ইতিমধ্যে আরেকটা কাজ করে এসেছে রবিন। পাহাড়ে চড়ায় ওস্তাদ সে। তাই তাকেই পাঠিয়েছিল কিশোর, টোডরা কিসে করে এসেছে দেখে আসার জন্যে। এ পাহাড় সে পাহাড় করে ঘুরে ঘুরে একটা পাহাড়ের গোড়ায়। যেই নেমেছে, অমনি একটা পাথরের আড়ালে দেখতে পেয়েছে ছোট নৌকাটা।
প্রণালী দিয়ে ঢোকেনি টোডরা, সেজন্যেই জিনার নৌকাটা দেখতে পায়নি। তবে ওস্তাদ নাবিক বলতে হবে টোডকে। দ্বীপের যেখানে এনে নৌকা ভিড়িয়েছে, সেখানে আনাটা সত্যি কঠিন। ভাঙা জাহাজটার কাছাকাছিই, কিশোর যেখানে সন্দেহ করেছিল।
বিকেল পেরিয়ে গেল। আরেকটু পরেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই ছায়া নামতে শুরু করেছে পাহাড়ের গোড়ায়।
কিশোর বলল, মনে হচ্ছে রাতটা এখানেই কাঁটাবে ওরা।
বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে কোন লাভ হলো না, তিক্তকণ্ঠে বলল মুসা। যাদের যন্ত্রণায় পালালাম, তারাই এসে হাজির। ধুর!
গুহার ভেতরে অন্ধকার হয়ে এসেছে। মোম জালল রবিন। বলল, চলো, ভয় দেখাই ব্যাটাদের।
মানে? ভুরু কুঁচকে তাকাল মুসা।
আছে তো পাতালঘরে। তোমার মত ওদেরও ভূতের ভয় থাকতে পারে।
রবিনের পরিকল্পনা কিছুটা আন্দাজ করে ফেলেছে কিশোর। মুচকি হাসল।
মুসা বুঝল না। খুলেই বলো না ছাই!
রবিন বলল, বুঝলে না? দুর্গের নিচে কিছু কিছু জায়গায় প্রতিধ্বনি খুব বেশি হয়, ভুলে গেছ? পাতালঘরের কাছে গিয়ে চেঁচামেচি শুরু করব আমরা। ভূতের ভয় দেখাব ওদের।
চটাস করে নিজের উরুতেই চাটি মারল মুসা, দারুণ আইডিয়া! এক্ষুণি চলো! ব্যাটাদের কলজে শুকিয়ে না দিয়েছি তো আমার নাম মুসা আমান নয়!
এখন না, মুচকি হাসল কিশোর, আরেকটু রাত হোক।
জিনা বলল, রাফিকে কি করব? ও তো গিয়েই ঘেউ ঘেউ শুরু করবে। ভূত যে নয়, বুঝে ফেলবে টোড। ভাববে, বুনো কুকুরটাই, মারতে বেরোবে।
ওকে সিঁড়ির মুখে পাহারায় রেখে যাব। স্মাগলারদের কেউ এলে সতর্ক করতে পারবে আমাদের।
আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক পর রওনা হলো ওরা। চলে এল দুর্গের চতুরে। টোডদের ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। আগুন নেই, আলো নেই। পাতালঘরে নামার সিঁড়ির মুখের পাথরগুলো সরানো, তাতে বোঝা গেল নিচেই রয়েছে ওরা।
রাফি, একদম চুপ করে থাকবি, কড়া নির্দেশ দিল জিনা। কেউ এলে আমাদের হুঁশিয়ার করবি। মানুষ না দেখলে চেঁচাৰি না, খবরদার!
ও কি আর বুঝবে নাকি কিছু? কিশোর বলল, খরগোশ দেখলেও চেঁচানো শুরু করবে। একজনকে এখানে থাকা দরকার।
কে থাকবে? ভয় পেয়ে টোডরা কি করে, মজা দেখার লোভ সবারই। শেষে জিনা নিজেই বলল, তোমরাই যাও। আমি থাকি। রাফিকে একা একা ছেড়ে রাখতে ভরসা পাচ্ছি না আমি।
সিঁড়ি বেয়ে পাতালঘরে নেমে এল তিন গোয়েন্দা। নিচে অনেক ঘর, কোনওটা সেলার, কোনওটা ডানজন। বদ্ধ বাতাসে একধরনের ভাপসা গন্ধ।
বড় একটা ঘরে ঢুকল ওরা। টর্চের আলোয় দেয়ালে গাথা লোহার সারি সারি আঙটা দেখা গেল। একসময় এটা বোধহয় জেলখানা ছিল, কিংবা টর্চার চেম্বার। দুর্ভাগা বন্দিদের ধরে এনে এখানে বন্দি করে রাখা হত, লোহার আঙটায় শেকল দিয়ে বেধে অমানুষিক অত্যাচার চালানো হত তাদের ওপর। মধ্যযুগীয় এসব বর্বতার ইতিহাস অনেক পড়েছে রবিন। মুসারও জানা আছে কিছু কিছু। তার মনে হতে লাগল, ভয়াবহ যন্ত্রণা পেয়ে মারা যাওয়া সে সব মানুষের প্রেতাত্মারা এখনও ঘুরে বেড়ায় পাতালের এসব ঘরে ঘরে, করিডরে। গায়ে কাঁটা দিল তার।
সঙ্গে টর্চ আছে। কিন্তু পারতপক্ষে সেটা জ্বালছে না কিশোর। প্যাসেজ ধরে যাওয়ার সময় দেয়ালে চক দিয়ে একে চিহ্ন দিয়ে রাখল, যাতে ফেরার। সময় অসুবিধে না হয়।
হঠাৎ কথার শব্দ কানে এল। আরেকটু আগে বাড়তেই একটা ফোকর। দিয়ে আলো চোখে পড়ল। সেই ঘরটায় আস্তানা গেড়েছে টোডরা, যেখানে সোনার বারগুলো খুঁজে পেয়েছিল তিন গোয়েন্দা।
ফিসফিসিয়ে মুসা বলল, আমি গরু।
মানে! চমকে গেল রবিন। ভাবল, ভূতের ভয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সহকারী গোয়েন্দার।
আমি গরুর ডাক ডাকব।
ও, তাই বলো। আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। বেশ, আমি তাহলে ছাগল। কিশোর, তুমি? গাধা?
জন্তু-জানোয়ারের ডাক আমি ভাল পারি না। তবু দেখি, পারি কিনা।
একটা পাথরের থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে গরুর ডাক ডেকে উঠল মুসা। শব্দ শুনে সে নিজেই চমকে গেল। বিকট শব্দ হয়েছে বদ্ধ জায়গায়, সেই সঙ্গে প্রতিধ্বনি; মূল শব্দটাকে ভয়াবহ করে তুলেছে।
ফোকর দিয়ে তাকিয়ে আছে রবিন ও কিশোর। টোডদের প্রতিক্রিয়া দেখছে।
ভীষণ চমকে গিয়ে প্রায় ককিয়ে উঠল টেরি, মা, কিসের শব্দ!
তার কুকুরটা তার চেয়েও ভীতু। গিয়ে লুকাল ঘরের কোণে।
গরু, বলেই টোড নিজেও থমকে গেল। এখানে গরু আসবে কোত্থেকে।
মুসা সরে এল থামের আড়াল থেকে। সেখানে চলে গেল রবিন। মা-মা। করে উঠল ছাগলের মত। থামল না, ডেকেই চলল।
আরিসব্বোনাশ! চোখ বড় বড় করে ফেলল মিসেস টোড। এসব এল কোত্থেকে।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল টোড। কাগজের মত সাদা হয়ে গেছে মুখ।
কয়েকবার ডেকে চুপ হয়ে গেল রবিন।
কিশোরের গায়ে গুঁতো দিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত করল মুসা। নীরব হাসিতে ফেটে পড়ছে।
কিশোর ব্যাঁ-ব্যাঁ করে যে ডাকটা ডাকল, সেটা গাধায় শুনলেও চমকে যেত, এতটাই বিকৃত আর ভয়ঙ্কর, পিলে চমকে দেয়ার মত; এবং সত্যি সত্যি চমকেও দিল টোড পরিবারের।