এবারও নিরাপদেই কিনারে ফিরে এল সবাই। পিছলে পড়ে কোন দুর্ঘটনা ঘটাল না।
এতক্ষণ একা বসে থেকে অস্থির হয়ে পড়েছিল বেচারা রাফি। আনন্দে হাত চেটে দিতে লাগল সবার।
কিশোর বলল, জাহাজে তো জায়গা হলো না, রাতে থাকি কোথায় বলো তো? জিনা, তোমার কোন জায়গা জানা আছে? গুহাটুহা হলে ভাল হত,..,
আছে! তুড়ি বাজাল জিনা। উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চেহারা। এসো আমার সঙ্গে।
.
একটা পাহাড়ের কাছে ওদেরকে নিয়ে এল জিনা। ঢালে ঝোপঝাড় যেমন ঘন, পাথরেরও ছড়াছড়ি। হাত তুলে দেখাল, ওই যে।
কিছুই দেখতে পেল না তিন গোয়েন্দা।
রবিন জিজ্ঞেস করল, কই?
ওই তো। চলো, আরও কাছে, তাহলেই দেখবে।
ঝোপঝাড় আর লতায় প্রায় ঢাকা পড়ে আছে গুহামুখটা। এখানে আছে ওটা জানা না থাকলে চোখেই পড়ে না।
আগে আগে ঢুকল জিনা। পেছনে অন্যেরা।
খাইছে! ঢুকেই বলে উঠল মুসা, দারুণ তো!
গুহার ভেতরটা আসলেও সুন্দর। সাদা পাউডারের মত মিহি, শুকনো বালিতে ঢাকা মেঝে। সমুদ্র সমতল থেকে অনেক ওপরে, সাংঘাতিক জলোচ্ছাসের সময়ও এখানে পানি ঢোকে কিনা সন্দেহ। একধারের দেয়ালে একটা তাকমত রয়েছে।
বাহ, খুশি হয়ে বলল রবিন, এক্কেবারে যেন আমাদের জন্যে বানিয়ে রাখা হয়েছে। জিনিসপত্র রাখতে পারব ওটাতে। কিশোর, ওই দেখো, স্কাইলাইটও আছে।
গুহাটা অনেক বড়। ছাতের একধারে একটা ফোকর। আলো আসছে সে পথে। ফোকর দিয়ে বৃষ্টির পানি গুহায় ঢোকে, তবে সরাসরি মেঝেতে না পরে দেয়াল বেয়ে গড়িয়ে চলে যায় একটা গর্তের দিকে। দীর্ঘদিন পানি পড়ে পড়েই বোধহয় তৈরি হয়েছে গর্তটা। নিশ্চয় নালাও আছে পাহাড়ের ভেতরে।
কিশোর বলল, নৌকা থেকে আমাদের জিনিসগুলো এনে দড়িতে বেধে ওখান দিয়ে নামিয়ে দেয়াটা সহজ হবে, বার বার পাহাড়ের খাড়া দেয়াল। বাইতে হবে না আর। যে দিক দিয়ে ঢুকেছে সে পথটা দেখিয়ে বলল, সৈকত থেকে এ পথ দিয়ে আসা কঠিন।
গুহা থেকে বেরিয়ে প্রায় খাড়া দেয়াল বেয়ে পাহাড়ে চড়তে শুরু করল। ওরা। প্রথম কাজ, বাইরে থেকে স্কাইলাইটের ফোকরটা খুঁজে বের করা।
ঢাল বেয়ে উঠতে সবচেয়ে অসুবিধে হলো রাফির। মানুষের মত হাত নেই তার, ঝোপ কিংবা লতা ধরে যে পতন ঠেকাবে, সে উপায়ও নেই। হড়হড় করে পিছলে পড়ে যেতে চায়। হাস্যকর ভঙ্গিতে শরীরটাকে বাকিয়ে নখ দিয়ে মাটি খামচে ধরে উঠতে লাগল সে।
ওপরে উঠে এল ওরা। ফোকরটা কোনখানে, মোটামুটি আন্দাজ থাকায় খুঁজে বের করা কঠিন হলো না। জানা না থাকলে গুহামুখের মতই এটাও সহজে দেখতে পেত না। এক ধরনের কাঁটাঝোপে ঢেকে রেখেছে।
কাঁটাডাল সরিয়ে নিচে উঁকি দিল কিশোর। ফোকরটা একটা সুড়ঙ্গমুখ। মাত্র কয়েক ফুট লম্বা সুড়ঙ্গ, ওপর থেকে মোটা একটা পাইপের মত নেমে গেছে ঢালু হয়ে। গুহার ছাতে গিয়ে শেষ হয়েছে। দেখেটেখে মাথা দুলিয়ে বলল, হুঁ, বেশি নিচে না। কিন্তু বিপজ্জনক। না দেখে এই গর্তে পা দিলে নিচে পড়ে হাত-পা ভাঙতে পারে।
সবাই মিলে গর্তের মুখের কাছের ঝোপ আর লতা পরিষ্কার করে ফেলল। কাঁটার আঁচড় লাগল হাতে।
নিচের দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, দড়ি ছাড়াও কিন্তু লাফিয়ে নামা যায়।
দরকারটা কি ঝুঁকি নেয়ার, কিশোর বলল। চলো, মালগুলো নিয়ে আসি।
সৈকতে চলে এল ওরা। যে যতটা পারল, জিনিসপত্র হাতে তুলে নিল। নিয়ে এল ফোকরের কাছে। সেগুলো রেখে আরও মাল আনতে ফিরে গেল। এভাবে কয়েকবারে সমস্ত মাল এনে জমা করল একজায়গায়। এইবার নিচে নামানোর পালা।
লম্বা একটা দড়িতে এক ফুট পর পর গিট দিল কিশোর। দড়ির একমাথা বাধল একটা বড় ঝোপের গোড়ায়। গাছটার শেকড় অনেক গভীরে, ভার রাখতে পারবে। দড়ি বেয়ে নেমে যেতে বলল জিনা আর রবিনকে। ওপর থেকে সে আর মুসা দড়িতে মাল বেধে নামিয়ে দেবে, নিচে থেকে ওরা দু জনে খুলে নেবে। তারপর আবার মাল পাঠানো হবে।
নেমে গেল রবিন ও জিনা। দড়িতে গিট থাকায় সুবিধে হলো, হাত পিছলে গেল না।
মাল নামানোটা আরও সহজ কাজ।
সমস্যা হলো রাফিকে নিয়ে।
মুসা জিজ্ঞেস করল, ওকে নামাব কি ভাবে?
বেঁধে নামাতে হবে, আর তো কোন উপায় দেখি না।
তবে সমস্যার সমাধান রাফি নিজেই করে দিল। হঠাৎ ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল একটা খরগোশ। কুকুরটাকে দেখে ভয় পেয়ে বিরাট লাফ দিয়ে ফোকর পেরিয়ে চলে গেল অন্যপাশে।
তাড়া করল রাফি। উত্তেজিত না হলে, সাবধান থাকলে সে-ও ফোকরটা পেরিয়ে যেতে পারত, কিন্তু তাড়াহুড়োয় কোন কিছু খেয়াল না করে লাফ দিয়ে বসল, পড়ল একেবারে ফোকরে। নিমেষে ঢালু সুড়ঙ্গ গলে পিছলে নেমে গেল নিচে। ধপ করে পড়ল মেঝেতে।
ওপর থেকে জিনার তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনতে পেল মুসা আর কিশোর।
রাফির কিছু হয়েছে কিনা দেখার জন্যে তাড়াতাড়ি দড়ি বেয়ে নেমে গেল মুসা।
তার পেছনেই নামল কিশোর।
রাফির কিছু হয়নি দেখে হাঁপ ছাড়ল। মিহি নরম বালি বাঁচিয়ে দিয়েছে কুকুরটাকে। হাড়টাড় ভাঙেনি।
প্রচুর পরিশ্রম করেছে। খিদে পেয়েছে সবারই। খাবারের টিন খুলে খেতে বসে গেল ওরা।
পেট কিছুটা শান্ত হয়ে এলে কিশোর বলল, কাজ কিন্তু আরও আছে। বিছানার জন্যে লতাপাতা জোগাড় করে আনতে হবে।
মুসা বলল, কি দরকার কষ্ট করার। যা মিহি আর নরম বালি, এর ওপরই কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ব।