শোনো, জিনা, অধৈর্য হয়ে বললেন মিস্টার পারকার, নিজে ভাল তো জগৎ ভাল। তোমরা তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার কোরো, সে-ও তোমাদের সঙ্গে করবে। এসব ফালতু কথা নিয়ে বিরক্ত করবে না আমাকে। এমনিতেই অনেক ঝামেলায় আছি।
আমি আসব। আম্মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
না, আসবে না, বাড়িতে থাকো। বাড়ি থেকে যাবে না কোথাও। আরও হপ্তা দুয়েকের আগে তোমার আম্মাকে ছাড়বে বলে মনে হয় না। দেখি, ঝামেলা কেটে গেলে আমি একবার এসে দেখে যাব তোমাদের। গুড-বাই।
লাইন কেটে দিলেন তিনি।
রিসিভার রেখে বন্ধুদের দিকে ফিরল জিনা। হতাশ কণ্ঠে বলল, পরশুর আগে ওরা বলতেই পারবে না আম্মার কি অবস্থা। আব্বার আসারও কোন ঠিক নেই। ততদিন আমাদের কাটাতে হবে মিসেস টোডের সঙ্গে। ওই বুড়িটার সঙ্গে থাকার কথা ভাবতেই এখন কেমন লাগছে আমার।
.
০৪.
এতটাই রেগেছে মিসেস টোড, সেদিন সন্ধ্যায় ওদেরকে খাবারই দিল না। রাতের খাওয়া বন্ধ। বলতে গিয়ে কিশোর দেখে, রান্নাঘরে তালা লাগানো।
ফিরে এসে সবাইকে জানাল খবরটা। তালা লাগিয়ে দিয়েছে, যাতে আমরা কিছু বের করে আনতে না পারি। এত্তবড় শয়তান মহিলা জীবনে দেখিনি আমি। কিন্তু
ঘুমাক, তারপর ভাঁড়ারে গিয়ে খুঁজে দেখব কিছু আছে কিনা, জিনা বলল।
খিদেয় পেট জ্বলছে। কান পেতে শুনছে কিশোর, মিসেস টোড আর টেরি ঘুমাতে গেল কিনা। ওপরতলায় উঠে গেল ওরা, দরজা লাগানোর শব্দ হলো, তারও কিছুক্ষণ পর পা টিপে টিপে নামল সে, রান্নাঘরের দিকে এগোল।
ঘর অন্ধকার, আলো জ্বালতে যাবে, হঠাৎ কানে এল ভারী নাক ডাকানোর শব্দ। কে? ডাটি? না, কুকুর তো ওরকম করে নিঃশ্বাস ফেলে না! মানুষের মত লাগছে।
সুইচে হাত রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। চোর-টোর ঢুকল না তো?
নাহ, দেখতেই হচ্ছে। আলো জ্বেলে দিল সে।
ছোটখাট একজন মানুষ শুয়ে আছে সোফায়। গভীর ঘুম। হাঁ করে শ্বাস টানছে।
দেখতে মোটেও ভাল না লোকটা। কতদিন শেভ করেনি কে জানে, খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গোসল করে না, এমনকি হাতমুখও বোধহয় ঘোয় না, হাতে ময়লা, নখের ভেতর ময়লা ঢুকে কালো হয়ে আছে। মানুষ এত নোংরা হতে পারে ভাবা যায় না। চুল আর নাক টেরির মত।
ও, তাহলে এই ব্যাপার, ভাবল কিশোর। ইনি তাহলে টেরি মিয়ারই বাপ। বাপ-মা যার এরকম, সে আর ভাল হবে কি।
নাক ডাকিয়েই চলেছে লোকটা। কি করবে ভাবতে লাগল কিশোর। ভাঁড়ারে ঢুকতে গেলে যদি শব্দ শুনে জেগে যায় নোকটা? চেঁচামেচি শুরু করে দেবে না তো? অন্যায় ভাবে ঢুকেছে বলে যে বেরিয়ে যেতে বলবে তারও উপায় নেই। তার স্ত্রী চাকরি করে এখানে। তাকে দেখতে আসতেই পারে স্বামী। আংকেল-আন্টিও এতে দোষের কিছু দেখবেন না। বিপদেই পড়া গেল!
খুব খিদে পেয়েছে তার। এবার জিনাদের বাড়িতে আসার পর থেকেই খাওয়া মোটেও সুবিধের হচ্ছে না। ফলে পেটের চাহিদা রয়েই যাচ্ছে। ভঁড়ারে লোভনীয় খাবার আছে ভাবতেই জিভে পানি এসে গেল তার। আলো নিভিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে এগোল আবার।
দরজা খুলল। অন্ধকারেই হাত বাড়িয়ে তাক হাতড়াতে শুরু করল। হাতে ঠেকল একটা পাত্র, খাবার আছে। গন্ধ শুকে বুঝল, মাংস।
আরেকটা পাত্র রয়েছে ওটার পাশে। বেশ বড়। এটা আর শুঁকতে হলো না, আঙুল ছুঁইয়েই বুঝল, ভেজিটেবল। বাহ, চমৎকার! মাংস, ভেজিটেবল, আর কি চাই? রুটি হলেই হয়ে যায় এখন। সেটা পেতে দেরি হলো না। ট্রেতে অনেক আছে।
পাত্রগুলো ট্রেতে গুছিয়ে নিয়ে ভাঁড়ার থেকে বেরিয়ে এল সে। পা দিয়ে ঠেলে আস্তে লাগিয়ে দিল পাল্লা।
অন্ধকারে এগোতে গিয়ে পথ ভুল করে ফেলল। সোজা এসে হোঁচট খেল সোফায়। ঝাঁকি লেগে ছলকে পড়ল তরকারির ঝোল, কয়েক টুকরো তরকারিও পড়ল। আর পড়বি তো পড় একেবারে মিস্টার টোডের হাঁ করা মুখে।
চমকে জেগে গেল লোকটা।
তাড়াতাড়ি পিছিয়ে গেল কিশোর। কোন শব্দ না শুনলে আবার ঘুমিয়ে পড়বে লোকটা। হয়তো পড়তও, কিন্তু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া তরকারির ঝোল বিরক্ত করছে তাকে। ঝটকা দিয়ে উঠে বসল। কে? কে ওখানে? টেরি? কি করছিস?
জবাব দিল না কিশোর। আন্দাজে দরজার দিকে সরে যেতে লাগল।
সন্দেহ হলো নোকটার। লাফ দিয়ে সোফা থেকে নেমে গিয়ে দেয়ালে সুইচবোর্ড হাতড়াতে লাগল। পেয়েও গেল।
অবাক হয়ে কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল সে। তাকাও এদিকে! কি করছ?
আমিও তো সে-কথাই জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম। আপনি এখানে কি করছেন?
তুমি কে? হাত দিয়ে মুখে লেগে থাকা তরকারির ঝোল মুছতে মুছতে বিড়বিড় করে বলল, তাকাও এদিকে!
বললে তো আর চিনবেন না। এটা আমার আংকেলের বাড়ি।
আমার স্ত্রী এখানে চাকরি করে, খসখসে গলায় বলল লোকটা। আমার জাহাজ বন্দরে ভিড়েছে। ছুটি পেয়েছি। দেখতে এসেছি তাকে। তোমার আংকেলের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছে আমার স্ত্রী, আমাকে আসার অনুমতি দিয়েছেন।
এই ভয়ই করছিল কিশোর। মহিলা টোড, আর একটা পুঁচকে টোডের জ্বালায়ই অস্থির হয়ে উঠেছিল, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এখন জলজ্যান্ত এক পুরুষ টোড! বাড়িতে আর টিকতে দেবে না ওদেরেকে।
অনুমতি দিয়েছেন, না? বেশ, কাল সকালে তো আংকেল ফোন করবেন, তখন তাকে জিজ্ঞেস করব। এখন সরুন সামনে থেকে। দোতলায় যাব।
দরজা জুড়ে দাঁড়িয়েছে টোড। কিশোরের হাতের ট্রে-র দিকে চোখ সরু করে তাকাল। আংকেলের বাড়ি, না! ভাড়ার থেকে খাবার চুরি করছ কেন তাহলে? চোর কোথাকার…