আলো জ্বালল কেন? মূসার প্রশ্ন। কি দেখল?
চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল, যে ভাবে আলোটা নাড়ল, মনে হলো কোন রকম সঙ্কেত দিল।
কাকে? রবিনের প্রশ্ন।
কি জানি। কোন জাহাজ হয়তো নোঙর করেছে এখন তীর থেকে দূরে। ওটাকে সঙ্কেত দিয়েছে।
কেন?
কারণ তো নিশ্চয় আছে। আরও তথ্য না পেলে সেটা জানা যাবে না। তবে সবার আগে দেখতে হবে, জাহাজ সত্যি আছে কিনা।
উঠে পড়ল ওরা। চুপচাপ এসে গুহায় ঢুকল।
রান্না করে খেয়ে নিয়ে আলোচনায় বসল। কিভাবে কি করা যায়, তার নানারকম ফন্দি আঁটতে লাগল।
মুসা বলল, বাইরে কোথাও লুকিয়ে থেকে সাগরের দিকে নজর রাখলে কেমন হয়?
মন্দ হয় না, কিশোর বলল। চলো যাই। জাহাজ থেকে বোটটোট পাঠালে দেখতে পারব।
কিন্তু গুহা থেকে বেরিয়েই ওরা পড়ে গেল কমান্ডারের সামনে। মনে হলো যেন আড়ি পেতে ওদের কথা শোনার চেষ্টা করছিল লোকটা। ওদেরকে দেখে কেমন থতমত খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, তোমাদের কাছেই যাচ্ছিলাম…
কেন? জানতে চাইল কিশোর।
এই এমনি…ইয়ে, তোমরা আর কতদিন আছ এখানে… কথা শেষ না করেই চুপ হয়ে গেল কমান্ডার।
আমরা চলে গেলে খুশি হন মনে হয় আপনি? ফস করে বলে বসল মুসা।
না না…তা কেন? কয়েকজন পোড় খাওয়া নাবিক পড়শী হলে বরং ভালই লাগে। মনে নেই সেই দ্বীপটার কথা? তোমাদের নিয়ে নামলাম…তারপর..তারপর কি যেন ঘটল?
কি আর ঘটবে? মগজে গোলমাল! বলে দিল মুসা। মাথার ছিটে খোঁচা লাগল।
মানে? রেগে উঠল কমান্ডার।
তাড়াতাড়ি বলল কিশোর, না না, আপনি রাগবেন না। আমরা কাল সকালেই চলে যাচ্ছি।
চুপ হয়ে গেল কমান্ডার। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল কিশোরের মুখের দিকে। যেন তার কথা বুঝতে পারছে না। তারপর আনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেল নিজের গুহার দিকে।
বড় একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে বসল তিন গোয়েন্দা।
রাত দুটো পর্যন্ত বসে থেকেও সাগরের দিক থেকে কোন জাহাজ বা বোট আসতে দেখল না। ঘন ঘন হাই তুলছে তিনজনেই। প্রচণ্ড ঘুম পেয়েছে।
মুখের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে রবিন বলল, নাহ, আজ রাতে আর কিছু ঘটবে বলে মনে হয় না।
ঘটার আশাও করিনি।
তবে শুধু শুধু বসে রইলে কেন?
শিওর হয়ে নিলাম, আমার সন্দেহ ঠিক আছে কিনা।
কি বুঝলে?
ঠিকই আছে।
তোমার কথার মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারছি না আমি, কিশোর, মূসা বলল। এই ভোররাতে অত হেয়ালি ভাল্লাগছে না। যা বলার পরিষ্কার করে বলো।
একটা ব্যাপার তো অবশ্যই খেয়াল করেছ, কিশোর বলল, কমান্ডার চায় না আমরা এখানে থাকি। কায়দা করে জানতে এসেছিল, আমরা কখন যাব। বলে দিলাম, কাল যাব। সুতরাং আজ রাতে যেটা ঘটাতে চেয়েছিল, সেটা কাল ঘটাবে সে। আজ আমরা আছি বলে অপেক্ষা করবে। কাল আর থাকব না…
না থাকলে দেখব কি করে কি ঘটাচ্ছে?
বুড়ো ডেলভারের সাহায্য নিতে হবে।
কিভাবে?
সেটা কালই দেখো। চলো, এখন আর বকবক না করে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
.
১৪.
পরদিন খুব সকালে ওর মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে বাইরে বেরোতেই দেখে কমান্ডার দাঁড়িয়ে আছে সৈকতে। ওদের দেখে হেসে জিজ্ঞেস করল, তাহলে চলেই যাচ্ছ?
হ্যাঁ, জবাব দিল কিশোর, একজায়গায় আর কত। দেখারও নেই তেমন কিছু।
আমার কিন্তু ভালই লাগে এখানে।
আমাদেরও লাগা শুরু করেছিল, কিন্তু থাকতে আর দিলেন কই?-বলার ইচ্ছে ছিল মুসার, কিন্তু চেপে গেল। মুখে বলল, দূর, এই পাগলের আড্ডায় কে থাকে। তা ছাড়া খাবার নেই, কিছু না, আনতে গেলেও বিরাট ঝামেলা…
কমান্ডারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গিরিখাতের দিকে এগোল ওরা। পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পেত মুখে মুচকি হাসি নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে কমান্ডার।
পাহাড় পেরিয়ে ডেলভারের বাড়িতে পৌঁছল ওরা। তখনও মাছ ধরতে বেরোয়নি বুড়ো। ওদের দেখে অবাক হলো। কি ব্যাপার? এত সকাল সকাল? চোখমুখের অবস্থা দেখে তো মনে হয় না রাতে ভাল ঘুম হয়েছে। ভূতের পাল্লায় পড়েছিলে নাকি?
মুসা জবাব দিল, ভূত নাহলেও পাগলের পাল্লায় পড়েছিলাম…
কনুইয়ের গুঁতো মেরে ওকে থামিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বলল কিশোর, গুহাটার একটা রহস্য আছে, মিস্টার ডেলভার, ঠিকই বলেছিলেন আপনি। রোখ চেপে গেছে আমার। এর রহস্য ভেদ না করে ছাড়ব না। এ জন্যে আপনার সাহায্য দরকার আমাদের।
চোখ কপালে উঠল বুড়োর। আমার সাহায্য! দেখো বাবা, আর যাই করতে বলো, গুহার কাছে যেতে বোলো না আমাকে, দুহাত নেড়ে বলল সে, আমি সেটা পারব না।
না, গুহার কাছে যেতে বলব না আপনাকে আশ্বস্ত করল কিশোর। মাছ ধরতে বেরোবেন না আজ?
বেরোব। নাস্তাটা সেরেই। তোমরা খেয়েছ?
না।
তাহলে এসো, বসে যাও আমার সঙ্গে।
হ্যাঁ। বসব। আপনার সঙ্গে মাছ ধরতে বেরোব আজ আমরাও আপত্তি আছে?
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বুড়ো। তারপর মাথা নাড়ল, না, আপত্তি নেই। আরও অনেক কথা আছে তোমার পেটে, বুঝতে পারছি। এসো, খেতে খেতে ঢেলে দাও।
.
অতি পুরানো একটা মোটর বোট। ইঞ্জিনটাও আদিম। তবু ওটারই গায়ে আদর করে হাত বোলাল বুড়ো ডেলভার। গর্ব করে বলল, এটা আমার তিরিশ বছরের সঙ্গী। একসঙ্গে সাগরে বেরিয়েছি আমরা, কত মাছ ধরেছি!
ডোবাবে না তো আমাদের? মুসা বলল।
আহত হলো ডেলভার। কি যে বলো! তোমাদের কাজ যদি কেউ উদ্ধার করে দিতে পারে, আমার এই বোটটাই পারবে।