মানে? অবাক হয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর।
যা করতে বলেছ তাই করেছি। তোমাদের মেসেজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কটেজ ঠিক করে, রূম থেকে তোমাদের মালপত্র বের করে এনে ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছি, টাকে হাত বোলাতে বোলাতে বলল ম্যানেজার। যাও, সব ঠিকঠাক পাবে। একটা জিনিসও খোয়া যাবে না। এ সব দিকে আমার কড়া নজর। ম্যানেজারি করতে করতে চুল পাকিয়ে ফেললাম…
টাকমাথা লোকটার মুখে চুল পাকানোর কথা শুনতে কেমন হাস্যকর লাগল। মুসার তো শুধরেই দিতে ইচ্ছে করল–বরং বলুন, চুল খসিয়ে ফেললাম; কিন্তু বলল না কিছু, চুপ করে রইল।
বোকা হয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল তিনজনে। কি বলছে কিছুই বুঝতে পারছে না।
বকবক করে চলেছে ম্যানেজার, কটেজ, নিয়ে ভাল করেছ। আরামে থাকবে, শান্তিতে থাকবে, রুমের চেয়ে ভাড়াও তেমন বেশি না, অথচ দুটো জায়গায় পার্থক্যটা অনেক। যে তিনজন বন্ধুকে পাঠালে তোমরা, ওরা এসে মেসেজটা দিয়ে বলল, আগের ঘরটা পছন্দ হয়নি তোমাদের, নিরিবিলি থাকতে চাও, একটা কটেজ যেন রেডি করে রাখি আমি। তা রেখেছি। তোমাদের আসতে দেরি হবে জেনেও একমুহূর্ত সময় নষ্ট করিনি। বোর্ডাররা বিরক্ত হয় এমন কোন কাজ আমাকে দিয়ে হবে না…
তা কটেজটা কোথায়? কিছুটা রেগে গিয়েই জানতে চাইল মুসা।
ওর রাগটা বোধহয় ধরতে পারল না ম্যানেজার। হাত তুলে ছোট ছোট বাড়িগুলো দেখিয়ে বলল, অসুবিধে নেই, খুব সুন্দর, গিয়ে দেখোই না…
আবার ছুটল তিন গোয়েন্দা। কটেজের কাছে এসে জানালা দিয়ে দেখল ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে গাট্টাগোট্টা এক তরুণ, ওদের চেয়ে কয়েক বছরের বড় হবে। ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই রেগে চিৎকার করে উঠল মুসা, এ সবের অর্থ কি?
ঘুরে দাঁড়াল তরুণ। কালো একটা মুখোশে মুখের ওপরের অংশ ঢাকা, বড় বড় ফুটো দিয়ে চোখ দুটো বেরিয়ে আছে। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল একটা বড় আলমারির দরজা। তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল আরও চারটে মুখোশধারী ছেলে।
আরি, হচ্ছেটা কি! কে আপনারা? চিৎকার করে উঠল রবিন।
তার কথার জবাব দেয়ার কোন প্রয়োজন মনে করল না ছেলেগুলো। তিনজনকে মেঝেতে ফেলে চেপে ধরে বেধে ফেলল। বয়ে এনে তুলল একটা গাড়িতে। মোটেল থেকে বেরিয়ে মহাসড়ক ধরে কয়েক মাইল এগোল গাড়িটা। তারপর মোড় নিয়ে একটা সরু রাস্তায় নামল। সেটা ধরে মাইলখানেক এগোতে দেখা গেল রেললাইন।
তিন গোয়েন্দাকে বয়ে আনা হলো লাইনের ধারে। ছোট ছোট ঝোপঝাড় জন্মে আছে ওখানে। ওগুলোর জন্যে রাস্তা থেকে লাইনটা ভালমত চোখে পড়ে না। তিনটে তক্তায় ওদেরকে চিত করে বেঁধে ওগুলো লাইনের ওপর আড়াআড়ি ফেলে চলে গেল ছেলেগুলো।
বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা নেমেছে অনেক আগেই। রাতের অন্ধকার। এগিয়ে আসছে। ছেলেগুলো সরে যেতেই বাধন খোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালাল তিন গোয়েন্দা। টানাটানি করতে করতে ঘেমে গেল, কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল ঘাম। কিন্তু বাধন ঢিল করতে পারল না একচুল।
ঠিক এই সময় কলজে কাঁপিয়ে দিয়ে দূরে শোনা গেল রেলইঞ্জিনের বাঁশি।
.
০৪.
মাথা ঘুরিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগল তিনজনে। প্রাণপণে আরেকবার বাধন খোলার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। আর কোন আশা নেই। কপালে মৃত্যুই আছে বুঝি এবার।
এগিয়ে আসছে ইঞ্জিনের ভারি শব্দ। ওদের ধ্বংস করে দিতে ছুটে আসছে যেন এক ভয়াল দানব। আতঙ্কে অবশ হয়ে আসছে হাত-পা।
এসে গেছে। আর একশো গজ দূরেও নেই। শেষবারের মত পরস্পরের দিকে তাকাল ওরা। যেন নীরবে শেষ বিদায় জানাল একে অন্যকে।
এসে গেল ইঞ্জিন। তারপর যেন কোন অলৌকিক কারণে ওদের গায়ের ওপর দিয়ে না গিয়ে কানফাটা ভয়ানক শব্দ আর প্রবল কম্পন তুলে পাশ দিয়ে। চলে গেল। বেঁচে আছে, বিশ্বাস হতে চাইল না ওদের। কি করে ঘটল ঘটনাটা? ঘটারং-ঘট ঘটারং-ঘট করে এখনও পার হচ্ছে একের পর এক মালবাহী ওয়্যাগন।
থরথর করে কাঁপছে শরীর। বেঁচে গেছে এটা যখন বিশ্বাস হলো মুসার, বাঁধন খোলার চেষ্টা চালাল আবার সে। বড় ধাক্কাটা কেটেছে, ওদেরকে লাইনের ওপর ফেলে রেখে যাওয়ার পর এই প্রথম মাথাটা আবার ঠিকমত কাজ করতে আরম্ভ করেছে। আড়চোখে অস্পষ্টভাবে দেখল লাইনের একটা মোটা পেরেকের চোখা মাখা বেরিয়ে আছে। শরীরটা আঁকাবাকা করে ঝাঁকাতে লাগল সে। তিল তিল করে ওর মাথার দিকটা এগিয়ে চলল পেরেকের দিকে। অনেক কষ্ট করে, লাইন আর পাথরের ঘষায় শরীরের কয়েক জায়গার চামড়া ছিঁড়ে-কেটে অবশেষে হাতের বাঁধন পেরেকটার কাছে নিয়ে যেতে পারল। দড়ি ঘষতে লাগল পেরেকের সঙ্গে। এক সুতা এক সুতা করে কাটতে লাগল দড়িটা।
আবার শোনা গেল ট্রেনের শব্দ। আরেকটা ট্রেন আসছে। একবার বেঁচেছে বলেই যে আবার বাচবে এমন সম্ভাবনা নেই। তাড়াহুড়া শুরু করল। সে। অবশেষে যেন দীর্ঘ কয়েক যুগ পর দড়িটা কাটতে সক্ষম হলো।
দড়িটা ছাড়িয়ে নিয়েই উঠে পড়ল সে। পকেটনাইফ বের করে পায়ের বাঁধন কাটল। তারপর কেটে দিল কিশোরের হাতের বাঁধন।
তিনজনেই মুক্ত হয়ে সরে গেল লাইনের ওপর থেকে। অনেক কাছে এসে গেছে দ্বিতীয় ট্রেনটা।
বিমূঢ় ভাব কাটেনি এখনও রবিনের। কব্জি ডলতে ডলতে বলল, এপারে আছি তো? না মরণের ওপারে চলে গিয়ে অদ্ভুত সব দৃশ্য দেখছি?