ডাকো না। থাকলে তো সাড়াই দেবে, একই রকম তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে জবাব দিল ছেলেটা।
ভয় পেয়ে গেল সবাই। টেরি এমন করে কথা বলছে কেন?
আম্মা, আম্মা! বলে ডাকতে ডাকতে ওপরতলায় দৌড় দিল জিনা। কিন্তু মায়ের বিছানা খালি। সব কটা বেডরুমে ছুটে বেড়াতে লাগল সে। কোথাও পাওয়া গেল না মাকে। সাড়াও দিলেন না মিসেস পারকার।
সিঁড়ি বেয়ে লাফাতে লাফাতে নিচে নামল জিনা। রক্ত সরে গেছে মুখ। থেকে।
দাঁত বের করে হাসল টেরি। চোখ নাচিয়ে বলল, কি, বলেছিলাম না? যত খুশি চিল্লাও এখন, কেউ আসবে না।
টেরির কাছে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল জিনা। কোথায় ওরা? জবাব দাও, কোথায়!
নিজেই খুঁজে বের করো।
ঠাস করে চড় মারল জিনা। যতটা জোরে পারল।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল টেরি। গাল চেপে ধরেছে। বিশ্বাস করতে পারছে না যেন। একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল জিনার দিকে। তারপর সে-ও চড় তুলল।
চোখের পলকে সামনে চলে এল মুসা, আড়াল করে দাঁড়াল জিনাকে। মেয়েমানুষের গায়ে হাত তুলতে লজ্জা করে না? মারতেই যদি হয়, আমাকে মারো, দেখি কেমন জোর?
টেনে তাকে সরানোর চেষ্টা করল জিনা। চিৎকার করে বলল, সরো তুমি, মুসা, সরো! অনেক সহ্য করেছি! পেয়েছে কি! আজ আমি ওর বাপের নাম ভুলিয়ে ছাড়ব!
কিন্তু সরল না মুসা।
তার গায়ে হাত তোলার সাহস করল না টেরি। পিছিয়ে যেতে লাগল দরজার দিকে।
পথ আটকাল কিশোর। দাঁড়াও। আন্টি কোথায়, বলো।
এই সময় টেরির বিপদ বাড়াতেই যেন ঘরে ঢুকল রাফি। এতক্ষণ বাগানে ছিল। ঢুকেই আঁচ করে ফেলল কিছু একটা ঘটেছে। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে গরগর করতে করতে এগোল।
আরে, ধরো না কুত্তাটাকে! কাঁপতে শুরু করল টেরি। কামড়ে দেবে তো!
রাফির মাথায় হাত রাখল কিশোর। চুপ থাক্।-হ্যাঁ, টেরি, এবার বলল, আন্টি কোথায়?
রাফির ওপর থেকে চোখ সরাল না টেরি। জানাল, হঠাৎ করে পেটব্যথা শুরু হলো। ডাক্তারকে খবর দিল জিনার আব্বা। ডাক্তার এসে দেখে বলল, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তখনই তাড়াহুড়া করে নিয়ে গেল।
ধপ করে সোফায় বসে পড়ল জিনা। দু-হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল, আম্মা..ও আম্মা, তোমার কি হলো- কেন আজ বেরোলাম ঘর থেকে…আম্মাগো…
তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল সবাই, এই সুযোগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল টেরি। রাফি একবার খেক করে উঠল, কিন্তু ততক্ষণে রান্নাঘরের দরজার কাছে চলে গেছে সে। দরজা পেরিয়েই দড়াম করে লাগিয়ে দিল পাল্লা।
ফিরেও তাকাল না গোয়েন্দারা।
জরুরী কণ্ঠে কিশোর বলল, নিশ্চয় নোট রেখে গেছেন আংকেল।
খুঁজতে শুরু করল তিনজনে।
.
০৩.
চিঠিটা খুঁজে পেল রবিন। জিনার আম্মার বড় ড্রেসিং টেবিলে চিরুনি চাপা দেয়া। ওপরে জিনার নাম লেখা।
তাড়াতাড়ি খুলে জোরে জোরে পড়ল রবিন:
জিনা,
তোমার মাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ভাল না হওয়া পর্যন্ত আমি তার সঙ্গে থাকব। সেটা দু-দিনও হতে পারে, দুই হপ্তাও হতে পারে। রোজ সকাল নটায় ফোন করে তার খবরাখবর জানাব তোমাদের। চিন্তা কোরো না। মিসেস টোড তোমাদের খেয়াল রাখবেন। বাড়িঘর দেখেশুনে রাখবে। –তোমার বাবা।
বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে হু-হু করে কাঁদতে লাগল জিনা। বলতে লাগল, আম্মা, আম্মাগো, তুমি আর আসবে না। আমি জানি! তোমাকে ছাড়া কি করে থাকব আমি!
তাকে সান্ত্বনা দিয়ে, বুঝিয়ে-শুনিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল তিন গোয়েন্দা। সহজে কাঁদে না জিনা। তাকে এভাবে বিলাপ করতে দেখে অস্থির হয়ে পড়ল ওরাও।
রাফিও জিনাকে কাঁদতে দেখেনি। প্রথমে অবাক হলো, তারপর অস্থির হয়ে উঠল তিন গোয়েন্দার মতই। জিনার হাঁটুতে মুখ রেখে কুঁই কুঁই করতে লাগল।
অনেকক্ষণ কেঁদেকেটে অবশেষে কিছুটা শান্ত হলো জিনা। মুখ তুলে বলল, আমি আম্মাকে দেখতে যাব।
কোথায় যাবে? কিশোর বলল, কোন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে জানি না। আর আমরা গেলেও ঢুকতে দেবে না। সারাদিন কিছু খাওনি। চায়ের সময় হয়ে গেছে। চলো, কিছু খেয়ে নিলে ভাল লাগবে।
আমি কিচ্ছু খাব না! প্রায় ফুঁসে উঠল জিনা। তোমাদের ইচ্ছে হলে যাও! আবার মুখ গুঁজল বিছানায়।
চুপ করে রইল কিশোর। জিনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছে।
কয়েক মিনিট পর আবার মুখ তুলল জিনা। চোখ মুছল। মলিন হাসি ফুটল ঠোঁটে। বলল, সরি! কিছু মনে কোরো না! যাও, চায়ের কথা বলে এসো।
কিন্তু কে যাবে মিসেস টোডকে চায়ের কথা বলতে? বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে যাওয়ার অবস্থা হলো যেন দূরদের। মুসা রাজি হলো না। রবিনও আমতা আমতা করতে লাগল। শেষে কিশোরই উঠল যাওয়ার জন্যে।
রান্নাঘরের দরজা খুলে উঁকি দিল সে। টেরি বসে আছে গুম হয়ে। গালের একপাশ লাল, যেখানে চড় মেরেছিল জিনা।
মুখ ভয়ানক গভীর করে মিসেস টোড বলল, আরেকবার খালি আমার ছেলেকে মেরে দেখুক, ওর অবস্থা কাহিল করে দেব আমি!
চড় খাওয়ার কাজ করেছে, খেয়েছে, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। ওসব আলোচনা করতে আসিনি আমি।
তাহলে কি জন্যে এসেছ?
চা দিতে হবে।
পারব না।
কিশোরের দিকে তাকিয়ে গরগর করে উঠল ঘরের কোণে বসে থাকা ডারবি, কিন্তু কাছে আসার সাহস করল না।
কুকুরটাকে পাত্তাই দিল না কিশোর। আপনি না দিলে আমিই নেব। রুটি কোথায় রেখেছেন? কেক?
জ্বলন্ত দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকাল মিসেস টোড। কিশোরও তাকিয়ে রইল একই ভঙ্গিতে। এরকম বাজে মহিলার সঙ্গে ভদ্রতা করার কোন প্রয়োজন মনে করল না সে।