মানুষটার ব্যাপারে নতুন করে কৌতূহল দেখা দিল তিন গোয়েন্দার।
খাইছে! মুসা বলে উঠল। নির্বাসিত হয়েছিলেন?
কোন অপরাধে? কে দিল নির্বাসন? প্রশ্ন করল রবিন।
কেউ দেয়নি। নিজে নিজেই হয়ে গেলাম। বেশ কয়েক বছর আগে একটা ডেস্ট্রয়ারে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছিলাম। দক্ষিণ সাগর দিয়ে চলছিল জাহাজ। খাওয়ার পানি নেয়ার জন্যে একটা ছোট দ্বীপে নোঙর করলাম। ম্যাপে নেই ওই দ্বীপ, নাম খুঁজে পাবে না। গরমও পড়েছিল সেদিন, সাংঘাতিক গরম। ছায়ার মধ্যেও একশো ডিগ্রির বেশি। আমার লোকেরা যখন পানি তুলছে জাহাজে, আমি বসলাম একটা ক্যাকটাসের ছায়ায় জিরাতে। কখন ঘুমিয়ে গেলাম বলতে পারব না।
আপনাকে ওখানে ফেলেই চলে গেল নাবিকেরা? আন্দাজ করল রবিন।
হ্যাঁ।
কিন্তু কমান্ডারের খোঁজ করল না একবারও?
ওরা জানতই না আমি নিচে নেমেছি। গাছের গোড়ায় বসে ঘুমিয়ে পড়েছি এটা কল্পনাই করতে পারেনি কেউ। ঘুম ভাঙলে দেখলাম, জাহাজটা চলে গেছে, সিন্দবাদ নাবিকের মত আমি একা পড়ে আছি ওই দ্বীপে।
দারুণ ব্যাপার তো! তারপর? জানতে চাইল মুসা। বাচলেন কি করে?
কি করব বুঝতে পারলাম না প্রথমে। প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটার পর মনে হলো, ফেলে গেছে, ভালই হয়েছে। রবিনসন ক্রুসো হয়ে কাটাব। একটা কুঁড়ে বানিয়ে ছয়টা মাস একা কাটিয়েছি ওই দ্বীপে। একেবারে একা, শুধু আমি।
আপনাকে নিতে ফিরে যায়নি জাহাজটা?
যায়নি। পরে জেনেছি দ্বীপটা নাকি খুঁজে পায়নি ওরা। তবে আমার বিশ্বাস, মিথ্যে কথা বলেছে। যায়ইনি ওরা! জাহাজের কোয়ার্টার মাস্টার, যে আমার জায়গাটা দখল করেছিল সে আর খুঁজে বের করতে যায়নি। তাহলে আবার তাকে কমান্ডারের পদটা হারাতে হত।
দ্বীপে থাকতে খেয়েছেন কি?
খাওয়ার অভাব ছিল না। শুয়াপোকা থেকে শুরু করে পাখি আর কচ্ছপের ডিম, যা পেয়েছি সব খেয়েছি। আদিবাসীরা যদি এ সব খেয়ে তাগড়া জোয়ান হয়ে বেঁচে থাকতে পারে, আমি পারব না কেন?
তা বটে। অথৈ সাগর অভিযানে বেরিয়ে দক্ষিণ সাগরের দ্বীপে নির্বাসিত হয়ে বেচে থাকার জন্যে এ সব আজেবাজে জিনিস খাওয়ার অভিজ্ঞতা তিন গোয়েন্দারও আছে। অবাক হলো না ওরা।
তবে খাবারের কথা উঠে পড়ায় সুযোগটা ছাড়ল না মুসা, বলে বসল, আমাদের খাবার ফুরিয়ে গেছে। আপনার কাছে কি কিছু ধার পাওয়া যাবে?
চুপচাপ উঠে চলে গেল কমান্ডার। ফিরে এল একটা পাউরুটি আর একটিন মাছ নিয়ে। মুসার হাতে দিতে দিতে বলল, চলবে এতে?
চলবে মানে! কৃতজ্ঞ হয়ে গেলাম! অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আরও দুচারটা টুকটাক কথাবার্তার পর তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজেদের গুহার দিকে রওনা হলো গোয়েন্দারা। সকালে নাস্তাটা তেমন জমেনি, খিদে পেয়ে গেছে। টিন থেকে মাংস বের করে রান্না করতে বসে গেল মুসা।
খাওয়ার পর বলল সে, এখন নিশ্চিন্তে রওনা হওয়া যায়।
কোথায়? আনমনা হয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
কোথায় আবার, খাবার আনতে। একবেলা খেয়েই কি শেষ হয়ে গেল নাকি? খানিক পরেই তো আবার খিদে লাগবে।
ওর দিকে তাকিয়ে ঘন ঘন দুতিনবার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। এখনই যাব? অন্যমনস্ক হয়ে আছে ওর ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেল।
এখনই তো যাওয়া উচিত। দেরি করলে রোদ চড়বে, খিদে লাগবে…
আচ্ছা লোকটাকে তোমাদের কেমন লাগল?
জিন মরিসের কথা বলছ? রবিন বলল, মোটেও ইংরেজ মনে হয়নি। আমার। ব্রিটিশ নেভিতে চাকরি করার কথাটা বিশ্বাস করতে পারছি না।
আমিও না, কিশোর বলল। চিন্তাটা সেজন্যেই হচ্ছে
আচ্ছা, আমাদের খাবার এই লোকই চুরি করেনি তো?
কথাটা আমারও মনে হয়েছিল। ভাল করে দেখেছি। তার খাবারের ভাঁড়ারে আমাদের টিনগুলো নেই।
লোকটাকে অবশ্য এতটা খারাপ মনে হয়নি আমার।
তবু কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারলে ভাল হত। বলা তো যায় না কার মনে কি আছে।
চলো তাহলে, যাই আবার।
এখনই?
গেলে এখনই। দেরি করলে আমাদের রওনা হতে দেরি হয়ে যাবে।
বেশ। চলো।
আবার কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করতে চলল ওরা। গুহার ভেতরে আগুনের ধারে বসে আছে সে। পাশে পড়ে আছে একটা ফ্রাইং প্যান। এইমাত্র খাওয়া শেষ করেছে বোঝা গেল।
শব্দ শুনে মুখ তুলে তাকাল কমান্ডার। ভোঁতা গলায় ধমকে উঠল, কে তোমরা?
আমরা! অবাক হয়ে বলল কিশোর, আরে আমরা, চিনতে পারছেন না? তিন গোয়েন্দা, একটু আগেই তো দেখা হলো…
যাও, ভাগো এখান থেকে! এখানে ঘুরঘুর করা আমার পছন্দ না।
১১.
কমান্ডারের এহেন আচরণে চমকে গেল তিন গোয়েন্দা। হাঁ করে তাকিয়ে রইল তার দিকে।
কিন্তু, স্যার, বলল রবিন, এই খানিক আগে অপিনিই…
স্যার স্যার করতে হবে না আর! লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল কমান্ডার। মুঠো চাল ছেলেদের দিকে। যাও এখন। বেরোও। আমাকে একা থাকতে দাও।
রবিনের দিকে তাকিয়ে নীরবে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল কিশোর, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই, বোঝানো যাবে না কমান্ডারকে।
ফিরে চলল তিনজনে।
গুহার কাছ থেকে সরে এসে মুসা বলল, ও ব্যাটা পাগল। বদ্ধ উন্মাদ! একা থাকতে থাকতে মাথাটা পুরোপুরিই গেছে!
হুঁ! কিশোর বলল, যতই দেখছি নোকটাকে, ততই অবাক হচ্ছি। সন্দেহ বাড়ছে আমার।
কোন ব্যাপারে? জিজ্ঞেস করল রবিন।
তা জানি না। তবে মন বলছে, রহস্য একটা অবশ্যই আছে এখানে।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের আসল রহস্যের তো কিনারা হলো না। একটা করতে এসে আরেকটাতে জড়িয়ে পড়ছি। হ্যারিস গেনারের খোঁজ নেয়ার দরকার না?