কি আর করা। সৈকতে হাঁটতে লাগল ওরা।
মুসা বলল, সকালেই বুঝেছি, আজ দিনটা ভাল যাবে না। শুরুতেই গণ্ডগোল।
হাঁটতে হাঁটতে উঁচু একটা পাড়ের কাছে চলে এল। বড় বড় ঘাস বাতাসে দোল খাচ্ছে। পাড়ের নিচের ঝকঝকে সাদা বালিতে পা ছড়িয়ে বসল সবাই। ও, না, ভুল হয়ে গেছে, সবাই না; রাফি বসল লেজ ছড়িয়ে।
মুসা জিজ্ঞেস করল, তোমাদের খিদে পেয়েছে?
মোটামুটি হ্যাঁ-ই করল সবাই।
খাবারের প্যাকেট খোলা হলো। কিন্তু স্যান্ডউইচে কামড় দিয়েই মুখ বাকাল কিশোর, এহহে, বাসি রুটি দিয়েছে!
ইচ্ছে করে শয়তানিটা করেছে মিসেস টোড, বুঝতে অসুবিধে হলো না কারও। বাসি রুটি, গন্ধ হয়ে গেছে। ভেতরে মাখন দেয়নি বললেই চলে। ফেলে দিল কিশোর, খেতে পারল না।
জিনা আর রবিনও খেল না।
জোরজার করে দুটো স্যান্ডউইচ গিলল কোনমতে মুসা।
কেবল রাফির কোন ভাবান্তর নেই। সে এসব পচা-বাসি সবই খেতে পারে। গপগপ করে গিলতে লাগল। নিজের ভাগেরগুলো তো খেলই, অন্যদেরগুলোও খেয়ে চলল।
মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে সকলের।
খানিকক্ষণ ঝিম মেরে থাকার পর মুসা বলল, দূর, এভাবে বসে থাকতে ভাল্লাগছে না! ওঠো।
কোথায় যাব? রবিনের প্রশ্ন।
ওই টিলাটার চূড়ায় গিয়ে বসি। দ্বীপে যখন যেতে পারলামই না, বসে বসে দেখিই এখান থেকে।
হু, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল কিলোর, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আরকি। চলো।
টিলার মাথায় এসে বসল ওরা। চারপাশে অনেক দূর দেখা যায় এখান থেকে। চমৎকার বাতাস।
জিনার দ্বীপটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রবিন জিজ্ঞেস করল, জিনা, সেই ভাঙা জাহাজটা এখনও আছে?
কোন জাহাজের কথা বলছে, বুঝতে পারল জিনা। সেই যে সেবার, প্রথম যখন তাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল তিন গোয়েন্দা, তখন এক সাংঘাতিক অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়েছিল ওরা। দ্বীপে গিয়েছিল বেড়াতে। প্রচণ্ড ঝড় হলো। ঝড়ে সাগরের নিচ থেকে উঠে এল পুরানো আমলের একটা ভাঙা কাঠের জাহাজ ম্যাপ পাওয়া গিয়েছিল। সোনার বার পেয়েছিল।
আছে, জানাল জিনা।
চকচক করে উঠল কিশোরের চোখ, আছে! আমি তো ভেবেছি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে তলিয়ে গেছে এদ্দিনে।
না যায়নি। পাথরের মধ্যে তেমনি আটকে আছে। বড় বড় ঢেউও ছাড়িয়ে নিতে পারেনি। দ্বীপে গেলেই দেখতে পাবে।
একেবারেই ভাঙেনি?
একেবারে ভাঙেনি তা নয়। খুলে খুলে পড়ছে তক্তা। দু-চারটে ঝড়ের বেশি আর হজম করতে পারবে বলে মনে হয় না।
দ্বীপের পুরানো ভাঙা দুৰ্গটার দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। দাঁড়কাকের বাসা ছিল যে টাওয়ারটাতে সেটা এখনও তেমনি দাঁড়িয়ে আছে।
জিজ্ঞেস করল, কাকগুলো এখনও আছে, না?
আছে, জানাল জিনা। প্রতি বছরই বাসা বানায়। কমেতেনিই, আরও বেড়েছে।
এই দেখো, দেখো, ধোঁয়া, মুসা বলল। দ্বীপে কেউ উঠেছে।
না, কে উঠতে যাবে। স্টীমারের ধোঁয়া হবে। দ্বীপের ওপাশে আছে, তাই দেখতে পাচ্ছি না আমরা।
ওরকম স্টীমার এখনও আছে নাকি এ-অঞ্চলে? জিজ্ঞেস করল রবিন। ফকফক করে ধোঁয়া ছাড়ে যেগুলো?
তার চেয়ে প্রাগৈতিহাসিকগুলোও আছে। জেলেরা মাছ ধরতে যায় ওসব নিয়ে।
পুরানো জলযান নিয়ে আলোচনা চলল।
ঘড়ি দেখল কিশোর। এবার ওঠা যাক। চায়ের সময় হয়ে এসেছে। গিয়ে যদি দেখতাম আন্টি ভাল হয়ে গেছে, একটা চিন্তা যেত।
হ্যাঁ, মাথা দুলিয়ে মুসা বলল, আন্টি খাবার টেবিলে না থাকলে সবই বিস্বাদ।
উঠল ওরা।
কিছুদূর এসে আবার ঘাড় ঘুরিয়ে দ্বীপটার দিকে তাকাল কিশোর। ঘুরে ঘুরে উড়ছে কয়েকটা সীগাল। ধোঁয়া মিলিয়ে গেছে। ঠিকই বলেছে বোধহয় জিনা, স্টীমারই। সরে চলে গেছে, ফলে আর ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে না।
কিন্তু একটা খুঁতখুঁতানি থেকেই গেল তার সন্দেহপ্রবণ মনে।
ব্যাপারটা লক্ষ করল জিনা। কি হলো? ধোঁয়াতে রহস্য খুঁজে পেলে নাকি?
নাক চুলকাল কিশোর। কি জানি!
ভেবো না, কালই চলে যাব। স্টীমারের ধোঁয়া ছিল, না কেউ দ্বীপে উঠে। আগুন জ্বেলেছে, জানাটা কঠিন হবে না।
বাড়ি ফিরে এল ওরা। বসার ঘরে ঢুকে দেখে মহাআরামে সোফায় বসে জিনার একটা বই পড়ছে আর পা নাচাচ্ছে টেরি।
এই ছেলে, এখানে কি? ধমক দিল জিনা। আমার বই ধরলে কেন?
তাতে ক্ষতিটা কি হলো? বইই তো পড়ছি, নষ্ট তো আর করছি না কিছু।
না বলে তুমি ধরলে কেন? সাহস তো তোমার কম না! আমার ঘরে ঢোকো…
ঘরে ঢোকা কি অন্যায়?
নিশ্চয় অন্যায়। না বলে যে অন্যের ঘরে ঢুকতে নেই এই শিক্ষাটাও দেয়নি তোমাকে কেউ? যা করেছ, করেছ। আব্বার স্টাডিতে যেন ঢুকতে যেয়ো না, পিঠের ছাল ছাড়াবে তাহলে
ওখানেও ঢুকেছি, নির্দ্বিধায় স্বীকার করল ছেলেটা। কি সব বিচ্ছিরি যন্ত্রপাতি। ওসব দিয়ে কি করে?
রাগে ক্ষণিকের জন্যে কথা হারিয়ে ফেলল জিনা। চেঁচিয়ে উঠল, বলো কি! ওখানেও…আমরাই যেখানে সাহস পাই না…আব্বা কিছু বলেনি?
না।
ঘরে ছিল না বোধহয়, তাই বেঁচে গেছ। বলবে না আবার! দাঁড়াও গিয়ে বলছি, তারপর বুঝবে মজা…
বলোগে, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়ল টেরি। পাবে কোথায় তাকে? জিনাকে আরও রাগানোর জন্যে সামনে-পেছনে শরীর দোলাতে লাগল। বইটা চোখের সামনে এনে গভীর মনযোগে পড়ার ভান করল।
ওর এই বেপরোয়া ভাবভঙ্গি সন্দেহ জাগাল জিনার মনে। পাব কোথায় মানে?
পাব কোথায় মানে, পাবে না।
হঠাৎ শঙ্কিত হয়ে উঠল জিনা। আম্মা কোথায়?