বাড়ি ফিরে এল কিশোররা। পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকল। টোডরা কেউ ঢুকতে দেখল না ওদের।
ওপরতলায় উঠে জোরে জোরে কথা বলতে লাগল, নানা রকম শব্দ শুরু করল, যেন এইমাত্র উঠল ঘুম থেকে। হুড়ুম-ধাড়ুম করে নামল নিচতলায়। বাগানে বেরিয়ে গেটের দিকে এগোল।
রান্নাঘরের জানালার দিকে তাকাল রবিন। নিচু স্বরে বলল, বেঙাচিটা চেয়ে আছে।
থাকুক, কিশোর বলল। দেখুক, আমরা কোনদিকে যাচ্ছি।
গেট খুলে বেরিয়ে এল ওরা।
০৯.
শান্ত সাগর। এই আবহাওয়ায় রাত থাকতেই মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়ে জেলেরা। সুতরাং পরিচিত কোন জেলের সঙ্গে দেখা হওয়ার ভয় নেই। হলোও না। গোবেল দ্বীপের যে প্রাকৃতিক বন্দরটা আছে, প্রণালী দিয়ে ঢুকতে হয়, নিরাপদেই তাতে নৌকা নিয়ে এল ওরা।
টেনে নৌকাটাকে তুলে আনল সৈকতের অনেক ওপরে। ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভয়ে। এখানকার সাগরে যখন-তখন ঝড় ওঠে, কোন ঠিকঠিকানা নেই। আর সে ঝড়ও যে-সে ঝড় নয়, ভয়ঙ্কর অবস্থা হয়ে যায় সাগরের।
দাড় টেনে টেনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে মুসা ও জিনা। মসৃণ সাদা বালিতে হাত-পা ছড়িয়ে প্রায় শুয়েই পড়ল।
শুয়ে পড়লে যে, রবিন বলল।
কি করব? পাথরের টিলায় বসা একটা সীগালের দিকে তাকিয়ে আছে মুসা।
খাওয়া লাগবে না? তোমার তো পেট ভরা, কিন্তু আমরা এখনও নাস্তাই করিনি।
আমিও খাইনি। ভাবলাম, একবারেই খাব।
টিন ওপেনার বের করে খাবারের টিন কাটতে বসল কিশোর।
ঘেউ ঘেউ করে একটা খরগোশকে তাড়া করে গেল রাফি। ধমক দিয়ে তাকে ডেকে ফিরিয়ে আনল জিনা। চুরি,
আহ, হাত-পা টানটান করতে করতে বলল কিশোর, মনে হচ্ছে জেলখানা থেকে বেরিয়ে এলাম।
আমারও সে-রকমই লাগছে, রবিন বলল। আসলে, খারাপ মানুষের সঙ্গে বাস করা যায় না।
তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে হবে।
কেন, তাড়াতাড়ি কেন? ভুরু নাচাল মুসা, কি কাজ আছে আমাদের? সময় তো অফুরন্ত।
অনেক কাজ। প্রথমেই রাতে থাকার একটা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। ঝড়বৃষ্টির মধ্যে তো আর বাইরে থাকা যাবে না। সেখানে সরিয়ে রাখতে হবে মালপত্রগুলো। তারপর আমরা ঝাড়া হাত-পা। চুটিয়ে আনন্দ করব তখন।
রুটি, মাখন, ঠাণ্ডা মাংস, টমেটো আর কেক দিয়ে নাস্তা সারল ওরা। তারপর রওনা হলো দুর্গে।
প্রথমবার এসে যেখানে রাত কাটিয়েছিল, সে জায়গাটা এবার আর পছন্দ করতে পারল না কিশোর। দেয়াল আরও অনেকখানি ধসে পড়েছে, ছাত প্রায়। নেই বললেই চলে। এখানে থাকা যাবে না।
জিনা প্রস্তাব দিল, পাতালঘরে থাকলে কেমন হয়?
সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানাল মুসা, ওই অন্ধকারে! আমি বাপু এর মধ্যে নেই। ভূতের আড্ডায় কে যায়…
মুসার কথা কানে তুলল না কিশোর, আর কোন জায়গা না পেলে থাকতেই হবে ওখানে। তবে খুব গরম লাগবে।
কথা বলতে বলতে দুৰ্গটার একধারে পাথরের চত্বরে এসে দাঁড়াল ওরা। এখান থেকে সাগর দেখা যায়।
হাত তুলে জিনা দেখাল, ওই দেখো, আমাদের জাহাজটা।
দেখল তিন গোয়েন্দা। ঝড়ে ভেসে উঠেছিল যেটা। একটা নকশা পেয়েছিল ওরা, খুঁজে বের করেছিল সোনার বার।
পাথরের খাঁজে আটকে রয়েছে জাহাজটা, বড় বড় ঢেউও সরিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি।
এক কাজ করলে কেমন হয়! ওটার দিকে তাকিয়ে চোখ চকচক করে উঠল কিশোরের। ওটাতেই গিয়ে থাকি না কেন? চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা হবে..
খাইছে, বলে কি! আঁতকে উঠল মুসা। পোড়ো জাহাজে বাসা! ও তো মেছো ভূতের আড্ডা! জলদস্যুরা মরে গিয়ে সব ভূত হয়ে ওতে বাসা বেঁধেছে।
দেখো মুসা, তোমার এই ভূতের কথা শুনতে শুনতে কান পচে গেছে। আর ভাল্লাগে না। দয়া করে ভূতটুতগুলোকে মাথা থেকে একটু বের করো।…এই, চলো সবাই। দেখে আসি জাহাজটা।
কিছুদূর এগিয়েই থমকে দাঁড়াল জিনা।
কি হলো? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ওই যে কুয়াটা!
সেদিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা। জানে ওরা, এই কুয়া নেমে গেছে অনেক নিচে, সাগর সমতলেরও নিচে, মিষ্টি পানি আছে ওটাতে। লোহার আঙটা বেয়ে নিচে নামা যায়। বেশ কিছুটা নামার পর একটা ফোকর আছে, ওটা দিয়ে ঢোকা যায় পাতালঘরে।
চমকালে কি দেখে? বুঝতে পারছে না মুসা।
দেখছ না, কুয়ার মুখের কাঠের ঢাকনাটা সরানো?
তাতে কি?
কে সরাল? আমি তো সরাইনি। নিশ্চয় কারও পানি খাওয়ার দরকার হয়েছিল!
কত লোক আছে এ কাজ করার ব্যাপারটাকে গুরুত্বই দিল না মুসা। আমরা সোনার বারগুলো খুঁজে পাওয়ার পর তো সাড়া পড়ে গিয়েছিল। বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল দ্বীপটা। নিশ্চয় লোকে দেখতে এসেছে। তাদেরই কেউ করেছে একাজ।
সেটা তো অনেক আগের কথা, রবিন বলল। জিনা, তারপর কি আর দ্বীপে এসেছ তুমি?
কতবার? সে জন্যেই তো বলছি…আরে, এই ঢাকনাটাও তো সরানো!
কোথায়? এদিক ওদিক তাকাচ্ছে কিশোর। জিনার দৃষ্টি অনুসরণ করে সে-ও দেখে ফেলল। দুর্গের নিচে পাতালঘরে নামার একটা সিঁড়ি আছে, কুয়ার মুখের মতই সিঁড়ির গর্তের মুখটাও ঢাকা থাকে ঢাকনা দিয়ে। সেটা সরানো। অর্ধেক বেরিয়ে আছে গর্তের মুখ।
আমার দ্বীপে আমার অনুমতি ছাড়া নামে কার এতবড় সাহস! জিনিস উলট-পালট করে! ধরতে পারলে…
চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল, আচ্ছা, সেদিন যে ধোঁয়া দেখলাম, এসব তার জবাব নয় তো?
কৃত্রিম হতাশায় মাথা নাড়ল মুসা, এই তো, শুরু করল গ্রীক ভাষা!
খালি কথা ভুলে যাও, সেজন্যেই তো এত কঠিন লাগে। সেদিন যাকে আমরা স্টীমারের ধোঁয়া ভেবেছি সেটা হয়তো ক্যাম্পফায়ারের ধোঁয়া। দ্বীপে নেমে আগুন জ্বেলেছিল কেউ।