অন্য কেউ এভাবে কথা বললে স্তব্ধ হয়ে যেত কিশোর। কিন্তু পারকার আংকেলকে চেনা আছে। তাই রাগল না। বোঝানোর চেষ্টা করল, আংকেল, আপনি বুঝতে পারছেন না, ওরা লোক ভাল না…
যত খারাপই হোক, বারো-চোদ্দ দিনে আর কিছু এসে যাবে নাঃ.. রাখলাম…
কিশোরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দিলেন তিনি।
আস্তে করে রিসিভার নামিয়ে রাখল কিশোর। কাছেই যে দাঁড়িয়ে আছে মিসেস টোড, ভুলে গিয়ে, জিনার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, না, হলো না…
মিস্টার পারকার কি বলেছেন আন্দাজ করে ফেলেছে কুটিলা মহিলা। হাসিমুখে বলে উঠল, আমরা ভাল না, না? খারাপের কিছু তো দেখোনি এতদিন, এইবার দেখবে। মিস্টার পারকার থাকার অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন, আমরা থাকব, দেখি তোমরা কি করো?
০৫.
গটমট করে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল মিসেস টোড। চেঁচিয়ে কথা বলে সুখবরটা শোনাতে লাগল স্বামী আর ছেলেকে।
বসার ঘরে সোফায় বসে রইল ছেলেমেয়েরা। সবারই মুখ কালো। নীরবে তাকাচ্ছে একে অন্যের দিকে।
আব্বাটাকে যে দেখতে পারি না আমি, এ-জন্যেই! হঠাৎ ফুঁসে উঠল জিনা। কোন কথা কখনও শুনতে চায় না!
আসলে আন্টিকে নিয়ে খুব অস্থির হয়ে পড়েছেন তো, মুসা বলল। আমাদের কপালই খারাপ, নটার আগেই ফোন করেছেন। কোন আক্কেলে যে বেরিয়েছিলাম!
আব্বা তোমাকে কি বলেছে, বলো তো? কিশোরকে জিজ্ঞেস করল জিনা।
বলেছেন, বেশি কষ্ট হলে বাড়ি চলে যেতে। আন্টি ভাল হলে আবার আসতে…
তুমি তো খালি আব্বাকে ভাল ভাল বললো, বোঝো এখন কার সঙ্গে বাস করি! শোনো, এখানে থেকে তোমাদের কষ্ট করার কোন দরকার নেই। চলে যাও। বেড়াতে এসে অযথা কেন অত্যাচার সহ্য করবে।
কি যে বলো না। তোমাকে একা বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে চলে যাব ভাবলে কি করে? যা-ই ঘটে ঘটুক, আমরা থাকছি। মাত্র তো দুটো হপ্তা, দেখতে দেখতে কেটে যাবে।
না, যাবে না! এত শয়তান লোকের সঙ্গে থাকতে গেলে দুই হপ্তা দুশো বছরেও শেষ হবে না। বাড়ি সামলে রাখার জন্যে ওদেরকে জায়গা দিয়েছে তো আব্বা, রাখুক ওরা। তোমরা বাড়ি চলে যাও, আমিও আমার মত চলব।
ঘাবড়ে গেল কিশোর। খেপিয়ে দেয়া হয়েছে জিনাকে। কি করে বসবে এখন, তার ঠিক নেই।
বোকার মত কথা বোলো না। কিভাবে চললে ভাল হবে, সবাই মিলে আলোচনা করে একটা উপায় বের করে ফেলতে পারব।
দেখো, টিকতে পারবে না এখানে, চলে তোমাদের যেতেই হবে।…রাফি, চলো, ঘুরে আসি।
আমরাও যাব তোমার সঙ্গে, মুসা বলল।
বাধা দিল না জিনা।
সৈকতে এসে বসল ওরা।
গুম হয়ে আছে জিনা। মায়ের জন্যে দুঃখ, বাবার ওপর রাগ-অভিমান, টোডদের ওপর ঘৃণা, সব মিলিয়ে অস্থির করে তুলেছে তাকে। চিরকাল সুখে থেকে থেকে মানুষ, এসব সহ্য করতে পারছে না।
কোমল গলায় জিজ্ঞেস করল কিশোর, আমরা চলে গেলে কি করার ইচ্ছে তোমার, বলো তো? কিছু একটা প্ল্যান তো নিশ্চয় করেছ।
না, বলব না। বললে আমাকে করতে দেবে না তোমরা।
কেন দেব না? রবিন বলল, খারাপ তো আর কিছু করবে না…
যদি করিই, তোমাদের কি? রেগে উঠতে গিয়ে সামলে নিল জিনা, সরি, ঝগড়া করতে চাই না। অহেতুক দাওয়াত দিয়ে এনে তোমাদের ছুটিটা পণ্ড করলাম।
পণ্ড হতে দিচ্ছি না, নিশ্চিন্ত থাকো, জোরগলায় বলল মুসা। দরকার হয় পিটিয়ে বের করব বেঙগুলোকে…বাড়িঘর যদি ঠিকঠাক রাখতে পারি আমরা, আংকেলের কিছু বলার থাকবে নাঃ..
ওই বাড়িটাতে ঢুকতেই ইচ্ছে করছে না আমার আর। বাইরেই ভাল।
চলো তাহলে, কিশোর বলল, দূরে কোথাও চলে যাই। তোমরা এখানে বসো, আমি খাবার নিয়ে আসি।
হুহ, গেলেই দেবে আরকি…
দেখোই না দেয় কিনা, উঠে বাড়ি রওনা হলো কিশোর।
রান্নাঘরে তখন হাসাহাসি চলছে, কথা বলছে তিন টোড। কিশোরকে ঢুকতে দেখেই গম্ভীর হয়ে গেল।
পাত্তাই দিল না কিশোর। ভারী গলায় বলল, স্যান্ডউইচ বানিয়ে দিন। বেড়াতে যাব আমরা।
বা-বা, আব্দার! মুখ ঝামটা দিয়ে বলল মিসেস টোড। রাতের বেলা সব চুরি করে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলেছে, এখন এসেছে স্যান্ডউইচের জন্যে। শুধু রুটি আছে ওখানে, নিলে নাও, নইলে বিদেয় হও।
সোফায় শুয়ে আছে টেরি। হাতে একটা কমিকের বই। সুর করে বলে উঠল, কিশোর, বিশোর...
এক চড় মেরে দাঁত ফেলে দেব, শয়তান ছেলে কোথাকার!
কিশোরকে ভয় পায় টেরি। ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেল।
খেঁকিয়ে উঠল মিসেস টোড, মারো তো দেখি চড়, কত্তবড় সাহস!
মারলে ধরে রাখতে পারবেন না। বজ্জাত বানিয়েছেন, আবার বড় বড় কথা…
গলা খাঁকারি দিল এককোণে বসা মিস্টার টোড। দেখো ছেলে, তাকাও এদিকে...
আপনার দিকে কে তাকায়!
দেখো, তাকাও এদিকে, রেগে গেছে টোড। বসা থেকে উঠল।
বার বার তাকাও এদিকে, তাকাও এদিকেকরছেন কেন? বললাম না। তাকাব না। দেখার মত আহামরি কোন চেহারা নয়।
চেঁচিয়ে উঠল মিসেস টোড, খবরদার, মুখ সামলে…
মুখ সামলে আপনি কথা বলবেন, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। কঠোর দৃষ্টিতে তাকাল মহিলার দিকে।
কয়েক মুহূর্তের বেশি তার চোখে চোখে তাকিয়ে থাকতে পারল না মিসেস টোড। ছেলেটার মধ্যে এমন কিছু আছে, যা অস্বস্তিতে ফেলে দেয় তাকে। শান্তকণ্ঠে কথা বলে, কিন্তু জিভে যেন বিছুটির জ্বালা। সসপ্যান দিয়ে মাথায় একটা বাড়ি মারতে ইচ্ছে করছে তার, কিন্তু অতটা সাহস করল না। এই ছেলে বিপজ্জনক ছেলে।