সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সবাই ক্লান্ত। গুহা থেকে এখন আর বেরোতে ইচ্ছে করল না কারও।
মোম জ্বালল রবিন। গুহার দেয়ালে ছায়ার নাচন। কেমন রহস্যময় হয়ে উঠল গুহার পরিবেশ।
আরও কিছুক্ষণ জেগে রইল ওরা। কম্বলের বিছানায় শুয়ে শুয়ে গল্পগুজব করল। ঘুমে কখন জড়িয়ে এল চোখ, বলতে পারবে না।
গলে গলে শেষ হলো মোম, নিভে গেল আলো; কেউ দেখল না সেটা একমাত্র রাফি ছাড়া…।
.
১০.
পরের দিনটাও যেন ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। হেসেখেলে, সাঁতার কেটে, আর দ্বীপে ঘুরে বেড়িয়ে কাটিয়ে দিল ওরা। সঙ্গে খাবার নিয়ে বেরিয়েছিল, ফলে আর একবারও গুহায় ঢোকার প্রয়োজন বোধ করেনি। ঢুকল একেবারে সন্ধ্যাবেলায়। মোম জ্বেলে খাওয়া সারল।
দেয়ালে ছায়া নাচছে। সেদিকে তাকিয়ে গায়ে কাঁটা দিল মুসার। বলল, আগুন জ্বলতে পারলে ভাল হত। আলো আরও বেশি পেতাম…
হেসে ফেলল রবিন, ভুতের ভয় পাচ্ছ তো? আগুনে আলো বেশি পাবে বটে, কিন্তু গরম হয়ে যাবে গুহার ভেতর। ধোঁয়ায় যাবে দম আটকে। বেরোনোর তো পথ নেই।
আছে, ওপর দিকে আঙুল তুলল মুসা। ফোকরটা চিমনির কাজ করবে।
তা করবে, কিশোর বলল, কিন্তু বাইরে থেকে ধোঁয়া দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। স্মাগলারদের চোখে পড়ে যেতে পারে। ভুলে যাচ্ছ কেন, আমরা এখানে লুকিয়ে আছি। এমন কিছু করা চলবে না, যাতে ওদের চোখে পড়ে যাই।
আগুন জ্বালানো আর হলো না। আগের দিনের মতই গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল ওরা। জেগে রইল কেবল রাফি। কান খাড়া।
হঠাৎ গরগর করে উঠল।
ঘুম ভেঙে গেল পাশে শোয়া জিনার। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, রাফি, কি হয়েছে?
রবিনও জেগে গেছে। মুসা আর কিশোর অনেকটা দূরে, তাই রাফির চাপা গরগর ওদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি।
নিচু স্বরে রবিন বলল, মনে হয় স্মাগলাররা এসেছে!
চলো, দেখি!
চলো।
দড়িটা বাঁধাই আছে, ঝুলে আছে ফোকর থেকে। সেটা বেয়ে প্রথমে উঠে এল রবিন। সাবধানে মাথা বের করল ফোকরের বাইরে। শরীরটা বের করার আগে উঁকি দিয়ে দেখে নিল কিছু আছে কিনা।
রাফিকে চুপ থাকার নির্দেশ দিয়ে তার পেছনে উঠল জিনা।
সাগরের দিকে তাকাল ওরা। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার রাত। চাঁদ ওঠেনি এখনও। কোন জাহাজ চোখে পড়ল না। এমন কি ভাঙা জাহাজটাও না।
চাঁদ থাকলে ভাল হত, রবিন বলল।
নেই যখন, কি আর করা।
হঠাৎ রবিনের চোখে পড়ল আলোটা। দেখেছ!
হ্যাঁ। উত্তেজিত হয়ে বলল জিনা, ভাঙা জাহাজটার কাছ থেকে আসছে! কেউ উঠেছে ওটাতে! হ্যারিকেনের আলো!
স্মাগলারই! আরও মাল এনে লুকাচ্ছে।
কিংবা ট্রাংকটা নিতে এসেছে।…দেখো, নড়ছে আলোটা। নৌকা নিয়ে এসেছে ওরা। জাহাজের গায়ে বেঁধে রেখে উঠেছে।
যতটা সম্ভব কান খাড়া করে রেখেছে দু-জনে, শব্দ শোনার আশায়। কিছুই শুনল না। জাহাজটা অনেক দূরে।
কয়েক মিনিট পর নিভে গেল আলো।
দাঁড়ের শব্দ শোনার অপেক্ষায় রইল ওরা। কিন্তু ঢেউয়ের একটানা শব্দের জন্যে আর কিছুই কানে ঢুকল না।
আরও মিনিট পনেরো অপেক্ষা করে নেমে চলে এল ওরা। কিশোর আর মুসা ঘুমিয়েই আছে। খবরটা ওরা জানল পরদিন সকালে।
আমাদের ডাকলে না কেন? অনুযোগের সুরে বলল মুসা।
তেমন কিছু তো আর দেখিনি, জিনা বলল, শুধু হ্যারিকেনের আলো। এটা দেখানোর জন্যে আর কি ডাকব। ভাবলাম, ঘুমিয়ে আছ, থাকো।
তারমানেই মানুষ, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। খেয়ে নাও। দেখতে যাব।
ভাটার সময় জাহাজটা দেখতে চলল ওরা। আগের বারের মতই পিচ্ছিল পাথর টপকে টপকে এসে দাঁড়াল জাহাজের ধারে। দড়ির সাহায্যে ডেকে উঠল।
লকারের দরজাটা বাতাসে আপনাআপনি খুলে যায় বলে ফাঁকে একটা কাঠের গোজ ঢুকিয়ে দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে।
গোঁজটা খুলে নিল কিশোর। দরজা খুলতে অসুবিধে হলো না।
পিচ্ছিল ডেকের ওপর সাবধানে পা ফেলে এগোতে এগোতে জিজ্ঞেস করল জিনা, ট্রাংকটা আছে?
আছে। অবাক কাণ্ড! আরও কি সব রেখে গেছে, দেখো! খাবারের টিন, কাপ, প্লেট, মোমবাতি, হ্যারিকেন, কম্বল, আমাদের মতই যেন দ্বীপে বাস করতে এসেছে কেউ! বার দুই ঘন ঘন নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। নিশ্চয় কেউ থাকতে এসেছে। চোরাই মাল আসার অপেক্ষায় থাকবে বোধহয়। দিন-রাত নজর রাখতে হবে আমাদের।
উত্তেজিত হয়ে জাহাজ থেকে নেমে এল ওরা। লুকিয়ে থেকে বাস করার চমৎকার একটা জায়গা পেয়ে গেছে বলে খুশি। এখানে থাকলে ওরা কারও চোখে পড়বে না, কিন্তু কেউ এলে ওদের চোখে ঠিকই পড়বে।
নৌকাটা লুকিয়ে ফেলতে হবে! হঠাৎ বলে উঠল জিনা। ও পথে ঢোকার সম্ভাবনাই বেশি। জাহাজটার এদিক দিয়ে ঢোকা ডেঞ্জারাস। বোকা না হলে এদিক দিয়ে দ্বীপে ওঠার কথা ভাববে না কেউ।
ভাববে, দক্ষ নাবিক হলে, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। সামান্য একটু সরে গেলেই নৌকা ভেড়াতে পারবে।
কিন্তু ঝুঁকি নেয়ার দরকার কি? মুসা বলল, নৌকাটা লুকিয়ে ফেলাই ভাল। চলো, এক্ষুণি।
কিন্তু লুকাব কোথায়? রবিনের প্রশ্ন, এতবড় একটা নৌকা?
জানি না, চিন্তায় পড়ে গেছে কিশোর। চলো আগে, যাই।–এখানে বসে কিছু বোঝা যাবে না।
দল বেধে সৈকতে চলে এল ওরা। সাগর থেকে এসে প্রণালীটা যেখানে খাঁড়িতে ঢুকেছে, তার একধারে পাহাড়ের গায়ে একটা ছোট গুহা আছে। সব সময় পানি থাকে। সেটা দেখিয়ে জিনা বলল, এর মধ্যে লুকানো যেতে পারে। ভেতরে অনেক বড় একটা পাথরের চাঙড় আছে। তার ওপাশে রাখলে সহজে চোখে পড়বে না। তবে ঝড় এলে, পানি ফেপে উঠলে আছাড় মেরে চুরমার করে দিতে পারে নৌকাটা।