চলে যেতাম, যদি পাশের লাইনটা দিয়ে না যেত ট্রেনটা, কিশোর বলল। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করার জন্যে হাত-পা ঝাড়ছে।
চাঁদের আলোয় চকচক করছে কয়েক গজ দূরের আরেকটা লাইন। সেদিকে তাকিয়ে তারপর আবার ওদের পায়ের কাছের লাইনটার দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল সে, দেখো, এটায় মরচে পড়া।
তাতে কি? মুসার প্রশ্ন।
এটা সাইডলাইন, জবাব দিল কিশোর, পুরানো। ব্যবহার হয় না।
তারমানে আমাদের ভাগ্যের জোরে ওরা ভুল করে বাতিল লাইনে ফেলে গেছে আমাদের।
আমার তা মনে হয় না, ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল কিশোর, জেনেশুনে ইচ্ছে করেই ফেলে গেছে। হয়তো কেবল ভয় দেখানোর জন্যে। মারতে চায়নি।
দাঁতে দাঁত চাপল মুসা, কায়দা মত পেয়ে নিই! ভয় দেখানো ওদের আমি বের করব!
পাঁচজনের সঙ্গে পারব না আমরা, মুসা, মনে করিয়ে দিল রবিন।
সে দেখা যাবে। ওরা আমাদের সঙ্গে এ রকম করতেই থাকবে আর আমরা মুখ বুজে সহ্য করব, কিছুই না করে ছেড়ে দেব, এটা ভাবলে মহাভুল করবে ওরা।
কি করবে তাহলে?
আপাতত মোটেলে ফিরে যাব, জবাব দিল কিশোর।
লাইন ধরে কয়েক মিনিট হাটার পর সরু রাস্তাটা চোখে পড়ল ওদের। সেটা ধরে এগিয়ে এসে উঠল মহাসড়কে। রাতের বেলা জোয়ান ছেলেছোকরা হাত তুললে গাড়িগুলো থামতে চায় না। সবাই বা ডাকাতিকে ভয় পায়। তবে একজন ট্রাক ড্রাইভারের মনে হলো, ছেলেগুলো খারাপ নয়। থামল সে। কোথায় যাবে জানতে চাইল। লিফট দিতে রাজি হলো।
ড্রাইভারের পাশে গাদাগাদি করে বসল তিনজনে। মুসার পাশের দরজাটা খোলা রাখতে হলো, নইলে বসা যায় না। তার অর্ধেকটা শরীরই বেরিয়ে রইল।
ড্রাইভার যখন গাড়ি চালাচ্ছে, নিচুস্বরে কিশোরের সঙ্গে কথা বলল রবিন, আচ্ছা, ওরা কোন ভুল করেনি তো? ভুল করে আমাদের শাস্তি দিয়েছে হয়তো। স্কুলের দলাদলি হতে পারে।
ভ্রূকুটি করল কিশোর। অন্ধকারে কারও চোখে পড়ল না সেটা। বলল, উঁহু, ভুল ওরা করেনি। ভয় দেখাতে চেয়েছে আমাদের, যাতে গেনারকে খোঁজাখুঁজি না করে আরলিংটন থেকে কেটে পড়ি আমরা।
তারমানে তোমার ধারণা গেনারকে কিডন্যাপ করা হয়েছে?
হওয়াটা কি অসম্ভব? হয়নি যে তেমন কোন সূত্র তো এখনও পাইনি আমরা।
ওদের আলোচনায় যোগ দিল না ড্রাইভার। বেশি কথা বলার মানুষ না সে। নীরবে গাড়ি চালিয়ে পৌঁছল আরলিংটনে। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে নেমে পড়ল তিন গোয়েন্দা। সোজা রওনা হলো ম্যানেজারের অফিসে।
টেকোকে ভালমত চেপে ধরার সময় হয়েছে এখন, ভারি গলায় বলল কিশোর। আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হবে ওকে।
দরজা বন্ধ। বেল টিপে ধরল কিশোর। কয়েকবার করে টেপার পর আলো জ্বলল ভেতরে। দরজা খুলে দিল ম্যানেজার। ঘুমে জড়ানো ফোলা ফোলা চোখ, চকচকে টাক, পায়জামা আর গেঞ্জি পরা পৈটমোটা লোকটাকে হাস্যকর লাগছে এখন। মেজাজ খারাপ না থাকলে হেসে ফেলত মুসা।
রাত দুপুরে ঘুমন্ত মানুষকে বিছানা থেকে টেনে তোলার অর্থ কি, আঁ? কর্কশ স্বরে জিজ্ঞেস করল ম্যানেজার। অফিসের চেয়ারে বসা বিগলিত হাসিওয়ালা সেই লোকটার সঙ্গে একে মেলানো যায় না। যেই মনে করেছে, ওরা কটেজ ছেড়ে দিচ্ছে, ওদের সঙ্গে ব্যবসা শেষ, অমনি বদলে গেছে আচরণ। মোটেল ছেড়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছে হলে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এখন কিছু করতে পারব না।
আর কিছু না পারেন, আমার কিছু প্রশ্নের জবাব আপনাকে দিতে হবেই, কিশোরও সমান তেজে বলল আমাদেকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ারই ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
থমকে গেল ম্যানেজার। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করল ঘরে ঢোকার জন্যে। সব শোনার পর বলল, ছেলেগুলোকে চিনতে পেরেছে। আরলিঙটন কলেজে পড়ে। এই এলাকারই ছেলে খুব পজি মারামারি, দলাদলি এ সূৰ্ব করে বেড়ায়।
মনে হয় নতুন মুখ দেখে তোমাদের সঙ্গে একটু মজা করতে চেয়েছিল ওরা, ম্যানেজার বলল।
মনে করা ওদের বের করব এবার গজগজ করতে লাগল মুসা।
পুলিশকে খবর দিতে যাচ্ছি আমরা, কিশোর কাল। নাম কি ওদের? কোথায় থাকে?
সুব্রার নাম জানে না ম্যানেজার। দুতিনজনের জানে, ওদের নাম আর ঠিকানা একটা কাগজে লিখে দিল। পুলিশের কাছে যাওয়ার আগে একটা বাড়িতে ঢু মেরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর। মুসাকে বলল সেদিকে যেতে। নীরব রাতে বিকট শব্দ তুলে ছুটল জেলপি। পর্ব আকাশে অন্ধকার কাটতে শুরু করেছে। ভোর হতে দেরি নেই।
বাড়ির সামনে এসে আগের মতই গাড়িতে বসে রইল মুসা, রবিন আর কিশোর নেমে গেল। কলিং বেলের বোতাম টিপল কিশোর। সাড়া না পেয়ে দরজায় থাবা মারতে লাগল রবিন।
অবশেষে দরজা খুলে দিল পায়জামা পরা একটা ছেলে। খালি পা। ঘুমজড়িত কণ্ঠে বলল, মাঝরাতে এত ডাকাডাকি কিসের? আমরা তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না।বলে দরজা লাগিয়ে দিতে গেল।
চট করে একটা পা ঢুকিয়ে দিয়ে আটকাল কিশোর, মজা করতে আসিনি আমরা। বব বোম্যান কোথায়?
বড় করে হাই তুলল ছেলেটা, ওকে জাগানো যাবে না।
যাবে না কেন? কিশোরের কাঁধের কাছ থেকে বলে উঠল মুসা, গাড়িতে বসে থাকতে পারেনি, কি ঘটছে এখানে দেখার জন্যে চলে এসেছে। জোরেজোরে ধাক্কা দাওগে, জেগে যাবে।
কিন্তু তোমরা বুঝতে পারছ না, ও আমাদের প্রেসিডেন্ট…
কিশোরকে সরিয়ে তার জায়গায় চলে এল মুসা, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নাকি ও? যাও, জুলদি গিয়ে উঠতে বলো নাকি থানায় যাওয়ার ইচ্ছা হয়েছে?