.
১৪.
পরদিন সকালে সবার আগে ঘুম ভাঙল কিশোরের। দড়ি বেয়ে উঠে এল ফোকরের বাইরে। সময়মতই বেরিয়েছে। দেখল, সিঁড়ির গর্ত দিয়ে বেরিয়ে আসছে দুই টোড। ঝোপের আড়ালে আড়ালে ওদের কাছাকাছি চলে গেল সে, কি বলে শোনার জন্যে।
টেরির জন্যে অস্থির হয়ে আছে দু-জনে।
মিসেস বলল, ও পাতালঘরে নেই, কতবার বলব! খোঁজা কি আর বাকি রেখেছি?,
অনেক ঘর অনেক গলিঘুপচি আছে ওর মধ্যে, উত্তেজনা আর দুশ্চিন্তায় অনেক বেশি খসখসে হয়ে গেছে টোডের কণ্ঠ। বাকি থাকলেও জানছি কি করে?
যে ভাবে চিৎকার করে ডেকেছি, তার কানে শব্দ যেতই।
না-ও যেতে পারে। মাটির নিচের এসব ঘরগুলো ভয়ানক…
তোমার মাথায় গোবর ভরা আছে, মিস্টার টোড! রেগে গেল মিসেস। আমি বলছি ও এ দ্বীপে নেই। ওকে গায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
কারা নিল?
যারা জিনিসগুলো নিয়ে গেছে। গুরু-ছাগলের ডাক ডেকে ভয় দেখিয়েছে। নৌকায় তুলে ওরাই নিয়ে গেছে আমার টেরিকে…
নৌকাটা তাহলে কোথায় ছিল?
সেটা আমি কি জানি? ছিল নিশ্চয় কোথাও। লুকিয়ে রেখেছিল। পুরো। দ্বীপের কোথায় কি আছে না আছে সব কি আমরা জানি নাকি?
কি করতে বলছ তাহলে?
গাঁয়ে গিয়ে খুঁজতে হবে। ভয় লাগছে আমার, জন। টেরির যদি কিছু হয়ে যায় আমি বাঁচব না…
তেতো হয়ে গেল কিশোরের মন। নিজের ছেলেকে যখন খুঁজে পাচ্ছে না, তখন কান্নাকাটি শুরু করেছে। যে মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে ওরা, তার মায়ের কি অবস্থা, মা হয়েও একবার ভাবেনি।
এখুনি চলো, তাগাদা দিল মিসেস।
ডারবিকে কি করব?
এখানেই থাকবে। মেয়েটাকে পাহারা দিক।
অন্ধকারে একা থাকবে মেয়েটা, ভয় পাবে না?
ডারবি তো থাকছেই, ভয় কিসের? চলো, চলো, দেরি করলে কি হয়ে যায় কে জানে!
কি মহিলারে বাবা!–ভাবছে কিশোর। ছোট্ট একটা মেয়েকে অন্ধকার পাতালঘরে রেখে যেতে এতটুকু মন কাঁপছে না। তবে একদিক থেকে ভালই হবে। ওরা চলে গেলে নির্বিবাদে গিয়ে মেয়েটাকে বের করে আনা যাবে, ঝামেলা হবে না।
কুকুরটাকে রেখে চলে গেল টোডেরা।
দু-পায়ের ফাঁকে লেজ গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের চলে যেতে দেখল ডারবি। তারপর দৌড়ে ফিরে গেল চত্বরে, অলস ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ল। দিনের আলোয় রোদের মধ্যে থেকেও ভারি অস্বস্তি বোধ করছে কুকুরটা। কান খাড়া, সারাক্ষণ তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। আজব এই দ্বীপটাকে মোটেও পছন্দ করতে পারছে না সে।
তাড়াতাড়ি এসে গুহায় ঢুকল কিশোর। বলল, বাইরে এসো সবাই। জরুরী কথা আছে। টেরি, তুমি বসে থাকো। এগুলো আমাদের কথা, তোমার শোনার দরকার নেই।
টেরির পাহারায় রইল রাফি। অন্যেরা কিশোরের সঙ্গে গুহার বাইরে বেরিয়ে এল।
শোনো, বলল কিশোর, টোডেরা নৌকায় করে গায়ে চলে গেছে। টেরিকে খুঁজতে। বাচ্চা মেয়েটাকে রেখে গেছে পাতালঘরে, ডার্টির পাহারায়। মিসেস টোড সাংঘাতিক দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। তার ধারণা, কেউ তার সোনামানিককে ধরে নিয়ে চলে গেছে, তার দুধের শিশুটা ভয়েই আধমরা হয়ে এখন তার জন্যে কান্নাকাটি করছে।
আহারে! জিভ দিয়ে চুকচুক করল মুসা।
শয়তান মেয়েমানুষ! ফুঁসে উঠল জিনা। ছোট্ট মেয়েটাকে যে ধরে এনেছে, কষ্ট পাচ্ছে অন্ধকার পাতালঘরে বসে, সেটা একবার তাবেনি! ওটা, মহিলা না, ডাইনী!
ঠিকই বলেছ, মাথা কাত করল কিশোর। আমার প্ল্যান শোনো। এখুনি গিয়ে মেয়েটাকে বের করে আনব। তারপর গুহায় ফিরে নাস্তা সেরে নৌকায় করে তাকে নিয়ে যাব থানায়। পুলিশই তার বাবা-মাকে খুঁজে বের করবে।
টেরিকে কি করব? জানতে চাইল রবিন।
টেরিকে! একেবারে তিন গোয়েন্দার মনের কথাটা বলে ফেলল জিনা, ওকে রেখে যাব পাতালঘরে। মেয়েটার জায়গায়। ফিরে এসে তার জায়গায় ছেলেকে দেখে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে ধাড়ি বেঙগুলোর।
টেরির একটা ঠ্যাং-ঠুং ভেঙে দেব নাকি? পরামর্শ চাইল মুসা, য়াতে সারাজীবন খুঁড়িয়ে চলতে হয়…
না না, হাত নাড়ল কিশোর, ওসব ভাঙাভাঙির মধ্যে গিয়ে কাজ নেই। এমনিতেই যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে যাবে, দেখোই না খালি। এসো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
গুহায় ঢুকে টেরিকে বলল কিশোর, এই, এসো আমাদের সঙ্গে। রাফি, তুইও যাবি।
সন্দেহ ফুটল টেরির চোখে, কোথায়?
চমৎকার একটা জায়গায়, যেখানে এখানকার চেয়ে আরাম অনেক বেশি। মহাআনন্দে থাকতে পারবে। এসো।
সেখানে গরুগুলোও তোমাকে কামড়াতে পারবে না, হেসে বলল মুসা। নাও, ওঠো।
আমি যাব না।
রাফি, ওঠো তো, আদেশ দিল কিশোর।
গরগর করতে করতে এগিয়ে এল রাফি। নাক ঠেকাতে গেল টেরির পায়ে।
একলাফে উঠে দাঁড়াল সে।
দড়ি বেয়ে আগে আগে উঠে গেল মুসা ও জিনা। টেরিকে উঠতে বলল কিশোর। কিন্তু ভয়ে উঠতে চাইল না সে। আবার এগিয়ে এল রাফি। খাউ করে পায়ে কামড়ে দেয়ার ভঙ্গি করল। লাফিয়ে উঠে দড়ি ধরে ফেলল টেরি। অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে চলে গেল রাফির নাগালের বাইরে। তারপর চুপচাপ ঝুলে থেকে চেঁচাতে থাকল। বাধ্য হয়ে ওপর থেকে টেনে তাকে তুলে নিতে হলো মুসা ও জিনাকে।
রবিন আর কিশোরও উঠল।
জলদি করো, তাগাদা দিল কিশোর। ওরা ফিরে আসার আগেই কাজ সারতে হবে।
ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে প্রায় দৌড়ে এগোল ওরা। রাফি উঠে আসতে লাগল ঢাল বেয়ে। সবাই এসে দাঁড়াল দুর্গের চত্বরে।
ওদেরকে সিঁড়ির দিকে এগোতে দেখে ভয় পেয়ে গেল টেরি, আমি নিচে নামব না!