কিন্তু কিশোরের সন্দেহ হলো। টিপেটুপে দেখল। ভেতরে কিছু আছে বলে মনে হলো না। তবু আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্যে কেটে দেখল একটা পুতুল। অতি সাধারণ খেলনা। ভেতরে কিছুই নেই হীরা, মাদকদ্রব্য, কিংবা চোরাচালানি করে আনার মত কোন জিনিস, কিচ্ছু না।
অবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল গোয়েন্দারা।
আনমনে নিচের ঠোঁটে বার দুই চিমটি কাটল কিশোর। বিড়বিড় করে বলল, এই জিনিস এত কষ্ট করে ভাঙা জাহাজে এনে লুকানোর অর্থ কি?
১৩.
অনেক ভাবে জিজ্ঞেস করেও টেরির কাছ থেকে কোন তথ্য আদায় করা গেল না। আসলেই কিছু জানে না সে।
কিশোর জিজ্ঞেস করল, রাতে যে একটা জাহাজ এসে সঙ্কেত দেয়, এ ব্যাপারেও কিছু জানো না?
মাথা নাড়ল টেরি। সঙ্কেতের কথা কিছু জানি না। তবে মাকে বলতে শুনেছি, আজ রাতে যোগাযোগ করার কথা মারিয়ার।
মারিয়া!কি ওটা? জাহাজ, বোট, না কোন মানুষ?
জানি না। জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলাম, মাথায় গাট্টা মারল বাবা।
তারমানে গুরুত্ব আছে। গোপন ব্যাপার, তোমাকে জানাতে চায়নি। বেশ, আজ রাতে নজর রাখব আমরা।
সারাটা দিন গুহা থেকে বেরোল না ওরা, বেরোতে পারল না, টোডদের চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে।
বহুযুগ পরে যেন অবশেষে সন্ধ্যা হলো। রাত নামল। তাড়াতাড়ি খাওয়ার পাট চুকিয়ে নিল সবাই। ভাল খাবার পেয়ে এত খাওয়া খেলো টেরি, পেট ভারী করে ফেলল। তারপর আর বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারল না। বালিতেই শুয়ে নাক ডাকাতে শুরু করল, অনেকটা বাপের মত করে।
দু-জন দু-জন করে পালা করে পাহারা দেবে, চোখ রাখবে সাগরের ওপর, ঠিক করল কিশোর। প্রথম উঠে গেল সে আর জিনা। রাত সাড়ে বারোটায় নেমে এসে মুসা আর রবিনকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে জানাল, কিছু দেখেনি। ওদেরকে যেতে বলল।
টেরি গভীর ঘুমে অচেতন। তার কাছেই শুয়ে আছে রাফি। পাহারা দিচ্ছে।
ফোকরের বাইরে বেরোল দুই গোয়েন্দা।
চাঁদ উঠেছে। ঘোলাটে জ্যোৎস্না ছড়িয়ে দিয়েছে সাগরের ওপর। আকাশে প্রচুর হালকা মেঘ, ছুটছে দিগ্বিদিক, আপাতত বৃষ্টি হওয়ার কোন লক্ষণ নেই।
আধঘণ্টা মত গেছে, হঠাৎ কানে এল কথার শব্দ।
রবিনের কানে কানে বলল মুসা, টোডরা বেরিয়েছে। ভাঙা জাহাজে যাচ্ছে বোধহয়।
দাঁড়ের শব্দ শোনা গেল। খানিক পরেই নৌকাটাও নজরে এল দু জনের।
মুসার গায়ে কনুই দিয়ে গুঁতো মারল রবিন। নীরবে হাত তুলে দেখাল সাগরের দিকে।
বেশ অনেকটা দূরে দেখা যাচ্ছে আলো। আগের রাতের মতই জ্বলছে নিভছে। চাঁদের আলোয় বড় একটা বোটের অবয়বও দেখা যাচ্ছে, সঙ্কেত দেয়া হচ্ছে ওটা থেকেই।
মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল চাঁদ। অন্ধকার হয়ে গেল সাগর। আর কিছু চোখে পড়ছে না।
একটু পরেই মেঘ সরে গেল।
ওই যে, আরেকটা নৌকা, মুসা বলল। বোটের কাছ থেকে আসছে।
নিশ্চয় দেখা করবে একটা আরেকটার সঙ্গে। মাল পাচার করে এভাবেই।
ঠিক এই সময় নিতান্ত বেরসিকের মত আবার মেঘের আড়ালে চলে গেল চাঁদ। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না গোয়েন্দারা। দেখার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে। গলা বাড়িয়ে দিয়েছে বকের মত। কিন্তু আলো না থাকলে কিছু করেই লাভ নেই।
কোন জায়গায় মিলিত হলো নৌকাদুটো, দেখতে পেল না ওরা। আবার যখন চাঁদ বেরোল, তখন দেখল, বোটের কাছ থেকে আসা নৌকাটা চলে যাচ্ছে।
বসেই রইল ওরা।
প্রায় বিশ মিনিট পর টোডদের নৌকাটাকে তীরে ভিড়তে দেখল।
কোন পথে ওপরে উঠল ওরা, দেখতে পেল না গোয়েন্দারা। দেখল, যখন একেবারে দুর্গের কাছে চলে এসেছে।
টোডের হাতে বড় বান্ডিলের মত একটা জিনিস।
অনেক মাল এনেছে আজ, ফিসফিস করে বলল মুসা।
এই সময় দুজনকেই চমকে দিয়ে শোনা গেল একটা চিৎকার, অনেকটা আর্তচিৎকারের মত। ভয়ে, বিরক্তিতে, যন্ত্রণায় কেঁদে উঠেছে যেন কোন ছোট্ট মেয়ে।
.
গুহায় ফিরে জিনা আর কিশোরকে সব জানাল দুজনে।
বুঝতে পেরেছি, বলে উঠল কিশোর, আর কোন সন্দেহ নেই!
কি বুঝেছ? জিজ্ঞেস করল মুসা।
বাচ্চাদের কম্বল, পুতুল, এসব।
আবার গ্রীক!
খুব সহজ করেই বলেছি। স্মাগলিং নয়, কিডন্যাপি।
তুমি বলতে চাইছ, রবিনের কণ্ঠে উত্তেজনা, কোন বাচ্চা মেয়েকে কিডন্যাপ করে এনেছে টোডরা?
কিডন্যাপটা সম্ভবত জাহাজের লোকগুলো করেছে। মারিয়া ওটার নামও হতে পারে, মেয়েটার নামও হতে পারে। এনে তুলে দিয়েছে টোডদের হাতে। লুকিয়ে রাখার জন্যে। মেয়েটা যাতে শান্ত থাকে, সে জন্যে আগেই তার পুতুলগুলো এনে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। কাপড়-চোপড়ও দরকার, সে জন্যে ওগুলো এনেছে।
খাইছে। তার মানে টোডের হাতের বান্ডিলটা মানুষ!
হ্যাঁ। আমার অনুমান ঠিক হলে, ছোট্ট মেয়েটা। তাকে বের করে আনতে হবে আমাদের।
অনেক ঘুমিয়ে ঘুম পাতলা হয়ে গেছে টেরির। কথাবার্তায় জেগে গেল। কিশোরের শেষ কথাটা কানে গেছে। জিজ্ঞেস করল, কাকে বের করে আনবে?
সেটা তোমার জানার দরকার নেই।
ধাড়ি বেঙগুলো নিশ্চয় পাহারায় থাকবে, মুসা বলল। আনব কি করে?
একটা উপায় বেরিয়ে যাবেই।
রাত এখনও অনেক বাকি। আর কিছু করার নেই। রাফির ওপর টেরিকে পাহারা দেয়ার ভার দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা ও জিনা। কয়েক মিনিট জেগে জেগে মা-বাবার কথা ভাবল টেরি। ভীষণ কান্না পেতে লাগল তার। শেষে কাঁদতেই শুরু করল, নীরবে। রাফির ভয়ে জোরে কাঁদার সাহস পেল না।