়নি। তাই ইমেজগুলো পাঠানো হবে লো-গেইন এ্যান্টেনা দিয়ে, খুব যন্ত্রণাদায়ক ধীরগতিতে। কম্পিউটারের প্রোগ্রামিংয়ে পরিবর্তন এনে জাদু ফলানোর চেষ্টা আংশিক সফল হলেও এক মিনিটে যেটুকু ডাটা পাঠানো যেত সেজন্য লাগবে কয়েক ঘন্টা।
আমাদের ধৈর্য ধরতেই হবে। আমি কল্পনাচোখে গ্যানিমিডকে দেখা শুরু করি সেটাকে সত্যি সত্যি দেখে ফেলেছে গ্যালিলিও ২৭ জুন, ১৯৯৬ সালে।
জুলাই, ১১, ১৯৯৬। বইটা শেষ করতে আর দুদিন বাকি। আমি জে পি এল থেকে প্রথম ইমেজটা ডাউনলোড করি। কপাল ভাল- এখন পর্যন্ত আমার বর্ণনা থেকে খুব বেশি দূরে নয় আসল চিত্র। কিন্তু যদি সেখানে বরফমোড়া এলাকা বাদ দিয়ে কোথাও না কোথাও পাম গাছের সারি দেখা যায়, সেই সাথে লেখা থাকে- ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও। তাহলে আমি সত্যি বেকায়দায় পড়ব, মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছি…
আমি বিশেষ করে গ্যানিমিড সিটির ক্লোজ-আপের অপেক্ষায় আছি (অধ্যায় ১৭ দেখুন)। অবাক ব্যাপার- এখানেও আমার ধারণা পুরোপুরি মিলে গেছে। আর এর রাস্তাঘাট যদি দশ কিলোমিটার চওড়া হয়ে থাকে তো ভাবনা কী? মিডরা হয়ত আসলেই বিশালবপু…
সিটিটা পাওয়া যাবে নাসা ভয়েজার ইমেজ ২০৬৩৭.০২ ও ২০৬৩৭.২৯ এ।
অধ্যায় ১৯ : মানবজাতির পাগলামি
মানবজাতিকে খান যে আংশিক উন্মাদ বলেছিল সেটা ভালভাবে দেখার জন্য মিটিং মেরির ২২ পর্ব দেখুন, আমার টেলিভিশন সিরিজ আর্থার সি ক্লার্কস মিস্টিরিয়াস ইউনিভার্সেস এ। এও মনে রাখবেন, খ্রিস্টধর্ম আমাদের প্রজাতির খুব সামান্য অংশেরই প্রতিনিধিত্ব করে। এ ধর্মের মানুষেরা মাতা মেরিকে যতটা অন্ধ হয়ে পূজা করেছে তার চেয়ে কোনো অংশে কম পূজিত হননি রাম, কালি, শিব, থর, উটান, জুপিটার, অসিরিস, ইত্যাদি, ইত্যাদি….
সবচে অবাক করা ব্যাপার, সবচে বেশি মেধাবীরাও যে ধর্মের পথে গোড়ামি করতে পারেন তার উদাহরণ আর্থার কোনান ডয়েল। শার্লক হোমসের স্রষ্টা এ পৃথিবী কাঁপানো লেখক ও গোয়েন্দা-দিকনির্দেশকের লেখায় তেমন সুর পাওয়া যায়।
কার্ল সাগানের অসাধারণ লেখা ডেমন হান্টেড ওয়ার্ল্ড এ দেখা যাবে এসব নিদর্শন, দেখা যাবে মার্টিনের বইগুলোতেও। আমার মতে এমন সব বই প্রত্যেক হাই স্কুল ও কলেজে অবশ্যপাঠ্য করা উচিৎ।
অন্তত আমেরিকার ইমিগ্রেশন বিভাগ এক ধর্ম প্রভাবিত বর্বরতার বিপক্ষে কাজ করা শুরু করেছে। টাইম ম্যাগাজিন প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, যেসব মেয়ে তার জন্মভূমিতে লৈঙ্গিক মিউটিলেশনের সম্মুখিন হতে পারে তাদের জন্য আশ্রম তৈরি করা এখন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
আমি এ অধ্যায়টা লেখার পর ফিট অব ক্লে: দ্য পাওয়ার এ্যান্ড ক্যারিশমা অব গুরুজ এ এ্যান্থনি স্টোর এর লেখায় দেখতে পাই, এক গুরুর তিরানব্বইটা রোলস রয়েস ছিল যার তিরাশি ভাগ শিষ্যই অন্তত কলেজগামী! এজন্যই বলা হয়, কেউ কেউ তার বুদ্ধিমত্তা ছাড়িয়ে পড়াশোনা করে।
অধ্যায় ২৬: জিয়াংভিল
১৯৮২ সালে ২০১০; ওডিসি টু’র প্রাক-কথনে ইউরোপায় অবতরণ করা চৈনিক স্পেসশিপটার নাম ডক্টর জিয়াং সু-সেন এর নামে রাখার কারণ ব্যাখ্যা করেছি। তিনি যুক্তরাষ্ট্র আর চিনা রকেট প্রোগ্রামের জনক।
জন্ম ১৯১১ সালে। ১৯৩৫ সালে একটা স্কলারশিপ পেয়ে চিন থেকে আমেরিকায় চলে আসে জিয়াং। সেখানে বিখ্যাত হাঙ্গেরিয় এ্যারোডাইনামিসিস্ট থিওডোর ভ্যান কারম্যানের ছাত্র ছিলেন; পরে সহকর্মী হন। ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির প্রথম গদার প্রফেসর হিসাবে তিনি গাগেনহেইম এ্যারোনটিক্যাল ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করেন। প্যাসাডেনার বিখ্যাত জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরি তৈরি হয় সরাসরি এ প্রতিষ্ঠানের উপর ভিত্তি করে।
১৯৫০ সালের দিকে খুব গোপনে তিনি আমেরিকান রকেট রিসার্চে যোগদান করেন। এ প্রজেক্টে তার অবদান ছিল অনেক। কিন্তু নিজের দেশে একবার ঘুরে আসার দায়ে তাকে বন্দি হতে হয়। লম্বা বন্দিদশা আর বিচার আচারের পর নিজ দেশে ফিরে যেতে দেয়া হয় তার সাথে করে যায় অতুল রকেটবিদ্যার জ্ঞান। তার সঙ্গীদের মতে, আমেরিকার করা সবচে বোকামিপূর্ণ কাজের মধ্যে তাকে হয়রানি করা একটা।
পরে দেখা যায়, তিনি শূন্য থেকে চৈনিক রকেটবিদ্যাকে অনেক বছর এগিয়ে নিয়ে যান, তাকে ছাড়া চাইনিজ টেকনোলজি বিশ বছর পিছিয়ে থাকত। তারই হাত থেকে বেরোয় সিল্কওয়ার্ম এ্যান্টিশিপ মিসাইল ও লংমার্চ স্যাটেলাইট লঞ্চার।
এ উপন্যাস শেষ করার পর পরই ইন্টারন্যাশনাল এ্যাকাডেমি অব এ্যাস্ট্রোনটিক্স আমাকে ফন কারম্যান এ্যাওয়ার্ড দেয়- সেটা দেয়া হবে বেইজিংয়ে। উপহারটা পাশ কাটানোর কোনো উপায় ছিল না, কারণ ডক্টর জিয়াং এখন সে নগরীর অধিবাসী। দূর্ভাগ্য, যখন গেলাম, জানা গেল তিনি হাসপাতালে, ডাক্তাররা কোনো দর্শনার্থীকে ঢুকতে দিচ্ছে না।
আমি তার পার্সোনাল এ্যাসিস্ট্যান্ট মেজর জেনারেল ওয়াং শেউনের প্রতি কৃতজ্ঞ, তিনি ২০১০ ও ২০৬১’র কপি দিয়েছিলেন তাকে। বিনিময়ে মেজর জেনারেল আমাকে সুবিশাল কালেক্টেড ওয়ার্কস অব এইচ এস জিয়াং: ১৯৩৮ ১৯৫৬ দেন। দারুণ সংগ্রহ। গুরু ও সহকর্মীদের সাথে রকেট নিয়ে আলোচনা ও পরে প্রকাশিত পেপারগুলো স্থান পেয়েছে।
বেইজিং ছাড়ার আগ মুহূর্তে জানতে পারি, ৮৫ বছর বয়সেও কাজ করছেন। আশা করি ফাইনাল ওডিসির কপিও পাঠাব।
অধ্যায় ৩৬ : আতঙ্কের কুঠরি
১৯৯৯ সালে কম্পিউটার সিকিউরিটির উপর সিনেটের লম্বা আলোচনা শেষে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ১৩০১০ তম এক্সকুসিভ অর্ডারে স্বাক্ষর করেছেন। এর ফলে সাইবার টেররিজমের উপর একটা টাস্ক ফোর্স তৈরি করা হবে। সি আই এ, এন এস এ, প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধি থাকবে এখানে।
পিকো, আসছি আমরা…
উপরের প্যারা লেখার সময়টায় আমি জানতে পারি ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে’র চুড়ান্ত অংশে কম্পিউটার ভাইরাস ট্রোজান হর্সের কথা আছে।
.
এ সিরিজের আগের বইগুলো থেকে বড় ধরনের পরিবর্তন সহ নিচের অংশগুলো নেয়া হয়েছে।
২০০১: আ স্পেস ওডিসি থেকে: অধ্যায় ১৮; অধ্যায় ৩৭।
২০১০: ওডিসি টু থেকে: অধ্যায় ১১; অধ্যায় ৩৬; অধ্যায় ৩৮।
.
কৃতজ্ঞতা
আই বি এম কে ধন্যবাদ। তারা আমাকে দারুণ এক থিকপ্যাড দিয়েছে ৭৫৫সিডি। এটাতেই এ বই কম্পোজ হয়। আমি একটা গুজব দেশে বছরের পর বর প্রতে হয়েছি- এইচ এ এল-হাল নামটা আই বি এম এর এক অক্ষর পিছনে পিছনে আসে। ২০১০ এ ডক্টর চন্দ্রর মাধ্যমে ব্যাপারটাকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করি। পরে জানতে পারলাম, এতে বিব্রত নয়, বিগ আনন্দিত। আরবানার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ১২ মার্চ ১৯৯৭হালের জন্মদিন পালন করছে তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
আমার ডেল রে বুক এডিটরদের অসংখ্য ধন্যবাদ। মূল জিনিসে অনেক উন্নয়ন করেছেন তারা।
সবশেষে, পুরনো বন্ধু সিরিল গার্ডিনারের প্রতি অনেক শুভাশীষ। গ্যাল ফেস হোটেলের চেয়ারম্যান আমাকে এ বইটা লেখার সময় অসাধারণ সইটে অনন্যসাধারণ আতিথেয়তা দিয়েছে। এত আরামদায়ক অবস্থায় কখনো কাজ করিনি। নিশ্চয়তা দিতে পারি, গ্যানিমিডের ঐ হোটেলটা এত মজার নয়।
আরো অনেকের কাছে কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞ এ্যাপোলো ১২’র অভিযাত্রীদের কাছে। ইউরি গ্যাগারিন, গ্রেগরি পেক, এ্যালিস গিনেজ, নোয়েল কাওয়ার্ড, স্টার ওয়র্সের গ্যারি ফিশার… ভিভিয়েন লেই ও লরেন্স ওলিভিয়ার- দুজনেই ২০৬১: ওডিসি গ্রিতে (অধ্যায় ৩৭) এসেছিল।
বিখ্যাত শহরের বিখ্যাত হোটেল নিউ ইয়র্কের চেলসিয়া থেকে এ কাহিনীর শুরু, শেষ পৃথিবীর অন্য প্রান্তে। কানের পাশে মৌসুমী ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ ভারত মহাসাগরের গর্জন শুনতে শুনতে ২৩ নং স্ট্রিটে ব্যসমস্ত ট্রাফিকের আওয়াজ যেন মিলিয়ে যায়।
স্মৃতির উদ্দেশে: ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬
কৃতজ্ঞতা লিখতে লিখতে কয়েক ঘন্টা আগে সেরিল গার্ডিনারের মৃত্যু সংবাদ শুনে কষ্ট পেলাম।
জেনে একটু স্বস্তি হয় উপরের কথাটুকু জেনেছিলেন মারা যাবার আগে।
বিদায়বাণী
‘কখনো ব্যাখ্যা নয়, কখনো ক্ষমা নয়’ কথাটা রাজনীতিক, হলিউডের হর্তাকর্তা আর বিজনেস টাইকুনদের ক্ষেত্রে খুব বেশি প্রযোজ্য হলেও একজন লেখককে অবশ্যই পাঠকের জন্য আরো বেশি বিবেচনা রাখা উচিৎ।
এসবের শুরু আসলে ১৯৪৮ সালের ক্রিসমাসে- হ্যাঁ, ১৯৪৮- একটা চার হাজার শব্দের হোটগল্প থেকে। গল্পটা লিখি বি বি সি’র প্রতিযোগিতার জন্য। দ্য সেন্টিনেল এ চাঁদের বুকে একটা ছোট পিরামিড আবিষ্কারের কথা এসেছিল, পিরামিডটা সেখানে অপেক্ষা করে মানুষের জন্য। মানুষ আসবে, গ্রহান্তরী হয়ে আসবে চাঁদের বুকে, সেজন্য অপেক্ষায় থাকে সেটা। চাঁদে যাবার আগ পর্যন্ত আমরা এতই সামান্য এক জাতি যে সেসব ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। *
[* সৌরজগতে মহাকাশের আগন্তুকদের তৈরি আর্টিক্যায়ের খোঁজ করাটাকে বিজ্ঞানের একটা সমৃদ্ধ শাখায় পরিণত করা প্রয়োজন (এক্সো-আর্কিওলজি)। দুঃখজনকভাবে এ শাখার উত্তবের আগেই এমন প্রমাণের কথা বির শোনা যায় বারবার নাসা এসবকে বাতিল করে দেয়। এসব কথা কেউ বিশ্বাস করবে তা বিশ্বাস করাও কষ্টকর। বাজেট সমস্যা সমাধানের জন্য নানা কাজ করতে হয়। (আপনার হাতে, নাসা এ্যাডমিনিস্ট্রেটর…)]
বি বি সি আমার এ চেষ্টাটাকে বাতিল করে দেয়। তিন বছর অপ্রকাশিত ছিল লেখাটা। তারপর টেন স্টোরি ফ্যান্টাসির একমাত্র ইস্যুতে প্রকাশ পায়। অমূল্য এনসাইক্লোপিডিয়া অব সায়েন্স ফিকশন পড়ে এ নিয়ে কথা বলেছে।
‘দ্য সেন্টিনেল গুম হয়ে পড়ে রইল এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। তারপর ১৯৬৪ সালে স্ট্যানলি কুবরিক যোগাযোগ করে আমার সাথে। তিনি সত্যিকারের ‘ভাল সায়েন্স ফিকশন মুতি তৈরি করতে চান। দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড অব ২০০১ এ লেখা আছে, আমরা মাথায় ঝড় তোলা কতগুলো সেশন চালিয়েছিলাম। সিদ্ধান্তে আসি, চাঁদের বুকে নিরব ভ্রা আমাদের কাহিনীর গোড়াপত্তনের জন্য ভাল হবে। আস্তে আস্তে আমি আরো অনেক কিছু করে ফেললাম। যেমন প্রথমে থাকা পিরামিডের জায়গায় বসে গেল এখনকার বিখ্যাত কালো এক শিলাস্তম্ভ।
আমরা যখন কীভাবে সৌরজগত বিজিত হল নিয়ে মেতে আছি, তখন মহাকাশ যুগের বয়স মাত্র সাত বছর। কোনো মানুষ একশ কিলোমিটারের বেশি উপরে যায়নি। প্রেসিডেন্ট কেনেডি ঘোষণা করে বসে আছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশবিদরা চাঁদে যাবেন এ দশকেই’- কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের কাছেই সে স্বপ্ন সুদূর পরাহত। হাড় কাঁপানো শীতে ২৯ ডিসেম্বর ১৯৬৫ এ দক্ষিণ লন্ডনে* চলচ্চিত্রায়ন। শুরু হলে আমরা জানতামও না চাঁদের উপরিভাগ কাছ থেকে দেখতে কেমন? অনেকেই বলে চলেছে, চাঁদের বুকে প্রথম এ্যাস্ট্রোনটের প্রথম শব্দটা হবে, বাঁচাও!, কারণ সে ট্যালকম পাউডারের মতো গুড়া ধুলার বুকে পা ফেলে ভড়কে যাবে। সব মিলিয়ে আমাদের ধারণা মন্দ ছিল না। শুধু একটা ব্যাপার। আমাদের চান্দ্র অবয়ব বাস্তবের চেয়ে একটু বেশি বন্ধুর।
[*শেপারটনে, যেটা ওয়েলসের মাস্টারপিস দ্য ওয়্যার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস এর মঙ্গলবাসিয়া ধূলার সাথে মিলিয়ে দেয়।]
আজকের দিনে এটাই অন্যরকম লাগে, আমরা দানবীয় স্পেস স্টেশন, প্রদক্ষিণরত হিলটন হোটেল, বৃহস্পতি অভিযানের কথা কল্পনা করতে পেরেছিলাম ২০০১ সালের মধ্যে। একটা ব্যাপার ভাবা উচিং, ১৯৬০ সালের দিকে মানুষের জল্পনা কল্পনা ছিল ১৯৯০ এর মধ্যে চাঁদে ঘাটি ও মঙ্গলে অবতরণ সম্ভব হবে। আসলে, এ্যাপোলো ১১ ছেড়ে যাবার পর পর সি বি এস স্টুডিওতে থাকতেই আমি মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্টকে বলতে শুনেছিলাম, এবার আমাদের অবশ্যই মঙ্গলের দিকে হাত বাড়াতে হবে।
আমরা যে জেলে পচিনি এটাই সৌভাগ্য। সেই দূর্নাম, একই সাথে ভিয়েতনাম ও ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি সব স্বপ্নকে ধুলার সাথে মিশিয়ে দেয়।
১৯৬৮ সালে চলচ্চিত্র আর বই দুইটাই আলোর মুখ দেখলেও ধারাবাহিক আরেকটা তৈরির সম্ভাবনা মনে উঁকি দেয়নি। তারপর, ১৯৭৯ সালে সত্যি সত্যি বৃহস্পতির দিকে একটা মিশন শুরু হয়। আমরা প্রথমবারের মতো দানবীয় গ্রহ আর তার প্রজাদের ক্লোজআপ দেখতে পাই।
ভয়েজার স্পেস প্রোবগুলোয়** কোনো মানুষ ছিল না, অবশ্যই। কি তাদের পাঠানো ইমেজগুলো বাস্তব। একই সাথে একেবারে অকল্পনীয়। ভুবনগুলো অবাক করা। আইওর সার্বক্ষণিক ফুটতে থাকা জ্বালামুখ, ক্যাসিস্টোর বিচিত্র মুখাবয়ব, গ্যানিমিতের চষে ফেলা বুক- আমরা যেন একেবারে আনকোরা এক সৌজগত আবিষ্কার করে ফেলেছি। এসবই আমাকে ২০১০ লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। ডেভ বোম্যানের বাকিটুকু ব্যাখ্যা করার সুযোগও আসে সেই সাথে।
[** এটা বৃহস্পতির কাছে সিং-ট বা গ্র্যাভিটি এ্যাসিস্ট ম্যানুভার নিতে পেরেছিল- যা ডিসকৰি করে ২০০১ এর তালে।]
১৯৮১ সালে নতুন বইটা লেখা শুরু করি। স্নায়ুযুদ্ধ চলছে তখনো। মনে হল আমেরিকা-রাশিয়ার যৌথ মহাকাশ অভিযানের নকশা প্রকাশ করে আমি যেন তোপের মুখে পড়ব। আন্দ্রে শাখারভ আর এলেক্সি লিওনকে উৎসর্গ করে আগুনে যেন আরো ঘৃতাহুতি দিলাম। লিওনকে আমি জানিয়েছিলাম, শিপটার নাম হচ্ছে আপনার নামে, তিনি বলেছিলেন, ‘তাহলে সেটা খুব ভাল শিপ হবে।’
এখনো আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়- ১৯৮৩ সালে পিটার হাইমস ছবিটা বানানোর সময় সত্যি সত্যি তিনি বৃহস্পতিয় চাঁদগুলোর ক্লোজআপ নিতে পেরেছেন তয়েজার মিশন থেকে (কোনো কোনোটা জেট পোপালশন ল্যাবরেটরি থেকে কম্পিউটার প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে আসে)।
গ্যালিলিও মিশন বৃহস্পতিয় এলাকায় থাকবে মাসের পর মাস। ছবি পাঠাবে অজস্র। এ সময়টায় আমাদের জ্ঞান বেড়ে যাবে বিস্ময়করভাবে। এখন ওডিসি থ্রি না লেখার কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না।
কিন্তু ১৯৮৬ সালে কিছু সমস্যা হয়ে যায়। আমরা আরো এক দশকের আগে গ্যানিমিড ক্যালিস্টে আইও ইউরোপার কোনো পরিষ্কার চিত্র পাব না।
আমি আর দেরি করার পক্ষপাতী নই। ১৯৮৫ সালে হ্যালির ধূমকেতু সৌরজগতের ভিতরের দিকে আসবে। পরেরবার আসছে ২০৬১ সালে। ওডিসি খ্রির জন্য সময়টা উপযুক্ত। সামান্য এ্যাডভান্সের বিনিময়ে প্রকাশককে যে সময়ে দেয়ার কথা তখন এটা দিতে পারব কিনা সে সম্পর্কেও আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। তাই আমি ডেল রের প্রকাশককে উৎসর্গ করেছিলাম বইটা।
একটা সায়েন্স ফিকশন সিরিজ লেখা হয় চার খন্ডে, ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে, প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের সময় (বিশেষত মহাকাশবিদ্যায়)। ২০১০ এর ভূমিকাতেই উল্লেখ করে দিয়েছি, এ বইগুলো একই সিরিয়ালের হলেও একই কাহিনী নয়, একই থিমের উপর ভিন্ন ভিন্ন প্রসারিত ধারণা।
তাই, এ ফাইনাল ওডিসিতে আগের বইগুলোর অনেক ধারণা বাতিল করা হয়েছে। অন্য গৌণ ধারণাকে করেছি মুখ্য। কেউ যদি এ প্রবাহ দেখে দুঃখিত হন, তাহলে এক আমেরিকান প্রেসিডেন্টের মতো রাগি বার্তা পাঠাব, এটা গল্প, বোকা।
এবং এসবই আমার নিজের গল্প, আপনি হয়ত টের পাননি। আমি জেন্ট্রি লি’র সাথে কাজ করে মজা পেয়েছি। মজা পেয়েছি আর সবার সাথেও। পরবর্তী বড় প্রজেক্টগুলোর যেগুলো আমি নিজে চালাতে কষ্ট পাব সেসবের জন্য এমন দামি মানুষ টেনে আনতে পিছপা হব না।
তাহলে, প্রতিটা শব্দই আমার: হ্যাঁ, প্রায় প্রতিটা শব্দ। আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে অধ্যায় ৩৫ এর প্রফেসর থিরুগনানাসাম্পাহামূর্তিকে পেয়েছি কলম্বো টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে। আশা করি নামের বর্তমান মালিক অভিযোগ করবেন না ধার নেয়াতে। বিশাল অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি থেকে আরো কিছু ঋণ আছে। আর দেখে অবাক হই যে এখানে আমার লেখা থেকে বিভিটা কোটেশন নেয়া হয়েছে বাক্য আর শব্দ বোঝানোর জন্য।
প্রিয় ও ই ডি, যদি এখানেও ব্যবহার করার মতো কোনো উদাহরণ পাও, প্লিজ, আমার আতিথেয়তা নিতে ভুল করোনা।
আমি এ কথাটুকু লেখার সময় যে কাশিগুলো দিয়েছি (অন্তত দশটা) তার জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।
সবশেষে, আমি আমার অসংখ্য বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, হিন্দু, মুসলমান বন্ধুকে আন্ত রিকভাবে জানাতে চাই যে আপনাদের ধর্ম শাস্তি যে বাণী বহন করে তা মানসিক উৎকর্ষে অত্যন্ত কাজে লাগবে, এটাই আমার বিশ্বাস। পশ্চিমা গবেষণায় দেখা যায় শারীরিক উন্নয়নেও ধর্মের প্রভাব রয়েছে।
সম্ভবত সজ্ঞান ও অসুখি হওয়াটা অজ্ঞান ও সুখি হওয়ার চেয়ে ভাল।
আশা রাখি আমাদের অনাগত বংশধররা দ্বিতীয় পথেই থাকবে।
আর্থার সি ক্লার্ক
কলম্বো, শ্রীলঙ্কা
সেপ্টেম্বর ১৯, ১৯৯৬