খাওয়া শেষ করে আগুন নেভাল ওরা। বেরিয়ে পড়ল। ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে চলল মুসা। কিশোর আর রবিন খাবারের টিনগুলো নিয়ে চলল খাদের ধারে পাহাড়ের খাজে লুকাতে।
লুকানো সেরে রবিন জিজ্ঞেস করল, কমান্ডারের ওখানে যাবে নাকি। আবার?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর, যাব।
যদি মারতে আসে?
পালিয়ে আসব। তবে প্রশ্নগুলো না করা পর্যন্ত আমার স্বস্তি নেই।
কমান্ডারের গুহায় রওনা হলো দুজনে।
দূর থেকেই দেখল, গুহার সামনে কি যেন করছে বুড়ো নাবিক। কাছে গিয়ে দেখল, একটা কাঠি দিয়ে মাটিতে কিছু আঁকছে সে। ওদের সাড়া পেয়ে জুতো দিয়ে ডলে তাড়াতাড়ি মুছে ফেলল। হাক দিল, এই যে ছেলেরা, আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ?
পরস্পরের দিকে তাকাল দুই গোয়েন্দা। আরেকবার অবাক করেছে। ওদের কমান্ডার।
কিশোর জবাব দিল, হ্যাঁ। আমাদের চিনতে পেরেছেন?
পারব না কেন, নিশ্চয় পেরেছি।
কই, তখন তো পারলেন না?
পারিনি নাকি? কি জানি! মাথা চুলকাল কমান্ডার, মাঝে মাঝে মাথাটার মধ্যে কি যে হয়ে যায়…যাকগে, তোমাদের আরেক বন্ধু কোথায়?
মাছ ধরতে গেছে। পাহাড়ের ঢালের নিচে।
ও। ওদিকটায় যাওয়া ঠিক হয়নি। জায়গা ভাল না।
কেন ভাল না, জিজ্ঞেস করল রবিন। জবাব পেল না।
আনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে, পিঠের ওপর দুহাত নিয়ে গিয়ে, একহাত দিয়ে আরেক হাতকে আঁকড়ে ধরে গুহামুখের সামনে পায়চারি শুরু করল কমান্ডার।
কমান্ডার মরিস, ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, আপনার গুহার সামনে কোন লোককে ঘোরাফেরা করতে দেখেছেন?
যেন দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল কমান্ডার। চোখ সরু করে তাকাল কিশোরের দিকে। দেখো, আমি একজন সন্ন্যাসী, জায়গাটা অতিরিক্ত নির্জন দেখে একা বাস করতে এসেছি এখানে। আমার কাছাকাছি কেউ আসে না। ওরা ভাবে আমি পাগল।
গেনার আর ডিগের চেহারার বর্ণনা দিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, এ রকম কাউকে দেখেছেন?
বললাম না কেউ আসে না!
তবু, একটু ভাল করে ভেবে যদি বলেন…চোখে হয়তো পড়েছিল, ভুলে
না, ভুলিনি…দাঁড়াও, দাঁড়াও… ভাবতে গিয়ে কপাল কুঁচকে ফেলল কমান্ডার।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল দুই গোয়েন্দা। ভাবছে, গেনারকে কি দেখেছে সত্যি?
কাকে দেখেছেন? জানতে চাইল কিশোর। যে দুজনের কথা বললাম, তাদের কোনজন?
প্রথমজন।
গেনার?
হ্যাঁ, একবার ওরকম চেহারার একজনকে দেখেছিলাম বটে। ফিলিপাইনে আমার ক্রুজারের মেট হয়েছিল।
হতাশায় মুখ বাঁকাল রবিন। এই পাগলের কাছ থেকে কোন তথ্য আদায় করার চেষ্টা বৃথা।
কমান্ডার বলতে থাকল, ওর নাম মনে পড়েছে আমার, গেনারই ছিল। আমাকে জাহাজ ছাড়তে বাধ্য করেছিল সে। জংলীরা এসে ঢাক বাজানো। শুরু করল। ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে শেষে আনারস গাছে চড়ে বাঁচলাম।
কিশোরের কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল রবিন, আবার গেছে ওর মাথাটা। আর কথা বলে লাভ নেই।
বকবক করেই চলেছে কমান্ডার। কোন দিকে খেয়াল নেই।
পাগলকে প্রশ্ন করে কি হবে!। কিশোর বলল, ঠিক আছে, কমান্ডার, আমরা এখন যাই।
ওর কথার জবাব না দিয়ে বিড়বিড় করতে লাগল কমান্ডার, সাঁতার। কাটতে যেতে হবে আমাকে। প্রচণ্ড গরম। আফ্রিকার কাছাকাছি এলেই এ রকম গরম লাগে। কারও দিকে তাকাল না সে। আর একটাও কথা না বলে ঘুরে গিয়ে ঢুকল তার গুহায়।
সৈকতে ফিরে চলল দুই গোয়েন্দা। শুহামুখের কাছ থেকে সরে এসে রবিনের হাত ধরে একটা বড় পাথরের আড়ালে তাকে টেনে নিয়ে এল কিশোর।
অবাক হলো রবিন। কি ব্যাপার?
দাঁড়াও, ও কি আসলেই পাগল, না আমাদের দেখলে ভান করে, সেটা বুঝতে চাই। পাথরের আড়াল থেকে উঁকি দিল কিশোর।
কি দেখছ?
ও বেরোয় কিনা।
বেরোলে কি করবে?
জবাব দিল না কিশোর। তাকিয়ে আছে গুহার দিকে।
কয়েক মিনিট পরই গুহা থেকে বেরিয়ে এল কমান্ডার। পরনে শুধু হাফপ্যান্ট। এদিক ওদিক তাকাল। তারপর এগিয়ে আসতে শুরু করল। ভাবভঙ্গিতে এখনও বোঝা যাচ্ছে না পাগল না ভালমানুষ।
রবিনকে নিয়ে পাথরের আড়ালে আরেকটু সরে গেল কিশোর।
পাশ দিয়ে চলে গেল কমাণ্ডার। দেখতে পেল না ওদের।
ফিসফিস করে রবিন বলল, যাচ্ছে কোথায়, বলো তো? সত্যি সাঁতার কাটবে নাকি?
যাক যেখানে খুশি। এসো। এত তাড়াতাড়ি সুয়োগ দেবে কল্পনাই করিনি।
কিসের সুযোগ।
ওর গুহায় ঢোকার। চলো, জলদি!
পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে একছুটে কমান্ডারের গুহার কাছে চলে এল ওরা। ঢুকে গেল ভেতরে।
বাপরে! গভীর কত! রবিন বলল। পেছনের কিছুই দেখা যায় না।
কিশোর খুঁজছে একদিকে, রবিন আরেক দিকে। পাথরের একটা তাকের কাছে চলে এল সে। চিৎকার করে বলল, দেখে যাও!
রবিনের পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর। একনজর তাকিয়েই বলে উঠল, বাহ, বন্দুকও আছে! রহস্যময় গুলির শব্দের রহস্য ভেদ হলো। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল তাকের কাছে। শটগানটার কাছে পড়ে আছে পুরানো একটা নোটবুক আর একটা ক্যাপ। ক্যাপটা হাতে নিয়ে কি যেন ভাবল সে। আগের জায়গায় রেখে দিয়ে নোটবুকটা তুলে নিল।
কোডবুক! পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলল সে। দূর, আলো এত কম, কিচ্ছু দেখি না। বাইরে চলো।
কি লেখা আছে জানার জন্যে অস্থির হয়ে গেল রবিনও।
গুহামুখের দিকে রওনা দিল দুজনে।
কিন্তু বেরোনোর আগেই মুখ জুড়ে দাঁড়াল কমান্ডার। আলো আসার একমাত্র পথটা আটকে দিয়ে আরও অন্ধকার করে দিল গুহা। ওদের দেখে চিৎকার করে উঠল, চোর! চোর কোথাকার! চুরি করতে ঢুকেছ আমার গুহায়! নোটবুকের জন্যে হাত বাড়াল, দাও ওটা!