.
১৫.
প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেল দুজনে। এই তাহলে ব্যাপার। কমান্ডার মরিস কোন ধরনের গোপন দলের নেতা, বেআইনী কিছু করছে এই পাহাড়ের গুহায় থেকে। সাবমেরিনে করে রসদপত্র নিয়ে আসা হয়েছে।
গুহামুখের কাছ থেকে আগের রাতের মত সার্চলাইট জ্বলে উঠল। সাবমেরিনের দিকে তাকিয়ে দুবার জলল-নিভল আলোটা।
ধীরে ধীরে পানির ওপর ভেসে উঠল সাবমেরিনের পুরো পিঠ, অতিকায়। একটা মাছের মত। লাল আলোর নিচে কালো শরীর, অন্ধকারে ভয়ঙ্কর লাগছে অবয়বটা।
আলোর সাহায্যে ওটাকে সঙ্কেত দিল কমান্ডার, কিশোর বলল। ইস্, একটা বোট যদি পেতাম গিয়ে দেখে আসতাম সাবমেরিনে কি ঘটছে।
মুসা বলল, এক কাজ করি, সাঁতরে চলে যাই আমি ওটার কাছে। বেশি দূর তো না। তুমি বসে থাকো এখানে।
কিশোর বাধা দেয়ার আগেই কাপড় খুলতে আরম্ভ করল সে।
সাবধানে যেয়ো, শুধু বলল কিশোর।
পাহাড়ের দেয়ালের সঙ্গে মিশে এগোল মুসা। পানির কাছে এসে ফিরে তাকাল একবার। কিশোরকে দেখা যায় না। পাথরের আড়ালে লুকিয়ে বসে আছে সে। ধীরে ধীরে পানিতে নেমে এল মুসা। মাথাটা কেবল ভাসিয়ে রেখে নিঃশব্দে সাঁতরে চলল সাবমেরিনের দিকে।
সেও পৌঁছল ওটার কাছে, সাবমেরিনের হ্যাচও খুলে গেল। পিচ্ছিল খোলসের গায়ে ধরার মত কিছু পেল না মুসা। ওটার গায়ে গা ঠেকিয়ে শুধু নাকটা পানির ওপরে ভাসিয়ে তাকিয়ে রইল হ্যাঁচের দিকে।
ছয়জন মানুষ বেরোল। কথা বলছে একটা অপরিচিত ভাষায়।
দশ ফুট দূর থেকে দেখছে মুসা। দুরুদুরু করছে বুক। ওদের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ ইংরেজিতে বলে উঠল একজন, আমার মনে হয়। এখানে আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলা উচিত না। কেউ শুনে ফেললে সন্দেহ করবে।
কে আর আসছে এখানে দেখতে, ইংরেজিতেই বলল আরেকজন।
তবু…এটা আমেরিকা, আমাদের সমঝে চলাই উচিত। অভ্যাস বদলাতে হবে।
ওদের সঙ্গে একটা রবারের ভেলা। ভেলাটা পানিতে ভাসিয়ে তাতে চড়ে বসল লোকগুলো। দাঁড় তুলে নিল দুজন। বেয়ে চলল তীরের দিকে।
বন্ধ হয়ে গেল হ্যাচ।
আর কিছু দেখার নেই এখানে। ভেলার পিছু পিছু মূসাও আবার তীরে ফিরে চলল। সাবধান রইল যাতে কোনমতেই লোকগুলোর চোখে পড়ে না। যায়।
কিছুদূর এসে কি মনে হতে ফিরে তাকাল। দেখল, পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে কনিং টাওয়ার। লোকগুলোকে নামিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে সাবমেরিন।
আবার জ্বলে উঠল সার্চলাইট। ভেলার দিকে মুখ করে জ্বলল-নিভল দুবার।
মাথা যতটা সম্ভব নিচে নামিয়ে ফেলল মূসা। আলো নেভার পর আবার মাথা তুলে শুনল ভেলার একজন বলছে, মরিস জ্বেলেছে।
আরেকজন জবাব দিল, হ্যাঁ। তা ছাড়া এই পাহাড়ের মধ্যে লুকিয়ে থেকে আর সঙ্কেত দিতে আসবে কে?
তীরে পৌঁছল ভেলা। লোকগুলোকে চলে যাওয়ার সময় দিল মুসা। তারপর সেও উঠে এল সৈকতে। পাহাড়ের গা ঘেষে ফিরে এল পাথরটার কাছে, যেখানে কিশোর লুকিয়ে আছে। সবকথা জানাল ওকে।
পা টিপে টিপে কমান্ডারের গুহার কাছে চলে এল দুজনে। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল, লোকগুলোকে স্বাগত জানাচ্ছে মরিস। এক এক করে হাত মেলাচ্ছে ওদের সঙ্গে।
একটা ব্যাপার দৃষ্টি আকর্ষণ করল দুজনেরই, বদলে গেছে মরিসের চেহারা। অনেক বেশি তরুণ মনে হচ্ছে তাকে। কেন এমন দেখাচ্ছে সেটা কিশোর প্রথম বুঝতে পারল। ওদের সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে লোকটার, ততবার পরচুলা পরে ছিল। এখন কুচকুচে কালো ওর মাথার চুল। এগুলোই আসল, পরচুলা খুলে ফেলেছে। মুখের ভাজও এখন অদৃশ্য, তারমানে মেকআপও নিত দিনের বেলা।
হাত মেলানো শেষ করে লোকগুলোকে নিয়ে গুহার পেছন দিকে চলে গেল কমান্ডার। সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকে যাওয়াতেই বোধহয় মিলিয়ে গেল ওর হাতের আলো।
চলো, আমরাও ঢুকে পড়ি, কিশোর বলল।
ভেতরে ঢুকল দুজনে। গুহার গভীর থেকে ভেসে আসছে কথা বলার মৃদু শব্দ। অনেকটা গুঞ্জনের মত শোনা যাচ্ছে। খুব সাবধানে এগোল ওরা। ফিসফিস করে মুসাকে বলল কিশোর, দেখো তো, সুড়ঙ্গের মুখে কেউ আছে। কিনা? গার্ড রেখে যেতে পারে।
ভাল করে দেখল মুসা, অন্ধকারে কাউকে চোখে পড়ল না। কোন নড়াচড়া নেই। কাউকে দেখছি না।
আবার এগোল দুজনে। মিলিয়ে গেল কথার শব্দ। আলো ছাড়া আর এগোনো অসম্ভব। আরও কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে লোকগুলোকে আরও ভেতরে চলে যাওয়ার সময় দিয়ে যা থাকে কপালে ভেবে কোমর থেকে টর্চ খুলে নিয়ে জ্বালল কিশোর। আলোর রশ্মি ঘুরিয়ে আনল একবার চারপাশে।
তাকের ওপর আগের মতই পড়ে আছে শটগানটা। পাশে নোটবইটাও আছে, তবে ক্যাপটা নেই। বোধহয় সরিয়ে ফেলেছে কমান্ডার। নিচে জড় করে রাখা খাবারের টিন।
লোকগুলো যেদিকে গেছে সেদিকে এগোল দুজনে। যতই ভেতরে ঢুকল বিস্ময়ে হা হয়ে গেল মুখ। গুহার পেছন থেকে বৈদ্যুতিক তারের মোটা পাইপ চলে গেছে সুড়ঙ্গের ভেতরে।
তোমার কথাই ঠিক, মুসা বলল। এই পাইপই আমার যন্ত্রে ধরা পড়েছিল। কিন্তু এ সব দিয়ে এখানে কি করছে ব্যাটারা?
চলো, গেলেই দেখতে পাব। আমার মনে হয় ওরা কোন দেশের স্পাই। রাডার স্টেশনটার দিকে লক্ষ। ওটাকে কিছু করতে চায়। ও কিন্তু ডিগ আর গেনারের ব্যাপারটা তাহলে কি? ওরা এর মধ্যে আসছে কি করে?
এখনও বুঝতে পারছি না। চলো, এগোই…
কিন্তু কিশোরকে কথা শেষ করতে দিল না একটা কণ্ঠ, অন্ধকার থেকে বলে উঠল, আর এগোনোর দরকার নেই। থাকো ওখানেই।