আর কথা না বলে দড়ি ধরে টান দিল সে। একটানেই স্টার্ট হয়ে গেল ইঞ্জিন। মৃদু হেসে গর্বিত চোখে মুসার দিকে তাকাল বুড়ো। নীরব ইশারা করে বুঝিয়ে দিল, কেমন বুঝলে?
ঢ্যাঙ্ক- ঢ্যাঙ্ক – ঢ্যাঙ্ক -ঢ্যাঙ্ক করে ইঞ্জিনের বিচিত্র আওয়াজ তুলে ঢেউ কেটে এগিয়ে চল বোট। কোনদিকে যেতে হবে বলে দিয়েছে কিশোর। সেদিকেই চালাল বুড়ো।
উপকূল একপাশে রেখে তীরের বেশ খানিকটা দূর দিয়ে এগিয়ে চলল বোট। ডেকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে রইল তিন গোয়েন্দা। গুহা থেকে নজর রাখলেও ওদের দেখতে পাবে না কমান্ডার।
গুহার কাছ থেকে অনেক দূরে নোঙর ফেলল বোট, যাতে কমান্ডারের সন্দেহ না হয়। বুড়ো ডেলভার মাছ ধরতে লাগল, আর বিনকিউলার দিয়ে গুহার দিকে নজর রাখল গোয়েন্দারা।
আচমকা শক্ত হয়ে গেল রবিন। অ্যাই কয়েকজন লোক!
পাশ থেকে কিশোর বলল, আমিও দেখতে পাচ্ছি।
মুসা বলল, সামনের লোকটা কে? কমান্ডার মরিস না?
মনে হয়। ব্যাঙের মত লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে।
কমান্ডারের সঙ্গে আরও তিনজন লোক রয়েছে। একটা বাক্স ধরাধরি করে নিয়ে গুহার ভেতর চলে গেল।
এরপর দুই ঘন্টা পেরিয়ে গেল। বিনকিউলার ধরে রাখতে রাখতে হাত ব্যথা হয়ে গেল তিন গোয়েন্দার। কিন্তু নোকগুলো আর বেরোয় না।
রবিন বলল, নেমে গিয়ে দেখব নাকি ভেতরে কি করছে ওরা?
না, এভাবে যাওয়া ঠিক হবে না, কিশোর বলল, দেখে ফেলতে পারে।
আকাশের অবস্থা ভাল না। বারবার দিগন্তের দিকে তাকাচ্ছে ডেলভার। পানির রঙ গাঢ় সবুজ হয়ে গেছে। বড় হচ্ছে ঢেউগুলো। বাতাস বাড়ছে। দিগন্তেরকালো মেঘের ভেতরে বিদ্যুৎ চমকাল একবার।
ঝড় আসছে, ঘোষণা করল বুড়ো। ফিরে যেতে হবে আমাদের।
আর কয়েক মিনিট থাকা যায় না? অনুরোধ করল রবিন।
না, লক্ষণ খুব খারাপ। এখুনি রওনা হতে হবে আমাদের।
ইঞ্জিন স্টার্ট দিল ডেলভার।
ঠিক এই সময় গুহা থেকে বেরিয়ে এল কমান্ডার। লোকগুলো নেই সঙ্গে। সৈকত দিয়ে পানির দিকে এগেলি সে।
কিন্তু কি করে সে, দেখার সুযোগ হলো না গোয়েন্দাদের। তার আগেই বাঁকের আড়ালে সরে এল বোট।
ঢ্যাঙ্ক-ঢ্যাঙ্ক করে এগিয়ে চলেছে বোট। বাতাস আর ঢেউ যে হারে বাড়ছে তাতে সময়মত জেটিতে পৌঁছতে পারবে কিনা সন্দেহ হলো মূসার। জিজ্ঞেস করল, স্পীড আর বাড়ানো যায় না?
না, মাথা নাড়ল ডেলভার, সাধ্যমত চলছে এটা।
বিশাল এক ঢেউ এসে ভেঙে পড়ল বোটের ওপর। পানির ছিটে ভিজিয়ে দিল আরোহীদের।
ঢেউয়ের সঙ্গে প্রাণপণ লড়াই করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে যেন এগিয়ে চলেছে বৃদ্ধ জল্যানটা। দমছে না কোনমতেই।
আকাশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে কালো মেঘ। কয়েক মিনিট পর আঘাত হানল বৃষ্টি।
মুসার মনে হতে লাগল, আজ ওদের ডুবিয়েই ছাড়বে বোট। সাগরের যা অবস্থা, এখন বোট ডুবলে মরতে হবে, বাঁচার কোনই আশা নেই।
কিন্তু বুড়োর কথাই ঠিক, ডুবল না বোট। ধুকতে ধুকতে প্রায় ডুবন্ত অবস্থায় এসে তীরে ভিড়ল। দড়ি আর শেকল দিয়ে শক্ত করে বোট বেধে নেমে পড়ল ডেলভার আর তিন গোয়েন্দা। বৃষ্টির মধ্যে মাথা নিচু করে দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকল।
বিকেলের দিকে ঝড় থামল, কমে এল বৃষ্টি। পরিষ্কার হতে লাগল। আকাশ। পেটভরে খেয়ে আয়েশের ঢেকুর তুলে চেয়ারটা ঠেলে পেছনে সরাল ডেলভার। পাইপ ধরাল। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বলল, ঝড় তো থামল। এবার কি করার ইচ্ছে?
গুহার কাছে যাব, কিশোর বলল, কি ঘটে ওখানে দেখব।
দাঁতের ফাঁকে পাইপটা চেপে ধরল ডেলভার। ধোঁয়া টানা থামিয়ে দিয়েছে। চোখে ভয়। রাতের বেলা!
হ্যাঁ। অন্ধকার নামলেই বেরিয়ে পড়ব আমরা। রাত বারোটার মধ্যে ফিরে আসব। টর্চটা বের করে ব্যাটারিগুলো খুলে নিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল কিশোর।
যা বলছে তাই করবে ছেলেগুলো, এতদিনে বুঝে ফেলেছে ডেলভার, ওদের ঠেকানো যাবে না। তাই বাধা দেয়ার চেষ্টা করল না আর। তবে কয়েকবার করে সাবধান করল। বলল, যেতে বাধা দেব না, তবে আমার একটা পরামর্শ শোনো। সবার একসঙ্গে গিয়ে কাজ নেই। যে কোন দুজন। যাও। একজন আমার এখানে থাকো। সময়মত যদি না ফেরো তোমরা, সাহায্য করতে পারবে সে।
পরামর্শটা মনে ধরল কিশোরের। রাজি হলো।
সন্ধ্যা হতেই তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল সে আর মুসা। রবিন রয়ে গেল ডেলভারের বাড়িতে। যদিও এভাবে একা পড়ে থাকার ইচ্ছে তার ছিল না। তবু নেতার নির্দেশ, মানতেই হয়।
পাহাড়ে উঠতে শুরু করল দুই গোয়েন্দা। বৃষ্টিতে ভিজে পিচ্ছিল আর নরম হয়ে আছে মাটি। অন্ধকার হলে এ পথে চলার সাহস করত না ওরা। চাঁদের আলো আছে বলে এগোতে পারছে।
নিরাপদেই ওপরে উঠে পাহাড়ী পথ ধরে হেঁটে চলল দুজনে। গিরিখাতটা দেখা গেল একসময়। ওটা ধরে চলে বেরিয়ে এল সৈকতে।
পৌঁছে গেছে। ওখানে বসে জিরিয়ে নিল কয়েক মিনিট। তারপর উঠে পাহাড়ের দেয়ালে গা মিশিয়ে পা টিপে টিপে এগোল কমান্ডারের গুহার দিকে।
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল কিশোর।
তার গায়ের ওপর এসে পড়ল মুসা। কি হলো!
হাত তুলে দেখাল কিশোর।
মুসাও দেখল। বড় বড় হয়ে গেল চোখ। নিজের অজান্তেই মুখ থেকে অস্পষ্টভাবে বেরিয়ে এল, খাইছে!
তীর থেকে তিনশো গজ দূরে সমুদ্রের পানিতে মিটমিট করে জ্বলছে একটা লাল আলো, যেন কোন একচোখো সাগর-দানবের চোখ। কিন্তু চাঁদের আলোয় লাল আলোর নিচের কালো অবয়বটাকে চিনতে ভুল হলো না। একটা সাবমেরিনের কনিং টাওয়ার।