তার চেয়ে খারাপ। আমাকে দেখলেই ভেঙচি কাটে, আজেবাজে ছড়া বলে খেপায়।
মারছে রে! শুঁটকি থেকে শেষে বেঙাচি টেরির পাল্লায় এসে পড়লাম…
মুসার কথা শেষ হতে না হতেই সুর করে বলে উঠল ছেলেটা:
জিনা, ঘিনা; জিনার মুখে ছাই,
দাঁড়কাকে ঠুকরে দিলে আর রক্ষা নাই!
রাগে লাল হয়ে গেল জিনার মুখ। তিন গোয়েন্দা মনে করল, ছুটে গিয়ে ঠাস করে এখন ছেলেটার গালে চড় কষাবে সে। কিন্তু ওদেরকে অবাক করে দিয়ে কিছুই করল না। বরং রাফির কলার ধরে আটকাল, ছেলেটার কাছে। যেতে দিল না। করুণ কণ্ঠে বলল, আমাকে দেখলেই এই ছড়া বলে! আর সহ্য হয় না।
মুসা ধমক দিয়ে বলল, এই ছেলে, খেপাও কেন?
টকটকে লাল মুখ ছেলেটার। মুসার কথায় মুখ বাঁকিয়ে হাসল। আবার শুরু করল, জিনা, ঘিনা…
দেখো, ভাল হবে না কিন্তু! এগিয়ে গেল মুসা।
কিন্তু মুসা তার কাছে পৌঁছার আগেই একছুটে রান্নাঘরে ঢুকে গেল ছেলেটা।
জিনার দিকে ফিরে বলল বিস্মিত মুসা, জিনা, ওর অত্যাচার সহ্য করো! এখনও কিছু করোনি!
চড়িয়ে সবগুলো দাঁতই তো ফেলে দিতে ইচ্ছে করে, নিতান্ত অসহায় ভঙ্গিতে হাত ডলল জিনা, কিন্তু উপায় নেই। আম্মার শরীর খারাপ। টেরিকে কিছু করলে ওর মা যদি কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যায়, ভীষণ বিপদে পড়ে যাবে আম্মা। সেজন্যেই কিছু করতে পারি না।
জিনা, সত্যি অবাক করলে, কিশোর বলল। তোমার যে এতটা সহ্যশক্তি, জানতাম না।
আম্মা নিশ্চয় উঠে পড়েছে এতক্ষণে। বিছানায় নাস্তা দিয়ে আসতে হবে। তোমরা দাঁড়াও এখানে, আমি আসছি। রাফিকে আটকে রাখো, টেরিকে দেখলেই কামড়াতে যাবে।
জিনা ঘরে ঢুকে যেতেই অস্থির হয়ে উঠল রাফি। নাক তুলে কি যেন শুঁকছে।
রান্নাঘরের দরজায় বেরিয়ে এল একটা ছোট কুকুর। সাদা রঙ, ময়লা, যেন বহুদিন ধোঁয়া হয়নি। মাঝে মাঝে বাদামী ছোপ। দেখতে একটুও ভাল না। রাফিকে দেখেই দু-পায়ের ফাঁকে লেজ গুটিয়ে ফেলল।
ওটাকে দেখেই গলা ফাটিয়ে ঘাউ ঘাউ করে উঠল রাফি। কিশোরের হাত থেকে হ্যাঁচকা টানে কলার ছুটিয়ে নিয়ে দিল দৌড়।
রাফি, রাফি, আয় বলছি! চিৎকার করতে করতে তার পেছনে ছুটল কিশোর।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। কুকুরটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রাফি। ভয়েই আধমরা হয়ে গেছে কুকুরটা। চার পা শূন্যে তুলে দিয়ে কেউ কেউ করছে। তার কান কামড়ে দেয়ার চেষ্টা করতে লাগল রাফি।
কুকুরটার চিৎকারে রান্নাঘরের দরজায় বেরিয়ে এল মিসেস টোড। হাতে একটা সসপ্যান।
হেই কুত্তা, হেই! বলে লাফ দিয়ে নামল নিচে। সসপ্যান দিয়ে বাড়ি মারল রাফিকে।
ঝট করে সরে গেল রাফি। বাড়িটা তার গায়ে না লেগে লাগল অন্য কুকুরটার গায়ে। আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল ওটা।
টেরিও বেরিয়ে এল। একটা পাথর তুলে নিয়ে রাফিকে ছুঁড়ে মারার সুযোগ খুঁজতে লাগল।
চেঁচিয়ে উঠল মুসা, খবরদার! মেরে দেখো খালি! শয়তান ছেলে কোথাকার!
ভীষণ চেঁচামেচি শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন পারকার আংকেল। ধমক দিলেন, অ্যাই, কি হচ্ছে! হচ্ছে কি এসব!
দমকা বাতাসের মত যেন ঘর থেকে উড়ে বেরোল জিনা। ছুটে গেল রাফির দিকে।
আবার কুকুরটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে রাফি। কান না ছিঁড়ে আর ছাড়বে না।
অ্যাই, সরাও, সরাও কুত্তাটাকে! ধমকে উঠলেন মিস্টার পারকার।
কাছেই একটা কল আছে। পাইপ লাগানো। বাগানে পানি দেয়া হয়। ছুটে গিয়ে পাইপটা তুলে নিয়ে কুকুর দুটোর ওপর পানি ছিটাতে শুরু করল রবিন। হঠাৎ এভাবে গায়ে পানি পড়ায় চমকে গিয়ে লাফিয়ে সরে দাঁড়াল রাফি। এই সুযোগে উঠে সোজা রান্নাঘরের দিকে দৌড় দিল অন্য কুকুরটা।
ইচ্ছে করেই পাইপের মুখ সামান্য সরিয়ে টেরিকেও ভিজিয়ে দিল রবিন। ছেলেটাও চেঁচিয়ে উঠে দৌড় দিল তার কুকুরের পেছনে।
কড়া চোখে রবিনের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে ধমক লাগালেন আংকেল, ওকে ভেজালে কেন?…জিনা, তোকে না কতবার বলেছি। কুত্তাটাকে বেঁধে রাখতে!…মিসেস টোড, তুমিও বাপু কথা শোনে না। রান্নাঘর থেকে বেরোতে দাও কেন কুত্তাটাকে? বেঁধে রাখলেই হয়। সবাইকে শাসিয়ে বললেন, আর যেন এমন না হয়।
চুপ করে আছে সবাই।
মিসেস টোডের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, নাস্তা হয়েছে? বেলা তো দুপুর হয়ে গেল। রোজই এক অবস্থা!
গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে চলে গেল মিসেস টোড।
পারকারও ঘরে চলে গেলেন।
রাফির গলায় শেকল বাঁধতে বাঁধতে খেঁকিয়ে উঠল জিনা, কতবার মানা করেছি ওটার সঙ্গে লাগতে যাবি না। তা-ও যাস। আটকে থেকে এখন মজা বোঝ…বাবাকে রাগিয়েছিস, সারাটা দিনই আজ রেগে থাকবে। বুড়িটাকেও খেপিয়েছিস। চায়ের জন্যে কেক-টেক কিছু বানাবে না আর।
বেচারা রাফি। খুব লজ্জা পেয়েছে। মাথা নিচু করে, লেজ গুটিয়ে মৃদু কুঁই কুঁই করল। থুক করে কয়েকটা লোম ফেলল দাঁতের আগা থেকে। কুকুরটার কান ছিঁড়তে পারেনি, তবে কানের ডগার লোম ছিঁড়তে পেরেছে। আপাতত তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।
পুরো ঘটনাটার জন্যেই নিজেকে দায়ী মনে করছে কিশোর। বলল, কি করে যে ছুটে গেল…আসলে অনেক জোর ওর, ধরে রাখতে পারলাম না…
ওর গায়ে বাঘের জোর, খুশি হয়ে বলল জিনা। বেঙাচির কুকুরটাকে দুই কামড়ে খেয়ে ফেলতে পারে ও।
নাস্তা দেয়া হলো। কেরিআন্টি নেই টেবিলে। তার বদলে রয়েছেন পারকার আংকেল, যেটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার ছেলেমেয়েদের জন্যে। এমনিতেই তাঁর সঙ্গে খেতে বসতে চায় না কেউ, আজ তো মেজাজ আরও সপ্তমে চড়ে রয়েছে। কি যে করে বসবেন ঠিক নেই। শুরুতেই কয়েকটা বকা দিলেন। জিনাকে। কড়া নজর বুলিয়ে আনলেন সবার ওপর একবার। কুঁকড়ে গেল রবিন। এখানে বেড়াতে এসেছে বলে এবার আফসোসই হতে লাগল তার।