আমিও যাব তোমার সঙ্গে। রাফিকে নিয়ে রবিন আর মুসা চলে যাক। তিনজনে মিলে ভালই সামলাতে পারবে মিসেস টোডকে।
না, আমি একা যাব। তোমরা যাও।
শেষ পর্যন্ত সবাইকে সঙ্গে নিতে বাধ্য হলো জিনা। কারণ, কিশোর। তাকে একা যেতে দেবে না, ওদিকে মুসা আর রবিনও মিসেস টোডের মুখোমুখি হতে রাজি নয়।
এক একটা দোকানে ঢুকে টর্চের জন্যে নতুন ব্যাটারি কিনল জিনা। দুই বাক্স দিয়াশলাই, আর এক বোতল মেথিলেটেড স্পিরিট কিনল।
এসব কেন? জিজ্ঞেস করল রবিন।
কাজে লাগে না এসব? এড়িয়ে গেল জিনা, দরকারী জিনিস।
জিনার কেনাকাটা এ-পর্যন্তই। বাড়ি ফিরে এল ওরা। অবাক হয়ে দেখল, টেবিলে চা দেয়াই আছে। যদিও আহামরি কিছু নয়-রুটি, জ্যাম আর চা, তবু আছে তো। দেয়ার জন্যে যে মিসেস টোডকে কিছু বলতে হয়নি এতেই খুশি ওরা। যা পেল খেয়ে ফেলল।
সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টি নামল। ঘর থেকে বেরোনোর উপায় নেই। বসে বসে কেরম খেলতে লাগল ওরা। কেরিআন্টির খবর শুনে মন অনেকটা হালকা ওদের।
এক সময় উঠে গিয়ে বেল বাজাল কিশোর।
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল জিনা, বেল বাজালে কেন?
মিসেস টোডকে ডাকলাম, খাবার দিতে বলব।
কিন্তু তার ঘণ্টার জবাব দিতে এল না কেউ।
আবার বাজাল সে। আবার। যতক্ষণ না রান্নাঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল মিসেস টোড। মুখ কালো করে, চোখ পাকিয়ে, কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল সে। বেল বাজাচ্ছ কেন? তোমার বেলের জবাব দিতে যাচ্ছে কে?
আপনি, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর, আর কে আছে বাড়িতে? খাবার দিন। ফালতু জিনিস আনলে ভাল হবে না। কাল রাতে কাউকে কামড়াতে পারেনি বলে খুব বিরক্ত হয়ে আছে রাফি।
আজ যদি কিছু করতে আসো রান্নাঘরে…আমি..আমি…
কি করবেন? পুলিশে খবর দেবেন তো? আমিও সেটাই চাইছি। পুলিশকে বেশ কিছু কথা বলার আছে আমার। ডাকবেন নাকি এখনই?
চোখের দৃষ্টিতে কিশোরকে ভস্ম করে দেয়ার চেষ্টা চালাল যেন মিসেস টোড, ব্যর্থ হয়ে ক্ষুব্ধ আক্রোশে হাত মুঠো করে ফেলল। বিড়বিড় করে কি বলতে বলতে, বোধহয় তাকে অভিশাপ দিতে দিতেই চলে গেল রান্নাঘরে। বাসন-পেয়ালা আছড়ানোর শব্দ পাওয়া গেল বসার ঘর থেকেও।
বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে হাসল কিশোর।
আগের দিনের মত এতটা ভাল খাবার পেল না ওরা, তবে তেমন খারাপও না। ঠাণ্ডা মাংস, পনির আর খানিকটা পুডিং। রাফির জন্যেও খানিকটা রান্না করা মাংস এনে দিল মিসেস টোড।
তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল জিনার দৃষ্টি। কড়া গলায় বলল, ওটা লাগবে না, নিয়ে যান। বিষ মিশিয়ে দিয়েছেন তো? আপনাকে বিশ্বাস নেই…
না, থাক, বাধা দিল কিশোর, নিতে হবে না। কাল এই মাংস কেমিস্টের কাছে নিয়ে যাব পরীক্ষা করাতে। দেখি, কি জিনিস মেশানো আছে ওতে। তারপর পুলিশের কাছে যাওয়ার আরও একটা ছুতো পেয়ে যাব।
একটা কথা বলল না মিসেস টোড। কারও দিকে তাকালও না। নীরবে বাসনটা তুলে নিয়ে চলে গেল।
খাইছে! বিশ্বাস করতে পারছে না যেন মুসা, কি ভয়ঙ্কর মেয়েমানুষরে বাবা?
মেঘ জমেছে জিনার মুখে। রাফিকে কাছে টেনে নিতে নিতে বলল, সাংঘাতিক অবস্থা! রাফিকে তো মেরে ফেলবে! কতক্ষণ পাহারা দিয়ে রাখব!
এই ঘটনা দিল ওদের সন্ধ্যাটাকে মাটি করে। .
খেলা তো নয়ই, আলাপ-আলোচনাও আর তেমন জমল না। হাই তুলল কিশোর। ঘড়ি দেখে বলল, রাত দশটা। বসে থেকে লাভ নেই। ঘুমাতে যাই।
সারাদিন প্রচুর পরিশ্রম করেছে, সাঁতার কেটেছে, হাঁটাহাঁটি করেছে, শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল সবাই, এমন কি কিশোরও।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তার। মনে হলো, কোন একটা শব্দ শুনেছে। সব চুপচাপ। মুসা আর রবিনের নিঃশ্বাসের শব্দ কানে আসছে। কেন ঘুমটা ভাঙল? টোডদের কেউ শব্দ করেছে? না, তাহলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করত রাফি। তাহলে?
বিদ্যুৎ চমকের মত মনে পড়ল জিনার কথা, প্ল্যান করেছে! লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল তার ঘরের দিকে।
দরজা খোলা। জিনা, জিনা বলে ডাকল সে। জবাব নেই। উঁকি দিল ঘরে। খালি ঘর। খুব অল্প পাওয়ারের একটা সবুজ আলো জ্বলছে। জিনাও নেই, রাফিও না।
আবার দৌড়ে ঘরে ফিরে এল কিশোর। ডেকে তুলল মুসা আর রবিনকে।
ঘুমজড়িত কণ্ঠে মুসা বলল, আবার কি হলো? টোডের মুখে তরকারি ফেলেছ?
জলদি ওঠো! জিনা নেই ঘরে!
গেল কোথায়? লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামল রবিন।
সেটা তো আমারও প্রশ্ন। তোমরা এসো। আমি ওর ঘরে গিয়ে খুঁজে দেখি।
সুইচ টিপে উজ্জ্বল আলো জ্বালল কিশোর। বালিশে পিন দিয়ে আটকানো চিঠিটা চোখে পড়ল। তাড়াতাড়ি খুলে আনল সেটা। জিনা লিখেছে?
কিশোর,
রাগ কোরো না। রাফিকে নিয়ে আর ঘরে থাকার সাহস পেলাম না। ওর কিছু হলে যে আমি বাঁচব না তোমরা জানো। মিসেস টোডকে বিশ্বাস নেই। রাফিকে মেরে ফেলবে ও। আমি কয়েক দিনের জন্যে চলে যাচ্ছি, আব্বা আম্মা না এলে ফিরব না। তোমরা কাল বাড়ি চলে যেয়ো। আমাদের বাড়ি পাহারা দেয়ার দরকার নেই। টোডদেরকে যখন এতই বিশ্বাস আব্বার, ওরাই থাকুক, পাহারা দিক। ধ্বংস করে দিক বাড়িঘর, আমার কিছু না। আবার অনুরোধ করছি, রাগ কোরো না।
–-জিনা।
ঘরে ঢুকল মুসা ও রবিন।
নীরবে রবিনের দিকে চিঠিটা বাড়িয়ে দিয়ে আনমনে বলল কিশোর, ইস, এরকম কিছু যে করবে আগে ভাবলাম না কেন! নিচের ঠোঁটে ঘন ঘন চিমটি কাটতে শুরু করল সে। পুরোদমে চালু হয়ে গেছে মগজ।