কিশোরের সন্দেহই যে ঠিক, তার আরও প্রমাণ মিলল। একজায়গায় পাওয়া গেল আগুন জ্বালানোর চিহ্ন। রান্না করে খেয়েছে কেউ। একটা সিগারেটের গোড়াও পড়ে আছে। দিন কয়েকের মধ্যে যে কেউ দ্বীপে উঠেছিল, তাতে আর সন্দেহ রইল না কারও।
তবে ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাল না তিন গোয়েন্দা। নির্জন দ্বীপ, যে কেউ উঠতে পারে এখানে, পিকনিক করার জন্যেও আসতে পারে। জিনা তো আর পাহারা দিয়ে রাখে না।
কিন্তু জিনা এত সহজে মেনে নিতে পারল না, ফুসতে লাগল, তাকে না বলে তার দ্বীপে লোকটা উঠেছিল বলে।
ভাটার সময় এখন। পানি নেমে যাওয়ায় মাথা উঁচু করে রয়েছে অসংখ্য পাথর। একটা থেকে আরেকটায় লাফিয়ে লাফিয়ে জাহাজটার কাছে পৌঁছানো যাবে।
তবে কাজটা মোটেও সহজ নয়। ক্রমাগত ভিজে ভিজে, শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে পাথরগুলো। পা পিছালানোর সম্ভাবনা প্রচুর।
খুব সাবধানে এগোল ওরা। নিরাপদেই এসে পৌঁছল জাহাজের পাশে। দূর থেকে যতটা মনে হয়, কাছে এলে তার চেয়ে অনেক বেশি বড় লাগে ওটা। আগের বার যেমন দেখেছিল, প্রায় তেমনি আছে, খুব একটা বদলায়নি। নিচের দিকটা পানিতে তলিয়ে আছে। শ্যাওলায় ঢাকা। কাঠ আঁকড়ে রয়েছে নানা রকম শামুক-গুগলি। কেমন একটা আঁশটে গন্ধ বেরোচ্ছে জাহাজের গা থেকে। ( সঙ্গে করে দড়ি নিয়ে আসা হয়েছে। বার তিনেক চেষ্টা করে জাহাজের ভাঙা মাস্তুলের গোড়ায় দড়ির ফাঁস আটকে ফেলল মুসা। দড়ি বেয়ে উঠে গেল ওপরে।
একে একে উঠে এল অন্য তিনজন। রাফিকে কিনারে রেখে আসা হয়েছে। চুপচাপ থাকতে নির্দেশ দিয়েছে তাকে জিনা। এদিকেই তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে সে, আসতে পারেনি বলে মন খারাপ।
আগের চেয়ে করুণ অবস্থা জাহাজটার। ফোকরের সংখ্যা বেড়েছে। গন্ধও যেন আগের চেয়ে অনেক বেশি। হাত নেড়ে রবিন বলল, অসম্ভব! এখানে বাস করা যাবে না। নিচেই নামব না আমি।
জলজ প্রাণী, শ্যাওলা আর কাঠ পচে হয়েছে এই ভয়াবহ গন্ধ। নিঃশ্বাস নিতেই যেন কষ্ট হয়।
কিশোর বলল, এসেছি যখন না দেখে যাব না। তোমার সহ্য না হলে। এখানেই থাকো। আমরা নেমে দেখে আসি।
এখানে যে থাকা যাবে না, বোঝা হয়ে গেছে। তবু পুরানো স্মৃতির আকর্ষণই যেন নিচে টেনে নামাল কিশোরকে। ক্যাপ্টেনের ঘরটা সবচেয়ে। বড়। তবে তাতে ঘুমানো তো দূরের কথা, জিনিসপত্র রাখারও প্রশ্ন ওঠে না। পুরো জায়গাটাই দুর্গন্ধে ভরা, ভেজা ভেজা। কাঠ এত পিচ্ছিল হয়ে আছে কোথাও কোথাও, পা রাখাই মুশকিল।
চলো, যাইগে, মুসা বলল। ইকটুও ভাল লাগছে না।
মই বেয়ে ওপরে উঠছে ওরা, এই সময় কানে এল রবিনের চিৎকার, কিশোর, দেখে যাও, দেখে যাও!
তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আরেকটু হলেই পিছলে পড়ে হাঁটু ভাঙত মুসা। ডেকে উঠে এল সবার আগে। কি হয়েছে? কি দেখেছ?
চোখ চকচক করছে রবিনের। হাত তুলে দেখাল। আগের বার যখন এসেছিলাম, ওটা ছিল না!
ডেকের একধারে একটা লকার, হাঁ হয়ে খুলে আছে। তার মধ্যে একটা কালো ট্রাংক।
তাই তো? রবিনের মতই অবাক হয়েছে কিশোর। আগের বার তো, এটা ছিল না! একেবারে নতুন জিনিস! কে রেখে গেল? কি আছে এর মধ্যে?
ডেকও পিচ্ছিল। সাবধানে লকারটার দিকে এগোল ওরা। দরজাটা বন্ধই থাকার কথা, কিন্তু বাতাসেই হোক, কিংবা ঢেউয়ের দোলায়ই হোক, খুলে গেছে।
ট্রাংকটা ছোট। বের করে আনল কিশোর।
ওখানে এই জিনিস রাখতে গেল কে? মুসার প্রশ্ন। চোর-ডাকাত নয় তো? স্মাগলার?
হতে পারে, ট্রাংকটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। চোরাই মাল লুকানোর দারুণ জায়গা এই জাহাজ। কেউ আসে না এখানে। হঠাৎ করে দেখে ফেলারও ভয় নেই।
যদিও আমরা দেখে ফেললাম, জিনা বলল।
আমাদের মত তো আর ছোঁক ছোঁক করে না কেউ, মুসা বলল।
কি আছে ভেতরে? ঝুঁকে ট্রাংকটার দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। এই কিশোর, কোকেন-টোকেন নয় তো? স্মাগল করে এখানে এনে লুকিয়ে রেখেছে।
দুটো নতুন তালা লাগানো রয়েছে। চাবি ছাড়া খোলা যাবে না।
ভেঙে ফেললেই হয়, জিনা বলল।
না। এটার কথা যে আর গোপন নেই, তালা ভাঙা দেখলেই বুঝে যাবে। চোরই হোক, আর চোরাচালানিই হোক, তাকে বুঝতে দেব না যে আমরা দেখে ফেলেছি।
ধরার ইচ্ছে?
নয় কেন? নিজেকেই যেন বোঝাচ্ছে কিশোর, আমরা যে দ্বীপে উঠেছি, কেউ জানে না। লুকিয়ে থেকে চোখ রাখব। কোনও বোট আসে কিনা দেখব।
মন্দ হয় না, মুসা বলল। একটা কাজ পেয়ে গেলাম। একঘেয়ে লাগবে আর এখানে
এমনিতেও লাগত না, বাধা দিয়ে বলল জিনা।
এখন আরও বেশি লাগবে না।
সাগরের দিকে চোখ পড়তেই বলে উঠল কিশোর, জোয়ার আসছে! জলদি নেমে যাওয়া দরকার।
ট্রাংকটা আবার আগের জায়গায় রেখে দিল সে।
সমস্যা কিন্তু একটা হবে, রবিন বলল। দড়িটা রেখে যেতে হবে আমাদের। লোকটা এসে এই দড়ি দেখলেই তো বুঝে যাবে, কেউ উঠেছিল।
ভাল কথা মনে করেছ! ঘুরে তার দিকে তাকাল কিশোর, কি করা যায়?
সমাধান করে দিল মুসা, তোমরা নেমে যাও। দড়িটা খুলে নিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়ব আমি।
না না, পা ভাঙবে।
ভুলে যাচ্ছ কেন, আমি মুসা আমান। টারজানের চেয়ে কম যাই কিসে? নামো তোমরা।
আর কিসে কম যাও বলতে পারব না, তবে খাওয়ার ব্যাপারে যে যাও না, গলাবাজি করে বলতে পারব, হেসে বলল রবিন।
অন্যেরাও হাসল।
টারজানের চেয়ে কম যে যায় না, প্রমাণ করে ছেড়ে দিল মুসা। সবাই নেমে যেতেই মাস্তুলের গোড়া থেকে দড়িটা খুলে নিল। সেটা কিশোরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে জাহাজের কিনার ধরে ঝুলে পড়ল। নিচে ওখানটায় পাথর আছে কিনা দেখে নিয়েছে আগেই। আলগোছে ছেড়ে দিল হাতটা। ঝপ করে পড়ল পানিতে। পানি ওখানে নেহায়েত কম নয়, পাথরও নেই, কিছুই হলো না ওর।